শিরোনামটি বাংলাদেশের আপামর জনগণের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন বললে খুব একটা ভুল হবে না। আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে, এ আর এমনকি! কিন্তু এই কথার মর্মার্থ অনেক গভীর।

বিআইজিডির ‘দুর্দিনের ডায়েরি’ নামক গবেষণায় উঠে আসে যে করোনা মহামারির পরে যাঁরা নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন, তাঁদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তিলাভের একটি কৌশল ছিল রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ভাতা, অনুদান, সুলভ মূল্যে পণ্য ক্রয় ইত্যাদি সেবা নেওয়া। এই সেবা নেওয়া প্রক্রিয়ার একটি বৃহৎ অংশজুড়ে ছিল রাজনৈতিক যোগসূত্রতা।

নতুন দরিদ্র কিংবা হতদরিদ্র, সবাই এই রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন দীর্ঘ সময় ধরে। এর বিপরীতে অনেকে আবার সরকারি সহায়তার রাজনৈতিক বণ্টন নিয়ে অসন্তোষও প্রকাশ করেছেন। উল্লেখ্য, এই গবেষণার সময় ছিল ২০২২ থেকে ২০২৩ সাল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিআইজিডি এবং আইডিএস, ‘ডেটা অ্যান্ড এভিডেন্স টু অ্যান্ড এক্সট্রিম পভার্টি (ডিইইপ)’ শিরোনামে আরেকটি যৌথ গবেষণার কাজ শুরু করে। এ গবেষণায় অংশ নেন হতদরিদ্র থেকে শুরু করে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাঁদের দারিদ্র্যের গতিপথ বুঝতে গিয়ে এক আপাতবিরোধী পরিস্থিতির সম্মুখীন হই।

গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা বলেন, হঠাৎ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এমন রদবদল তাঁদের বিপাকে ফেলেছে। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না রাষ্ট্রীয় সেবা গ্রহণের জন্য কার কাছে যাবেন, কার কাছে তদবির করবেন। কারণ, সিটি করপোরেশন কিংবা উপজেলায় যাঁরা বিভিন্ন পদে বা কমিটিতে দায়িত্বরত ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনার পলায়নের পর পালিয়ে যান বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অনেক জনপ্রতিনিধিও। ফলে সেবা গ্রহীতারা পড়েন ভোগান্তিতে। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা যে যোগসূত্র কাজে লাগিয়ে নানান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিলেন, তার এমন আকস্মিক অনুপস্থিতি তাঁদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয়।

এই দুই গবেষণা সাবেক সরকারের পতনের আগে ও পরে রাজনীতিকরণের দুটি ভিন্ন অবস্থা তুলে ধরে। সরকার পতনের আগে অনেক যোগ্য ব্যক্তিদেরও রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও সেবা না পাওয়ার কারণ ছিল মধ্যস্থতা করা ব্যক্তিদের মারাত্মক পর্যায়ের হস্তক্ষেপ; কিন্তু এখন রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে না পারার কারণ হলো কোনো মধ্যস্থতা করা ব্যক্তি নেই।

স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন আসে, ‘রাজনীতিকরণই কি তাহলে তাদের একমাত্র অবলম্বন? সমস্যাটা আসলে কোথায়?’ আমরা সংস্কারের কথা বলছি, রাজনীতিকরণ বন্ধ করার কথা বলছি; কিন্তু সব শ্রেণির মানুষের জন্য সেটি সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। কেন নয় তা বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে নিম্ন আয়ের মানুষ কেন রাজনীতিকরণের শিকার হন। তাঁরা কিন্তু পুকুরচুরির উদ্দেশ্যে রাজনীতি করেন না। তাঁরা ভাতা ও চাল-ডাল—এসবের জন্য রাজনীতি করেন। ‘আমার তো রাজনীতি নাই, আমার হলো পেটনীতি।’ মানে তাঁরা রাজনীতি করেন পেটের দায়ে। তাহলে কী করলে তাঁরা আর এই রাজনীতি করবেন না বা তাঁদের এই রাজনীতি ঠিক, নাকি ভুল? একজন গবেষক হিসেবে এই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

নিম্ন আয়ের মানুষের রাজনৈতিক বোঝাপড়া কীভাবে রাজনীতিকরণকে টিকিয়ে রাখে এবং সে কারণে কীভাবে ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স’ দুর্বল হয়ে পড়ে, তা বোঝা জরুরি। রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার বন্ধ করা বা জবাবদিহি নিশ্চিত করা শুধু সংবিধান বা নিয়মকানুন দিয়ে সম্ভব নয়। জনগণ এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, জনগণের রাজনৈতিক আচরণ অনুশাসনের ফলাফলকে প্রভাবিত করে।

আবার অনুশাসনের ধরনও জনগণের রাজনৈতিক চিন্তাধারা নির্মাণ করে। সুতরাং রাষ্ট্রীয় সেবা পেতে দলীয় রাজনীতির আশ্রয় নেওয়ার দায় শুধু সাধারণ মানুষের ওপর চাপালে ভুল হবে। স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগকে পুঁজি করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার এক খেলায় মেতে থাকেন। জনগণকে নানান কৌশলে অধস্তন হিসেবে রাখার এই চর্চা আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন নয়। আমাদের এই পুরোনো ও বিধ্বংসী চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে জনগণের সার্বভৌমত্বের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াব আমরা নিজেরাই।

সংস্কারের উদ্দেশ্য হলো জনগণের জীবনমান উন্নত করা। তাই কোনো সংস্কার স্থায়ী ও টেকসই হবে কি না, তা অনেকাংশেই নির্ভর করে জনগণের কাছে সেটির গ্রহণযোগ্যতার ওপর। আমাদের সংস্কারের আলোচনায়ও এই বহুমাত্রিক জটিল বাস্তবতার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রচেষ্টায় এই বিষয়গুলোর অনুপস্থিতি একেবারেই কাম্য নয়।

তবে সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যদি রাজনীতির এসব ছিদ্রপথ বন্ধ করা যায়, তাহলে মানুষের রাজনৈতিক আচরণেও পরিবর্তন আনা সম্ভব। সেটির জন্য প্রয়োজন প্রাসঙ্গিক এবং প্রেক্ষাপট–উপযোগী আলোচনা, তাৎক্ষণিক গবেষণা এবং সেই অনুযায়ী নীতিমালা নির্ধারণ করা। পারস্পরিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে গণতন্ত্র নিয়ে জনগণের মধ্যে পরিষ্কার ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তা প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় সংস্কার হলো এই উদ্যোগের প্রাথমিক ধাপ।

সংস্কার একটি চলমানপ্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হলো জনগণ। অতএব, তাদের বাস্তবতা বিবেচনা করেই এর পরিকল্পনা করতে হবে। তা না হলে আমরা এই অনিয়ম আর তা থেকে মুক্তির পথে যে নীতিগত ত্রুটি, সেই গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাব এবং বারবার ব্যর্থ হবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সব প্রচেষ্টা।

রাবিনা সুলতানা রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত।

*মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র র জন ত ক জনগণ র আম দ র র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

শেখ হাসিনা আমাদের আসন ও টাকা অফার করেছিল: নুরুল হক নুর

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগের আমলে শেখ হাসিনা আমাদের আসন অফার করেছিল, টাকা অফার করেছিল। কিন্তু আমরা ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আপস করিনি। আমরা ২-৪টি আসনের জন্য কারো সঙ্গে জোট করব না। যদি দেশের প্রয়োজনে জোট করি, তা ন্যায্যতার বিচারে সম্মানজনক আসন সমঝোতার ভিত্তিতে হবে।’’

শনিবার (৬ ডিসেম্বর) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার নবীনগর পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত এক জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) আসনে দলীয় প্রার্থীকে পরিচয় করিয়ে দিতে স্থানীয় গণঅধিকার পরিষদ এই জনসভার আয়োজন করে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) আসনে জেলা গণঅধিকার পরিষদের সহসভাপতি নজরুল ইসলাম দলের প্রার্থী হয়েছেন।

নুরুল হক নুর বলেন, ‘‘অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে আগাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন তার কার্যক্রম সম্পন্ন করছে। ১১ তারিখ তফসিল ঘোষণা করার কথা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের লড়াকু ও আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ থাকায় যদি কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি হয় নির্বাচন পেছানোর, সেটি হয়তো নির্বাচন কমিশন এবং সরকার বিবেচনা করবে। অন্যথায় ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হোক আর এপ্রিলে হোক, নির্বাচনে গণঅধিকার পরিষদ এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে। আর দেশের প্রয়োজনে যদি কোনো জোট করে, তাহলে যেসব জায়গায় জনসমর্থন আছে, সেসব আসনকে নিশ্চিত করেই আমাদের জোট হবে।’’

তিনি বলেন, ‘‘আমরা দেখতে পাই, কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা পুরনো ফ্যাসিস্টদের মতোই হুমকি-ধমকি ও আধিপত্য বিস্তারের অপরাজনীতি দেশব্যাপী কায়েম করতে চান। তদেরকে মনে করিয়ে দিতে চাই, ১৬ বছরের অপশাসন মুহূর্তের মধ্যেই চুরমার হয়ে গেছে। জনগণের প্রতিবাদে নেতারা সীমান্ত দিয়ে, হেলিকপ্টার দিয়ে, নদী-নালা ও খাল-বিল দিয়ে যে যেভাবে পেরেছেন পালিয়ে গেছেন। কেউ জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে তাদের পরিণতিও তা-ই হবে। গণঅভ্যুত্থানের অংশীজন সব রাজনৈতিক দলকে সংযত এবং সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানাই।’’

ঢাকা/পলাশ/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ২০০৬ সালে ফুলবাড়ীতে কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল
  • আমরা ধর্মকে কখনো ব্যবহার করিনি, করব না: জামায়াতের আমির
  • অবৈধ সংযোগ বন্ধ করে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাসের দাবিতে স্মারকলিপি
  • মুছাপুরে খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় দোয়া ও শীতবস্ত্র বিতরণ করলেন মাসুদুজ্জামান
  • ধর্মের নামে ট্যাবলেট বিক্রি করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণার পরিকল্পনা চলছে: সালাহউদ্দিন আহমদ
  • গণভোট কি প্রতীকী ভোটে পরিণত হচ্ছে
  • ভারতে ইতিহাস মুছে ফেলার রাজনীতি: এবার টার্গেট তাজমহল
  • জামায়াত দায়িত্ব পেলে ইসলামের ভিত্তিতে রাষ্ট্র চালাবে: এটিএম আজহারুল 
  • শেখ হাসিনা আমাদের আসন ও টাকা অফার করেছিল: নুরুল হক নুর
  • দাদাগিরি আর বরদাশত করা হবে না: জামায়াত আমির