চট্টগ্রাম বন্দর: আমাদের সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসটি...
Published: 25th, October 2025 GMT
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালসহ (এনসিটি) চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি অপারেটরের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।
অবশ্য এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই। মার্কিন নৌবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ডিপি ওয়ার্ল্ডকে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তখন সমালোচনা ওঠে।
বিশেষ করে এনসিটি, যে টার্মিনালটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থ ব্যয়ে (তিন হাজার কোটি টাকা) স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা হয়েছে, তা কেন একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দিতে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বন্দর–সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এসব মতামত উপেক্ষা করেই ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এর পরিচালনা ও মাশুল আদায়ের সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে অনড় থাকে তৎকালীন সরকার।
আরও পড়ুনচট্টগ্রাম বন্দর: মার্কিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অসম চুক্তিটির কথা মনে পড়ে২৪ জুন ২০২৫সেই একই পথে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও যাত্রা শুরু করার পর এ নিয়ে নাগরিক সমাজ ও শ্রমিক সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদে সভা-সমাবেশ-পদযাত্রাসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু এসব প্রতিবাদে কর্ণপাত না করে, এমনকি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ বা মতবিনিময়েরও তোয়াক্কা না করে যখন এ সরকার দ্রুতগতিতে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চায়, তখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, সরকার কি কোনো আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে?
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বড় উপায় দেখছেন বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো ও এর দিগন্ত প্রসারিত করার মধ্যে। সাম্প্রতিক কালে বেশ কয়েকবার তিনি তাঁর এই মত জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন। সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের বিভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্যেও এই মতের প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
অধ্যাপক ইউনূস বন্দর বিষয়ে তাঁর নিজস্ব ধারণা অবশ্য অনেক আগে থেকেই প্রকাশ করে আসছেন। মনে পড়ে, ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে চট্টগ্রামবাসীর দেওয়া এক সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেছিলেন, চট্টগ্রাম বন্দরকে এক শ গুণ বড় করা দরকার এবং তা করা সম্ভব। এ বন্দরকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দিতে হবে বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। তাঁর সেই উদ্দীপনামূলক বক্তব্য শুনে অনেকেই তাঁকে এ বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত ধারণাপত্র উপস্থাপন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সে রকম কিছু তিনি করেননি।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, বিদেশি অপারেটরদের সুবিধা দেওয়ার জন্যই আগেভাগে মাশুল বাড়ানো হচ্ছে। অর্থাৎ বিদেশি অপারেটর এসে যেসব উদ্যোগ নিলে প্রশ্নের সম্মুখীন হতো, তার অনেকটা আগেভাগে সরকারই সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এভাবেই হয়তো শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ব্যাপারটাও জায়েজ করার চেষ্টা হবে। সব মিলিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকার একটি অসম চুক্তির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী, শ্রমিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের ব্যক্তিরা।সরকার পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়ে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর দীর্ঘদিনের ধারণার বাস্তবায়ন ঘটাতে চাইবেন, তা স্বাভাবিক। কিন্তু এ বিষয়ে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের সঙ্গে আলোচনা বা তর্ক-বিতর্কের অবতারণা করা গেলে দেশবাসী তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রকৃতিপ্রদত্ত সম্পদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশদ জানার সুযোগ পেত।
দেশের নিরাপত্তাঝুঁকির কথা বাদ দিলেও বিদেশি অপারেটররা মাশুল বাড়ানো ও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলোর ব্যাপারে যে কতটা নির্দয়, তা পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিবুতির পরিণতি দেখে বোঝা যায়। জিবুতি এই ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে তাদের বন্দর পরিচালনার চুক্তি বাতিল করেও এখনো ঋণের জাল থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
আরও পড়ুনবিদেশি কোম্পানিকে বন্দর ব্যবস্থাপনার ইজারা দেওয়ার ঝুঁকিগুলো কী১৪ জুন ২০২৫আমাদের দেশেও কিছু আলামত আমরা এরই মধ্যে দেখতে শুরু করেছি। ১৫ অক্টোবর থেকে বর্ধিত হারে মাশুল আদায় শুরু করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। একলাফে ৪১ শতাংশ বেড়েছে বন্দরের বিভিন্ন সেবার মাশুল। বছরে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করার পরও মাশুল বৃদ্ধি, তা-ও ৪১ শতাংশ, এটা ব্যবসায়ীদের স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) বন্দরের মাশুল বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে যন্ত্রপাতি, জ্বালানি, জনবল ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বাড়ানোর কথা তুলে ধরেছে। ৪০ বছরের মধ্যে ২০০৭ সালে ৫২টি সেবা খাতের মধ্যে ৫টির মাশুল বাড়ানো হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছে চবক। নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেছেন, ৪০ বছর পরও কি ট্যারিফ বাড়ানো যাবে না? কিন্তু বন্দর ব্যবহারকারীরা যে বলছেন, ডলারের দাম বাড়ায় মাশুল এমনিতেই ৪১ শতাংশ বেড়েছে, সেই যুক্তিকেও তো নাকচ করা যায় না।
আরও পড়ুনচট্টগ্রাম বন্দর: ঘরের চাবি কি পরের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে১২ জুন ২০২৩তবে বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, বিদেশি অপারেটরদের সুবিধা দেওয়ার জন্যই আগেভাগে মাশুল বাড়ানো হচ্ছে। অর্থাৎ বিদেশি অপারেটর এসে যেসব উদ্যোগ নিলে প্রশ্নের সম্মুখীন হতো, তার অনেকটা আগেভাগে সরকারই সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এভাবেই হয়তো শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ব্যাপারটাও জায়েজ করার চেষ্টা হবে। সব মিলিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকার একটি অসম চুক্তির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী, শ্রমিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের ব্যক্তিরা।
এদিকে কয়েক দিন আগে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার চট্টগ্রাম বন্দরসংলগ্ন বারেক বিল্ডিং মোড়, নিমতলা মোড়, ৩ নম্বর জেটি কাস্টমস মোড়, সল্টগোলা ক্রসিংসহ বন্দর এলাকায় যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক, শ্রমিক ও সামাজিক সংগঠনের সভা-সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি এক মাসের জন্য (১১ নভেম্বর পর্যন্ত) নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
এর কারণ হিসেবে কমিশনার স্বাক্ষরিত একটি গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য পরিবহনের জন্য প্রতিদিন প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার যানবাহন বন্দরে চলাচল করে। এই বিপুল পরিমাণ যানবাহন চলাচলের কারণে বন্দরের ট্রাফিকব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা অত্যন্ত জরুরি।’
আরও পড়ুনবন্দর পরিচালনা বিদেশিদের দেওয়া কতটা যৌক্তিক১৯ মে ২০২৫বন্দরের ট্রাফিকব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা সব সময়ের জন্যই জরুরি। কিন্তু বিশেষ এই একটি মাসের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা নিয়ে সবার মধ্যেই কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই এনসিটিসহ চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়া হবে। তার আগে যাতে কোনো প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংগঠিত হতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে চায় পুলিশ।
জানি না, সরকারের দৃঢ় কিংবা একগুঁয়ে সিদ্ধান্তের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর সিঙ্গাপুরের চেয়ে বড় ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে কি না, নাকি সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসের প্রতীকী গল্পটির মতো করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও সাহিত্যিক
মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য আগ ভ গ রক র র ব যবস সরক র এনস ট
এছাড়াও পড়ুন:
আট দশক পর দেশের মাটিতে ফিরে যাওয়া
জাপানের টোকিওর নগরকেন্দ্রের ব্যস্ত এক জায়গাজুড়ে আছে বিতর্কিত একটি শিন্তো মন্দির। জাপানে যেটা ইয়াসুকুনি মন্দির নামে পরিচিত। ১৮৬৯ সালে যাত্রা শুরু করা শিন্তো ধর্মের এই মন্দির তৈরি করা হয়েছিল মূলত এক বছর আগে গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সামন্ত্রতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক জাপানের ভিত্তি তৈরি করে নেওয়া মেইজি পুনরুত্থানের সময় গৃহযুদ্ধে নিহত বিজয়ী পক্ষের সৈন্যদের ‘দেবতুল্য’ ভাবমূর্তি তুলে ধরার উদ্দেশ্যে। ফলে বিজয়ী পক্ষের নিহত সব সৈনিকের নাম সেখানে দেবতার সারিতে সন্নিবেশিত আছে, পরাজিতদের নয়।
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবন বিসর্জন দেওয়ার বিনিময়ে পাওয়া এ রকম প্রতিদানের মধ্যে বিতর্কের কিছু থাকার কথা নয়। দীর্ঘকাল ধরে এটা নিয়ে কোনো রকম বিতর্কও ছিল না। তবে সেই হিসাব পাল্টে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সর্বোচ্চ সাজা পাওয়া জাপানের সেই সময়ের কয়েকজন নেতাকে ১৯৭০–এর দশকের শেষ দিকে ইয়াসুকুনির দেবতার তালিকায় যুক্ত করার প্রচেষ্টা চালানোর মধ্য দিয়ে।
ফলে যুদ্ধের পুরো সময় ধরে জাপানের যে কয়েক লাখ তরুণ দেশপ্রেমে নিবেদিত থেকে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, ইয়াসুকুনির সেই ঘটনার আলোকে তাঁদেরও এখন ধরে নেওয়া হচ্ছে ‘বিতর্কিত’ হিসেবে। জাপানের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের বাইরে অন্য একটি মর্মান্তিক দিক হচ্ছে এটা।
যেকোনো যুদ্ধের বলি সর্বাগ্রে হতে হয় যুদ্ধে জড়িত কোনো একটি দেশের তরুণদের। নিজেরা না চাইলেও দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে যাঁদের সাধারণত বাধ্য করা হয়। এর পরোক্ষ ফলশ্রুতিতে নেতৃত্বের স্খলনের জন্য নেতারাই কেবল নয়, সেসব তরুণকেও চিহ্নিত করা হয় ‘খলনায়ক’ হিসেবে।
এমনটাই সম্ভবত ঘটেছে আট দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত জাপানের কয়েকজন তরুণ সৈনিকের জীবনে। তাঁদের অনেকেরই সম্ভবত জানা ছিল না কেন তাঁরা যুদ্ধে জড়িত। আর যাঁরা তাঁদের যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা সেই তরুণদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটে, তা নিয়ে খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করার দরকার সম্ভবত নেই।
সমাধিতে চিরনিদ্রায় শায়িত জাপানিদের নামফলক