সবাই সংঘাতের জন্য মুখিয়ে আছে: তথ্য উপদেষ্টা
Published: 26th, October 2025 GMT
“সবাই সংঘাতের জন্য মুখিয়ে আছে। আপনারা অবশ্যই এটা অল্প কয়েক মাসের মধ্যে দেখতে পাবেন এবং আমি আশঙ্কা করছি, যদি এটার সঙ্গে ধর্মীয় যে দৃষ্টিকোণ, এটা যদি যুক্ত হয়, তাহলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।’’
তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম শনিবার (২৫ অক্টোবর) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বিএমএ ভবনে ‘মাজার সংস্কৃতি: সহিংসতা, সংকট ও ভবিষ্যৎ ভাবনা’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে এ কথা বলেন।
মাকাম: সেন্টার ফর সুফি হেরিটেজ কর্তৃক আয়োজিত ইমরান হুসাইন তুষার এবং মিজানুর রহমানের সঞ্চালনায় সংলাপে মাহফুজ আলম বলেন, “আওয়ামী লীগ ‘দরবারগুলোর’ সঙ্গে সংযোগ তৈরি করার চেষ্টা করছে। দরবারগুলোকে এটা বোঝানোর জন্য যে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার এসে মাজার ভেঙে দিচ্ছে, মসজিদ থেকে বের করে দিচ্ছে।”
তিনি বলেন, “এই কোশ্চেনটা (প্রশ্ন) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ইস্যু নয়। এটা ৫০ বছর ধরে চলছে। যখন সরকার পরিবর্তন হয়, মসজিদ কমিটি বদল হয়ে যায়। ইসলামী ফাউন্ডেশনের গভর্নিং কমিটি বদল হয়ে যায়।”
তথ্য উপদেষ্টা আরো বলেন, “রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ চলে গেলেও সামাজিক জায়গায় ফ্যাসিবাদ রয়ে গেছে। দেশে ইসলামের যতগুলো ধারা আছে, সবক’টি ধারার মধ্যে সংলাপ এবং সংযোগের সুযোগ তৈরি না হলে রাষ্ট্র খুবই শঙ্কার মধ্য দিয়ে এগোবে।”
তিনি বলেন, “দেশে ৯০ থেকে ৯২ শতাংশ মুসলমানের মধ্যে বিভিন্ন তরিকা আছে। তাদের মধ্যে কীভাবে সমন্বয় করা যায়, আজ পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতারা এটা নিয়ে ভাবেননি; বরং কেউ কওমিদের সঙ্গে, কেউ সুন্নিদের সঙ্গে—এভাবে ভাগ করে নিয়েছেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতির হাতিয়ার করে নিয়েছেন।”
মাজার ভাঙার বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, “একটি ক্ষোভের জায়গা আছে যে এক বছরে কিছুই করা হয়নি। এই ক্ষোভ থেকে পাল্টা আঘাতের চিন্তা করলে ভালো কিছু হবে না।”
তিনি বলেন, “মাজারে হামলার পর অনেক লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন সমীক্ষা করে মাজারগুলোকে সংস্কারের ব্যবস্থা করা হবে।”
হামলার শিকার মাজারগুলোর পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে মামলা করার আহ্বান জানিয়ে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, “এই কালচার (সংস্কৃতি) যদি টিকে যায়, তাহলে এরপর আরেক দলের ইসলাম আসবে, ওই ইসলাম আরেকটা দলের মসজিদ ভেঙে ফেলবে। আজ সুফিদের ওপর আছে, কাল কওমিদের ওপর হবে। এটা অব্যাহত থাকতে পারে না।”
মাহফুজ আলম বলেন, “গত ১৫ বছরে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আদর্শিক বিরোধিতার জায়গা থেকে সুফি ঘরানাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি সংযোগ ঘটেছিল। আওয়ামী লীগ তাদের সুরক্ষা দেবে এবং তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে। এই পরিমণ্ডলেই ধর্মীয় রাজনীতিটা আটকে গেছে। কওমিরাও এর বাইরে নয়। তারাও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়েছে।”
দেশে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের দূতাবাসগুলোর সংযোগ রয়েছে উল্লেখ করে মাহফুজ আলম বলেন, ‘‘কোনো কোনো অ্যাম্বাসি চায় যে মাজারগুলো ধ্বংস হোক। একধরনের রাজনৈতিক আদর্শিক জায়গাগুলো এখানে আছে।’’
তিনি বলেন, ধর্মীয় জনগোষ্ঠী লড়াই করবে, মব করবে-এমন ভয় না পেয়ে, এই সংকটগুলো রাষ্ট্রীয় জায়গা থেকে, রাজনৈতিক জায়গা থেকে, নীতির জায়গা থেকে দেখতে হবে। না হলে সংকট ঘনীভূত হতে থাকবে।”
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড.
সুফি সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের রহমানিয়া মঈনিয়া মঞ্জিলের প্রতিনিধি মোহাম্মদ আসলাম হোসেন, অলিতলা দরবার শরীফের পীর মাওলানা গোলাম মহিউদ্দিন লতিফী, নলতা দরবার শরীফের শাঈখ মুহাম্মদ উছমান গনী, ফরাজিকান্দী দরবার শরীফের মাসুক আহমেদ, গাজীপুরী দরবার শরীফের সৈয়দ মুহাঃ রবিউল ইসলাম, ফরিদপুরের পীর আবদুল ওয়াহেদ, দরবারে চাঁদপুরের গোলাম জিলানী, মুর্শিদপুর দরবারের মাওলানা মতিউর রহমান, আহলা দরবার শরীফের মো. মোখলেছুর রহমান, হাকিমাবাদ দরবারের মোহাম্মদ সফিউল আজম, কামারডাঙ্গী দরবার শরীফের খলিফা মো. মাহমুদুল হুদা খান, খানকায়ে এমাদিয়া কারান্দারিয়ার মাওলানা হায়দার আলী এমাদী আল কাদেরী, আশেকানে মদিনা দরবারের পীর মুফতি আবদুস সাত্তার কাদেরী, হোমনা সুফি দরবার শরীফের খন্দকার মহিউদ্দিন সুফি, বাগমারী হাদি আমানুল্লাহ দরগাহ শরীফের মাওলানা আবদুস সালামসহ প্রমুখ।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. আয়াতুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশ অলি আউলিয়ার দেশ। এখানে সকল ধর্মের, সকল মতের মানুষের পাশাপাশি বসবাস। আমরা ছোটকাল থেকেই দেখে এসেছি হজরত শাহজালাল, শাহ পরাণ ও অন্যান্য আউলিয়াদের মাজারে, দরবারে মানুষ জেয়ারত করতে যান। এই সংস্কৃতি দিনদিনই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই, জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সকল ধর্মের, সকল মতের মানুষ সহিংসতাকে মোকাবেলা করে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করবেন।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, “মাজারে সহিংসতা বিষয়ে কথা বলা একটা ট্যাবুতে পরিণত হয়েছে, আজকের এই অনুষ্ঠানে আসতেও আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম কিন্তু এই ট্যাবু ভাঙতে হবে। আমাদের দেশে মাজার, দরবারের দায়িত্বশীল যারা আছেন তাদের একটা ঘাটতি হলো তারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে প্রভাব রাখতে পারছেন না। যে কারণে তাদের কণ্ঠস্বর রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে পারছে না। সুফি সমাজের এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা প্রয়োজন যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে আপনারা অবদান রাখতে পারবেন। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে মাজার, দরবারে যে সহিংসতা হলো এ ঘটনাগুলোর তদন্ত ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা দরকার। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই কমিশন গঠনের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা করবে। সর্বশেষ কথা হলো, এদেশের নাগরিক কওমি হোক, আলিয়া হোক, সুন্নী হোক, যে যেই মতাদর্শ ধারণ করুক না কেন কেউ কারো গায়ে আঘাত করবো না। এই জায়গায় আমাদের একটি বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন।”
আইনজীবী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মানজুর আল মতিন বলেন, “কুরআন এত সুন্দর, নির্মল, পবিত্র অথচ কুরআনের নাম ধারণ করে অনেকে মাজার, দরবারে হামলা চালাচ্ছেন। এটা একজন মুসলমান হিসেবে সহ্য করা খুবই কষ্টকর। এই সহিংসতার ফলে দেশের সমাজ ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এই বিপর্যয় রোধ করতে না পারলে বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে, যা কারো জন্যই কল্যাণকর নয়।”
হামলার শিকার হওয়া শেরপুরের মুর্শিদপুর দরবারের প্রতিনিধি মাওলানা মতিউর রহমান বলেন, “যে নাজেহাল পরিস্থিতির মধ্যে মুর্শিদপুর দরবারকে পড়তে হয়েছে তা বর্ণনাতীত। এই দরবারে মাজার নেই, সেজদা নেই, কোনো বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নেই, তবুও কেন এই বর্বরোচিত হামলা হলো? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই।”
গাজীপুর দরবারের প্রতিনিধি মুহাঃ রবিউল ইসলাম বলেন, “মাজারে আক্রমণ মানে সমাজকে বিভক্ত করা। আমরা যদি চুপ থাকি তাহলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। এখনই সময় সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করা। মাজার কেবল ধর্মীয় বিষয় নয়, বরং বাংলাদেশের ঐতিহ্য। সরকারকেই এর সুরক্ষার জন্য দায়িত্ব নিতে হবে।”
পীরজাদা মাহমুদুল হুদা খান বলেন, “আমরা যারা হামলার শিকার হচ্ছি তারাই কেবল হামলার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারছি। যারা মাজারে শায়িত আছেন তাদের জীবনে মানুষের প্রতি সহানুভূতি ছিল, গরিবের প্রতি দরদ ছিল কিন্তু হাতে লাঠি ছিল না। কিন্তু তাদের প্রতিই অমানবিক আচরণ প্রদর্শন করা হচ্ছে।”
নলতা দরবারের প্রতিনিধি, আহছানিয়া ইন্সটিটিউট অফ সুফিজমের অধ্যাপক শাঈখ মুহাম্মদ উছমান গনী বলেন, “মাজার বা দরবারের কারো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত নয়। বিভিন্ন উরসে রাজনৈতিক নেতারা বক্তব্য দিতে চেষ্টা করেন কিন্তু সরাসরি দরবার থেকে এমন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করা উচিত নয়। এবং ধর্মীয়ভাবে আমাদের ঐক্য হবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুর ভিত্তিতে। তাহলে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক বিবাদ কমে আসবে।”
মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের প্রতিনিধি জনাব আসলাম হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে ১২ হাজার মাজার ও দরবার রয়েছে। আমরা কি পারতাম না এই সহিংসতাকে মোকাবেলা করতে? কিন্তু আমাদের পীর, মুর্শিদরা আমাদেরকে এই শিক্ষা দেননি। আমার মনে হয় এখন সময় এসেছে সহিংসতাকে মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার।”
ওমর ফারুক ফেরদৌস বলেন, “মাজারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় যেমন বেদাত ও শিরকের কার্যকলাপ রয়েছে সেগুলোকে মাজার কর্তৃপক্ষ নিজেরাই প্রতিরোধ করতে হবে। কিন্তু এটাকে কেন্দ্র করে সহিংসতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার যে সংস্কৃতি আমাদের দেশে রয়েছে তার পেছনে ধর্মীয় অপব্যাখ্যার একটি ভূমিকা রয়েছে।
কবি ও লেখক সৈয়দুল হক বলেন, “বাংলাদেশে সুফি সমাজের মত এত বড় ঘরানা মুসলমানদের মাঝে আর নেই। কিন্তু কেন এই সমাজ সহিংসতা মোকাবেলা করতে পারলো না? রাষ্ট্রকে কেন আমরা বাধ্য করতে পারলাম না এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে? আমার মনে হয় এই প্রশ্নের মাঝেই আমাদের মূল সংকট লুকিয়ে আছে।”
লেখক ও গবেষক তাহমিদাল জামি বলেন, “রাষ্ট্রের দায়িত্ব সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কার আকিদা, মতাদর্শ কেমন তার দিকে তাকানো রাষ্ট্রের কাজ নয়। মাজার, দরবারে যদি সংস্কার প্রয়োজন হয় তাহলে তা মাজার, দরবার কর্তৃপক্ষ ভেতর থেকেই করবেন। বাহির থেকে সহিংসতা করে সংস্কার করা যাবে না বা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। এ বিষয়ে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।”
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এস
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর দরব র র প র প র দরব র ম হ ম মদ র জন ত ক র রহম ন ল ইসল ম র জন য মন ত র ন বল ন আম দ র ন র জন ম বল ন র একট সরক র আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
জ্বলি ন’ উধিম কিত্তেই!
পাহাড়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনাগুলো দশকের পর দশক ধরে চলা অমীমাংসিত সমস্যা—ভূমি বিরোধ, দমন-পীড়ন, উচ্ছেদ ও আদিবাসীদের প্রান্তিকীকরণের এক তিক্ত ফসল। ঘটনাগুলো আবারও দেখিয়ে দিয়েছে, বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে আদিবাসীদের ক্ষেত্রে সুরক্ষাব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর।
১৯৯২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আদিবাসী কবি কবিতা চাকমা এই চলমান সংকট ও সংগ্রামের মর্ম উপলব্ধি করে তাঁর গভীর অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন এভাবে:
‘রুখে দাঁড়াব না কেন।
যা ইচ্ছে তাই করবে—
বসত বিরান ভূমি
নিবিড় অরণ্য মরুভূমি,
সকালকে সন্ধ্যা
ফলবতীকে বন্ধ্যা।
রুখে দাঁড়াব না কেন!
যা ইচ্ছে তাই করবে—
জন্মভূমে পরবাসী
নারীকে ক্রীতদাসী,
দৃষ্টিকে অন্ধ
সৃষ্টিকে বন্ধ।
অবহেলা অপমানে ক্রোধ
ধমনিতে তুমুল রক্তের স্রোত
আঘাতে আঘাতে ভাঙে বিঘ্ন,
চেতনার সমুদ্র তারুণ্যে তীক্ষ্ণ।
—আমার সম্পূরক একমাত্র আমিই
রুখে দাঁড়াব না কেন!’
(কবিতা চাকমা, ১৯৯২, , জ্বলি ন’ উধিম কিত্তেই! রুখে দাঁড়াব না কেন!)
তিন দশক আগের লেখা কবিতাটি আজও প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। কবিতাটি যেন তাদেরই ক্রোধ, বেদনা ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতিচ্ছবি, যাদের অধিকার বারবার উপেক্ষিত, যাদের ভূমি ও অস্তিত্ব অপরাজনীতির শিকার এবং যাদের কণ্ঠস্বর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিনিয়ত রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সহিংসতা ও প্রাণহানিগত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়িতে এক ১২ বছর বয়সী মারমা স্কুলছাত্রী টিউশন শেষে বাড়ি ফেরার পথে যৌন সহিংসতার শিকার হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর ‘জুম্ম ছাত্র–জনতা’ ন্যায়বিচারের দাবিতে খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা চত্বরে বিক্ষোভ করে।
তারা ঘোষণা করে যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব আসামিকে গ্রেপ্তার না করা হলে জেলাব্যাপী অবরোধ করা হবে। ২৬ সেপ্টেম্বরের সংঘটিত ঘটনাগুলো একটি বড় মোড় আনে। প্রতিবাদকারীরা জেলাব্যাপী অবরোধ ঘোষণা করে।
পরদিন আন্দোলন আরও বিস্তৃত হয়ে পড়ে এবং বিক্ষোভকারীরা সড়ক অবরোধ করে। একাধিক স্থানে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কর্তৃপক্ষ খাগড়াছড়ি সদর ও আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। তবু সহিংসতা বন্ধ হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, খাগড়াছড়ির বিভিন্ন জায়গায় সশস্ত্র হামলা চালানো হয় পাহাড়িদের বসতির ওপর। দুজন আদিবাসী গুরুতর আহত হন।
পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ২৮ সেপ্টেম্বর, গুইমারা উপজেলা এলাকায়, যেখানে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে, যার ফলে তিনজন তরুণ আদিবাসী নিহত হন এবং আরও অনেকে আহত হন। শতাধিক আদিবাসী মালিকানাধীন বাড়ি, দোকান এবং যানবাহন বাঙালি সেটেলাররা লুটপাট ও আগুনে পুড়িয়ে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
আরও পড়ুনহাসিনা সরকারের নীতি পাহাড়ে এখনো বহাল আছে১৮ অক্টোবর ২০২৪তথ্য বিকৃতি, অপপ্রচার ও প্রশ্নবিদ্ধ মেডিকেল রিপোর্টএই সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে দাবি করা হয় হামলার জন্য বিক্ষোভকারীরাই দায়ী। একই সঙ্গে মেডিকেল রিপোর্টের ফলাফল পত্রিকায় প্রকাশের কয়েক দিন পূর্বেই বাঙালি সেটেলারদের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়, কথিত ধর্ষণের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। পরবর্তী সময়ে সরকারি মেডিকেল বোর্ড জানায়, ১২ বছর বয়সী মেয়েটির দেহে ‘ধর্ষণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি’। কিন্তু আদিবাসী অধিকারকর্মীরা রিপোর্ট সাজানো বলে প্রত্যাখ্যান করেন এবং স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্তের দাবি জানান।
১ অক্টোবর একটি ফেসবুক পোস্টে চাকমা সার্কেলের রানি ইয়েন ইয়েন যেসব প্রশ্ন তুলেছেন তার মধ্যে কয়েকটি প্রশ্ন ছিল: মেডিকেল রিপোর্টে নেগেটিভ আসবে সেটি সংবাদপত্রে রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার তিন দিন আগে এনারা জানলেন কীভাবে? কারা তাদের সে আশ্বাস দিয়েছিল? মেডিকেল রিপোর্ট কি গতকাল সাংবাদিকদের কাছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করেছে? তাদের সে এখতিয়ার আছে? না পুলিশ করেছে? করে থাকলে থানার রিসিভ করার কোনো সিল নেই কেন? আর পুলিশ করুক বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ভুক্তভোগীর ছবি নামসহ ব্যক্তিগত পরিচয়–সংবলিত রিপোর্ট প্রকাশ করা আইনত দণ্ডনীয় নয় কি?
রানি ইয়েন ইয়েন এর মতে, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারী এবং শিশুদের ধর্ষণ–পরবর্তী রাষ্ট্রযন্ত্রের ধর্ষণ ঘটনার সত্যতা ধামাচাপা দেওয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না, তাদের জেনে রাখা উচিত এই মেডিকেল রিপোর্ট বিনা প্রশ্নে সত্য বলে গ্রহণ করার কোনো অবকাশ নেই। ছাত্রনেতা অলিক মৃসহ সচেতন অনেকেই ইতিমধ্যে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর সোহানি জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা ঘটনায় তাঁর মেডিকেল রিপোর্টেও ধর্ষণের আলামত উধাও করে দেওয়া হয়েছিল। কেবল ধর্ষণ বাদ দিলেও জুলাই শহীদ আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছয়বার বদলাতে বাধ্য করা হয়েছিল।
এটি লিখলাম কেবল মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে নিপীড়ককে বাঁচানোর জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সংস্থাগুলো চাইলে অনেক কিছু করতে পারে, মিথ্যা মেডিকেল রিপোর্ট তৈরি করা সহজ কাজগুলোর মধ্যে একটি।
আরও পড়ুনপাহাড়ে কেন এখনো সংঘাতময় পরিস্থিতি০২ ডিসেম্বর ২০২১ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির জন্য সুপারিশঅন্যান্য অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের মতো মানবাধিকার সংগঠন ফিয়ান ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস কমিশন, ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক গ্রুপ অন ইন্ডিজিনাস অ্যাফেয়ার্স এবং মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ ইন্টারন্যাশনাল আদিবাসীদের ওপর ক্রমবর্ধমান সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ এবং তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এবং চলমান প্রাতিষ্ঠানিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। সেগুলো হলো:
১. ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত সব ব্যক্তিকে দ্রুত শনাক্ত, গ্রেপ্তার ও বিচার করতে হবে।
২. ভুক্তভোগীর জন্য নিরাপত্তা, জরুরি চিকিৎসা ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা দিতে হবে।
৩. পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীদের ওপর সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে দায়মুক্তির সংস্কৃতি এবং যৌন সহিংসতার রাজনৈতিক ব্যবহারের অবসান ঘটাতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং বাঙালি সেটেলারদের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সব মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে দ্রুত, নিরপেক্ষ ও কার্যকর ফৌজদারি তদন্ত, বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণে জড়িতদের বিচার দাবিতে খাগড়াছড়িতে সড়ক অবরোধ। চেঙ্গী স্কয়ার, খাগড়াছড়ি, ২৫ সেপ্টেম্বর