বিতণ্ডার মধ্যে মাকে ছুরিকাঘাত, চিৎকারে ঘুম থেকে উঠে এলে মেয়ের ঘাড়ে কোপ
Published: 11th, December 2025 GMT
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মা–মেয়েকে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার গৃহকর্মী আয়েশা আক্তার প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, বাসাটি থেকে দুই হাজার টাকা চুরি হওয়া নিয়ে গৃহবধূ লায়লা আফরোজের সঙ্গে গৃহকর্মীর বাগ্বিতণ্ডা হয়। এর জের ধরেই মা–মেয়ে খুনের এ ঘটনা ঘটে।
গত সোমবার মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের একটি ভবনের সপ্তম তলার বাসায় লায়লা আফরোজ (৪৮) ও তার একমাত্র সন্তান নাফিসা নাওয়াল বিনতে আজিজকে (১৫) গলা কেটে হত্যা করা হয়। চার দিন আগে ওই বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নিয়েছিলেন আয়েশা (২০)। গতকাল বুধবার দুপুরে ঝালকাঠির নলছিটি থেকে আয়েশা ও তাঁর স্বামী রাব্বীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো.
কেন এই হত্যাকাণ্ড, সে বিষয়ে আয়েশার দেওয়া বক্তব্যের বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিত থেকে চুরি করার অভ্যাস তাঁর আগ থেকেই ছিল। এই বাসায় কাজে যোগ দেওয়ার দ্বিতীয় দিন আয়েশা গৃহকর্তার মানিব্যাগ থেকে দুই হাজার টাকা চুরি করেন। এ নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে গৃহকর্ত্রী লায়লা আফরোজের সঙ্গে তাঁর বাগ্বিতণ্ডা হয়। গৃহকর্ত্রী আয়েশাকে পুলিশে দেওয়ার ভয় দেখান। এ নিয়ে কাজের তৃতীয় দিনেও দুজনের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়। চতুর্থ দিনে কাজে যাওয়ার সময় আয়েশা পরিকল্পনা করেন, তাঁর সঙ্গে আবার বিতণ্ডা হলে তিনি লায়লাকে ছুরিকাঘাত করবেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী বাসা থেকে সুইচ গিয়ার ছুরি সঙ্গে করে নিয়ে যান। সেদিন লায়লার সঙ্গে আয়েশার আবার কথা–কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে লায়লা তাঁর স্বামীকে মোবাইলে কল দিতে গেলে আয়েশা পেছন থেকে তাঁর ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করেন। তখন তাঁদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। এরপর আয়েশা ছুরি দিয়ে লায়লাকে একের পর এক আঘাত করেন। তখন পাশের ঘুরে ঘুমিয়ে ছিল লায়লার মেয়ে নবম শ্রেণিপড়ুয়া নাফিসা। চিৎকার শুনে ঘুম থেকে উঠে এসে মাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে সে বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীকে ফোন করতে যায়। তখন তার ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করেন গৃহকর্মী আয়েশা।
নজরুল ইসলাম বলেন, ঘটনার দিন আয়েশা নিজেও আহত হন। এরপর তিনি নিজের রক্তমাখা পোশাক পাল্টে নাফিসার স্কুলড্রেস পরে একটি ল্যাপটপ ও মোবাইল নিয়ে চলে যান।
মা–মেয়েকে হত্যার পর বাসা থেকে বেরিয়ে আয়েশা কীভাবে চলে যান, তার বর্ণনা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইবনে মিজান ও অতিরিক্ত উপকমিশনার জুয়েল রানা। তাঁরা জানান, আয়েশা ওই বাসা থেকে বেরিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতরে যান। সেখানে গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে সাভারের দিকে চলে যান। তাঁদের বাসা সাভারের হেমায়েতপুরে। স্বামী রাব্বীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাঁরা ওই বাসা থেকে চুরি করে নেওয়া মোবাইল ও তাঁর নিজের রক্তমাখা কাপড় সিঙ্গাইর সেতু থেকে নদীতে ফেলে দেন। পরে তাঁরা আত্মগোপনে থাকার জন্য ঝালকাঠির নলছিটিতে রাব্বীর দাদাবাড়ি চলে যান।
চুরির এক জিডির সূত্র ধরে আয়েশাকে শনাক্ত
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, ওই বাসায় কাজে যোগ দেওয়ার সময় আয়েশার কোনো মোবাইল নম্বর, ঠিকানা রাখা হয়নি। গত জুলাইয়ে মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের হওয়া চুরির ঘটনাসংক্রান্ত একটি জিডির সূত্র ধরে তাঁকে শনাক্ত করে পুলিশ। ওই জিডিতে বলা হয়, বাবর রোডের একটি বাসা থেকে আয়েশা আট হাজার টাকা ও একটি সোনার আংটি চুরি করেছিলেন।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইবনে মিজান বলেন, ওই জিডির তদন্ত কর্মকর্তা আয়েশার কাছ থেকে চুরি হওয়া টাকা ও সোনার আংটি উদ্ধার করেছিলেন। মা–মেয়ে খুনের ঘটনা উদ্ঘাটনে বসা বৈঠকে ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে তাঁরা জানতে পারেন, বাবর রোডের বাসা থেকে সোনার আংটি চুরি করা আয়েশার গলার একপাশে পোড়া দাগ রয়েছে। আয়েশার দেওয়া একটি মুঠোফোন নম্বর রয়েছে বলে জানান তিনি। মা–মেয়ে খুনের রহস্য উদ্ঘাটনে এটাই ছিল একমাত্র ক্লু (সূত্র)। ওই মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে মহসিন নামের একজন ফোন ধরে জানান, একটি ঘটনায় তিনি জেলে গিয়েছিলেন। সেই সময় নম্বরটি তাঁর বন্ধু রাব্বী ব্যবহার করতেন। মোবাইলের ডিসপ্লে নষ্ট থাকায় তা ঠিক করতে কিছুদিন আগে রাব্বী সেটি তাঁকে দিয়েছিলেন। মহসিন জানান, রাব্বীর স্ত্রীর নাম আয়েশা, গৃহকর্মীর কাজ করেন এবং সাভারের হেমায়েতপুরে থাকেন। এভাবে রাব্বীকে শনাক্ত করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম বলেন, আয়েশার খোঁজে হেমায়েতপুরে তাঁদের ভাড়া বাসায় অভিযান চালানো হয়। সেখানে রাব্বী ও তাঁর স্ত্রীকে পাওয়া যায়নি। ওই বাসায় আয়েশার সঙ্গে তাঁর শাশুড়ি ও মা থাকতেন। তাঁদের কাছ থেকে আয়েশা বরিশালে যেতে পারেন এমন ধারণা পেয়ে পুলিশ পটুয়াখালীর দুমকিতে এবং পরে বুধবার দুপুরে ঝালকাঠির নলছিটিতে রাব্বীর দাদার বাড়িতে অভিযান চালায়। সেখান থেকে রাব্বী ও আয়েশাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে মা–মেয়েকে খুন করার পর ওই বাসা থেকে খোয়া যাওয়া একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে।
শুধু দুই হাজার টাকা চুরির জন্যই এ জোড়া খুন—এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যদি দুই হাজার টাকার জন্য বিতণ্ডা না হতো, তাহলে সে কাজে না–ও আসতে পারত। কিন্তু পরদিন সে ওই বাসায় ছুরি নিয়ে ঢুকেছে, ক্রাইম করার জন্যই ঢুকছে। সে কোনো মোবাইল ব্যবহার করেনি। মুখ ঢেকে আসছে, কাজটা করার পরে কীভাবে সেফ এক্সিট হবে, মেয়ের স্কুলড্রেস পরে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেছে। তার ক্লিয়ার ক্রিমিনাল ইনটেনশন আছে। এর পাশাপাশি পুলিশে দেওয়ার ভয়, রাগারাগির ক্ষোভ কাজ করেছে আয়েশার।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয়তো আরও তথ্য পাওয়া যাবে। তাঁর সঙ্গে আরও কেউ জড়িত কি না বা এর পেছনে কোনো সিন্ডিকেট আছে কি না, তা জানা যাবে।
রিমান্ড মঞ্জুর
মা–মেয়েকে হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সহিদুল ইসলাম আয়েশা ও তাঁর স্বামী রাব্বীকে আজ ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন জানান। শুনানি শেষে আদালত আয়েশার ছয় দিন ও রাব্বির তিন দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম হ ম মদপ র কর মকর ত ওই ব স য় গ হকর ম ঘ ত কর আয় শ র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচনে পুলিশ সদস্যদের শতভাগ নিরপেক্ষ থাকতে হবে: ডিএমপি কমিশনার
আসন্ন নির্বাচনে পুলিশ সদস্যদের শতভাগ নিরপেক্ষতা বজায় রাখার পাশাপাশি সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। আজ বুধবার রাজধানীর রাজারবাগে পুলিশ অডিটরিয়ামে চলতি বছরের নভেম্বর মাসের অপরাধ পর্যালোচনা সভায় পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।
ডিএমপির বিভিন্ন থানায় সদ্য যোগ দেওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) উদ্দেশে কমিশনার বলেন, নতুন ওসিদের সংশ্লিষ্ট থানা এলাকার অপরাধচিত্র ও পরিস্থিতি ভালো করে বুঝে নিতে হবে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অভ্যাসগত অপরাধীদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
সভায় ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) মো. সরওয়ার বলেন, অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিটি থানায় টহল কার্যক্রম জোরদার করার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। তিনি টহলকাজে সরকারি মোটরসাইকেলগুলো ব্যবহার করার তাগিদও দেন।
নতুন ডিসি (উপকমিশনার) এবং ওসিদের প্রতিটি থানা এলাকার অপরাধের নিজস্ব ধরন অনুযায়ী কাজ করতে বলেন অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, মামলা নিষ্পত্তি ও ওয়ারেন্টের বিষয়ে কর্মকর্তাদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। কমিউনিটি পুলিশিং ও বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে গৃহকর্মী নিয়োগে পরিচয়পত্র যাচাই এবং অপরিচিতদের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আসন্ন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবসে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
মাসিক অপরাধ সভায় নভেম্বর মাসে ঢাকা মহানগরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, জননিরাপত্তা বিধানসহ উত্তম কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ডিএমপির বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করেন ডিএমপি কমিশনার।
অপরাধ পর্যালোচনা সভায় অতিরিক্ত কমিশনার (সিটিটিসি) মাসুদ করিম, অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) শফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত কমিশনার (লজিস্টিকস, ফিন্যান্স এবং প্রকিউরমেন্ট) হাসান শওকত আলী, যুগ্ম কমিশনার, উপকমিশনার, ডিএমপির সব থানার ওসি ও বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।