ঐক্যমত্য এনে আমরা নতুন সরকারের দিকে চলে যাব: ড. ইউনূস
Published: 15th, January 2025 GMT
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর মতৈক্যের ভিত্তিতে তৈরি হবে গণঅভ্যুত্থানের চার্টার (সনদ) এবং সেই চার্টারের ভিত্তিতে পরবর্তী নির্বাচন হবে। ঐক্যমত্য নিয়ে এসে আমরা নতুন সরকারের দিকে চলে যাব। বুধবার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চার সংস্কার কমিশনের প্রধান প্রধান উপদেষ্টা ড.
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে কমিশন প্রধানদের নিয়ে বৈঠকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর মতৈক্যের ভিত্তিতে তৈরি হবে গণঅভ্যুত্থানের চার্টার (সনদ) এবং সেই চার্টারের ভিত্তিতে পরবর্তী নির্বাচন হবে। সংস্কার কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বহু রকমের কমিটি হয়, রিপোর্ট আসে, গ্রহণ করি, আনুষ্ঠানিকতা পালন করি, আজকের ঘটনাটা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। কেন ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে আমরা সবাই জানি। কারণ ইতিহাসের প্রবাহ থেকেই কমিশনগুলো সৃষ্টি হয়েছে। একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির হঠাৎ পুনরুত্থান হয়েছে।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘এটা ইতিহাসের অংশ, কোনো বিচ্ছিন্ন রিপোর্ট দেওয়ার বিষয় না। আমরা সেই ইতিহাসকে ধারণ করতে পারছি কিনা এবং সেটা সামনে নিয়ে যেতে পারছি কিনা। ইতিহাসের যে অঙ্গীকার ছিল, সেই অঙ্গীকার আমরা পূরণ করতে পারছি কিনা সেটাই আজকে আমাদের প্রশ্ন। আমাদের আত্মবিশ্বাস হতে হবে যে, আমরা পারবো।’
তিনি বলেন, ‘আজকে যে রিপোর্টগুলো আমরা হাতে নিলাম, নিশ্চিতভাবেই এটা একটা বড় ইনটেলেকচুয়াল এক্সারসাইজ দেশের জন্য। কেউ এটাকে অস্বীকার করবে না। কিন্তু আজকের গুরুত্বটা ইনটেলেকচুয়াল এক্সেলেন্সের জন্য না। ‘আমরা মানুষের মনোভাবকে, মানুষের স্বপ্নকে এর মধ্যে ধারণ করতে পারছি কিনা সেটাই হলো মূল প্রশ্ন। যে বিচার হবে, আমরা সেই স্বপ্নকে ধারণ করতে পেরেছি কিনা? সেটার যাত্রা শুরু হলো, এই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রবাহে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা একটা নতুন বাংলাদেশ তৈরি করার স্বপ্ন নিয়ে এটার কাঠামো রচনা করার কাজ আপনাদের হাতে দিয়েছিলাম কমিশনের মাধ্যমে। স্বপ্ন আছে, সেটার রূপরেখা তুলে ধরার জন্য।’ সবার সঙ্গে আলোচনা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটার মাধ্যমে আমরা আলোচনা শুরু করব সবার সঙ্গে যে- সবার মন সায় দিচ্ছে কিনা। অধিকারগুলো পূরণ হচ্ছে কিনা। আলোচনার পরবর্তী অধ্যায়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা হবে। এতে গণঅভ্যুত্থানের একটা চার্টার তৈরি হবে। সেই চার্টার মতৈক্যের ভিত্তিতে হবে। নির্বাচন হবে, সবকিছু হবে। এই চার্টার থেকে যাবে। ইতিহাসের অংশ হিসেবে এটা আমাদের জাতীয় কমিটমেন্ট, দলীয় কমিটমেন্ট না। আমরা আশা করছি, সব দল এই চার্টারে সই করবে।’
‘এটা বাঙালির একটা সনদ, যে সনদ আমরা বুকে নিয়ে অগ্রসর হবো। যত তাড়াতাড়ি পারি, যত বেশি পরিমাণে এটা বাস্তবায়ন করতে পারি, বাস্তবায়ন করতে থাকব। ভবিষ্যতে যে নির্বাচন হবে এটার ভিত্তিতে, এই চার্টারের ভিত্তিতে, সেটাও যেন ঐক্যমত্যের সরকার হয়- যে চার্টারকে আমরা ধরে রেখেছি, যত কিছুই হোক, এটা যেন আমরা হাত থেকে ছেড়ে না দেই। তাহলে এই স্বপ্নের যে ধারাবাহিকতা সেটা থাকবে কী করে? আমরা সেই স্বপ্নের ধারাবাহিকতা চাই, বাস্তবায়ন চাই। নির্বাচন তারই একটা অংশ হবে, চার্টারের একটা অংশ হবে,’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ড. ইউনূস বলেন, ‘ঐক্যমত্যের নির্বাচন হবে, তা না হলে চার্টার তো হারিয়ে যাবে, যদি ঐক্য না থাকে। কাজেই এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আমাদের সেই গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। এই যে পরবর্তী অধ্যায় শুরু হবে, আলোচনা, সেটা কীভাবে আমরা করব, ঐক্যমত্য নিয়ে এসে আমরা নতুন সরকারের দিকে চলে যাব।’
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে চারটি কমিশনের রিপোর্ট জমা পড়েছে বুধবার। অন্য দুটি কমিশনের জন্য ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে প্রয়োজন মনে করলে জমা পড়া চারটি কমিশনের রিপোর্টেরও পুনর্মূল্যায়ন কমিটিগুলো করতে পারবে। আজ যারা প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তারা হলেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান সরফরাজ হোসেন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান। পরে রিপোর্টের সারসংক্ষেপ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কমিশন প্রধান ও উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন সরক র র পরবর ত র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
এলডিসি উত্তরণে সঠিক পথে বাংলাদেশ, নতুন চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক অস্থিরতা
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক ধাক্কা সত্ত্বেও স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে টেকসই উত্তরণে সঠিক পথেই আছে বাংলাদেশ। তবে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। চ্যালেঞ্জগুলো হলো—আর্থিক খাতের দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতা, বৈদেশিক মুদ্রার চাপ, রপ্তানিতে ঝুঁকির মাত্রা, জলবায়ু ঝুঁকি, যুব বেকারত্ব ও বহির্বিশ্বের বাণিজ্য–সংক্রান্ত রাজনৈতিক উত্তাপ। এ ছাড়া দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতাও নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে।
এলডিসি উত্তরণের প্রস্তুতি পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সম্প্রতি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে এ কথা বলেছে বাংলাদেশ সরকার। আগামীকাল জাতিসংঘের সিডিপির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন অর্থ মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। সভাটি ভার্চ্যুয়াল উপায়ে হবে।
দীর্ঘ আট বছরের নানা প্রক্রিয়ায় ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি কম থাকার জন্য এলডিসি উত্তরণ আরও তিন থেকে ছয় বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করা হচ্ছে।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এলডিসি উত্তরণের তিনটি মানদণ্ড আছে। এগুলো হলো—মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা।
বাংলাদেশ ২০১৮ ও ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক মানদণ্ডের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয়। ২০২১ সালেই বাংলাদেশ চূড়ান্ত সুপারিশ পায় যে ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ হতে পারে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে প্রস্তুতির জন্য আরও দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ যদি এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হয়, তাহলে বাংলাদেশই হবে প্রথম দেশ, যেটি তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে বের হবে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবেদনটি শুধু সরকারের প্রতিবেদন নয়; দেশের প্রতিবেদনও। সরকারের পাশাপাশি অন্য অংশীজনেরা কী বলেন, তাও প্রতিবেদনে থাকা উচিত। আমরা এলডিসি উত্তরণের শর্ত পূরণ করেছি। কিন্তু টেকসই উত্তরণের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। যেহেতু অ্যানহেন্সড মনিটরিং ম্যাকানিজমের (ইএমএম) আওতায় এই প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, তাই সামনের চ্যালেঞ্জ ও বাস্তব পরিস্থিতি থাকা উচিত। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি; নির্বাচনের কারণে বিনিয়োগ শঙ্কা; ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ-এসব নতুন করে এসেছে। বাড়তি সময় পেলে আরও শক্ত অবস্থানে যাওয়া সম্ভব হবে। কিছু সময় পেছানোর সুযোগ থাকলে তা নেওয়া যেতে পারে।
প্রতিবেদনে যা বলা আছেজাতিসংঘকে পাঠানো সরকারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলডিসি উত্তরণ–পরবর্তী সময়ে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি আছে। যেমন অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা চলে যেতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ কিছু বাজারে তিন বছর সুবিধা বাড়ালেও দীর্ঘ মেয়াদে কঠোর শর্ত আসবে। ট্রিপসের আওতায় সুবিধা যাবে, যা ওষুধশিল্পকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। স্থবির হয়ে পড়া বিদেশি বিনিয়োগে আরও প্রভাব পড়তে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রাজনৈতিক পরিবর্তন ও দীর্ঘমেয়াদি সংকট কাটিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে আছে। এলডিসি–পরবর্তী যুগে নানা চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। যেমন রপ্তানি প্রতিযোগিতা, ব্যাংকিং সংস্কার, রাজস্ব কাঠামো, জলবায়ু অর্থায়ন, ঋণ ব্যবস্থাপনা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, তবে সরকার যদি নীতি সংস্কার ধরে রাখে, বেসরকারি খাত উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে এবং উন্নয়ন সহযোগীরা যথাযথ সহায়তা দেয়। তাহলে বাংলাদেশ শুধু এলডিসি উত্তরণই নয়, বরং উচ্চমধ্যম আয়ের পথে স্থায়ী অগ্রগতি অর্জন করতে পারে।
উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে যাএকের পর এক বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ইস্যু বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রাকে সবচেয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত করেছে—এমন মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এক. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও খাদ্যসরবরাহে বড় ধাক্কা লাগে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। দুই. মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে শ্রমবাজার অনিশ্চয়তা ও রেমিট্যান্সপ্রবাহে আঘাত। তিন. ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়েছে। চার. দীর্ঘদিনের অনিয়ম, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, তদারক ব্যবস্থার ঘাটতিতে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা। পাঁচ. যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের কারণে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতের রপ্তানিতে চাপ। এসব বিষয় বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণে পথকে জটিল করেছে। নীতিনির্ধারণী চাপ বাড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে ২০২৪–এর গণ-অভ্যুত্থানজাতিসংঘে পাঠানো প্রতিবেদনে ২০২৪–এর গণ-অভ্যুত্থান ও ক্ষমতার পটপরিবর্তনের চিত্রও ওঠে আসে। প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটালেও এরপরে প্রশাসনিক পুনর্গঠন, রাজস্ব ঘাটতি, নীতিগত শূন্যতাসহ বেশ কিছু ইস্যু আরও কিছু সময় অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বহু বছর ধরে রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত এলিটদের প্রভাব ছিল। বিগত সরকারের সময়ে বছরে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার করে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। যা আর্থিক খাত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করেছে।