গাছিদের গুড়-পাটালির পসরায় জমজমাট মেলা
Published: 15th, January 2025 GMT
চার দশক ধরে খেজুর গুড় তৈরি করেন গাছি আবদুল গণি (৭০)। শীতের মৌসুমে ব্যস্ততা বেড়ে যায় তার। খেজুরের রস ও গুড় বিক্রি করেই চলে এই গাছির সংসার। গুড়-পাটালি নিয়ে তিনি বুধবার (১৫ জানুয়ারি) হাজির হয়েছিলেন যশোরের চৌগাছা উপজেলা চত্ত্বরে আয়োজিত গুড়ের মেলায়। সেখানে ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষি করে ন্যায্য দামে গুড় ও পাটালি বিক্রি করতে পেরে খুশি তিনি।
অপর গাছি আবদুল কুদ্দুস (৩৫) তিন শতাধিক খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় পাটালি বিক্রি করেন। গুড় মেলায় প্রায় ১০০ কেজি গুড়ি ও পাটালি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তিনিও। ক্রেতাদের সাড়া পেয়েছেন ভালো।
শুধু আবদুল গণি কিংবা আবদুল কুদ্দস নয়, তাদের মতো প্রায় দুই শতাধিক গাছির খেজুর গুড়-পাটালির পসরায় জমজমাট হয়ে উঠেছে যশোরের চৌগাছার খেজুর গুড়ের মেলা। আজ সকালে উপজেলা চত্ত্বরে উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত তিন দিনব্যাপী এই মেলার উদ্বোধন করা হয়। ফিতা কেটে ও বেলুন উড়িয়ে মেলাটির উদ্বোধন করেন যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম।
আরো পড়ুন:
দুই বাঘাইড়ের দাম ৩ লাখ টাকা
পইলের মাছের মেলায় মানুষের ঢল
২০২৩ সালে যশোরের চৌগাছা উপজেলা প্রশাসন প্রথম খেজুর গুড়ের মেলা চালু করে। তারই ধারাবাহিকতায় তৃতীয়বারের মতো এবারো মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এবারের মেলায় উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের দুই শতাধিক গাছি অংশ নেন। গাছিরা তাদের উৎপাদিত গুড়, পাটালি নিয়ে স্টল দিয়েছেন। গুড়, পাটালি বিক্রির পাশাপাশি এই শিল্পের সম্প্রসারণে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। গুড় মেলায় গাছিদের পাশাপাশি ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। মানভেদে খেজুর গুড় ও পাটালি প্রতি কেজি ৩৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি হচ্ছে।
পাঁচ ও সাত বছর বয়সী দুই মেয়েকে নিয়ে মেলায় আসেন এনজিও কর্মী তৌফিকুর রহমান। তিনি বলেন, “শীতের মৌসুমে বিকেল বেলায় বাবা রস সংগ্রহের জন্য খেজুরের গাছ কাটতেন। সংগ্রহ করা সেই রস জ্বালিয়ে মায়ের হাতের গুড় খাওয়ার জন্য গোল হয়ে বসে থাকতাম আমরা ভাই-বোনরা। এখন মা-বাবা নেই আর গাছও নেই। আমরা গুড় তৈরি করা দেখলেও আমার সন্তানরা তা দেখেনি। তাই সন্তানদের নিয়ে মেলায় এসেছি। ঘুরে ঘুরে ওদের গুড় তৈরি ও গুড় দেখাচ্ছি। ওরা খুব আনন্দ পেয়েছে।”
গুড়ের ক্রেতা শিহাব উদ্দিন বলেন, “যশোরের গুড় স্বাদে মানে অন্যন্য। বাজারে গুড় কিনতে ভয় পায় ভেজালের কারণে। মেলার খবর শুনে চলে এসেছি; ঘুরে ঘুরে গুড় দেখছি; স্বাদ নিচ্ছি। নির্ভেজাল গুড় এখানে।”
মেলায় আগতদের গুড় দেখাচ্ছেন বিক্রেতারা
মেলায় অংশ নেওয়া হুদা ফতেপুর গ্রামের গাছি নজরুল ইসলাম বলেন, “বিশ বছর ধরে গাছ কাটি। এবছর ৫২টি গাছ কাটছি (রস সংগ্রহ) করছি। খুব বেশি গুড় বানাতে (তৈরি) পারিনি। গুড় বেশি হবে ফাল্গুন মাসে। এখন শীত বেশি, জিরেন (স্বচ্ছ) রস সব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এক ভাড় রস ২৫০ টাকায় বিক্রি করছি। গুড়ের চেয়ে রস বিক্রিতে বেশি লাভ।”
পাশাপোল গ্রামের গাছি আলম গাজি বলেন, “ত্রিশ বছর ধরে গাছ কাটি (রস সংগ্রহ)। এবারো ২৫টি গাছ কাটছি। গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এজন্য গুড় বেশি তৈরি করতে পারছি না। মেলায় গুড়-পাটালি এনেছি। ভালো দাম পাচ্ছি।”
মেলায় আসা সিংহঝুলি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হামিদ মল্লিক বলেন, “২০২২ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রথমবারের মতো চৌগাছায় খেজুর গুড়ের মেলা চালু করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এবারো মেলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে খেজুর গুড় যশোরের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। খেজুর গুড়ের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও শিল্পের বিকাশে এই মেলা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।”
উপজেলা সমবায় অফিসার অহিদুর রহমান বলেন, “গাছিরা আগে সংগঠিত ছিল না। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১১টি ইউনিয়নে একটি করে গাছি সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছে। গাছিরা এখন সংগঠিত। তাদেরকে সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।”
মেলার আয়োজক চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুস্মিতা সাহা বলেন, “খেজুর গুড় যশোরের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। খেজুর গুড়ের অর্থনীতি সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় ব্যাপক সাড়া পড়েছে।”
যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম বলেন, “খেজুর গুড়ের ঐতিহ্যকে সারাবিশ্বের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। খেজুর গুড় উৎপাদনের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাই।”
এদিকে মেলা উপলক্ষে প্রতিদিন গম্ভিরা, লাঠিখেলা, পিঠা উৎসব ও কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। তিন দিনের এই মেলা শেষ হবে আগামী শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি)।
ঢাকা/রিটন/মাসুদ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম ল র খবর ম ল র আয় আবদ ল উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
দেড়শ বছর টিকে আছে বালিকান্দি চামড়ার হাট
প্রায় দেড়শ বছর আগে মৌলভীবাজারের বালিকান্দি গ্রামে গড়ে ওঠে চামড়ার হাট। কোরবানির ঈদ এলেই মনু নদী তীরবর্তী গ্রামের এ হাটে চামড়া কেনাবেচা চলে দীর্ঘ রাত পর্যন্ত। ক্রেতা-বিক্রেতা, শ্রমিকের আনাগোনায় উৎসবমুখর থাকে বালিকান্দি বাজার।
মৌলভীবাজার জেলায় চামড়া কেনাবেচার একমাত্র হাট বালিকান্দি বাজার। জল ও স্থলপথে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় এটি দ্রুত বিভিন্ন এলাকায় পরিচিতি লাভ করে। স্থানীয় বাজারে চা স্টলের মালিক আব্দুল করিম জানান, তারা বাপ-দাদার আলোচনায় শুনেছেন, চার-পাঁচ পুরুষ আগে এ ব্যবসার যাত্রা শুরু। এক সময় খুব জমজমাট ছিল এ হাট। তিনিও এক সময় চামড়া কেনাবেচায় জড়িত ছিলেন। ব্যবসায় লস খাওয়ায় চায়ের দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন এখন।
জানা যায়, ১৮৬০ থেকে ১৮৭০ সালের দিকে এ বাজারের যাত্রা। এখন এ ব্যবসার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। ট্যানারি মালিকরা টাকা আটকে রাখায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। চামড়া বেচাকেনা যখন জমজমাট ছিল, তখন ঈদকেন্দ্রিক বাজার সরব থাকত।
স্থানীয়রা জানান, অতীতে ঈদকেন্দ্রিক মৌসুমি ব্যবসায়ীসহ শতাধিক মানুষ চামড়া কেনাবেচা করতেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা মাংস ছিলে লবণ লাগিয়ে বড় পুঁজির ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতেন। বড় ব্যবসায়ীরা আগেকার দিনে ঢাকার হাজারীবাগ এবং নাটোরে ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করতেন। শওকত মেম্বার, সানুর মিয়া, আনোয়ার মিয়া, মো. তারণ, মিন্টু মিয়া, সুলেমান মিয়ারা তাদের আদি পুরুষের ব্যবসার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
গত ৭ জুন ঈদের দিন সন্ধ্যায় সরেজমিন বালিকান্দি চামড়ার বাজারে যেতে দেখা যায় চামড়াবোঝাই ছোট-বড় ট্রাক-পিকআপ, টমটম, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভিড়ে জ্যাম লেগে গেছে। ফাঁড়ি রাস্তায় যেতে হয়েছে বালিকান্দি বাজারে। সেখানে শামিয়ানা টানিয়ে সড়কের পাশে, কোথাও সড়কের অংশজুড়ে চলছে চামড়া থেকে মাংস সরানোর কাজ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এ কাজ করছেন।
চামড়া ব্যবসায়ী সুলেমান মিয়া জানান, ঈদের সময় বালিকান্দি বাজারে এখনও ১৫ থেকে ১৬ হাজার চামড়া কেনাবেচা হয়। এতে এক দিনে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকার বেচাকেনা হয়। এবার গরুর আকারভেদে দেড়শ থেকে ৬০০ টাকা দরে চামড়া কেনাবেচা হয়েছে। চামড়া বিক্রি করতে আসা মাদ্রাসা শিক্ষক মাওলানা তাফাজ্জুল বিন ফারুকী রাজনগরী জানান, চামড়া ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দেড়শ-দুইশ টাকায় প্রতি পিস চামড়া কিনেছেন। এতে ট্রাক ভাড়া ও অন্যান্য খরচ ওঠানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শওকত মিয়া মেম্বার সমকালকে জানান, ব্যবসার মজা শেষ হয়ে গেছে ২০১৩ সাল থেকে। আগে ঈদ এলেই ট্যানারি মালিকরা বকেয়া পরিশোধ করে দিতেন। এখন বছরের পর বছর যাওয়ার পরও পাওনা টাকা পরিশোধ করেন না। গত বছরের পাওনা ৫৫ লাখ টাকার মাঝে এবার ঈদের আগের দিন ট্যানারি মালিক মাত্র ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এ বছর চার হাজারের বেশি চামড়ায় লবণ লাগিয়ে রেখেছেন। আরও কিছু লবণযুক্ত চামড়া কেনার জন্য দাম-দর চলছে। তিনি জানান, এ বছর বড় গরু কোরবানি দেওয়ার সংখ্যা খুব কম। ছোট চামড়ার সংখ্যাই বেশি।