এই পথ দিয়ে এখন সহজে হাঁটতেই পারে না কেউ। ছুটির দিন শুক্র-শনিবারে তো পা-ই ফেলা মুশকিল। মৌসুমের ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াও এখন চাকরির পরীক্ষার উপযুক্ত কেন্দ্র এই বিদ্যালয়। এইসব দিনে ফুটপাতে পত্রিকা-নোটবইয়ের পাতা বিছিয়ে দীর্ঘ সময় বসে থাকে অগণন নারী-পুরুষ। এদের অধিকাংশই গ্রাম-মফস্বল থেকে এসেছে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গী হিসেবে। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে ওরা অবশেষে উঠে গেলে ওদের আসনের কাগজগুলো নকশা করা ফুটপাতের সাথে লেপ্টে থাকে। তখন এসব অন্য আরেক নকশা হয় সাদা-কালো।
বিদ্যালয়টির পুরো দেয়াল ঘেঁষে যে ফুটপাত, তার ওপর কংক্রিটের স্থায়ী বেঞ্চ লাগানো। স্কুলের ছাত্রীদের মায়েরাই অধিকাংশ সময় উপবিষ্ট থাকেন। তারা উঠে গেলে এখানে ঠাঁই হয় ভবঘুরে, কখনও শ্রমজীবীদের। তবে নাকে রুমাল-টিস্যু গুঁজে না দিয়ে কেউ এই ফুটপাত পেরোতে পারে না। দেয়ালজুড়ে মনীষীদের উৎকীর্ণ বাণীগুলো তখন বেমানানই ঠেকে। ফুটপাতের কোথাও কোথাও বড়-ছোট মাছি জমে থাকে মৌচাকের মতো। মানুষের পদশব্দে এরা উড়ে যায়, তবুও মেঝেতে কিছু চোখে পড়ে না। এত মানুষের আঙুল কিংবা পায়ের পাতার চাপে পিষ্ট হতে হতে দুপুর গড়াতে না গড়াতেই রাতে ত্যাগ করা বিষ্ঠার দলা উধাও হয়ে যায়। এতে সিটি করপোরেশনের পয়সা বাঁচে, ধাঙড় নিয়োগের কসরত করতে হয় না। কিন্তু গন্ধ তো থেকে যায়, মাছি বসবে না-ই-বা কেন? গন্ধও তাহলে একটা খাবার। দিনের আলোয় যে কালো কুচকুচে উদ্বাস্তুটি শুয়ে আছে, তার মতো শরীর নয় লালু কিংবা হাসুর। মানুষের শরীর এত ময়লা হয় কী করে? মনে হয় জীবনে সে স্নান করেনি। খালি গা, কিন্তু নিম্নাংশে ময়লা জিন্সের প্যান্ট। বাবরি চুল, ঈষৎ দাড়ি গজিয়েছে। কিছুক্ষণ লেপ্টে থাকা সূর্যের আলো ওর ঘুমকে মোটেও বিঘ্নিত করে না। এখানে সেখানে বসে থাকা বাইরের কতিপয় ছাত্রী কোন উদ্দেশ্যে নোটবই পড়ে, তা বোঝা যায় না। প্রতিদিন তো আর পরীক্ষা থাকে না। এরা কি এই ওছিলায় কারও জন্য অপেক্ষা করে? হয়তো করে। মাঝেমধ্যে দেখা যায় মেয়েটি ছেলেসঙ্গীর সাথে সময় কাটায় কিংবা ছেলেটি কোনো মেয়ের সাথে। তবে রাতে যারা দাপিয়ে বেড়ায়– সেই লালু কিংবা হাশেম ওরফে হাসু অথবা জমসু, দিনের বেলায়ও কালেভদ্রে আসে। এ কি কেবলই জায়গার মায়া, না অন্য কিছু? কেউ কেউ বলতে চায় এই বেশেই নাকি লোকজন গোয়েন্দাগিরি করে। যা-ই হোক, এরা যেন রাত আর দিন ভাগ করে নিয়েছে। দিনে শাসন করবে কর্তৃপক্ষ, রাতে এরা। এটি না স্বৈরতন্ত্র, না গণতন্ত্র। প্রহরারত পুলিশের ভাষ্যে এসব আপনতন্ত্র। তবে নিশুতি রাতে একজনকে বর্জ্য ত্যাগরত অবস্থায় পুলিশ রুলের গুঁতো দিতে দিতে জানতে পেরেছিল, এ হচ্ছে নিরুপায়তন্ত্র।
কোনো একটা মুল্লুক শাসনের যেন এক অলিখিত নিয়ম চালু হয়েছে। লালু-ভুলুরা এখানে আসে অনেকটা বাধ্য হয়েই। উদ্বাস্তু-উন্মূলের শহরে ভবঘুরেও ঠাঁই করে নেয়। একসময় শহরটি ফ্লাইওভারে ছেয়ে গেলে আকাশ রুদ্ধ হয়, তখন এসবের নিচে ভালো আশ্রয় পেয়েছিল ঘরহীন মানুষ। তবে ফ্লাইওভারের তলা বাণিজ্যিকীকরণ হলে অনেকের অসুবিধা হয়। ঘেরাও দেওয়া বস্ত্রের ভেতর কী হতো কে জানে! আজ হাসু বলে লালুকে, “তুই না মগবাজারের নিচে থাকতি, এহন এইহানে ক্যান?”
“আরে সারাদিনের মাছ বেচার পানির গন্ধ থাহে। এইহানে তো এই রকম বিছানাও নাই। সোম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করি, বুঝলি না।” “রেলগাড়ির মতো গদির বিছানা অইলে বুঝতি সম্পদের ব্যবহার কারে কয়। পাক্কা বেঞ্চি না অইলে চিমটানিতে সর্বোচ্চ ব্যবহার অইয়া যাইতো। বাসে-গাড়িতে উঠলে মনে অয় সিটগুলা পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে। এই লালু, তুই না কইছিলি ফ্যাক্টরিতে কাম করবি।”
“পাইলে তো করিই। মেশিন ঘুরাইতে কী লাগে?”
“আরে হালা, এইডা কি আমাগো বোরো ক্ষেতের শ্যালো মেশিন পাইছস?”
“যেই মেশিনই হোক, আমি পারুম। আরে রক্তের একটা শক্তি আছে না? আমার দাদা কারখানায় কাম করত, তার মুখে কত কিচ্ছা শুনছি। কেমনে শ্রমিকরা ভোর না অইতেই কারখানার গেটে লাইন ধইরা খাড়াইত। আর মেশিন চালু অইলে চিমনির ধুঁয়া উপরে উঠতে উঠতে আসমানের মেঘের লগে গিয়া মিলত। এইসব এহন নাই। সব জায়গায় খালি টিপাটিপি।” এসব বলে লালু কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে থাকে। অতঃপর পশ্চিম দিকে কাত হয়ে শরীরটা ঐদিকে ঠেলে দেয়। মাথার ওপর ছাউনি থাকলেও দেয়ালটাই বড় আশ্রয়। এজন্য অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লেও বেঞ্চ থেকে কখনও পড়ে যায় না। এ দেয়ালের কোনো কানও নেই, ওরা যখন নিশুতি রাতে কথা বলে, ঐপারে তখন ওদের কথা শুনবার জন্য সন্তর্পণে কেউ দাঁড়িয়েও থাকে না। এটা নিরাপদ দেয়াল।
খানিক বাদে জমশেদ আলী ওরফে জমসু এসে মাস্তানি শুরু করে দেয়। জোরে কথা বলাটাই তার মাস্তানি, যা এই স্তব্ধতার সাথে বেমানান। বলে কিনা– “এই ব্যাটারা ব্যাংকের কাছাকাছি বইয়া গুলতানি মারলে ব্যাংক ডাকাতি অইলে ধরব আমাগোরে। একটু দূরে গিয়া বয়।”
এ সময় আড়মোড়া ভেঙে লালু উঠে বসে।
হাসু বলে– “এহন আর ব্যাংক ডাকাতি অয় না, চাইর দিকেই দেখস্ না ফকফকা লাইট।”
“আরে কিশোরগঞ্জে তো ডাকাতি অইছিল সুড়ঙ্গ কাইটা।”
“তাতে কী, যেইখানে অন্ধকার, সেইখান থাইকাই সুড়ঙ্গ কাটা শুরু করে”– এ হলো হাসুর জবাব।
“এহন সব জায়গায়ই লাইট।” অনিচ্ছা সত্ত্বেও লালু বিষয়টা ধরিয়ে দেয়।
“ঠিক, এই জন্যই তো সিঁধকাটার ভাত মরছে। তবে ওস্তাদেরা আন্ধাইরেই চোখে বেশি দেহে।” জমশেদ আর চুপ থাকে না।
“প্রশ্ন অইলো, আলো সুড়ঙ্গের শুরুতে না লাগলেও শেষ মাথায় তো লাগেই?”
লালুর তন্দ্রা পুরোটাই কেটে যাওয়ায় সে সতেজ কণ্ঠে বলে, “এই জমশা, অতো যে লেকচার মারছ্, এই ব্যাংকের ভিতরে দিনের বেলায় কী অয় কুনু দিন দেখছস?”
“দেখুম না আবার?”
“তাইলে ক’ হুনি।”
“এহন তো আর দু’নলা বন্দুক নিয়া দারোয়ান বইয়া থাহে না, তাই একদিন ঢুইকা গেলাম। দেহি কাউন্টারে কী জানি একটা অইছে। সবার ঐদিকে চোখ বইলা কেউ আমারে কিছু জিগায় নাই। লুকটা আসছে বউয়ের দেওয়া চেক নিয়া টেকা তুলতে। কিন্তু চেকের সইয়ে বারবার ক্যাশিয়ার সাবের সন্দেহ। একজন কইলো– আরে ফেমিলির চেক অইলে দিয়া দেন, অতো কথা ক্যান? লুকটা টেকা নিয়া বিদায় অইলে ক্যাশিয়ার বলে, জানেন না ভাই এহন কতো কী অয়। আমাগো মতো নিষ্কর্মা-ভাদাইম্যা স্বামীরা নাকি বউয়ের টেকা মাইরা দেওয়ার ধান্ধায় থাহে। হা হা!”
“জমশা রে, এই ইস্কুলের নাম জানস?”
“ভিকারুন্নেসা।”
“আরে পুরা নাম ক’।” লালু একটু জোর দিয়ে বলে।
“ভিকারুন্নেসা নূন।”
হাসু হাবার মতো বলে ফেলে– “তাইলে কি ভিক্ষা কইরা আর নুন বেইচা ইস্কুল বানাইছিল কেউ?”
“খবরদার এমন কথা কইছ না। আর কইলেও কুনু দিন ফেসবুকে দিবি না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা অইতে পারে।”
“অই হালা নিমচা অইলেও ওরে চাবি তো একখান মাইরা দিলি জমশা। আমি জানি হালায় ছিচকামি করে একটা স্মার্ট মোবাইল কিনার লাইগা।”
তখন দুটো মেয়েকে আসতে দেখে ওরা সতর্ক হয়ে ওঠে।
জমশেদ বলে, “অতো রাইতে কইত্থে? একটু বসো এইহানে, বিশ্রাম নিয়া যাও।”
“আমরা বাসায় কাম করি।”
“অতো রাইতে? কী কাম?”
“তার কোনো ঠিক আছে?”
“তা বসো।”
“না, এইহানে ছাদ নাই।”
“এই যে আছে।”
“এইডা ছাদ না, ছাউনি।”
“ও বুঝছি, তোমরা ইস্মার্ট।”
ওরা হিহি হেসে উঠতেই ছেলেগুলোর সন্দেহ হয়।
“পুলিশের ভয় আছে তোমাগো,” বলে হাসু।
“আমরা কি এইহানে বসছি? এই জন্যই তো খাড়াইয়া থাহি।”
“তোমরা সত্যিই বাসায় কাম করো, না অন্য কিছু”– এইবার সরল মানব লালুও পুলিশি জেরা শুরু করে দেয়।
“সত্যই করি।”
“অতো রাইতেও কাম?”
“আমাগো খালাম্মার আত্মীয়ের বিয়ার কাম আছিলো।”
“রাইতেও বিয়ার কাম, জিন্দেগি বরবাদ, তার চাইতে গারমেন্টস্ই তো ভালা।”
“না, ঐখানে খালি দেওয়াল। শুনছি একবার ঢুকলে আর বাইর অওয়া যায় না। এই জন্যই আগুন লাগলে মানুষ পুড়ে।”
“ঠিক কইছো। বাসাবাড়িতে কাম আমিও করছি। কিন্তু ঐখানে কোনো আসমান থাহে না।”
“এর লাইগ্যে খোলা আসমানের নিচে আইয়া ভাদাইম্যাগিরি?” মেয়েদের জবাব বেশ কড়া।
এইবার লালুর মুখে খই ফুটতে থাকে– “তা কইতে পারো। তয় আমি তোমাগো সব জারিজুরি জানি। শোনো, আমার দাদা আছিলো ফ্যাক্টরির সুবারভাইজার। তখন শ্রমিকরা ছিল ভিমরুলের চাকের মতো, সংখ্যায় ম্যালা। কিছু অইলেই দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য রাস্তায় বইয়া যাইতো। আর এহন তোমরা অইছো সংখ্যায় অল্প। একদিন আসো তো অন্যদিন আসো না। মাসে পনেরো দিন কাম কইরাও পুরা বেতন নেও। তোমাগো খালাম্মাদের না দিয়া কুনু উপায় যে নাই। এইডা অইলো উল্টা শোষণ, বুঝছো? যাও এখন।”
জমশেদ বলে, “চলো তোমাদের আগাইয়া দিয়া আসি।”
“না, লাগবো না”– মেয়েদের একজন বলে।
“তবে হুইনা যাও, তোমাগো খালাম্মারা আদতেই অসহায়। বিষব্যথায় জর্জরিত। আরও ছোট থাকতে কত যে পাও আর কোমর টিপছি তাদের। কাঠের মেইড ইন চায়না হাতুড়ি দিয়াও পিডে ম্যাসেজ করছি।”
মেয়ে দুটো বাঁকা হাসি দিয়ে চলতে শুরু করে। জমশেদ অযাচিতভাবে এদের পিছু নেয়। ছোট মেয়েটি পথে পড়ে থাকা কিছু গুলঞ্চ ফুল কোঁচড়ে নিয়ে বড়টিকে অনুসরণ করে।
এদের বিদায়ের পর হাসু ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু উত্তেজিত কথার রেশ থেকে যাওয়ায় লালুর ঘুম আসে না। সে একটা বিড়ি ধরায়। অতঃপর হাসুকে বলে, “দিনের বেলায় তো এই জায়গাটা ভদ্রলোকদের দখলে থাহে, তখন কী অয় জানস্?”
লালুর প্রশ্নে হাসু উঠে বসে।
“ম্যাডামরা খালি সংসারী আলাপ করে আর নিজের মাইয়াগো চিন্তায় অস্থির থাহে। কখনও ভেইলপুরি আর আমড়া-তেঁতুল, চাপ খায়। ছুটি অইলে মাইয়াগোরেও দেয়। ঐদিন হুনি এক ম্যাডাম আরেক ম্যাডামরে কয়, ‘যাদের স্কুলটাই শুরু হয় ময়লা আর আবর্জনা দেইখা তারা কী হিখবো কন তো দেখি আপা?’ ‘আরে বাদ দেন আপা। শহরের যেইখানে ময়লার ভাগাড় আছে, তার পাশের কেউ তো জানালাই খুলতে পারে না। আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেন, রিজল্টটা ভালা অইলেই অয়।’ মায়েদের আলাপ মেয়ে ডাক্তার অইবো, না ইঞ্জিনিয়ার অইবো, তার মইধ্যেই আটকা।”
লালু বলে– “অইলেই কী, শেষ পর্যন্ত তো ঐ বিদেশ। দেশে থাহে কেউ?”
“এই, তুই জানস্ ক্যামনে?”
“জানি।”
“আরে এই জন্যই তো ভালা ইস্কুলের শিক্ষা দরকার।”
“পুরুষদের আলাপাটা কেমন অয় ক’ দেহি।”
“বাজারদর ছাড়া অন্য কোনো আলাপ নাই।”
“তা তো অইবোই, পকেটের পয়সা তো তাগোই যায়। নতুন কইরা আবার ট্যাক্স-ভ্যাট বসাইছে, কথা কইবার সময় সরকাররে গাইলও দেয় শুনি।”
“একজন কইলো, ‘তাও তো ভাই আমরা মধ্যবিত্তরা এহনও মাছ-মাংস খাইতে পারি।’ আইচ্ছা, মধ্যবিত্তটা আসলে কী ক’ দেহি।”
“কী জানি, জমশেদ হালায় থাকলে কইতে পারতো।”
“ঐ হালায় না জানি এহন ছেরিগো লগে কোন তাফালিং করতাছে।”
দু’জনেরই আলাপে ছেদ পড়ে অদূরের একজনের ‘ওয়াক ওয়াক’ বমির শব্দে।
“আরে লুকটা বমি করে ক্যান?”
“কী করবো, দ্যাখ এক কোনায় লেখা আছে– এইখানে পায়খানা করা নিষেধ, তাই বমি করতাছে।”
“এহন কী অইবো?”
“কী আর অইবো, সকালে কাওয়ায় খাইয়া ফালাইব। এই শহর তো কাওয়ারই। কত রকমের কাওয়া, মানুষও কাওয়ার মতো করে। কাওয়া গু খায় না ঠিক, তয় বমি খায়।”
এইবার লালুকে শেষরাতের ঝিমানো পেয়ে বসে। সে সটান শুয়ে পড়ে শবাসনের মতো। তার কালো শরীরটাকে হাসু ভাবে কারখানার ধোঁয়ায় লেপ্টানো কিংবা সদ্য যেন সে কয়লার খনি থেকে উঠে এসেছে। সে আরও একটা সিগারেট জ্বালালে সেটির ধোঁয়া চিমনির ধোঁয়ার মতো খাড়া ওপরে উঠতে থাকে।
এই ধোঁয়া যেন ইঙ্গিত দেয় রাতের জড়তা ভেঙে এখনই কলকারখানায় কাজ শুরু হয়েছে। তাকে যদি কাজে ডাকা হতো, তবে আসল ধোঁয়াটা সে দেখতে পেত। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সূর্যের সামনে স্কাইডাইভার, তৈরি হয়েছে এক অলীক আলোকচিত্র
প্রাচীন গল্পে আছে, ইকারাস মোমের ডানা নিয়ে সূর্যের খুব কাছে উড়ে গিয়েছিল। তখন মোম গলে গেলে ইকারাস নিচে পড়ে যায়। সৃজনশীল এক ফটোগ্রাফার সম্প্রতি সূর্যের দারুণ এক ছবি তুলে সেই দৃশ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় একজন স্কাইডাইভার মাত্র এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য সূর্যের সামনে দিয়ে নেমে যান। ঠিক তখনই তাঁকে ক্যামেরাবন্দী করেন অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার অ্যান্ড্রু ম্যাককার্থি। জ্বলন্ত সূর্যের মুখের ওপর দিয়ে যেন এক মানব প্রতিকৃতি নিচে নেমে গেল, এমন দৃশ্য ধরা পড়ে ক্যামেরা লেন্সে। দৃষ্টিবিভ্রমের এক অসাধারণ কীর্তি তৈরি করেছেন অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার অ্যান্ড্রু ম্যাককার্থি।
অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার অ্যান্ড্রু ম্যাককার্থি নিখুঁতভাবে তাঁর ক্যামেরা দিয়ে একজন স্কাইডাইভারকে ক্যামেরার সংকীর্ণ ফিল্ড অব ভিউয়ের মধ্য দিয়ে নেমে যাওয়ার সময় ধারণ করেন। ছবিটি বেশ পরাবাস্তব এক অনুভূতি তৈরি করেছে। ইকারাসকে নিয়ে প্রাচীন মিথের সঙ্গে ছবিটি তুলনা করেছেন অনেকেই।
অ্যান্ড্রু ম্যাককার্থি চাঁদ ও সূর্যের অত্যন্ত সূক্ষ্ম ছবি তোলার জন্য পরিচিত। তিনি সূর্যের সামনে স্কাইডাইভারের এই একটি মাত্র ছবির জন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। সূর্যের ছবি তোলা এমনিতেই কঠিন কাজ। সেখানে সূর্যের সামনে গতিশীল একটি বিমান বা একজন পতিত মানবকে একই ফ্রেমে আনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন চ্যালেঞ্জ। বিমানটির গতিপথ, সূর্যের কোণ, ক্যামেরার অবস্থান ও স্কাইডাইভারের অবতরণের মতো সব বিষয়কে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে এক করে কাজটি হয়েছে।
অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার অ্যান্ড্রু ম্যাককার্থি বলেন, ‘বলা যায়, একেবারে অযৌক্তিক একটি কাজ করেছি। যদিও চূড়ান্ত ছবিটি দারুণ এক অনুভূতি দেয়। স্কাইডাইভার ছিলেন ইউটিউবার ও সংগীতজ্ঞ গ্যাব্রিয়েল সি ব্রাউন। সে সূর্যের উত্তাল হলুদ পৃষ্ঠের বিপরীতে একটি কালো সিলুয়েট বা ছায়ামূর্তি হিসেবে ছবিতে চলে এসেছে। সূর্যের অবস্থান ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল দূরে হলেও ক্যামেরায় দারুণভাবে দেখা যাচ্ছে সব। ইকারাসের সঙ্গে তুলনা করা ছবি অসম্ভব বলে মনে হয়। আগুনের মতো সৌর ক্রোমোস্ফিয়ারের আবহের বিপরীতে একটি সত্যিকারের মানব চিহ্ন আমাদের মুগ্ধ করে। দেখে মনে হবে যেন, মহাকাশে কেউ নিচে পড়ে যাচ্ছে।’
স্কাইডাইভাররা ব্রাউনের ৩ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতা থেকে পতন শুরু করলে প্রায় ১০ সেকেন্ড সময় ব্যয় করে প্যারাসুট খোলার আগে ছবি তোলার সুযোগ মেলে। ম্যাককার্থি একটি লুন্ট ৬০ মিলিমিটার এইচ–আলফা ক্যামেরায় তার ফ্রি ফলের ছবি তোলেন। একটি এএসআই ১ হাজার ৬০০ মিলিমিটারে একক এক্সপোজার ধারণ করা হয়। আসলে এই বিভ্রমের মূল কারণ হচ্ছে দূরত্বের সামঞ্জস্য। ব্রাউন একটি ছোট বিমান থেকে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ ফুট ওপর থেকে লাফ দেন। আর ম্যাককার্থি প্রায় আট হাজার ফুট দূরে অবস্থান করেছিলেন। স্কাইডাইভার অবশ্যই সূর্যের কাছে ছিলেন না। শুধু ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ থেকে নিখুঁত অবস্থানের কারণে স্কাইডাইভারকে অসম্ভব কাছাকাছি দেখাচ্ছিল। আসলে লাফ দেওয়ার আগে বিমানটিকে সঠিক অবস্থানে আনার জন্য ছয়বার চেষ্টা করতে হয়েছে। স্কাইডাইভারকে ফ্রেমে ধরার জন্য মাত্র একবারের সুযোগ ছিল। ম্যাককার্থি তাঁর মনিটরে সেই ক্ষুদ্র অবয়বটিকে সূর্যের আলোর সঙ্গে মিলিয়ে একটি নিখুঁত অবয়ব ধারণ করেন।
এই ছবিকে অনেকেই পৌরাণিক রূপকথার সঙ্গে তুলনা করছেন। গ্রিক মিথের ইকারাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ম্যাককার্থির এ ছবিটি সেই আখ্যানকেই একটি আধুনিক ও স্পষ্ট রূপে যেন তুলে ধরছে।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া