Risingbd:
2025-12-14@09:12:12 GMT

চুম্বকে বাঁধা শেফালীর জীবন

Published: 4th, February 2025 GMT

চুম্বকে বাঁধা শেফালীর জীবন

একটা চুম্বকের সঙ্গে রশি বাঁধা। যাতায়াতের রাস্তায় চুম্বকটি ফেলে হাতের রশি টেনে হেঁটে চলেন শেফালী বেগম। চুম্বকের আকষর্ণে সড়কে পড়ে থাকা লোহার টুকরো, পুরাতন ব্লেডসহ বিভিন্ন ধরনের লৌহজাত বস্তু আটকে যায় সেই চুম্বকে। পরে ওইসব বস্তু চুম্বক থেকে আলাদা করে বিক্রি করেন ৭০ বছর বয়সী এই নারী। তা থেকে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে শেফালীর একাকী জীবন। এটি শেফালীর বেঁচে থাকার পেশা।

সাদা-কালো চুলের শ্যামলা বর্ণের এই নারীকে অপরিচিতরা পাগল ভাবেন। তবে পরিচিতরা জানেন তিনি পাগল নন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বৃদ্ধ বয়সে তার পাশে নেই কেউ। পরিত্যক্ত চাটমোহর দাতব্য চিকিৎসালয়ের উত্তরপাশে বড়াল নদীপাড়ে ছোট একটি ঝুপড়ি ঘরে শেফালী থাকেন। স্বামী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন কেউ না থাকায় মানবেতর জীবন কাটছে তার।

কয়েকদিন আগে চাটমোহর পৌর সদরে কথা হয় শেফালী বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, তার পৈত্রিক নিবাস চাটমোহর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের লাউতিয়া গ্রামে। বাবা মৃত আব্দুর রহমান প্রামাণিক। শেফালীরা ছিলেন চার ভাই, দুই বোন। বড় পরিবার পরিচালনা করতে হিমশিম খেতেন শেফালীর মৎসজীবী বাবা আব্দুর রহমান। শেফালী যখন ছোট তখন তার বাবা মারা যান। তাই অভাবের সংসারে পড়ালেখার সুযোগ হয়নি তার।

এক পর্যায়ে কাজের সন্ধানে শেফালী চলে যান পার্শ্ববর্তী ঈশ্বরদী উপজেলায়। ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনের পাশে থাকতেন তিনি। যৌবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন সেখানে। জিআরপি থানার তৎকালীন পুলিশ সদস্যরা তার অসহায়ের কথা ভেবে আলম হোসেন নামে রংপুরের এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেন শেফালীকে।

অন্ধকার জীবনে নতুন সংসার হয় শেফালীর। স্বামীর সঙ্গে ভাড়া বাড়িতে সুখে-দুঃখে ভালোই দিন কাটছিল তাদের। প্রায় ১৫ বছর সংসার করার পর একদিন শেফালীকে ছেড়ে পালিয়ে যান আলম। অনেক খুঁজেও স্বামীকে ফিরে পাননি তিনি। পরে শুনেছেন, অন্য কাউকে বিয়ে করে তার সঙ্গে সংসার করছেন আলম।

নদীপাড়ের ভাঙাচোরা ঝুপড়ি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে শেফালী বেগম 

কী করবেন, কিভাবে চলবেন ভেবে না পেয়ে অভিমানে ঈশ্বরদী ছেড়ে জন্মভূমি চাটমোহরে ফিরে আসেন শেফালী। পৌর সদরে সুলতান হোসেন নামের এক ব্যক্তির সহায়তায় তার জায়াগায় একটি ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করতে থাকেন। সেখান থেকে নিমতলা এলাকায় বড়াল নদীর পাড়ে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স-এর পাশে সরকারি জায়গায় মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় শেফালীর। কয়েক বছর পর সেখান থেকেও সরে যেতে হয় তাকে। সর্বশেষ গত ১০ বছর ধরে বসবাস করছেন পরিত্যক্ত চাটমোহর দাতব্য চিকিৎসালয়ের উত্তর পাশে বড়াল নদীপাড়ে ছোট ভাঙা একটি ঝুপড়ি ঘরে।

শেফালী বেগম বলেন, “খেয়ে পরে জীবন চালানোর জন্য কিছু না কিছু তো করতে হবে। ভিক্ষা করে পেট চলে না। তাই বেঁচে থাকার জন্য পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি চুম্বকের সাহায্যে লোহা সংগ্রহের কাজ।”

তিনি বলেন, “ভোর হলে বেরিয়ে পড়ি যেদিকে মন চায় সেদিকে। মাঝারি আকৃতির একটা চুম্বকের সঙ্গে রশি বাঁধা থাকে। চুম্বকটি রাস্তায় ফেলে রশির অপর প্রান্ত ধরে চুম্বকটিকে টেনে হেঁটে চলি। চলার সময় চুম্বকের সঙ্গে আটকে যায় লোহার টুকরো, পুরাতন ব্লেড ও অন্য লোহার বস্তু। বিক্রি হয় না বলে ধারালো ব্লেডগুলো চুম্বক থেকে টেনে খুলে দেই। লোহার টুকরোগুলো বিক্রি করে যে টাকা পাই, তাতেই চলে আমার জীবিকা।”

তিনি আরো বলেন, “শুধু লোহা নয়, প্লাস্টিকও সংগ্রহ করতে হয়। প্রায় সারাদিন চলে লোহা ও প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহের কাজ। লোহা-প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়েই জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে। সংগ্রহ করা লোহা ও প্লাস্টিকের বোতল চাটমোহর দাতব্য চিকিৎসালয়ের বারান্দায় জমাই। কিছুদিন পরপর বিক্রি করি। যে টাকা পাই তা দিয়েই খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়।”

কুড়িয়ে আনা লোহার বিভিন্ন বস্তুর সঙ্গে শেফালী বেগম

শেফালী বলেন, “বাড়িঘর, ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন কাজ করা কঠিন হয়ে গেছে। অসুখ লেগেই থাকে। পেটের ভাত-কাপড়ের পাশাপাশি লাগে ওষুধ। তাই জীবন চালাতে কাজ করতে হচ্ছে। ভাঙা ঘরে শেয়াল কুকুর ঢোকে। রান্না করা ভাত কুকুরে খেয়ে যায়। বৃষ্টির সময় পানি পরে ঘরের চাল দিয়ে। একটা ঘর থাকলে সেখানে নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম। সরকারিভাবে একটা ঘরের ব্যবস্থা হলে শান্তিতে মরতে পারতাম।”

চাটমোহর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সোহেল রানা বলেন, “শেফালীর ব্যাপারটি আমি জানলাম। তিনি যদি চাটমোহরের নাগরিক হয়ে থাকেন সমাজসেবা অফিস থেকে বয়ষ্ক ভাতার ব্যবস্থা করে দেব। অসুস্থ হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রোগী কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থা করব।”

চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুসা নাসের চৌধুরী বলেন, “তার (শেফালী বেগম) বিষয়ে কেউ কিছু জানায়নি। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে। সরকারি প্রকল্পের ঘর খালি থাকা সাপেক্ষে তাকে একটি ঘর বরাদ্দ দেওয়া যায় কি না সেটি দেখা হবে।”

ঢাকা/মাসুদ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র ব যবস থ উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

ময়মনসিংহে হেলে পড়েছে পাঁচতলা ভবন, আতঙ্কে মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন বাসিন্দারা

ময়মনসিংহ নগরে নির্মাণাধীন ভবনের পাশে পাঁচতলা একটি ভবন হেলে পড়েছে। ওই অবস্থায় গতকাল শনিবার রাতের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবনের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে দেন। এতে আশপাশের এলাকায়ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আজ রোববার সকালে বাসিন্দারা ভবনের ভেতর থেকে তাঁদের মালামাল সরিয়ে নিয়েছেন।

হেলে পড়া ভবনটি ময়মনসিংহ নগরের গুলকিবাড়ি বাইলেন এলাকায় অবস্থিত। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ভবনের প্রবেশমুখে কিছু জায়গায় ফাটল দেখা গেছে। ভবনটি হেলে পেছনের ১৬ তলা একটি বহুতল ভবনের দিকে চলে গেছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাঁচতলাবিশিষ্ট ‘শাকিল ম্যানসন’ নামের বাড়িটির মালিক লন্ডনপ্রবাসী এ এস এম রিয়াজুল আমিন। তবে বাড়ির দেখভাল করেন রিয়াজুলের বড় ভাই রফিকুল ইসলাম। পাঁচ শতক জমিতে ২০১১ সালে বাড়ির নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রথমে চারতলা সম্পন্ন হলেও সম্প্রতি পঞ্চম তলার কাজ শুরু হয়, যা সম্পূর্ণ শেষ হয়নি। বাসার ১০টি ইউনিটের মধ্যে আটটি ইউনিটে ভাড়াটেরা বসবাস করতেন।

পাশে গ্রিনল্যান্ড ডেভেলপার প্রাইভেট লিমিটেডের ১৩ তলা ‘কাজীবাড়ি’ ভবনের নির্মাণকাজ চলছিল। প্রায় ছয় মাস ধরে পাইলিং শেষে খননযন্ত্র দিয়ে গভীর গর্ত করে মাটি সরানো হচ্ছিল। গতকাল ভবনের সামনে ও পাশের অংশে ফাটল দেখা দিলে আতঙ্ক শুরু হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে যান।

ময়মনসিংহ ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার জুলহাস উদ্দিন বলেন, পাইলিং শেষে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য খননযন্ত্র দিয়ে গভীর গর্ত থেকে মাটি সরানো হচ্ছিল। এতে পাশের পাঁচতলা ভবনটির বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরেছে। যেকোনো সময় বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। ভবনটিতে অনেক বাসিন্দা থাকায় তাঁদের নিরাপদে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নির্মাণাধীন ভবনটির কাজও বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। বাসার মালিককে বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীর সহযোগিতা নিতে। সিটি করপোরেশন যদি বলে, ভবন ব্যবহার করা যাবে এবং কোনো ঝুঁকি নেই, তবেই লোকজন ফিরে যেতে পারবেন। বাসার ভেতরে থাকা ভারী মালামাল সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিল্ডিং কোড মেনে যদি ভবন করা হতো, তাহলে এমন পরিস্থিতি হতো না।

আজ বেলা সাড়ে ১১টায় বাসিন্দারা ভবনের ভেতর থেকে মালামাল সরিয়ে নিচ্ছিলেন। আনন্দ মোহন কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শাহ মো. জুয়েল বলেন, ‘হঠাৎ গতকাল সন্ধ্যায় ফাটল দেখা দেওয়ায় জরুরি কাগজপত্র নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। রাতভর উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলাম। আজ বাসা থেকে মালামাল নিয়ে শ্বশুরবাড়ি রেখেছি, পরে নতুন বাসায় উঠব। হঠাৎ এই ভোগান্তি হলেও বড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছি, এটা স্বস্তির।’

হেলে পড়া ভবনের দেখভালকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গতকাল মাগরিবের নামাজের পর ফাটল বেশি লক্ষ করি। দুই দিন ধরে হালকা ফাটল দেখা যাচ্ছিল। খননযন্ত্র দিয়ে মাটি কাটায় এমন হয়েছে। বেশি ফাটল দেখে ডেভেলপার কোম্পানির লোকজন, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশকে জানাই। আমি বিল্ডিং কোড অনুযায়ী তিন ফুট জায়গা ছেড়ে ভবন করেছি, কিন্তু নির্মাণাধীন ভবনটি কোনো জায়গা ছাড়ছিল না। আমার সীমানাপ্রাচীরও পাইলিং করার সময় ভেঙে ফেলেছে। সরকারের কাছে আবেদন, বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিন। এত সরু এলাকায় কীভাবে বহুতল ভবনের অনুমোদন দেওয়া হলো, তা ভাবতে হয়। আমার ভবনের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’

আজ বেলা সাড়ে ১১টায় গ্রিনল্যান্ড ডেভেলপার প্রাইভেট লিমিটেডের নির্মাণাধীন ভবনে দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি। ফোন করা হলেও উত্তর মেলেনি। নির্মাণ তদারকির দায়িত্বে থাকা রেজাউল করিম বলেন, ‘নির্মাণকাজ চলাকালে গতকাল সন্ধ্যায় পাশের ভবন হেলে পড়ায় আমাদের কাজ বন্ধ করা হয়েছে।’

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের নগর–পরিকল্পনাবিদ মানস বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার খবর পেয়ে আমাদের লোক পাঠানো হয়েছিল। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী চারপাশে জায়গা ছাড়ার কথা। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে, বিল্ডিং কোড না মেনে কাজ করায় এমন হয়েছে। কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। যাচাই–বাছাই শেষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুমনা আল মজীদ বলেন, আজ দুপুরের পর হেলে পড়া ভবন পরিদর্শন করা হবে। সবকিছু যাচাই করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ