ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় ছবি তুলে দেওয়ার কথা বলে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর নাম মো. সজীব খান (২৪)। শনিবার বরিশাল বিমানবন্দর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

রোববার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। গ্রেপ্তারের সময় সজীব খানের কাছ থেকে চুরি হওয়া মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে অবস্থান করছিলেন মো.

শামীম নামের এক ব্যক্তি। তখন সজীব এসে তাঁর মোটরসাইকেলের সঙ্গে ছবি তুলতে চান এবং চাবি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। চাবি দেওয়ার পর সজীব তাঁকে ছবি তুলে ও ভিডিও করে দিতে বলেন।

পুলিশ জানায়, শামীম ছবি তোলার এবং ভিডিও করার সময় সজীব কৌশলে মোটরসাইকেলটি নিয়ে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় শামীমের অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় সজীবের অবস্থান শনাক্ত করে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

গ্রেপ্তার সজীবকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে পুলিশ জানিয়েছে, তিনি একজন পেশাদার চোর। আগেও একাধিকবার চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

মোড় ঘোরানো দুই দিনের সম্মেলন শিলিগুড়িতে 

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে এই সরকার গঠন করা হয়।

দায়িত্ব গ্রহণের পর মুজিবনগর সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল পূর্ববঙ্গের জনগণের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মূল কেন্দ্র হিসেবে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করা এবং নানা মত–পথের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এর নেতৃত্বকে প্রমাণ করা। শেখ মুজিবুর রহমানই তখন অবিসংবাদিত নেতা। অথচ তিনি পাকিস্তানে বন্দী। তাঁর অনুপস্থিতি ঐক্যের সংকটকে প্রকট করে তুলছিল। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে জ্যেষ্ঠ ও তরুণ নেতাদের অনেকে নানা প্রশ্ন তুলছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঘিরে দেখা দিয়েছিল ভিন্নমত, ভুল–বোঝাবুঝি, আস্থাহীনতা।

এই সংকটময় পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ৫ ও ৬ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত শহর শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত হয় এক গোপন রাজনৈতিক সম্মেলন। শিলিগুড়ি সম্মেলন তার নাম।

আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের অনেকেই সে সময় ছড়িয়ে ছিলেন বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চলে। অন্যদিকে নবগঠিত প্রবাসী সরকার পরিচালনা করছিল মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক কৌশল। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকারের ছিল না। আবার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ না থাকায় আওয়ামী লীগের বহু নেতার মনে ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। নেতৃত্বের এই বহুমুখী অবস্থানকে একটি পূর্ণাঙ্গ ঐক্যের ছায়াতলে আনাই ছিল শিলিগুড়ি সম্মেলনের লক্ষ্য।

যেভাবে আয়োজন

আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পরামর্শ এসেছিল ভারত সরকারের পক্ষ থেকে। সম্মেলন আয়োজনের মূল দায়িত্ব পায় শিলিগুড়িতে অবস্থিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩৩ কোর সদর দপ্তর। এ ছাড়া আবাসন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ছিল বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা বিএসএফ। সম্মেলনে অংশ নেন প্রায় ৪০০ জন। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন ১৯৭০ সালে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। ৪ জুলাই, অর্থাৎ সম্মেলনের আগের দিন বিমান, রেল ও সড়কপথে মেঘালয়, ত্রিপুরা, উত্তর বাংলা বা কলকাতা থেকে একে একে এসে তাঁরা জড়ো হন। অনেকের মনে ক্ষোভ ছিল, দ্বিধা ছিল, জিজ্ঞাসা ছিল। তবে প্রত্যেকেই জানতেন, এই সভায় যদি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা হয়ে পড়বে ঝুঁকিপূর্ণ।

কঠোর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দুই দিনের সম্মেলন। পুরো সম্মেলনস্থলে ছড়িয়ে ছিল চাপা উত্তেজনা। একদিকে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিদের আবেগ—দেশকে পরিচালনা করার ম্যান্ডেট তাঁরা ব্যালটের মাধ্যমে পেয়েছেন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা—প্রবাসী সরকার দিনরাত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছে, কৌশল ঠিক করছে, আন্তর্জাতিক সমর্থন আনার চেষ্টায় আছে। এই দুই পক্ষকে মিলিয়ে দেওয়া সহজ ছিল না।

অভিযোগ, অনাস্থা ও ঐক্য

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ১৯৭১, শিলিগুড়ি সম্মেলন বইয়ে সম্মেলনের সময়সূচি থেকে জানা যায়, ৫ জুলাই ছিল গোপন সভা ও উন্মুক্ত সম্মেলন। ৬ জুলাই কার্যনির্বাহী কমিটির সভা ও উন্মুক্ত সম্মেলন। 

এই বইয়ে শিলিগুড়ি সম্মেলন সম্পর্কিত দলিলে তাজউদ্দীন–বিরোধীদের অভিযোগ, অনাস্থা ও প্রশ্নসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। উপদলীয় নেতাদের মধ্যে মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ আ. আজিজসহ কয়েকজন বলেন, মুজিবনগর সরকার দুর্বল, ব্যর্থ। এই সরকার কোনো রাষ্ট্রের কাছ থেকেই স্বীকৃতি পাবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা বা অস্ত্র সরবরাহের জন্য তারা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। মিজানুর রহমান চৌধুরী তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘এটা সুস্পষ্ট যে মুক্তিফৌজকে বাজেভাবে অবহেলা করা হয়েছে। শুধু প্রশান্তিদায়ক আশ্বাসে আমাদের গা ভাসালে চলবে না।’

এই বক্তব্যের বিপরীতে কর্নেল ওসমানীর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তিনি জানিয়ে দেন, তাঁর ওপর যদি কার্যনির্বাহী কমিটির ও অন্যদের আস্থা না থাকে, তাহলে তাঁকে পদত্যাগের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। সঙ্গে এ-ও বলেন, অভিযোগের আঙুল না তুলে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেই মিজানুর রহমান তাঁর সংশয় দূর করতে পারতেন। কী কী সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন, কর্নেল ওসমানী তুলে ধরেন তা-ও।

ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদও সম্মেলনের বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। তাঁদের কথায় ঘুরেফিরে একটি প্রসঙ্গই গুরুত্ব পেয়েছিল বেশি, ঐক্য। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আহ্বান জানান, কেউ যেন বিদ্বেষমূলক প্রচারণায় প্রভাবিত না হন। কেননা এ ধরনের প্রচারণা নিজেদের মধ্যে এবং বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য বন্ধুত্বপূর্ণ সরকারের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝির সৃষ্টি করবে। 

তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘কয়েকজন সদস্য একে অপরকে দোষারোপ করে আমার কাছে আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন। এ মুহূর্তে আমি সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে যথাসময়ে যথাযথভাবে তদন্ত করা হবে, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং অসুবিধাগুলা দূর করা হবে।’ তাজউদ্দীনও আপাতত মতানৈক্য ভুলে কেবল বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করার ওপর জোর দেন।    

স্বপ্ন একটাই

শুরু থেকে শঙ্কা ছিল, তাজউদ্দীন আহমদ হয়তো প্রবল বিরোধিতার মুখোমুখি হবেন। কিন্তু নানা মতভেদ কিংবা উষ্ণ তর্কবিতর্ক হলেও শেষ পর্যন্ত সফলভাবে শেষ হয় শিলিগুড়ি সম্মেলন। কারণ, প্রত্যেকে উপলব্ধি করতে পারছিলেন, স্বাধীনতার স্বপ্নের সামনে ব্যক্তিগত অবস্থান খুবই নগণ্য।

সভা শেষে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়—প্রবাসী সরকারই হবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সর্বোচ্চ নেতৃত্ব এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের সঙ্গে কৌশলগত সমন্বয়ে কাজ করবেন। 

এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের এক বড় বাঁকবদল ছিল। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঐক্য স্পষ্ট হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার শক্তি আরও বেড়ে যায়। প্রবাসী সরকারের ওপর নির্বাচনে বিজয়ী প্রতিনিধিদের আস্থা সুসংহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও বার্তা ছড়িয়ে পড়ে—নেতৃত্বে আর কোনো দ্বন্দ্ব নেই, স্বপ্ন আর লক্ষ্য একটাই।

শিলিগুড়ি সম্মেলন তাই কেবলই একটি রাজনৈতিক বৈঠক নয়। এর মধ্য দিয়ে আলোচনার টেবিলেই নির্ধারিত হয়েছিল আগামীর মুক্ত বাংলাদেশের পথরেখা। 

অথচ অজানা

১৯৭১ সালের ৩০ জুলাই প্রকাশিত সাপ্তাহিক জয়বাংলায় বলা হয়েছিল, এই বৈঠকের রাজনৈতিক তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। ভাবীকালের ঐতিহাসিকেরা যেদিন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস লিখবেন, সেদিন এই বৈঠকের গুরুত্ব তার যথার্থ পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

শিলিগুড়ি সম্মেলন মুক্তিযুদ্ধের একটি সম্পূর্ণ অনালোচিত অধ্যায়। সম্মেলনের বিস্তারিত ইতিহাস ও দাপ্তরিক কার্যক্রমের নথিপত্র কোথাও সংরক্ষণ করা হয়নি। সম্মেলনে যোগ দেওয়া ৪০০ প্রতিনিধির মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন এ বিষয়ে লিখেছেন। তবে তাঁদের লেখায় সীমিত তথ্য থেকে এ সম্মেলনের বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়।

আজ আমরা শিলিগুড়ি সম্মেলন সম্পর্কে যতখানি জানি, ততটাও হয়তো জানা হতো না।

শিলিগুড়ি সম্মেলনের প্রশাসনিক তদারকির দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩৩ কোরে কর্মরত বাংলাভাষী ব্রিগেডিয়ার অজিতকুমার মিত্র। তাঁর সন্তান দেবাশীষ মিত্রর মাধ্যমে কিছু দলিল প্রথম আলোর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রথমার হাতে আসে ২০২২ সালে। সেই দলিলের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হয় নাইন্টিন সেভেন্টি ওয়ান: দ্য শিলিগুড়ি কনফারেন্স। পরে এই বইয়ের বাংলা সংস্করণও প্রকাশিত হয়। নাম: ১৯৭১, শিলিগুড়ি সম্মেলন। এই বইয়ে রয়েছে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সভার বিবরণ, মুক্তিযুদ্ধের এক অজানা কাহিনি। সম্মেলনের সময় অনুষ্ঠিত আনুষ্ঠানিক বৈঠকের কার্যপ্রণালি এবং অনানুষ্ঠানিক আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এ বইয়ে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী গবেষক ও পাঠকদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

যদিও এই দলিল অসম্পূর্ণ। পুরো দলিল–নথি পাওয়া গেলে মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘোরানো  শিলিগুড়ি সম্মেলন সম্পর্কে আরও জানার সুযোগ তৈরি হবে। 

তথ্যসূত্র: ১৯৭১, শিলিগুড়ি সম্মেলন, প্রথমা প্রকাশন, ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ