বছরের পর বছর বিশ্ব ঘটনাপ্রবাহ ও সিদ্ধান্ত পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ইতিহাসে একই ধারা বারবার ফিরে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্র হলো কর্মপ্রবণতার প্রতীক। তারা চট করে সাহসী পদক্ষেপ নেয় এবং তা নেয় অনেক সময় না ভেবেই। ভালো হোক বা খারাপ হোক—না ভেবেই তারা কাজ করে বসে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র হলো এমন এক দেশ, যারা আগে কাজ করে, পরে চিন্তা করে। ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক শুল্কযুদ্ধ পর্যন্ত হিসাব করলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে চাল দেয়, তারপর হিসাব মেলায়।

এর বিপরীতে ভারত আইডিয়ায় সমৃদ্ধ, কিন্তু সিদ্ধান্তের আগে অতিরিক্ত বিশ্লেষণ ও বিতর্কে আটকে যায়। ফলে পদক্ষেপ নিতে তাদের দেরি হয়ে যায়। অনেক সময় আদৌ কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয় না। স্মার্ট সিটি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডর, স্টার্টআপ ইন্ডিয়া, মেক ইন ইন্ডিয়া—এসব প্রকল্প জাঁকজমকপূর্ণ ঘোষণার পর শিগগিরই আমলাতান্ত্রিক জটের নিচে চাপা পড়ে যায়।

অন্যদিকে চীন দশকের পরিকল্পনায় চলে। তারা ধীরে ধীরে কৌশলে গড়ে তোলে। আর একবার যখন তারা এগোয়, তখন তা পুরো পৃথিবীকে হতবাক করে দেয়। যেমন শেনজেনকে প্রযুক্তির কেন্দ্র বানানো বা ‘ডিপসিক’ নামের এক এআই অ্যাপ বানানো, যা ওয়াল স্ট্রিটকে নাড়িয়ে দেয় এবং এক রাতেই মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বাজারমূল্য থেকে এক ট্রিলিয়ন ডলার উধাও করে দেয়।

এই পার্থক্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক ধারাবাহিকতা, এক গভীর সত্য। কে কীভাবে বিশ্বকে দেখে এবং তাদের অবস্থান নেয়, তা এই পার্থক্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়।

আরও পড়ুনইউনূস-মোদি বৈঠকের ফলাফল কী০৯ এপ্রিল ২০২৫

আমেরিকা সাহসী পদক্ষেপ নিতে পরিচিত। কিন্তু তারা কখনো জিজ্ঞেস করে না, ‘এর মূল্য কত পড়বে?’ ভারতের আছে অসাধারণ সম্ভাবনা ও মেধা, কিন্তু ভেতরের ধীরগতি সবকিছু আটকে দেয়। চীনের চিন্তা ও কাজের মধ্যে যে ভারসাম্য, সেটাই তাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখে।

বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্যে শক্তির মাপকাঠি কেবল সামরিক ক্ষমতা বা অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে নয়। এটি চাপের মুখেও নিজের অবস্থানে অটল থাকার সাহসের ওপর নির্ভর করে।

ভারত ২০০৮ সালে এই সাহসিকতার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিল। সে বছর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তির বিষয়ে তাঁর অবস্থান ধরে রেখেছিলেন। দুর্বল একটি জোট সরকার পরিচালনা করার পরও মনমোহন সিং আন্তর্জাতিক চাপে মাথা নত করেননি। বিশ্বজুড়ে ভারতের ওপর চাপ ছিল, যেন তারা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করে। কিন্তু সিং এ চুক্তিতে স্বাক্ষর না করেই ভারতের পরমাণু স্বায়ত্তশাসন অক্ষুণ্ন রেখে এনএসজি (নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপ) থেকে একটি ঐতিহাসিক ছাড় আদায় করেন।

প্রবল বিরোধিতার মধ্য দিয়ে মনমোহন এ চুক্তিকে ভারতীয় পার্লামেন্টে পাস করান। এর জন্য তাঁকে একবার অনাস্থা প্রস্তাব পর্যন্ত মোকাবিলা করতে হয়। সেই সময় তিনি একদিকে পার্লামেন্টের সমর্থন নিশ্চিত করেন, অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের পক্ষে একটি বড় কূটনৈতিক জয় অর্জন করেন। এতে এনপিটিতে স্বাক্ষর না করেও পারমাণবিক প্রযুক্তি গ্রহণের দরজা খুলে যায় ভারতের জন্য। এই চুক্তির মাধ্যমে ১৯৯৮ সালের পর ভারতের আন্তর্জাতিক পারমাণবিক বিচ্ছিন্নতা শেষ হয় এবং বিশ্ব মঞ্চে ভারতের কৌশলগত স্পষ্টতা, রাজনৈতিক সাহস এবং দৃঢ় কূটনীতির পরিচয় মেলে।

বর্তমানে রাশিয়া ও চীন দেখিয়েছে তাদের সাহসিকতা। যখন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তখন মস্কো পিছু হটে না। বরং তারা নিজেদের অর্থনীতিকে নতুনভাবে সাজায় এবং বৈদেশিক নীতিও সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে, যাতে পশ্চিমা চাপ মোকাবিলা করতে পারে। চীনও ট্রাম্প সরকারের আমলে আগ্রাসী শুল্কনীতির মুখোমুখি হয়ে কড়া জবাব দেয়; অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক উভয় দিক থেকেই পাল্টা ব্যবস্থা নেয়, যেন তারা বুঝিয়ে দিতে পারে যে ভয় দেখিয়ে তাদের কিছু করানো যাবে না।

অন্যদিকে ভারত একরকম নরম ও আত্মসমর্পণমূলক পথ বেছে নেয়। নিজের সার্বভৌম স্বার্থ জোরালোভাবে তুলে ধরার বদলে তারা যেন ওয়াশিংটনকে খুশি রাখতেই বেশি আগ্রহ দেখায়। ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে মোদি সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল দুর্বল ও অনিশ্চিত। ২০০৮ সালের মতো দৃঢ় কৌশলগত অবস্থান আজ আর দেখা যাচ্ছে না।

ভারত যেন পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে, বিশাল জনসংখ্যা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সাহসিকতা প্রশ্নে তারা দ্বিধায় ভোগে। ভারত কি বিশ্বশক্তি থেকে ক্রমেই ‘ক্লায়েন্ট স্টেট’-এ পরিণত হচ্ছে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে অভিষেক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানাননি, যদিও মোদি বারবার তাঁকে ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। পরে ফেব্রুয়ারিতে মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও সেটা ছিল খুব সাধারণ, ব্যবসাভিত্তিক একটি সফর। একটি কর্মসূচিতেই এটি সীমাবদ্ধ ছিল।

আরও পড়ুনমোদি, এ বিজয় ভারতের নয়, বাংলাদেশের১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

ট্রাম্প বহুবার ভারতকে ‘শুল্কের রাজা’ ও ‘বাণিজ্যিক প্রতারক’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর এই কঠোর অবস্থান বজায় ছিল। তাঁকে খুশি করতে মোদি সরকার তাঁর সফরের আগে কিছু অর্থনৈতিক ছাড় দেয়, যেমন হাই এন্ড মোটরসাইকেলের ওপর শুল্ক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয় (বিশেষ করে হার্লে-ডেভিডসনের জন্য) এবং সামগ্রিকভাবে গড় শুল্ক ১৩ শতাংশ থেকে নামিয়ে ১১ শতাংশ করা হয়। এমনকি ২০২৪ সালে ব্রিকস জোটের মাধ্যমে ডলারের বিকল্প ব্যবহারের যে উদ্যোগ ছিল, ভারত সেখান থেকেও সরে আসে। কারণ, ট্রাম্প এর জেরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।

তবু এসব ছাড় দেওয়ার পরও ট্রাম্প তাঁর মূল উদ্দেশ্যেই অটল ছিলেন। সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমানো। তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যঘাটতি ১০০ বিলিয়ন ডলার, যদিও এর প্রকৃত পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন। কিন্তু মোদি এই বাড়িয়ে বলা তথ্য যৌথ সংবাদ সম্মেলনে কোনোভাবে সংশোধন করেননি।

এর বদলে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ভারতের কাছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানসহ আরও বেশি পরিমাণে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করা হবে এবং তেল ও গ্যাস রপ্তানি বাড়ানো হবে।

ভারতের বিশ্বমঞ্চে মর্যাদা কমে যাওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো এর গণতান্ত্রিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া। গত এক দশকে মোদি সরকার ধীরে ধীরে একধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে চলে গেছে। ভারতের যে বৈশিষ্ট্যটি একসময় তাকে আলাদা করে তুলেছিল, সেটি হলো দেশটি একটি প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের দেশ ছিল, যেখানে ভুল হতো, আবার তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সংশোধনও করা যেত। তবে সেই বৈশিষ্ট্যটাই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু সফরের চিত্র খুব দ্রুত বদলে যায়। মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের মাত্র দুই দিন পর দুটি মার্কিন সামরিক বিমানে ২২৮ জন ভারতীয়কে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তাঁদের মধ্যে নারী, শিশু, নবজাতকও ছিল। এই ভারতীয়দের হাত-পা শিকলে বাঁধা অবস্থায় ছবি ছড়িয়ে পড়ে। এটি দেশজুড়ে ক্ষোভ তৈরি করে। এ ঘটনা দুটি অস্বস্তিকর বাস্তবতা সামনে নিয়ে আসে: ভারতের অর্থনীতি তার তরুণদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে চাকরি তৈরি করতে পারছে না (প্রতিবছর এক কোটির মতো নতুন কর্মসংস্থান প্রার্থী তৈরি হয়) এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের কথিত ‘মিত্রদের’ সঙ্গেও কোনো বিশেষ আচরণ করে না।

ট্রাম্পের ভারতনীতি বরাবরই ছিল লেনদেননির্ভর ও অবজ্ঞাসূচক। তিনি একদিকে ভারতকে শুল্ক দিয়ে চাপে ফেলেছেন, আবার অভিবাসন ও বাণিজ্য নিয়েও চাপ সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু বিনিময়ে খুব একটা কিছু দেননি। যুক্তরাষ্ট্র এখন আর ভারতকে সমান কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখছে না। বরং এমন একটি অনুগত দেশের মতো দেখছে, যার কাজ শুধু নির্দেশ মানা।

একসময় ভারতকে মনে করা হতো একটি উদীয়মান বিশ্বশক্তি হিসেবে—গণতন্ত্র, সম্পদ ও চীনকে টেক্কা দেওয়ার সক্ষমতা যার আছে। কিন্তু মোদির ১০ বছরের নেতৃত্বে ভারতের এই ভাবমূর্তি অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে। ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক অবস্থান দেখে এখন মনে হতে পারে, এটি ক্রমেই সেসব দেশের কাতারে যাচ্ছে, যারা সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাস্তব বিশ্বপ্রভাব অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, যেমন ইউক্রেন কিংবা পাকিস্তান।

ভারত কি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে

ভারতের বিশ্বমঞ্চে মর্যাদা কমে যাওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো এর গণতান্ত্রিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া। গত এক দশকে মোদি সরকার ধীরে ধীরে একধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে চলে গেছে। ভারতের যে বৈশিষ্ট্যটি একসময় তাকে আলাদা করে তুলেছিল, সেটি হলো দেশটি একটি প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের দেশ ছিল, যেখানে ভুল হতো, আবার তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সংশোধনও করা যেত। তবে সেই বৈশিষ্ট্যটাই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়তো কখনোই চীনের মতো দ্রুতগতির হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু ভারতের গণতন্ত্র তাকে টেকসই এবং ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার পথ দিয়েছিল। গণতন্ত্রের মূল শক্তি ছিল ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে উন্নত করার ক্ষমতা। কিন্তু গত এক দশকে এই ভিত্তিই দুর্বল হয়ে গেছে। সরকারের জবাবদিহির অভাব এবং ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক বিকাশ আটকে দিয়েছে।

আজকের দিনে সাধারণ মানুষ মনে করছে, সরকার আসল সমস্যাগুলো (যেমন বেকারত্ব, দুর্নীতি ও দারিদ্র্য) সমাধানে ব্যর্থ। অনেকেই বলেন, যখন চীন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, ভারত তখন প্রাচীন মসজিদের তলে মন্দির খুঁজে বেড়ানোতে ব্যস্ত।

পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও ভারতের অবস্থান এখন আর আগের মতো ভারসাম্যপূর্ণ ও বিচক্ষণ বলে মনে হচ্ছে না। একসময় বিশ্বমঞ্চে ভারতের অবস্থান ছিল যুক্তিসংগত ও পরিমিত। কিন্তু এখন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক আলোচনায় ভারতের প্রভাব পড়ছে না। যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়া থেকে তেল আমদানি অব্যাহত রাখে, যা আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার জন্ম দেয়।

অল্প সময়ের জন্য এ সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাজনক হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর ফল ভালো নয়। ভারতের যে দুটি বৈশিষ্ট্য ছিল (গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জোট-নিরপেক্ষতা), সেগুলোকেই এখন প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।

অনেকে মনে করছেন, ভারত এখন নীতিকে বিসর্জন দিয়ে স্বল্পমেয়াদি লাভ খুঁজছে। ফলে দেশের বিদেশনীতি দুর্বল ও অবিশ্বস্ত হয়ে পড়ছে। রাশিয়ান জ্বালানির ওপর ভারতের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এবং বিকল্প উৎস না থাকা তাকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্প্রতি হুমকি দিয়েছেন, রাশিয়া থেকে তেল কিনলে ভারতকেও ‘সেকেন্ডারি ট্যারিফ’ বা পরোক্ষ শুল্কের মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে। এটি ভারতের জন্য বড় চাপের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ, রাশিয়া বর্তমানে ভারতের অন্যতম প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী।

এই চ্যালেঞ্জ এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মোদির নেতৃত্বে বলিষ্ঠ কথা বলার প্রবণতা থাকলেও বাস্তবে ফল খুব কম দেখা যাচ্ছে। ফলে ভারত এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে তার ভবিষ্যৎ বিপদের মুখে। যদি ভারত এখনই নিজের অবস্থান পরিষ্কার না করে, একটি স্বাধীন, আত্মবিশ্বাসী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে না পারে, তাহলে খুব শিগগির এটি ইউক্রেনের মতো এমন সব দেশের মতো হয়ে উঠতে পারে, যাদের ভাগ্য অন্যরা নির্ধারণ করে।

এখনই পরিবর্তনের সময়। এই পথচলা যদি এখানেই না থামে, তাহলে একসময় এটি এমন এক দিকে নিয়ে যেতে পারে, যেখান থেকে ভারতের ফেরার আর সুযোগ থাকবে না।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

রবি কান্ত এশিয়া টাইমসের নয়াদিল্লিভিত্তিক একজন কলাম লেখক ও সংবাদদাতা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র অবস থ ন গণতন ত র পদক ষ প এমন এক র জন য দ র বল ভ রতক ক ষমত সরক র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এটি শুধু প্রচলিত কারচুপির পদ্ধতিগুলোকেই আরও সফিসটিকেটেড বা কৌশলী করে তুলবে না; বরং আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে জনগণের বিশ্বাস, সেটিই নষ্ট করে দিতে পারে।

নির্বাচনে এআইয়ের প্রভাব কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি একটি বাস্তব ঝুঁকি। এআই-চালিত টুলগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘ডিপফেক’ (ভুয়া অডিও, ভিডিও এবং ছবি) তৈরি করা সম্ভব।

এই ডিপফেকগুলো সহজেই মিথ্যা কেলেঙ্কারি ছড়াতে পারে, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত বটগুলো সেকেন্ডের মধ্যে এমন সব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যাপক জনসমর্থনে বা বিরোধিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।

যখন জনগণ দেখতে পাবে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা বোঝা কঠিন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে যাবে। এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।

এআই অ্যালগরিদমগুলো বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ভোটারদের লক্ষ করে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দুর্বলতা অনুযায়ী রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে। এই ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটদানের সময় বা স্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখাও সম্ভব।

আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে

এআই শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি নির্বাচনী পরিকাঠামোর ওপর সাইবার হামলাও জোরদার করতে পারে। এআই-চালিত টুলগুলো আরও সফিসটিকেটেড ফিশিং আক্রমণ তৈরি করে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে বা এমন ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এ ধরনের আক্রমণ ভোটার ডেটাবেজ বা ভোটিং মেশিনকে লক্ষ্য করে করা যেতে পারে। সেটি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন বা পুরো প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপত্তির সমাধান কী? এ প্রশ্নের জবাব হিসেবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এই গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই (এক্সএআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই মডেলের সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলে এক্সএআই। এটি এআইয়ের স্বচ্ছতা বাড়ায়।

ডিপফেক শনাক্তকরণ: এক্সএআই ব্যবহার করে এমন টুল তৈরি করা সম্ভব, যা কেবল ডিপফেক শনাক্ত করে না; বরং কেন একটি বিষয়বস্তু জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়। এর ফলে মানব ফ্যাক্ট-চেকাররা বিশ্লেষণ যাচাই করতে পারেন এবং জনগণের আস্থা তৈরি হয়।

প্রচারণার নিরীক্ষা: এক্সএআই রাজনৈতিক প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নিরীক্ষা করতে পারে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে, কীভাবে একটি অ্যালগরিদম তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট বা কারসাজিমূলক টার্গেটিং কৌশলগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করে।       

নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক্সএআই হুমকির শনাক্তকরণ সিস্টেমকে উন্নত করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটি নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।

অংশগ্রহণকারীদের করণীয়: এআইয়ের হুমকি মোকাবিলায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তাঁরা প্রতারণামূলক এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচারে জড়িত হবেন না। তাঁদের উচিত এআইয়ের যেকোনো বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা এবং এআই জেনারেটেড কনটেন্টে সুস্পষ্ট লেবেল ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রচারে এআই ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাদের উচিত এআই-চালিত টুলগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং ভোটারদের সচেতন করার জন্য বড় আকারের প্রচার চালানো।

এ ছাড়া একটি যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন দল গঠন করা প্রয়োজন, যারা নির্বাচনের আগপর্যন্ত কমিশনকে এআই এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে এআইয়ের হুমকি সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রটোকল স্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের উচিত ফ্যাক্ট-চেকিং এবং জনগণের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।

আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এআইয়ের ক্ষমতা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপব্যবহারের বিপদও কম নয়।

জনগণের বিশ্বাস এবং একটি ন্যায্য নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই আমাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দল এআই-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও অনুমান করবে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।

অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন এআইয়ের সাবেক অধ্যাপক, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত এআরআইটিআইয়ের সাবেক পরিচালক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অধ্যাপক ইউনূস একটি কথাও বলেননি: মেজর (অব.) হাফিজ
  • নেতা-কর্মীদের মতের মূল্য না দিলেও জি এম কাদের স্ত্রীর মতামত প্রাধান্য দেন: আনিসুল ইসলাম
  • এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়
  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে
  • মিয়ানমারে ডিসেম্বরে নির্বাচনের ঘোষণা জান্তা সরকারের, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার
  • বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সরাসরি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পক্ষে