অনেক পরিচয় বহন করেন আহমদ রফিক। মেধাবী ছাত্র। পড়েছেন মেডিকেল কলেজে। কিন্তু পেশা হিসেবে চিকিৎসাকে বেছে নেননি তিনি। জড়িয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনে। পাকিস্তানের রুদ্ধ সময়ে বাঙালির চেতনাকে শাণিত করার প্রয়াসে নিয়েছেন নানা উদ্যোগ। তবে সাহিত্য থেকে তিনি কখনও বিচ্ছিন্ন হননি। ষাটের দশকের বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা ‘নাগরিক’ তিনি সম্পাদনা করেছেন। লিখেছেন কবিতা, গল্প এবং অসংখ্য প্রবন্ধ। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামও আহমদ রফিকের ধ্যানের সারথী। সবকিছু ছাড়িয়ে গত কয়েক দশক জুড়ে তিনি রবীন্দ্র গবেষণায় মগ্ন ছিলেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতৃস্থানীয় নেতা। এবং সেই থেকে আহমদ রফিক বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতির অবিসংবাদিত ‘মহাজন’।
‘মহাজন’ শব্দটা আহমদ রফিকের সঙ্গে যায় না। কারণ ‘মহাজন’ সামন্ততান্ত্রিক শব্দ। কিন্তু এই মুহূর্তে এর চেয়ে জুতসই শব্দ পাচ্ছি না। মহাজনই তিনি, বাংলা শিল্পের, বাংলা সাহিত্যের। আহমদ রফিককে নিয়ে কী লিখব? কোন দিকটায় হাত রাখব? এ সব ভাবনার মধ্যে আমার চোখের সামনে ধরা পরে, একটা বই- ‘দেশ বিভাগ: ফিরে দেখা’।
বইটি আহমদ রফিকের সকল পরিচয়ের বিপরীতে নতুন আরেকটি পরিচয় তুলে ধরে, তিনি ইতিহাসবিদ। আমাদের দেশে অন্তত তিনজন স্বনামখ্যাত লেখককে ‘ইতিহাসবিদ’ আখ্যা দেওয়া যায়, যারা মননশীল বা সৃজনশীল লেখক। প্রথমত কবি নির্মলেন্দু গুন, যতীন সরকার এবং অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। এ কথা লিখতে হচ্ছে আহমদ রফিকের ইতিহাসবিদ হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিত সামনে রেখে। কেন তিনি উপমহাদেশের বির্দীন দিনের ইতিহাস লিখতে গেলেন? আমার ধারণা, যতোটুকু আহমদ রফিককে চিনি, জানি ও ধারণ করি, এই ইতিহাস না লিখে আহমদ রফিকের মুক্তি ছিল না। প্রশ্ন উঠতে পারে, আহমদ রফিক কি বন্দী ছিলেন? হ্যাঁ ছিলেন। কোথায় ছিলেন বন্দী? নিজের কাছে, বিবেক ও প্রখর চেতনা পরম্পরার কাছে। কেননা তিনি বইটির দ্বিতীয় পর্বের আঠারো পৃষ্ঠায় লিখেছেন:
‘আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে সেজো চাচার বাড়ি। শ্রাবণ পেরিয়ে ভরা ভাদ্র। পাটের আঁশ ছাড়াচ্ছেন বাইরের আঙিনায় বাঁশঝাড়ের নিচে নিন্মবর্গীয় কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনি- পাকিস্তান নিয়ে কথা, সোনালী আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে সে কথকতায় ফুটে ওঠে ভবিষ্যৎ স্বপ্নের সোনালী আঁকিবুকি। এগিয়ে গিয়ে তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করি, কেমন বোঝেন দেশ ভেঙ্গে এই পাকিস্তান হওয়াটা?
মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকান মধ্যবয়সী ভূমিহীন দিনমজুর রেয়াজুদ্দিন (গ্রামের প্রচলিত ডাক রেজদ্দি)। পরনে ভেজা গামছা, খালি গা। প্রশ্নের উত্তরে তাৎক্ষণিক জবাব, জিন্না সাবরে আমরা বাশসা [বাদশাহ] বানাইছি, পাকিস্তান আইছে। আমরার আর কষ্ট থাকব না। তার মুখে স্বাপ্নিক আলোর আভা।
আমার পাল্টা জিজ্ঞাসা, কেমনে বুঝলেন, আপনাদের আর কষ্ট থাকবে না?
জিন্না সাবে কইছে। হ্যার লাইগ্যাইতো পাকিস্তান বাক্সে বুট (ভোট) দিছি। কণ্ঠে গভীর প্রত্যয়ের সুর। নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধেও সচেতন।
এরপর আর কথা চলে না। জিন্না সাহেবের ওপর তাদের অগাধ বিশ্বাস। শহর থেকে অনেক দূরে মেঘনাপারের প্রত্যন্ত গ্রাম শাহবাজপুরের শ্রমজীবী মানুষ রেয়াজদ্দিন একবারে ভূমিহীন নন। দু-তিন কানি চাষের জমি থাকলেও তাতে পাঁচ ছ জনের সংসার চলে না। তাই দিনমুজরীই জীবনযাত্রার প্রধান নির্ভর। তার ছোটভাই জৈনুদ্দিনের একই অবস্থা। অবাক হই দেখে যে, জিন্না সাহেবের রাজনৈতিক প্রভাব কত দূর প্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে।’
আহমদ রফিক জন্মেছেন ১৯২৯ সালে। আর উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছে ১৯৪৭ সালে। আহমদ রফিকের বয়স কতো তখন? ১৮ বছর। ১৮ বছর বয়সের এক তরুণের মনে প্রশ্ন জেগেছিল- ‘জিন্না সাহেবের রাজনৈতিক প্রভাব কত দূর প্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে।’ সেই তরুণ ছিল ভিন্ন চিন্তার। তরুণের চেতনা প্রবাহে ছিল অসাম্প্রদায়িক অখণ্ড উপমহাদেশ। যেখানে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান জৈন পার্সী একসঙ্গে থাকবে। দুঃখ যে, এই বিশ্ব নাগরিকের চিন্তা সেই কালে আহমদ রফিকের মতো মাত্র দু’চারজনের মাথায়ই ছিল, বাকীদের মাথায় ছিল লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, খণ্ডিত পাকিস্তান। কিন্তু সব ধর্মের সব বর্ণের মানুষদের নিয়ে বিশাল একটি ভূখণ্ডের নাগরিক হওয়ার যে গৌরব, সেই গৌরব ধারণ করার মতো মানুষ কেন কম ছিল?
কারণ? উপমহাদেশে মোগল শাসনের পর ব্রিটিশ বেনিয়ারা আসে। এরপর ক্ষমতার ছড়ি চলে যায় হিন্দুদের হাতে। মুসলমানেরা হয়ে পরে ব্রাত্যজন। এবং প্রায় দেড়শ বছর ধরে মুসলমানের নিজেদের নির্বুদ্ধিতার কারণে, হিন্দুদের আগ্রাসী মনোভাবের শিকার হয়ে পিছিয়ে পড়ে। শাসন যন্ত্রে একবার পিছিয়ে পড়লে উঠে আসা দুস্কর। সেই প্রবল কঠিন পথ পার হওয়ার চেষ্টা যখন উপমহাদেশের মুসলমানেরা করতে শুরু করেছে, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।
আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হিন্দুদের সঙ্গে সংখ্যায়ও পিছিয়ে পড়া। দুই দিকের পিছিয়ে পড়া নিঃস্ব নিপীড়িত শত শত বছরের দুঃশাসনের নিগৃহীত মুসলমানদের যখন ত্রাহি অবস্থা, সেই সময়ে মোহাম্মাদ আলী জিন্না এসে দাঁড়ান। নিজের একটি ইমেজ তৈরি করে সাফল্যের সঙ্গে উপমহাদেশে মুসলমানদের ত্রাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বিলেত থেকে এসে তিনি যদিও প্রথমে কংগ্রেসেই নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার চেয়ারে বসার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পরায় জিন্না নিজের মতো একটা প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। সেই প্রতিশোধের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে কংগ্রেস, কংগ্রেসের আগ্রাসী নেতারা। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জিন্না, পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের জনক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।
উপমহাদেশের বিভক্তি নিয়ে দেশে এবং বিদেশে অনেক অভিসন্দর্ভ লেখা হয়েছে, অনেক গবেষণা হয়েছে। একই বিষয়ে ভারতে এবং পাকিস্তানেও বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। এখনও, উপমহাদেশ বিভক্তির একাত্তর বছরও কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়া ঠিক হয়েছে কি না? যদি ঠিক না হয়ে থাকে, তাহলে দায় কার?
১৯৪৭ সালে, আজ থেকে আটাত্তর বছর আগে যে ইতিহাসের মিমাংসা হয়ে গেছে; পাকিস্তান ভেঙ্গে বাঙালি ভাষার জাতিগোষ্ঠীর আরেকটি নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে, যার বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে, তারপরও কেনো এই হাহাকার? এই বৃথা রোদন?
প্রকৃতপক্ষে, আহমদ রফিকের হাহাকাও নয়, নয় রোদনও। ‘দেশবিভাগ : ফিরে দেখা’ বইটি মূলত আহমদ রফিকের বিশ্বনাগরিকের মনের আত্মানুসন্ধান। এই আত্মানুসন্ধান না করে আহমদ রফিকের উপায় ছিল না। কেননা তিনি সত্তা সুধায় মহান মানবিক মানুষ ছিলেন। তিনি মনে করেছেন, চোখের সামনে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির মধ্যে দিয়ে মানুষ হত্যার যে নির্মম খেলা রাজনীতিবিদরা করেছে, তার একটা প্রামাণ্য দলিল রেখে যাওয়া দরকার। কেননা, এই বাংলাদেশে এতো নিবিড় আর ইতিহাসের রক্তচোখে কেউ লেখেনি। উপমহাদেশ বিভক্তির প্রতিক্রিয়া বিচিত্র। যারা বয়সের কারণে সেই সময়ের মানুষ এবং গভীর আত্মানুসন্ধানী, যারা আহমদ রফিকের মতো বিশ্বনাগরিক এবং মহত্তম মানবিক, তারা মেনে নিতে পারেননি এই বিভক্তি। তাদের মধ্যে স্বজন হারানোর বিমূর্ত হাহাকার কাজ করে এখনও। আহমদ রফিক একদিকে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে, দ্বিতীয় পর্বে স্বজন হারানোর হাহাকারের স্রোতে ভাসতে ভাসতে লিখতে বাধ্য হয়েছেন ‘দেশবিভাগ: ফিরে দেখা’।
কী লিখেছেন আহমদ রফিক প্রায় পাঁচশ পৃষ্ঠার বইয়ে? বিশাল ঘটনার মধ্যে থেকে তিনি ডুবুরীর দক্ষতায় রক্ত আর জীবনের বলিদানের আখ্যান থেকে সেচে তুলেছেন, নিরেট ইট আর পাথরের ইতিহাস। তিনি লেখেন: ‘ভারত বিভাগ বিষয়ক ঘটনাবলীর অনুপুঙ্খ বিচারে দেখা যায়, যেসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দেশবিভাগের চাকা ঘুরতে শুরু করে তার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কংগ্রেসের, বিশেষ করে জওহরলাল নেহেরুর অবদান সবার চেয়ে বেশি। যেমন উত্তর প্রদেশে লীগ- কংগ্রেসের কোয়ালিশন, তেমনি এক দশক পরে অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রসঙ্গে নেহরুর বিবৃতি ইত্যাদি ঘটনা জিন্নাকে ভারত বিভাগের হাতিয়ার জুগিয়ে দেয়। তেমনি একই ঘটনা ১৯৩৭ এ প্রজাপার্টির সঙ্গে সমঝোতায় না যাওয়ার ক্ষেত্রে নেহেরুর নেতিবাচক ভূমিকা। সবদিক বিবেচনায় ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৯ মাত্র দুটো বছরের রাজনৈতিক ঘটনাবলী দেশবিভাগের পক্ষে নিশ্চিত পথ তৈরী করে দেয়। অবশ্য সেই সঙ্গে আরো একাধিক অনুঘটক শক্তিও ছিল সক্রিয়, যেমন পাঞ্জাব ও বাংলার মুখ্যমন্ত্রীদ্বয়ের লীগকে শক্তিশালী করার ভূমিকা গ্রহণের কথা, যা একাধিক বার উল্লিখিত। উত্তর প্রদেশের লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামানের সঙ্গে পরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কেনো সুফল মেলেনি। কারণ, ততক্ষণে পাশার দান পড়ে গেছে। সব সম্ভবনা শেষ।’
দেখুন, আহমদ রফিক কতো মনোযোগের সঙ্গে ইতিহাসের ঠিকুজি খুঁজে বের করেছেন, ইতিহাসের যথার্ততা প্রমাণ করবার জন্য। বিশাল ইতিহাসকে তিনি চুয়ান্নটা পর্বে ভাগ করেছেন উপ শিরোনামে। ফলে, বইটি পাঠ করতে গেলে, সেলুলয়েডের ফিতার মতো একের পর এক দৃশ্যশব্দকল্প পাঠকের চেতনার মানমিন্দরে চলে আসে খুব সহজে। পাঠকের বোঝার জন্য কয়েকটি উপ-শিরোনাম উপস্থাপন করছি: আমজনতারও স্বপ্ন ছিল পাকিস্তান, রাজনীতির সাম্প্রদায়িক বিভাজন, সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ: লীগ কংগ্রেস প্রজাপার্টি, রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বিপর্যস্ত ফজলুল হক, বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে লীগ কংগ্রেস ও রাজ, কংগ্রেসের নীতিগত অন্তবিরোধ: যথারীতি গান্ধি- প্রাধান্য, কংগ্রেসে ডান বা দ্বন্দ্ব ও সুভাষ সমাচার, সিকান্দার হায়াতের পাকিস্তান বনাম পাঞ্জাব ভাবনা, ক্রিপস প্রস্তাব নিয়ে টানাপোড়েন, বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতীয় কমিউনিস্টদের জনযুদ্ধ, বিয়াল্লিশের ক্রান্তিকালে জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতৃত্ব, ভারত ছাড় আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন: সাহিত্যচর্চায় প্রভাব, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ও সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী, রাজনীতিতে ধর্মীয় চেতনা ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত, সারে জাঁহাসে আচ্ছা’র ঐক্যবোধ টেকেনি, লীগ কংগ্রেসের দ্বন্দ্বের রাজনীতি, জিন্না : ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র, অগ্নিগর্ভ ভারত: ছাত্র জনতা শ্রমিক ও নৌসেনার তৎপরতায়, কেবিনেট মিশন: সমঝোতার নয়া প্রচেষ্টা, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস: কলকাতায় সাম্প্রদায়িক গণহত্যা, কোন ভাঙ্গনের পথে ভারত, ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধি জিন্না সমাচার, দেশবিভাগের নিয়তি: নেহরু বনাম আজাদ- নেপথ্যে প্যাটেল, দেশভাগ বাংলাভাগ: জাতীয়তাবাদ থেকে সাম্প্রদায়িকতায়, দেশভাগের পটভূমিতে বাঙালি জাতিসত্তা, জিন্নার পাকিস্তান: পাকিস্তানের জিন্না, দেশভাগ ও উদ্বাস্তকথা।
জায়গার অভাবে আরও অনেক শিরোনাম দেওয়া হলো না। কিন্ত যে কটি শিরোনাম দেওয়া হলো, এই শিরোনাম পাঠ করেই কী পাঠক ধারণা পাচ্ছেন না, আহমদ রফিক কতোটা ইতিহাস সচেতন? বইটি রচনা করতে আহমদ রফিকের দুটি বিষয় আমাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে। প্রথমটি তিনি সরাসরি ইতিহাসের দর্শক। দ্বিতীয়ত তিনি ইতিহাসমনস্ক ও লেখক। দুটি সত্তা মিলে আহমদ রফিক যখন দেশভাগের ইতিহাস লেখেন, তখন সেই ইতিহাস হয়ে ওঠে ইতিহাসের চেয়েও বেশি কিছু।
যারা জানতে চান উপমহাদেশের বিভক্তির রক্ত অধ্যায়, রাজনীতির ক্ররতা কেমন করে সাধারণ মানুষ হয়ে যায় নিয়তির নির্মম শিকার, তারা ধারাবাহিক ঘটনায় পেয়ে যাবেন সব বইটি পড়লে। আমরা যারা দূর থেকে দেখে, অন্যের কাছে শুনে ইতিহাসের পাঠ নেই বা শেখার চেষ্টা করে, সেই আমরা কিন্তু মস্ত ফাঁকির মাঝখানে পরে থাকি। কারণ, দূর থেকে দেখা আর অন্যের কাছে শোনা ইতিহাস কখনো বিশ্বস্ত হতে পারে না। ইতিহাসের বিশ্বস্ততা খুব জরুরি। কিন্তু আহমদ রফিক আমাদের কাছে যে ইতিহাস তুলে ধরেছেন, সেটি দূরেরও নয়, শোনাও নয়, এই ইতিহাস কোটি কোটি জীবনের দামে কেনা।
মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে আমাদের এক ধরনের দূরের মুগ্ধতা আছে। সেই মুগ্ধতা ভেঙ্গে যায় যখন আমরা পাঠ করি আহমদ রফিকের এই বইটি। তিনি লেখেন: ‘গান্ধী চরিত্রের দুই পার্শ্বমুখ সত্ত্বেও ভারতীয় রাজনীতি তার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এমন কি সুভাষ প্রভাবিত বাংলা বা বঙ্গীয় কংগ্রেসও। কারো কারো মতে ভারতীয় চারিত্র্যবৈশিষ্ট্যের কারণে গান্ধী তার অহিংসা ও সত্যাগ্রহ নীতি নিয়ে রাজনৈতিক ভুবন দখল করেছিলেন- অবশ্য ভারতীয় হিন্দুদের। যদিও স্বাধীনতা ও স্বাদেশিকতার টানে বেশ কিছুসংখ্যক মুসলমান রাজনৈতিক নেতা কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন তবুও সংখ্যাগড়িষ্ঠ মুসলমান জনতা বরাবর গান্ধীর প্রভাব বলয়ের বাইরে।’
উপরে লেখা কয়েকটি লাইনের মধ্যে গান্ধীর মনন জমিন পরিষ্কার হয়ে যায় আমাদের কাছে। গান্ধী কেবল উপমহাদেশে নন, গোটা পৃথিবীতে খ্যাতিমান অহিংস আন্দোলনের প্রবর্তক হিসেবে। কিন্তু গান্ধী যে উপমহাদেশের বিভক্তি রোধ করতে পারলেন না, বরং অগনিত মানুষের নির্মম হত্যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে রইলেন, এই বিষয়ে সবাই নীরব। সময়ের পরিধি অতিক্রম করে গেলে, প্রবলভাবে খ্যাতিমান হয়ে গেলে, পিছনের ব্যর্থতা ভুলে যায় মানব সমাজ, এটাই প্রথা। আহমদ রফিক সেই প্রথা ভেঙ্গে নির্মোহ চোখে ইতিহাসের এবং রাজনীতির পালাবদলের চিত্র তুলে ধরেছেন বইটিতে।
ইতোমধ্যে আমরা বইয়ের অনেকগুলো উপ-শিরোনাম পাঠ করেছি, কিন্তু শেষের দিকের দুটি উপ-শিরোনাম পাঠ করিনি। সেই দুটি উপ-শিরোনাম: দেশবিভাগ বিচার: একুশ শতকে দাঁড়িয়ে- এক ও দুই। এই দুই পর্বে আহমদ রফিক কী লিখেছেন, একটু পাঠ নেওয়া দরকার। কারণ, বিশাল এই বইটির উপসংহার টেনেছেন তিনি এই দুই পর্বে।
তিনি লিখেছেন: ‘উপমহাদেশের মানুষ, বিশেষ করে নিম্মবর্গীয় ও সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার সুফল যতোটা পেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। এর দায় তৎকালীন নেতাদের, যেমন জিন্না, নেহেরু, প্যাটেলের। এমন কি গান্ধীও সেই দায় পুরোপুরি এড়াতে পারেন না। তবে ভারত বিভাগ ও তজ্জনিত সহিংসার মূল দায় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান দাবির অনড় নায়ক জিন্নার সবচেয়ে বেশি। এদের পরবর্তী শাসকগণও একই ধারার। শুধু পাকিস্তান অর্জনের জন্য জিন্না ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানদের প্রায় হাজার বছরের সহাবস্থানের ইতিহাস অস্বীকার করেছেন। নিছক রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য তিনি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তুলেছেন অনৈতিহাসিক দাবি যে, যে হিন্দু-মুসলমান নানা অভিধায় পরস্পরবিরোধী পৃথক জাতি, তাদের সহাবস্থান সম্ভব নয়। তাই তাদের স্বার্থে দরকার ভারত বিভাগ ও স্বতন্ত্র পাকিস্তান ভূখণ্ড। এ দাবি ছিল সংকীর্ণ ধর্মীয় চেতনার প্রতিফলন। আসলে রাজনৈতিক ইচ্ছাপূরণ।
অবশ্য ইতিহাস র্পযালোচনায় এ সত্য অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত যে জিন্নাই দ্বিজাতিতত্তের একমাত্র প্রবক্তা নন। লাহোর প্রস্তাবের বছর দুই তিনেক আগে উগ্র হিন্দুত্ববাদী হিন্দুমহাসভা নেতা সাভারকরের বক্তব্যে শোনা গেছে এমন দাবি যে, ‘হিন্দু মুসলমান স্বতন্ত্র জাতি’।’
উপমহাদেশের বিভক্তি নিয়ে পক্ষে এবং বিপক্ষে নানা মুনির নানা মত ও মতবাদ আছে, থাকবে। সেই সব মতবাদের বাইরে ইতিহাসের মানচিত্র থেকে আহমদ রফিক নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন ‘দেশবিভাগ: ফিরে দেখা’ বইয়ে। যারা ১৯৪৭ সালের উপমহাদেশ বিভক্তি বিষয়ে জানতে চান, তাদের জন্য বইটি আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে। ছয়শ টাকা মূল্যের বইটি প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য প্রকাশ।
ঢাকা/তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উপ শ র ন ম ম সলম ন র ১৯৪৭ স ল র জন ত ক র র জন ত প ঠ কর আম দ র কর ছ ন র জন য র বছর
এছাড়াও পড়ুন:
সিলেটে গ্যাস ফিল্ডস কর্মকর্তা হত্যায় প্রধান আসামির জামিন নামঞ্জুর
সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের কর্মকর্তা ময়নুল হোসেন আয়ানীকে (৫৫) সড়ক দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে হত্যার অভিযোগে করা মামলার প্রধান আসামির জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে সিলেটের অতিরিক্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন মামলার প্রধান আসামি উমর আলী (২২)। বিচারক তাঁর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী শামীম আহমদ।
নিহত ময়নুল হোসেন সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের উপব্যবস্থাপক পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল ইউনিয়নের উমনপুর গ্রামের বাসিন্দা। ২০২৪ সালের ১৩ জুন রাত ১১টার দিকে মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে তিনি নিহত হন। তখন সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল বলে প্রচার পায়। এ ঘটনায় তামাবিল হাইওয়ে থানার পক্ষ থেকে মামলা দায়ের হয়েছিল।
ময়নুল হোসেনের মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পর স্থানীয় মসজিদে এক বৈঠকে একই গ্রামের ইউসুফ আলী (২২) নামের এক তরুণ ময়নুল হোসেনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার কথা স্বীকার করেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নামও তিনি বলেন। উমনপুর গ্রামে একটি বাড়ি থেকে লিচু চুরি ও সালিসের জেরে ময়নুল হোসেন আয়ানীকে হত্যা করা হয়।
আরও পড়ুনদাফনের দুই সপ্তাহ পর জানা গেল, দুর্ঘটনা নয় হত্যা করা হয়েছিল গ্যাসফিল্ড কর্মকর্তাকে২৮ অক্টোবর ২০২৪ইউসুফ আলীর স্বীকারোক্তির পর নিহত ময়নুলের ভাই নাজমুল হোসাইন ওই বছরের ৭ জুলাই আদালতে হত্যা মামলার আবেদন করেন। আদালত ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর মামলা রেকর্ড করার আদেশ দেন। ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর জৈন্তাপুর থানায় মামলা রেকর্ড হয়। এতে উমনপুর গ্রামের উমর আলী (২২), সোহেল আহমদ বারেক (২২), ইউসুফ আলী (২২), সুবেদ আলী (২১), হরমুজ আলী (৪২), মোহাম্মদ আলী (৪২), মরম আলী (৬০), তাহের আলী (৪৫) ও সমসুর ইসলামকে (৫৪) আসামি করা হয়। মামলা করার পর আসামিরা পালিয়ে যান।
বাদীপক্ষের আইনজীবী শামীম আহমদ বলেন, এর আগে উমর আলীর চাচা হরমুজ আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আজ উমর আলী আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেছিলেন। পরে আদালত তাঁর জামিন নামঞ্জুর করেছেন।