সুপেয় পানির সংকট নিরসনে সরকার ১০টি জেলায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু বরগুনায় এই প্রকল্পের কাজে নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোথাও যেনতেনভাবে কাজ হয়েছে, আবার কোথাও অর্ধেক কাজ করে ফেলে রাখা হয়েছে। যদিও ঠিকাদার বরাদ্দের বেশির ভাগ বিল তুলে নিয়েছেন। এই প্রকল্পের উপকারভোগী বাছাইয়েও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বরগুনায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম’ নামের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় জেলার তিনটি উপকূলীয় উপজেলায় ৫ হাজার ৫৪২টি পরিবারে তিন হাজার লিটার ধারণক্ষমতার পানির ট্যাংক সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিটি ইউনিটের জন্য বরাদ্দ ৪৫ হাজার টাকা, সঙ্গে অতিরিক্ত ৬ হাজার ৯৮০ টাকা বরাদ্দ ছিল ক্যাচমেন্ট এরিয়া (প্ল্যাটফর্ম বা গোলাকার অবকাঠামো) নির্মাণের জন্য। মেসার্স কামাল এন্টারপ্রাইজ নামে বরগুনার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তিনটি প্যাকেজের কাজ পায়।

আমিও অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি। শুধু বরগুনা নয়, অন্য জেলাগুলো থেকেও এসেছে। আমি সরেজমিনে যাব এবং কাজগুলো যাতে ত্রুটিমুক্ত হয়, সে ব্যাপারে কোনো ছাড় দেব না।প্রকল্পটির পরিচালক মো.

বাদশাহ মিয়া

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ‘উপকূলীয় জেলাসমূহের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ’ নামে মূল প্রকল্পের কাজ চলছে ১০টি জেলায়। জেলাগুলো হচ্ছে বরগুনা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট। ২০২২ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে।

উপকূলে সুপেয় পানি অধিকার নিশ্চিতের জন্য জাতীয়ভাবে গঠিত পানি অধিকার ফোরামের বরিশাল বিভাগীয় সদস্য সংগঠন রিচ টু আনরিচের পরিচালক রফিকুল আলম বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে শুধু বরগুনায় নয়; ঝালকাঠি, পিরোজপুর জেলায়ও সরকারি এই প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি হয়েছে। এতে উপকারভোগী ব্যক্তিরা এখন ভুক্তভোগীতে পরিণত হয়েছেন।’

প্রকল্পটির পরিচালক মো. বাদশাহ মিয়া সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিও অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি। শুধু বরগুনা নয়, অন্য জেলাগুলো থেকেও এসেছে। আমি সরেজমিনে যাব এবং কাজগুলো যাতে ত্রুটিমুক্ত হয়, সে ব্যাপারে কোনো ছাড় দেব না।’

নিম্নমানের সামগ্রী, অর্ধসমাপ্ত কাজ

উপকারভোগীরা বলছেন, ট্যাংকের প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে প্রথম শ্রেণির ইটের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণির ইট। দেওয়া হয়েছে নিম্নমানের বালু ও প্রয়োজনের চেয়ে কম সিমেন্ট। এতে প্ল্যাটফর্মগুলো টেকসই হয়নি।

বরগুনা সদরের চালিতাতলী, ফালিশাতলী; পাথরঘাটা উপজেলার বড় টেংরা, কোড়ালিয়া ও ছোট টেংরা গ্রামের বেশ কয়েকজন উপকারভোগী জানান, তাঁদের বাড়িতে শুধু নিচের অবকাঠামো করা হয়েছে। ট্যাংক, পাইপলাইন, ফিল্টারসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে জানার জন্য মেসার্স কামাল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী কামাল হোসেনের বরগুনা শহরের কার্যালয়ে দুই দিন গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মুঠোফোনে ফোন করলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠালে তাতেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

পানির ট্যাংক স্থাপনের জন্য কোনো অর্থ নিইনি। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বরং আমার স্ত্রী এই ওয়ার্ডে প্রায় ১৫টি ট্যাংক বিতরণ করেছেন।মজিবর রহমান

অর্থ আদায়, স্বজনপ্রীতি

প্রকল্পের তালিকাভুক্ত হওয়ার পর সরকারি খাতে সহায়ক চাঁদার নামে প্রত্যেক উপকারভোগীর কাছ থেকে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বরগুনা সদরের চালিতাতলী গ্রামের গোলাম সরোয়ার অভিযোগ করেন, স্থানীয় নারী ইউপি সদস্য ছবি বেগমের স্বামী মজিবর রহমান প্রকল্প দেওয়ার জন্য ৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। ২০২৩ সালের শেষ দিকে তাঁর বাড়িতে দুই ব্যাগ সিমেন্ট, বালু এবং ২৫০টি ইট দিয়ে প্ল্যাটফর্ম করেছে। যে ইট ব্যবহার করা হয়েছে, তা খুবই নিম্নমানের। তারপর বাকি কাজ আর করেনি। তবে এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য ছবি বেগমের স্বামী মজিবর রহমান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘পানির ট্যাংক স্থাপনের জন্য কোনো অর্থ নিইনি। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বরং আমার স্ত্রী এই ওয়ার্ডে প্রায় ১৫টি ট্যাংক বিতরণ করেছেন।’

এদিকে পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কবীরের বড় টেংরা গ্রামের বাড়িতে পাঁচটি ট্যাংক বসানো হয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, এই ট্যাংকগুলো পেয়েছেন চেয়ারম্যানের দুই ভাইসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। একইভাবে সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেনের গ্রামের বাড়িতেও দুটি ট্যাংক রয়েছে।

বরগুনা জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাইসুল ইসলাম বলেন, ‘যদি অনিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে ঠিকাদার বিল তুলে নিলেও সমস্যা নেই। আমরা সেসব প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থানেব। কারণ, ঠিকাদারের সিকিউরিটি মানি (জামানত) এখনো আমাদের কাছে রয়েছে।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প ল য টফর ম এই প রকল প স বজনপ র ত প রকল প র বরগ ন য় র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

আশাহত হতে চাই না, অলৌকিক বলতেও একটা ব্যাপার আছে

দেশের মানুষ অনেক ধরনের সরকারই দেখেছে। সব সরকারের মধ্যেই ছিল দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির প্রবণতা। সহজাত দুর্নীতি তো ছিলই। দলীয় নেতাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং স্বজনপ্রীতির হাত ধরেও দুর্নীতিকে আসতে দেখা গেছে। সরকারের চরিত্রের বদল না হওয়ায় এ অপবাদ থেকে মুক্ত নয় এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু দলীয় নয়, আমরা আশা করেছিলাম নানা ধরনের সংস্কারের কাজ তারা করবে এবং উপদেষ্টারা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবেন। কিন্তু তা হয়নি। আগের সরকারগুলোর চরিত্র বর্তমান সরকারেও গেড়ে বসেছে। পরিবর্তন দেখছি না, শুধু হাতবদল ও মুখবদল হয়েছে। তাঁদের অনেকের কর্মকাণ্ডে জনগণ হতাশ হয়েছেন।

আমি মনে করি, বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক বিষয়ের ওপরে প্রথম আলোর জরিপটিকে একটি বাস্তবতার নিরিখে দেখা প্রয়োজন। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আর্থসামাজিক বিষয়ে সাধারণ মানুষের প্রত‍্যাশা অনেক। তাঁরা মনে করছেন, নির্বাচনের পরে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং তাঁদের জীবনে স্বস্তি ফিরে আসবে।

জরিপের ফলাফল সাধারণভাবে ঠিক এই সময়ের সাধারণ মানুষের চিন্তাচেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। যেহেতু যাঁরা ভোট দেবেন, তেমন ১ হাজার ৩৪২ জনের মতামত নেওয়া হয়েছে। সহিষ্ণুতা এবং দুর্নীতি কমার বিষয়টি নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করায় যে জবাবগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো বর্তমান বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে।

তবে কিছু কিছু জবাব সাধারণ চিন্তাচেতনার সঙ্গে যায় না বলে মনে হচ্ছে। যেমন ‘নারীর মধ‍্যে দেশ নিয়ে আশাবাদ বেশি’, কথাটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। বহু নারীর মধ‍্যেই এমন ভীতি আছে যে ধর্মভিত্তিক দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতা পেলে তাঁরা আরও ঘরের মধ‍্যে বন্দী হয়ে যাবেন। সুতরাং জরিপে আসা এ জবাব ঠিক সাধারণ চিন্তাচেতনার সঙ্গে যায় না।

শেষ দিকে যদি বলি, প্রথম আলোর জরিপে মানুষের নৈরাশ্যের চিত্র উঠে এসেছে, যা দেখা গেছে, কেউ হতাশ আবার কেউ খুবই হতাশ। গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, জরিপে ১৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী জবাবই দেননি। সার্বিক বিবেচনায় যা মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতেও যে সরকারের চরিত্র বদলাবে, সেই আশা করা কঠিন। তবু চূড়ান্ত বিচারে আশাহত হতে চাই না। অলৌকিক বলতেও তো একটা ব্যাপার আছে।

সেলিম জাহান সাবেক পরিচালক, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আশাহত হতে চাই না, অলৌকিক বলতেও একটা ব্যাপার আছে