‘চোখের দেখায়’ সিলিন্ডারের মান পরীক্ষা
Published: 27th, October 2025 GMT
তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সরবরাহের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডে (এলপিজিএল) এখন প্রায় সাড়ে চার লাখ সিলিন্ডার আছে। কিন্তু এসব সিলিন্ডারের মান যাচাইয়ে আধুনিক কোনো প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় না। গ্যাসের বুদ্বুদ্ উঠছে কি না, সেটি খালি চোখে দেখে পরীক্ষা করা হয়, যা বিস্ফোরণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গায় অবস্থিত এলপি গ্যাস লিমিটেড একটি সংবেদনশীল এলাকা, কিন্তু সেখানে নিরাপত্তাব্যবস্থা শিথিল। সিলিন্ডারের মান নিয়ন্ত্রণে কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই, ছিদ্র শনাক্তেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় না।
জ্বালানি বিভাগের যুগ্ম সচিব খন্দকার সাদিয়া আরাফিনের নেতৃত্বে চার সদস্যের কমিটি এই প্রতিবেদন তৈরি করে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। কমিটির এক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস ভর্তি করার পর বুদ্বুদ্ দেখা গেলে সিলিন্ডার বাতিল করা হয়। এতে শুধু গ্যাসের অপচয় নয়, দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বাড়ে। সেন্সর প্রযুক্তি চালু হলে ছিদ্র শনাক্ত নির্ভুল হবে।
প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ১৩ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার বাতিল, ৮ হাজার ২১৫টি মেরামত এবং ৯৪ হাজার ভাল্ভ পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে রি-টেস্টিং ইউনিটটি ৪৭ বছরের পুরোনো এবং যন্ত্রপাতি অচলাবস্থায়। নতুন ইউনিট স্থাপনে প্রায় ১২ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।১৯৭৮ সালে কার্যক্রম শুরু করা বিপিসির শতভাগ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি ইস্টার্ন রিফাইনারি ও রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির উৎপাদিত এলপিজি সংগ্রহ করে বোতলজাত করে। পরে সরকারি তেল কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে তা ভোক্তার হাতে পৌঁছায়।
অগ্নিনিরাপত্তায় অবহেলা
তদন্ত কমিটি সম্প্রতি এলপিজিএলে পরিদর্শনে গিয়ে চত্বরজুড়ে গ্যাসের গন্ধ পায়। সেখানে ধোঁয়া শনাক্তকারী যন্ত্র নেই, আড়াই বছর ধরে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে কোনো অগ্নিমহড়াও হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা ও মাননিয়ন্ত্রণে অবহেলা স্পষ্ট। তদন্ত কমিটি ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন, প্রতিটি সিলিন্ডারে উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদ ও ‘অটো ক্লিপ’ বাধ্যতামূলক করা এবং ছিদ্র পরীক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তি প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে।
স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সিলিন্ডার পরীক্ষা করতে নতুন একটি রি-টেস্টিং প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি চালু হলে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে মান যাচাই করা যাবে।মো.ইউসুফ হোসেন ভূঁইয়া, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এলপিজিএল
এলপিজিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইউসুফ হোসেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সিলিন্ডার পরীক্ষা করতে নতুন একটি রি-টেস্টিং প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি চালু হলে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে মান যাচাই করা যাবে।
অতীতে সরকারি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে। ২০১৬ সালের ২০ আগস্ট বগুড়ায় বিপিসির আঞ্চলিক ডিপোতে প্রায় ৩০০ সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। সেই ঘটনার পর কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরিবেশকদের অভিযোগ, সেগুলো টেকসই হয়নি।
পুরোনো সিলিন্ডারে বাড়ছে ঝুঁকি
এলপিজিএলের হিসাবে, ৪ লাখ ৫৯ হাজার সিলিন্ডারের মধ্যে ৯৩ হাজারের বয়স ১৫ বছরের বেশি। তাদের দাবি, ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার ১০ হাজারের মতো। কিন্তু পরিবেশক সমিতির হিসাব ভিন্ন। তাদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি।
পরিবেশকদের অভিযোগ, এসব পুরোনো সিলিন্ডারেও এখনো গ্যাস ভরা হচ্ছে। দুই-তিন দিনের মধ্যেই গ্যাস উবে যায়, এতে পরিবেশক ও ভোক্তা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ১৩ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার বাতিল, ৮ হাজার ২১৫টি মেরামত এবং ৯৪ হাজার ভাল্ভ পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে রি-টেস্টিং ইউনিটটি ৪৭ বছরের পুরোনো এবং যন্ত্রপাতি অচলাবস্থায়। নতুন ইউনিট স্থাপনে প্রায় ১২ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বিপিসি চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেন, ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডার বাদ দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি নতুন সিলিন্ডার কেনার প্রক্রিয়াও চলছে।
চিঠি যায়, কাজ হয় না
সারা দেশে সরকারি এলপিজির প্রায় তিন হাজার পরিবেশক আছেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিবেশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আয়ুব আলী চৌধুরী বলেন, বারবার চিঠি দিয়েও কাজ হচ্ছে না। বিপিসি ও এলপি গ্যাস লিমিটেড কেউই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি মান নিয়ন্ত্রণে উদাসীনতার বিষয়টি মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে।
সর্বশেষ ১ জুন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কাছে চিঠি দেয় এলপি গ্যাস পরিবেশক সমিতি। চিঠিতে বলা হয়, এলপি গ্যাস লিমিটেডের সরবরাহ করা সিলিন্ডারগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের অভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী এবং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে মানসম্মত ও ত্রুটিমুক্ত সিলিন্ডারের মাধ্যমে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহে ব্যবস্থা করতে হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম প্রকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, সরকারি সিলিন্ডারগুলোই সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত। সেগুলো বিস্ফোরক পণ্য; সামান্য দেবে যাওয়া বা আঘাতের চিহ্ন দেখলেই কারখানায় পাঠিয়ে চাপ পরীক্ষা করা উচিত। এ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস থ র পর ক পর ক ষ সরক র ইউন ট
এছাড়াও পড়ুন:
আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধের পর পাকিস্তানে টমেটোর কেজি ৬০০ রুপি
আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্তে সংঘাতের কারণে পাকিস্তানের প্রধান সীমান্ত ক্রসিংগুলো দিয়ে বাণিজ্য ও যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে টমেটোর দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এ নিয়ে ইসলামাবাদের বাসিন্দারা চিন্তিত।
দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির পর পাকিস্তান চলতি মাসের শুরুতে উত্তর-পশ্চিমের টরখাম এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের চমন সীমান্ত ক্রসিংগুলো বন্ধ করে দেয়।
সাধারণত পাকিস্তানে উৎপাদন কমে গেলে আফগানিস্তান থেকে এই দুটি সীমান্ত দিয়ে টমেটো এবং অন্যান্য দ্রুত পচনশীল পণ্য আমদানি করা হয়, যা দেশের ঘাটতি পূরণ করে। সীমান্ত বন্ধ থাকায় সম্প্রতি টমেটোর দাম ৪০০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে। পাকিস্তানজুড়ে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি টমেটো ৬০০ পাকিস্তানি রুপি (বাংলাদেশি প্রায় ২৬০ টাকা) পর্যন্ত পৌঁছেছে।
ইসলামাবাদের জি-৯ সবজি বাজারের ক্রেতা শান মসিহ আরব নিউজকে বলেন, ‘এগুলো খুব দামি হয়ে গেছে। আমরা এর কোনো কারণ বুঝতে পারছি না।’ তিনি যোগ করেন, ‘যেহেতু যেকোনো রান্নায় টমেটো ব্যবহার করা হয়, তাই আমরা সমস্যায় পড়েছি।’
ইসলামাবাদের ফল ও সবজি বাজারের বিক্রেতা মোহাম্মদ ইমরান কীভাবে সরবরাহে টান পড়েছে, তা নিয়ে কথা বলছিলেন। তিনি বলেন, সীমান্ত বন্ধ থাকায় আফগানিস্তান থেকে সরবরাহ বন্ধ।
ইমরান আরও বলেন, এখন ইরান, সিন্ধু ও কোয়েটা থেকে টমেটো আসছে। মানুষের চাহিদা কমেনি, এখনো ক্রেতারা একই পরিমাণ কিনছেন। কিন্তু তুলনামূলক সরবরাহ অনেকটা কমে গেছে।’ ইমরান আরও বলেন, এক সপ্তাহ আগেও টমেটো প্রতি কেজি ৫৬০ পাকিস্তানি রুপিতে বিক্রি হয়েছিল।
আরেক ক্রেতা নুসরাত জেহান বলেন, তিনি ১ কেজি টমেটো ৪০০ রুপি দিয়ে কিনেছেন। কয়েক দিন আগেও তিনি অনেক কম দামে টমেটো কিনেছেন। তিনি বলেন, আগে দাম কিছুটা কম ছিল, তবে সীমান্ত বন্ধের কারণে মনে হচ্ছে দাম এতটা বেড়েছে।
সবজির পাইকারি বিক্রেতা শাপুর খান বলেন, সীমান্ত বন্ধ হওয়ার পর টমেটোর সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। তিনি আরব নিউজকে বলেন, পাকিস্তানে টমেটো কম। এমনকি ইরান থেকে যে টমেটো আসছে, সেটাও পরিমাণে কম।
এই ব্যবসায়ী বলেন, পাকিস্তান আফগানিস্তান থেকে প্রতিদিন প্রায় ৮০ থেকে ১২০ ট্রাক টমেটো আমদানি করত।
শাপুর খান বলেন, ‘এখন আমরা ইরান থেকে ১০ থেকে ১৫ ট্রাক এবং বাকিটা সোয়াত (পাকিস্তানের একটা অঞ্চল) থেকে পাচ্ছি, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।’
কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আশা করছে, শিগগিরই দাম স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
ইসলামাবাদের মার্কেট কমিটির চেয়ারম্যান সাজিদ আব্বাসি বলেছেন, কর্তৃপক্ষ টমেটোর দামের আকস্মিক বৃদ্ধি সম্পর্কে জানে। তারা সরবরাহ বৃদ্ধি করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে।
আব্বাসি বলেন, ‘সীমান্ত বন্ধের কারণে দামের এই তারতম্য সম্পর্কে আমরা জানি। বিকল্প সরবরাহ রুট শক্তিশালী করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, শিগগিরই দাম স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’