পাকিস্তান ও আফগানিস্তান কেন কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারছে না
Published: 30th, October 2025 GMT
দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা ও সংঘাত থামানোর উদ্দেশ্যে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে চার দিনের আলোচনা ব্যর্থতায় শেষ হয়েছে। পাকিস্তানের কর্মকর্তারা এমনটা বলেছেন।
আজ বুধবার ভোরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করা এক বার্তায় পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার আফগান প্রতিনিধিদলকেই ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেছেন।
কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় এই আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। এর আগে দোহায় দুই দেশের মধ্যে প্রথম দফার বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকের পর ১৯ অক্টোবর এক সপ্তাহের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থামিয়ে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছিল।
গত সোমবার পাকিস্তানের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, আফগান প্রতিনিধিরা ইসলামাবাদের মূল দাবির বিষয়ে অবস্থান বদল করেছেন। তাঁদের মূল দাবি ছিল, কাবুলকে পাকিস্তান তালেবান (টিটিপি) গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা আল-জাজিরাকে বলেন, আফগান আলোচক দলকে কাবুল থেকে দেওয়া নির্দেশনাগুলোই আলোচনাকে জটিল করে তুলেছে।
বিশ্লেষকেরা আশা করছেন, পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়ানো থেকে দুই দেশকে বিরত রাখতে শেষ মুহূর্তের চেষ্টা চলতে থাকবে। তবে দুই দেশের মধ্যে নতুন সংঘাতের আশঙ্কা এখন প্রবল বলে মনে করছেন তাঁরা।
আলোচনায় ব্যর্থতার জন্য কাবুল কর্তৃপক্ষ পাল্টা পাকিস্তানকে দোষারোপ করেছে। কাবুল কর্তৃপক্ষের বরাতে আফগান গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের মধ্যে ‘সমন্বয়ের অভাব’ ছিল, তারা ‘পরিষ্কার যুক্তি উপস্থাপন করেনি’ এবং বারবার ‘আলোচনার টেবিল ছেড়ে উঠে গেছে’।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক উপমন্ত্রী হাজি নাজিব আফগান আলোচক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কারা অংশ নিয়েছেন, তা প্রকাশ করা হয়নি।
সম্প্রতি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে আন্তসীমান্ত সংঘর্ষে দুই দেশের সেনা ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও অনেকে।
ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানকে আফগান তালেবানের প্রধান সমর্থক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসাকে পাকিস্তানে অনেকেই প্রকাশ্যে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু তখন থেকে দুই দেশের সম্পর্ক প্রচণ্ড রকমের খারাপ হতে শুরু করে। মূলত পাকিস্তান তালেবান বা টিটিপিকে নিয়েই এ দ্বন্দ্ব।মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়ই বিশ্বজুড়ে নানা সংঘাত মেটানোর কৃতিত্ব দাবি করে থাকেন। এবারও ট্রাম্প বলেছেন, তিনি নাকি ‘আফগানিস্তান-পাকিস্তান সংকট খুব দ্রুতই মিটিয়ে’ ফেলবেন। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আসিয়ান সম্মেলনের ফাঁকে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় এই মন্তব্য করেন ট্রাম্প।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের মধ্যে ‘গভীর অবিশ্বাস’ ও ‘পরস্পরবিরোধী অগ্রাধিকারের জায়গাগুলোর’ কারণে দীর্ঘস্থায়ী সমঝোতায় পৌঁছানোটা কঠিন।
উইলসন সেন্টারের সাবেক ফেলো ও জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সাংবাদিক বাকির সাজ্জাদ সৈয়দ মনে করেন, আফগান তালেবানের জন্য পাকিস্তান তালেবানের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়াটা কঠিন কাজ।
আল-জাজিরাকে বাকির সাজ্জাদ বলেন, ‘আমার দৃষ্টিতে মূল সমস্যাটা মতাদর্শগত জায়গায়। আফগান তালেবানরা দেশের ভেতরের নিরাপত্তা বজায় রাখতে টিটিপির (পাকিস্তান তালেবান) ওপর নির্ভর করে। সেই নির্ভরতার কারণেই পাকিস্তানের উদ্বেগ সত্ত্বেও তাদের থেকে আলাদা হওয়া কঠিন।’
সমস্যাপূর্ণ বন্ধুত্ব
ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানকে আফগান তালেবানের প্রধান সমর্থক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসাকে পাকিস্তানে অনেকেই প্রকাশ্যে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু তখন থেকে দুই দেশের সম্পর্ক প্রচণ্ড রকমের খারাপ হতে শুরু করে। মূলত পাকিস্তান তালেবান বা টিটিপিকে নিয়েই এ দ্বন্দ্ব।
টিটিপি একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ চলাকালে এ গোষ্ঠীর উত্থান হয়। এ গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের সরকারবিরোধী বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে আসছে।
টিটিপি চায় পাকিস্তানের কারাগারে আটক তাদের সদস্যদের মুক্তি দেওয়া হোক। তারা পাকিস্তানের আদিবাসী এলাকাগুলোকে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত রাখার বিরোধিতা করে।
আফগান তালেবান ও পাকিস্তান তালেবান দুটি আলাদা সশস্ত্র গোষ্ঠী হলেও মতাদর্শগত জায়গা থেকে দুটি গোষ্ঠীর মিল রয়েছে।
আফগান প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা ইয়াকুব ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ কাতারের দোহায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষরের পর হাত মেলাচ্ছেন। ১৯ অক্টোবর, ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আফগ ন ত ল ব ন আফগ ন স ত ন মন ত র প রক শ
এছাড়াও পড়ুন:
পাখি তাড়াতে কত কী করা হলো, তবু তারা এলাকা ছাড়েনি
পাখিদের তাড়ানোর জন্য গাছ কেটে ফেলা হয়েছিল। হত্যা করা হয়েছিল প্রায় ৮০টি পাখি। বন বিভাগ এই ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করেছিল। তার মধ্যে পাখির আবাসস্থল ধ্বংসের আনুমানিক ক্ষতি এক কোটি টাকা ও পরিবেশের আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দুই কোটি টাকা। এই ক্ষতির জন্য আদালতে মামলাও করা হয়েছিল।
চার বছর আগে এ ঘটনা ঘটেছিল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে। তারপরও পাখিরা হাসপাতাল ছাড়েনি। প্রজনন মৌসুমে শামুকখোল পাখিরা আসে। আরও থাকে পানকৌড়ি ও নিশিবক।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে দীর্ঘদিন ধরে শামুকখোল পাখিরা প্রজনন মৌসুমে বাসা বাঁধে। বাচ্চা ফুটিয়ে তারা আবার চলে যায়। নিশিবক ও পানকৌড়ি প্রায় সারা বছরই থাকে। ২০২০ সালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পাখির বিষ্ঠায় পরিবেশ নষ্টের অজুহাতে কিছু গাছের ডালপালা কেটে দিয়েছিল।
এ ঘটনার পর পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো প্রতিবাদ করে। এরপর হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেছিলেন, হাসপাতালের পরিবেশ ও পাখি নিয়ে মানুষের আবেগ, এই দুটি বিষয়কে সমন্বয় করেই তিনি কাজ করবেন। পাখির যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখবেন।
২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনে ড্রেন নির্মাণের জন্য একটি অর্জুনগাছ কাটা হলে উড়তে না শেখা শতাধিক পাখির ছানা মাটিতে পড়ে যায়। কিছু পাখি মারা যায়। আর কিছু পাখির ছানা জবাই করে নিয়ে যান শ্রমিক ও রোগীর স্বজনেরা। এর প্রতিবাদ জানিয়ে রাজশাহী, নাটোর ও নওগাঁয় পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।
এত অত্যাচারের পরও পাখিরা হাসপাতাল ছাড়েনি। এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আমিনুজ্জামান মো. সালেহ রেজা বলেন, শামুকখোল খুব বাছাই করা গাছে বাসা বাঁধে। তারা প্রথমেই নিরাপত্তা বিবেচনা করে। যেখানে মানুষের ভিড় বেশি, সেখানে মানুষ পাখিদের বিরক্ত করে না—এটা তারা বুঝে গেছে। আবার বাসা বানানোর উপকরণ ও খাবারের উৎস সহজলভ্য কি না, সেটাও তারা বিবেচনায় রাখে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার মোশাররফ হোসেন ২০০৪ সাল থেকে এই হাসপাতালে কর্মরত। তিনি বলেন, আগে শামুকখোল পাখিগুলো রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের গাছগুলোয় থাকত। ২০১৮ সালে সেসব গাছ কাটা হলে তারা হাসপাতাল এলাকায় চলে আসে। এর আগে হাসপাতল এলাকায় অনেক কাক থাকত। পাখির বিষ্ঠার কারণে রোগীদের ভোগান্তি হতো। এ কারণে হাসপাতাল এলাকার গাছের ডালপালা ছেঁটে দেওয়া হয়েছিল। তারপরও পাখিরা হাসপাতাল এলাকা ছেড়ে যায়নি।
গাছ কাটা ও পাখি হত্যার ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে রাজশাহী বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের পক্ষ থেকে আদালতে মামলা করা হয়েছিল। বন্য প্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহী চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। সেই মামলায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বিবাদী করা হয়েছিল।
এ বিষয়ে বন্য প্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটির এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
কয়েক দিন আগে হাসপাতাল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতাল চত্বরের ন্যাড়া জারুলগাছগুলোতেও পাখিরা একেবারে গাদাগাদি করে বাসা তৈরি করেছে। পাখিগুলো গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছে। হাসপাতালের সামনের সড়ক বিভাজকের ছোট ছোট গাছেও পাখিরা ভিড় করে আছে। গাছগুলো এত ছোট, যে কেউ চাইলেই পাখিদের ছুঁতে পারবে, কিন্তু সেদিকে পাখিদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
পাখির বাসার নিচেই আছে একাধিক খাবারের দোকান। স্থানীয় এক দোকানি বলেন, হাসাপাতাল এলাকায় যাঁরা থাকেন বা আসেন, তাঁদের অন্যদিকে তাকানোর সময় থাকে না। কেউ ব্যস্ত ব্যবসা নিয়ে, কেউ আসেন রোগী নিয়ে। পাখি দেখতে কেউ আসেন না। পাখির বাসা ভাঙার সময় কারও নেই।