দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা ও সংঘাত থামানোর উদ্দেশ্যে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে চার দিনের আলোচনা ব্যর্থতায় শেষ হয়েছে। পাকিস্তানের কর্মকর্তারা এমনটা বলেছেন।

আজ বুধবার ভোরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করা এক বার্তায় পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার আফগান প্রতিনিধিদলকেই ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেছেন।

কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় এই আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। এর আগে দোহায় দুই দেশের মধ্যে প্রথম দফার বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকের পর ১৯ অক্টোবর এক সপ্তাহের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থামিয়ে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছিল।

গত সোমবার পাকিস্তানের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, আফগান প্রতিনিধিরা ইসলামাবাদের মূল দাবির বিষয়ে অবস্থান বদল করেছেন। তাঁদের মূল দাবি ছিল, কাবুলকে পাকিস্তান তালেবান (টিটিপি) গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা আল-জাজিরাকে বলেন, আফগান আলোচক দলকে কাবুল থেকে দেওয়া নির্দেশনাগুলোই আলোচনাকে জটিল করে তুলেছে।

বিশ্লেষকেরা আশা করছেন, পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়ানো থেকে দুই দেশকে বিরত রাখতে শেষ মুহূর্তের চেষ্টা চলতে থাকবে। তবে দুই দেশের মধ্যে নতুন সংঘাতের আশঙ্কা এখন প্রবল বলে মনে করছেন তাঁরা।

আলোচনায় ব্যর্থতার জন্য কাবুল কর্তৃপক্ষ পাল্টা পাকিস্তানকে দোষারোপ করেছে। কাবুল কর্তৃপক্ষের বরাতে আফগান গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের মধ্যে ‘সমন্বয়ের অভাব’ ছিল, তারা ‘পরিষ্কার যুক্তি উপস্থাপন করেনি’ এবং বারবার ‘আলোচনার টেবিল ছেড়ে উঠে গেছে’।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক উপমন্ত্রী হাজি নাজিব আফগান আলোচক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কারা অংশ নিয়েছেন, তা প্রকাশ করা হয়নি।

সম্প্রতি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে আন্তসীমান্ত সংঘর্ষে দুই দেশের সেনা ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও অনেকে।

ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানকে আফগান তালেবানের প্রধান সমর্থক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসাকে পাকিস্তানে অনেকেই প্রকাশ্যে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু তখন থেকে দুই দেশের সম্পর্ক প্রচণ্ড রকমের খারাপ হতে শুরু করে। মূলত পাকিস্তান তালেবান বা টিটিপিকে নিয়েই এ দ্বন্দ্ব।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়ই বিশ্বজুড়ে নানা সংঘাত মেটানোর কৃতিত্ব দাবি করে থাকেন। এবারও ট্রাম্প বলেছেন, তিনি নাকি ‘আফগানিস্তান-পাকিস্তান সংকট খুব দ্রুতই মিটিয়ে’ ফেলবেন। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আসিয়ান সম্মেলনের ফাঁকে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় এই মন্তব্য করেন ট্রাম্প।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের মধ্যে ‘গভীর অবিশ্বাস’ ও ‘পরস্পরবিরোধী অগ্রাধিকারের জায়গাগুলোর’ কারণে দীর্ঘস্থায়ী সমঝোতায় পৌঁছানোটা কঠিন।

উইলসন সেন্টারের সাবেক ফেলো ও জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সাংবাদিক বাকির সাজ্জাদ সৈয়দ মনে করেন, আফগান তালেবানের জন্য পাকিস্তান তালেবানের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়াটা কঠিন কাজ।

আল-জাজিরাকে বাকির সাজ্জাদ বলেন, ‘আমার দৃষ্টিতে মূল সমস্যাটা মতাদর্শগত জায়গায়। আফগান তালেবানরা দেশের ভেতরের নিরাপত্তা বজায় রাখতে টিটিপির (পাকিস্তান তালেবান) ওপর নির্ভর করে। সেই নির্ভরতার কারণেই পাকিস্তানের উদ্বেগ সত্ত্বেও তাদের থেকে আলাদা হওয়া কঠিন।’

সমস্যাপূর্ণ বন্ধুত্ব

ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানকে আফগান তালেবানের প্রধান সমর্থক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসাকে পাকিস্তানে অনেকেই প্রকাশ্যে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু তখন থেকে দুই দেশের সম্পর্ক প্রচণ্ড রকমের খারাপ হতে শুরু করে। মূলত পাকিস্তান তালেবান বা টিটিপিকে নিয়েই এ দ্বন্দ্ব।

টিটিপি একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ চলাকালে এ গোষ্ঠীর উত্থান হয়। এ গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের সরকারবিরোধী বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে আসছে।

টিটিপি চায় পাকিস্তানের কারাগারে আটক তাদের সদস্যদের মুক্তি দেওয়া হোক। তারা পাকিস্তানের আদিবাসী এলাকাগুলোকে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত রাখার বিরোধিতা করে।

আফগান তালেবান ও পাকিস্তান তালেবান দুটি আলাদা সশস্ত্র গোষ্ঠী হলেও মতাদর্শগত জায়গা থেকে দুটি গোষ্ঠীর মিল রয়েছে।

আফগান প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা ইয়াকুব ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ কাতারের দোহায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষরের পর হাত মেলাচ্ছেন। ১৯ অক্টোবর, ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আফগ ন ত ল ব ন আফগ ন স ত ন মন ত র প রক শ

এছাড়াও পড়ুন:

সুন্দর থাকুন, আল্লাহ সৌন্দর্য ভালোবাসেন

মানুষের প্রকৃতিগত প্রবণতার মধ্যে সৌন্দর্যপ্রিয়তা ও সৌন্দর্যচর্চার আকাঙ্ক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ তায়ালা মানুষের হৃদয়ে সৌন্দর্যের প্রতি ভালোবাসা প্রোথিত করেছেন এবং মানবজাতিকে সেই ভালোবাসাকে সঠিক পথে চালিত করার নির্দেশনা দিয়েছেন।

ইসলাম শুধুমাত্র মানুষের বাহ্যিক রূপকে নয়, বরং অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা, আচরণ ও চিন্তাভাবনার সৌন্দর্যকেও গুরুত্ব দেয়। এই দ্বিমুখী সৌন্দর্যই একজন মুমিনের পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক।

নবীজির এই বাণীই ইসলামে সৌন্দর্যের মূলনীতি, “নিশ্চয় আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯১)

নিশ্চয় আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯১

যখন একজন মুসলিম মহাবিশ্বের দিকে তাকান, তখন তিনি আল্লাহর সৃষ্টিতে এই সৌন্দর্যের প্রতিফলন দেখতে পান।

আকাশকে আল্লাহ তারকারাজি দিয়ে সুশোভিত করেছেন (সুরা সাফফাত, আয়াত: ৬)।

পৃথিবীতে তিনি সৃষ্টি করেছেন নানা আকৃতি, রঙ, স্বাদ ও ঘ্রাণের শস্য ও ফল (সুরা ক্বাফ, আয়াত: ৭)।

এমনকি গৃহপালিত পশুদের মধ্যেও সৌন্দর্য রয়েছে, বিশেষত সকালে চারণভূমিতে যাওয়ার সময় এবং সন্ধ্যায় ফিরে আসার সময় (সুরা নাহল, আয়াত: ৬)।

মানুষকে আল্লাহ বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহ নিজেই মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে সৃষ্টি করেছেন (সুরা গাফির, আয়াত: ৬৪)।

এই সর্বব্যাপী সৌন্দর্য কেবল চোখকে আনন্দ দেয় না, বরং মানুষের অনুভূতিকে কোমল করে এবং হৃদয়ে এই সৌন্দর্যের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে।

সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের অধিকার ও দায়িত্ব

মহাবিশ্ব ও নিজের মধ্যে এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখার পর একজন মানুষের ওপর কিছু দায়িত্ব বর্তায়:

আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার: প্রথমে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, যিনি তাঁর সৃষ্টির ওপর এমন সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছেন। মানুষ তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে ওঠে, “হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। আপনি পবিত্র। সুতরাং জাহান্নামের আজাব থেকে আমাদের রক্ষা করুন।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯১)

কর্ম ও আচরণের সৌন্দর্য: মানুষকে অবশ্যই তার প্রতিটি কাজ, কথা বা উৎপাদিত পণ্যেও সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে হবে, যাতে সে তার চারপাশের মহাবিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে।

গভীর চিন্তাভাবনা: এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার প্রতিটি কোণে যদি এত সৌন্দর্য থাকে, তাহলে অনন্তকালের জন্য সৃষ্ট জান্নাত কেমন হবে? কীভাবে আল্লাহ তায়ালা সেই জান্নাতকে এমন চিরস্থায়ী নিয়ামত দ্বারা সুসজ্জিত করেছেন, যা দেখে মানুষ কখনও ক্লান্ত হবে না বা বিরক্ত হবে না?

আরও পড়ুনসুন্দর জীবন গড়ে তুলতে কোরআনের ৬ শিক্ষা২১ জুলাই ২০২৫শারীরিক সৌন্দর্য: আল্লাহর দান ও তার সীমা

শারীরিক সৌন্দর্য আল্লাহর দেওয়া একটি রিজিক, যা তিনি বান্দাদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। এটি আল্লাহর সুন্নাত যে কিছু মানুষ অন্যদের চেয়ে বেশি সুন্দর হবে। মানুষ সৌন্দর্য চর্চা করতে চায়, যা এক স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তি। ইসলামে হালাল উপায়ে সৌন্দর্যচর্চা করার অনুমতি রয়েছে।

তবে এই সৌন্দর্যচর্চা যখন সীমালঙ্ঘন করে ‘সৌন্দর্যের উন্মাদনা’ (The Obsession of Beauty)-তে পরিণত হয়, তখন তা ক্ষতিকর। কেউ কেউ নিজের অবস্থার ওপর কখনও সন্তুষ্ট হতে পারে না এবং বারবার অস্ত্রোপচার বা কৃত্রিম উপায়ে সৌন্দর্য কামনা করে, যা কেবল নিজের ক্লান্তি ও সম্পদের অপচয় ঘটায়। প্রখ্যাত কসমেটিক সার্জনরা পর্যন্ত এমন রোগীর অস্ত্রোপচার করতে অস্বীকৃতি জানান, যদি তারা মানসিক অবসেশন বা অপ্রাপ্তির উন্মাদনায় ভোগেন।

বাইরের সৌন্দর্য ও ভেতরের সৌন্দর্যের ভারসাম্য

কিছু মানুষ কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যকে অগ্রাধিকার দেয়, আর চরিত্রের সৌন্দর্য নিয়ে ভাবে না। এই পছন্দ যখন জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়—যখন একজন নারী বা পুরুষ কেবল সৌন্দর্যের ভিত্তিতে জীবনসঙ্গী বেছে নেয় এবং এই সৌন্দর্যকে সব দোষের ঊর্ধ্বে মনে করে—তখনই জটিলতা তৈরি হয়।

ইসলাম বাহ্যিক সৌন্দর্যের বিরোধী নয়, কারণ মানুষ তার জীবনসঙ্গীকে আকর্ষণীয় দেখতে চাইতেই পারে। তবে, কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দিলে তা অনেক সময় দাম্পত্য জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে।

কারণ, চারিত্রিক সৌন্দর্য না থাকলে বাহ্যিক সৌন্দর্য অহংকার, অসততা বা স্বামীর প্রতি অসন্তোষ তৈরি করতে পারে। স্ত্রী তখন নিজেকে সর্বদা আরও ভালো স্বামী ও জীবন পাওয়ার যোগ্য মনে করতে শুরু করে, যা দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নিয়ে আসে।

পক্ষান্তরে, উত্তম চরিত্র বাহ্যিক ত্রুটিগুলোকে মুছে দেয় বা তার প্রভাব কমিয়ে দেয় এবং সম্পর্কের স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করে।

কথার সৌন্দর্য: অন্তরের ছবি

নবীজি (সা.)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া ছিল, “হে আল্লাহ, যেমন তুমি আমার অবয়বকে সুন্দর করেছ, তেমনি আমার চরিত্রকেও সুন্দর করে দাও।” (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ২৫৯০৩)

যখন একজন মানুষের অন্তর সৌন্দর্যে ভরে যায়, তখন তার মুখ থেকে সুন্দর ও কল্যাণকর কথা বের হয়। আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে মুমিনদেরকে কথার শিষ্টাচার বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, “তোমরা মানুষের সঙ্গে উত্তম কথা বলো।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ৮৩)

একটি উত্তম বাক্য ভেঙে যাওয়া মনকে জোড়া লাগাতে পারে, গভীর মানসিক ক্ষত নিরাময় করতে পারে, আলস্য দূর করে উৎসাহ জোগাতে পারে এবং আল্লাহর প্রতি সুধারণার দরজা খুলে দিতে পারে।

অন্তর থেকে উৎসারিত বাক্য: মানুষের জিহ্বা তার হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। হৃদয়ে যদি মন্দ কথা জমা থাকে, তবে জিহ্বা তা-ই প্রকাশ করে। যে মুসলিম তার কথা, কাজ ও আচরণে সৌন্দর্য কামনা করে, সে তার অন্তরকে কল্যাণ দিয়ে ভরে তোলে এবং অশ্লীল কথা পরিহার করে।

অশ্লীলতা পরিহার: রাসুল (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ অশ্লীলতাকে অপছন্দ করেন, অথবা অশ্লীল ও অশ্লীলতা অবলম্বনকারীকে তিনি ঘৃণা করেন।” (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ২০৭৫৩)

কিছু মানুষ কঠোর ভাষা ব্যবহার করে এই ভেবে যে তা তাদের দুর্বলতা ও ত্রুটি গোপন করে সমাজে তাদের প্রভাব বজায় রাখবে। এটি এমন এক প্রকার কদর্যতা যা একজন মুসলিমের অবশ্যই পরিহার করা উচিত।

আরও পড়ুনআল্লাহর প্রতি সুন্দর ধারণা১৯ নভেম্বর ২০২৫ধৈর্যে, ক্ষমাশীলতায় ও দূরত্ব বজায় রাখায় সৌন্দর্য

একজন ব্যক্তি যত বেশি আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে পারে এবং নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তত বেশি সে সৌন্দর্যের অধিকারী হয়। এই সৌন্দর্য তিন ধরনের আচরণে প্রতিফলিত হয়:

সুন্দর ধৈর্য: ধৈর্য কঠিন, কারণ এটি ক্রোধের আবেগকে দমিয়ে রাখে। কিন্তু সৌন্দর্যপূর্ণ হৃদয়ের মানুষ এই তিক্ততা সহ্য করতে পারে। নবী ইয়াকুব (আ.)-কে যখন তাঁর সন্তানেরা জানাল যে ইউসুফকে নেকড়ে বাঘে খেয়েছে, তখন তিনি বলেছিলেন, “ফাসব্‌রুন জামিল” (সুতরাং সুন্দর ধৈর্য ধারণ করাই শ্রেয়)। (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৮৩)

সুন্দর ধৈর্য হলো অভিযোগমুক্ত ধৈর্য। এটি কেবল তখনই সম্ভব, যখন মুমিন মনে করে যে আল্লাহর ফয়সালা তার জন্য কল্যাণকর। রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণের চেষ্টা করে, আল্লাহ তাকে ধৈর্যশীল করে দেন।” (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ২৫৯৬০)

সুন্দর ক্ষমা: যখন হৃদয়ে সৌন্দর্য থাকে, তখন মানুষ সুন্দরভাবে ক্ষমা করে। ক্ষমা কষ্টকর, কারণ মানব মন প্রতিশোধ নিতে চায়। কিন্তু যে জানে আল্লাহ ক্ষমাশীলদের প্রতিদান দেন, সে নিজের প্রবৃত্তিকে দমন করতে পারে। সুন্দর ক্ষমা হলো প্রতিশোধের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অভিযোগহীন ক্ষমা করা।

সুন্দর বর্জন: সুন্দর বর্জন হলো, কারও থেকে দূরে সরে যাওয়া বা সম্পর্ক সাময়িকভাবে ছিন্ন করা, কিন্তু কোনো ধরনের ক্ষতি বা কষ্ট না দেওয়া। এর উদ্দেশ্য হলো ভালোবাসার শেষ সুতোটিকে বাঁচিয়ে রাখা, যেন আল্লাহ ভবিষ্যতে কোনো পুনর্মিলনের ব্যবস্থা করতে পারেন।

একজন ব্যক্তি যত বেশি আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে পারে এবং নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তত বেশি সে সৌন্দর্যের অধিকারী হয়।কণ্ঠস্বরের সৌন্দর্য

আকৃতি ও কাজের মতো কণ্ঠস্বরেও সৌন্দর্য থাকে। সুন্দর কণ্ঠস্বরের প্রশংসা করে রাসুল (সা.) আবু মুসা আশআরি (রা.)-কে বলেছিলেন,“যদি তুমি আমাকে গত রাতে তোমার কোরআন পাঠ শুনতে দেখতে! তোমার কণ্ঠকে নবি দাউদের সুরের মতো সুললিত দেওয়া হয়েছে।” (সুনানে বায়হাকি, হাদিস: ৩২০৬)

আবু মুসার কণ্ঠস্বরে কেবল নিয়ন্ত্রণই ছিল না, বরং আয়াতগুলোর নির্দেশনা ও বার্তা সম্পর্কে তাঁর হৃদয়ে গভীর অনুভূতি ছিল। ইবনে বাত্তাল বলেন, “কোরআনকে অলংকৃত করার অর্থ হলো এর জন্য কণ্ঠস্বরকে সুন্দর করা, যাতে হৃদয়ে তার প্রভাব গভীর হয় এবং তার উপদেশাবলী আত্মাকে আকর্ষণ করে।” (শারহু সহিহ আল-বুখারি, ১০/২৬৮, মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ, ২০০০)

কোরআন তেলাওয়াতের সময় যখন তেলাওয়াতকারী আল্লাহর ভয় হৃদয়ে ধারণ করেন, তখনই শ্রোতার ওপর তার প্রভাব পড়ে। রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “কোরআনে কার কণ্ঠস্বর সবচেয়ে সুন্দর?” তিনি বলেছিলেন, “যাকে দেখলে তুমি অনুভব করো যে সে আল্লাহকে ভয় করে।” (খালদুন আল-আহদাব, যাওয়াঈদ তারিখ বাগদাদ আলাল কুতুবুস সিত্তা, ৮/১১৭, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৯৫)

দেহের সৌন্দর্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ম্লান হয়, কিন্তু উত্তম আচরণের সৌন্দর্য চিরস্থায়ী ও সুদৃঢ়।সৌন্দর্য চর্চার মাধ্যম

সৌন্দর্যচর্চা দুই ভাবে হতে পারে—

১. প্রসাধনী ও মিথ্যা দিয়ে সৌন্দর্য: মানুষ প্রসাধনী ব্যবহার করে কাঙ্ক্ষিত ছবি ফুটিয়ে তুলতে চায়। কেউ কেউ আবার দুর্বলতা লুকাতে মিথ্যা বলে বা যা নেই তার দাবি করে। এই কৃত্রিমতা দ্রুতই প্রকাশ পায়। এর চেয়ে উত্তম হলো, আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতগুলো দিয়ে সৌন্দর্যচর্চা করা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে পছন্দের গুণ অর্জন করা।

আত্মার পরিশুদ্ধি দ্বারা সৌন্দর্য: প্রতিটি মানুষের মধ্যে কিছু ত্রুটি থাকে। আত্মার ক্রমাগত পরিশুদ্ধির মাধ্যমে এই ত্রুটিগুলো সংশোধন করা সম্ভব। যত পুরনো বা গভীরে প্রোথিতই হোক না কেন, আন্তরিকতা ও চেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সাহায্য লাভ করা যায় এবং ভেতরের সৌন্দর্য বিকশিত হয়।

পারিবারিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক পর্যায়ে এই সৌন্দর্যের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা উচিত, যেন মানুষ কেবল বাইরের চাকচিক্য নয়, বরং আচরণ, কথা ও কাজে সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দেয়। মনে রাখতে হবে, দেহের সৌন্দর্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ম্লান হয়, কিন্তু উত্তম আচরণের সৌন্দর্য চিরস্থায়ী ও সুদৃঢ়।

আরও পড়ুনসুন্দর আচরণ ও উত্তম ব্যবহার ইবাদত০৮ আগস্ট ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ