টিলার বুকে ক্ষত বাড়াচ্ছে লাল বালুর নেশা
Published: 28th, January 2025 GMT
চুনারুঘাটের অন্তত ১০টি ইউনিয়নে রীতিমতো তাণ্ডব চালাচ্ছে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীরা। এর মধ্যে শানখলা ইউনিয়নের পানছড়ি ইকো রিসোর্ট-সংলগ্ন স্থানসহ কালিনগরের গাধাছড়ায় পাহাড় ও টিলা কেটে সাবাড় করছে চক্রটি।
এ অঞ্চলে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের প্রতিযোগিতায় মেতেছে বালু ব্যবসায়ীদের একাধিক চক্র। প্রশাসনের অভিযানেও লাগাম টানা যাচ্ছে না তাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের। টিলা ও পাহাড় ছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাগান, ছড়া, খাল ও নদী থেকেও বেপরোয়াভাবে বালু উত্তোলন করছে অবৈধ বালু ও মাটি ব্যবসায়ীরা।
প্রায় প্রতিদিনই উপজেলার বিভিন্ন নদী, খাল ও ছড়া থেকে শক্তিশালী ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করছে চক্রের সদস্যরা। সেই সঙ্গে টিলা ও পাহাড়ি বনাঞ্চলও ধ্বংস করছে তারা। যেসব স্থান থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, সেখানকার রাস্তাঘাট, ফসলি জমিসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ড্রেজার মেশিন ও বালু পরিবহনে ব্যবহৃত ডাম্প ট্রাক ও ট্রাক্টরের বিকট শব্দে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। যেখানে সেখানে বালু উত্তোলন করায় পথঘাট নষ্ট হচ্ছে। এ অবৈধ বালু ব্যবসা চলছে প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায়। যার কারণে স্থানীয়রা প্রতিবাদও জানাতে পারে না।
উপজেলার বিভিন্ন নদী-খাল-ছড়া থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে নেওয়া হচ্ছে এসব চক্রের মাধ্যমে। স্থানীয়রা বলছেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) এক জায়গায় বালু তোলা বন্ধ করলে চক্রের সদস্যরা অন্য জায়গায় বালু তোলা শুরু করে। বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযান চালিয়ে সরঞ্জাম জব্দ করা হলেও উত্তোলন করা বালু বিক্রিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে না।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে পানছড়ি ও গাধাছড়ার বিভিন্ন এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়ে গেছে। এদের মধ্যে সম্প্রতি সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে পাহাড় কেটে বালু সংগ্রহকারী চক্রটি। এ ঘটনায় সম্প্রতি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে হবিগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর। এরপরেও থেমে নেই পাহাড় খুবলে খাওয়ার প্রতিযোগিতা। গত বছরের ১৩ নভেম্বর চুনারুঘাট থানায় করা মামলায় চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জামিনে বের হয়ে এসে আবারও তারা একই কাজে লিপ্ত হন।
বালু ব্যবসায়ীদের অভিনব কায়দায় টিলা কেটে বালুতে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া চোখে পড়ার মতো। তারা প্রথমে মেশিনের সাহায্যে পানির চাপ দিয়ে টিলার নিচের অংশ পানিতে নিমজ্জিত করে। এক পর্যায়ে নিচের অংশ থেকে ধীরে ধীরে মাটি সরে গিয়ে টিলার উপরিভাগ থেকে গড়িয়ে সৃষ্ট গর্তের মতো অংশে পুরো টিলা ধসে পড়ে। পরে সেই পানির মধ্যে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালুতে রূপান্তরিত করা হয়। এভাবে এলাকাজুড়ে অন্তত ২০ থেকে ২৫টি শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে টিলা ধসিয়ে বালু সংগ্রহ করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, স্থানীয় এক বালু উত্তোলনকারী শ্রমিক জানান, ওই এলাকার আমজত উল্লার নেতৃত্বে ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দল বালু তোলার কাজ করছেন। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন শ্যালো মেশিন চালানো হচ্ছে টিলার বুকে; দিন-রাত চলে বালু তোলার কাজ। ডাম্প ট্রাকসহ ভারী মালবাহী যানবাহনে করে এসব বালু পরিবহন করা হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে।
একটি স্থানে কর্মরত শ্রমিকদের একাংশ জানান, শতাধিক শ্রমিক ছোটখাটো শিল্প কারখানার মতোই বালু তোলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। পাহাড় ও টিলা কেটে বালু উত্তোলনের সেগুলো স্তূপ করে রাখা হচ্ছে আরেক টিলায়। কেউ কেউ আবার ডাম্প ট্রাক কিংবা ট্রাক্টরে আনলোড করছেন মালপত্র। প্রায় ২০ থেকে ২৫টি নিষিদ্ধ ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করে পাহাড়ের ১০ থেকে ১৫টি স্পটে চলছে বালু তোলার কাজ। পাহাড়ি ছড়ার পানি সেচ দিয়ে শ্রমিকরা এসব স্পট থেকে বালু তুলছেন। এভাবে দৈনিক কয়েক লাখ টাকার বালু সংগ্রহ করা হচ্ছে পাহাড়ি টিলা কেটে। এ বিষয়ে জালাল নামে এক ব্যক্তি জানান, বালু উত্তোলনের কাজ করে সংসারের খরচ চালান তারা। এর বেশি কিছু জানেন না। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় তহশিলদার এবং বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততায় গড়ে উঠেছে বালুখেকোদের এ চক্র। নামসর্বস্ব একাধিক সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরাও রয়েছেন তাদের চক্রে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বালুখেকো চক্র লালচান্দ চা বাগানের বিভিন্ন ছড়া থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করে পাচার করছে দীর্ঘদিন ধরে। দৈনিক কমপক্ষে ১৫ থেকে ২৫ ট্রাক্টর বালু পাচার হয় ওই বাগান থেকে। বাগানের ভুলকিছড়া, কাঁঠালবাড়ি, শাহজিবাজার টিলাসহ বিভিন্ন ছড়া থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রির জন্য নির্ধারিত স্থানে নিয়ে আসা হয়। পরে সেখান থেকে ট্রাক্টরযোগে বালু পাঠানো হয় নির্ধারিত গন্তব্যে। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করায় বাগানের পরিবেশ বিপন্ন। সেই সঙ্গে সেখানকার স্থানীয় সড়ক ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। একইভাবে বিভিন্ন বাগানের ভেতরে থাকা টিলাগুলোও কেটে নেওয়া হচ্ছে। ছড়া থেকে বালু উত্তোলন হলে টিলাগুলো ধীরে ধীরে ধসে যাচ্ছে। পরে সেখান থেকেও বালু সংগ্রহ করা হচ্ছে।
উপজেলার শানখলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম জানান, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের ফলে ব্রিজ ও রাস্তার ক্ষতি হচ্ছে। বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। চা বাগান ব্যবস্থাপক মোফাজ্জল হোসেন জানান, বালু চুরি বন্ধে তিনি কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। বাগানের চৌকিদারদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল জানান, চা বাগানের ভেতর থেকে বালু উত্তোলন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। চুনারুঘাট উপজেলা ভূমি সহকারী কমিশনার মাহবুব আলম মাহবুব জানান, জায়গাটি দূরবর্তী হওয়ায় অভিযান পরিচালনায় সমস্যা হচ্ছে। তা ছাড়া পুলিশে জনবল সংকট থাকা ও নজরদারি করা যাচ্ছে যথাযথভাবে।
স্থানীয়দের ক্ষোভ, বালুবাহী ডাম্প ট্রাক চলতে চলতে রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়ে গেছে। বছরের পর বছর ধরে নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে টিলা ও পাহাড়ি বনাঞ্চল। এই বালু উত্তোলন একটা সিন্ডিকেটে যারা কাজ করছে তারা প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক বালু পাচার করছে। প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করলেও মূল হোতাদের নাগাল কখনোই কেন পায় না, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দুর্গম পাহাড় কেটে যে রাস্তা করছে, তা বন্ধ করে দিয়ে সিলগালা করে দিতে হবে।
ইউএনও রবিন মিয়া জানান, অভিযানে এরই মধ্যে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। অবৈধ বালু উত্তোলন ও মাটি কাটার বিরুদ্ধে একের পর এক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। উপজেলাজুড়ে অভিযান চলমান।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: উপজ ল র ব ভ ন ন অব ধ ব ল পর ব শ ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হলো একটু সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রূপান্তর এগিয়ে নেওয়া। এ জন্য যে ধরনের সংস্কার দরকার, সেই সংস্কার নিশ্চিত করা। আর কয়েক মাস পর নির্বাচন। নির্বাচন ভালোমতো করার জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করার জন্য এখন মনোযোগ দেওয়া দরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করা। পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনা। অথচ এসব দিকে সরকারের মনোযোগ বা সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না।
নির্বাচনের এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে যেটিতে তাদের এখতিয়ার নেই, সেই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতেই সরকারের যত আগ্রহ। রীতিমতো জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে। দেশের মানুষ, বিশেষজ্ঞ—কারও কথা না শুনে, জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা না করে ভয় দেখিয়ে একের পর এক চুক্তি করছে সরকার।
একটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার কোনো এখতিয়ার এ রকম অস্থায়ী সরকারের থাকে না। এসবের জন্য নির্বাচিত সরকার দরকার হয়। শুধু নির্বাচিত সরকারও এভাবে করতে পারে না। নির্বাচিত সরকার এ ধরনের চুক্তি করলে সেগুলো সংসদে তুলতে হবে, সেখানে তর্ক-বিতর্ক হবে, দেশের মানুষ জানবে। আর কয় মাস পর নির্বাচন। এই সময় সরকারের এই ধরনের চুক্তিতে এত আগ্রহ কেন? বন্দর নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি যদি দেশের উন্নয়নের জন্যই হয়, তাহলে এত গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা ও তাড়াহুড়া কেন?
চুক্তি নিয়ে এই সরকারের অতি আগ্রহ বড় সন্দেহের কারণ। মনে হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির কিছু লবিস্ট এই সরকার চালাচ্ছে। তাদের কাজ হলো কোনো না কোনোভাবে বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় গোপনে অস্বচ্ছভাবে চুক্তি করে ফেলা। সেটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, যাতে পরবর্তী কোনো সরকার এসে কিছু করতে না পারে। কিন্তু এই চুক্তির বোঝা বাংলাদেশের মানুষকে ভোগ করতে হবে বহু বছর।
গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, স্বচ্ছতা নিয়মনীতি মেনে কাজ হবে, তার প্রতি এটা বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়। একই সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক দল সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলাপ-আলোচনা করছে, অথচ সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা নিয়ে তারা যে নিশ্চুপ থাকল, সেটার দায়িত্বও তাদের নিতে হবে।
আমরা দেখেছি, এ রকম চুক্তির আগে সব সময় যুক্তি দেওয়া হয়, বিদেশি কোম্পানি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কোম্পানি। আবার মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি করা হয় যে আমরা পারব না। আমাদের পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়। বিদেশিরা এলে কাজ হবে। আবার আমরা থাকলে দুর্নীতি হবে। বিদেশিরা এলে দুর্নীতি হবে না। এই হীনম্মন্যতা তৈরি করে এবং তার ওপর ভর করে বিদেশি কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। বিদেশিদের পক্ষে বিজ্ঞাপনী প্রচার চালাতে থাকে তাদের সুবিধাভোগী দেশি লোকজন। কিন্তু বিদেশিরা এলে যে দুর্নীতি হবে না, সেটার নিশ্চয়তা কীভাবে দেওয়া হয়? আন্তর্জাতিকভাবে কি দুর্নীতি হয় না? চুক্তির আগে মাশুল যে বাড়ানো হলো, এটাও তো দুর্নীতির একটা ধরন।
বিদেশি কোম্পানি যে দক্ষ, আন্তর্জাতিক যে স্বীকৃতি, সেই কোম্পানিগুলো কিন্তু এমনিতেই গড়ে ওঠেনি। জাতীয় সক্ষমতার প্রক্রিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠেছে এসব কোম্পানি। বাংলাদেশকেও জাতীয় সক্ষমতার ওপর দাঁড়াতে হবে। সে জন্য নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। একটা দেশ শক্তভাবে দাঁড়াতে পারে, যখন নিজের সক্ষমতা তৈরি হয়। এই সরকার দেশকে বিপন্ন করে তার উল্টো দিকে যাত্রা করছে।
লেখক পরিচয়: অর্থনীতিবিদ ও সম্পাদক, সর্বজনকথা