‘পাকিস্তান’ থেকে ‘বাংলাদেশ’ আবুল মনসুর আহমদের বিচার
Published: 14th, March 2025 GMT
আবুল মনসুর আহমদ মশহুর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে কয়টা অল্প নজির রয়েছে, যাঁরা একাধারে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে সমভাবে সফলতার মুখ দেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ অন্যতম। দেশভাগ-পূর্ববর্তী পাকিস্তান আন্দোলন থেকে শুরু করে বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচনহ পুরো পাকিস্তান আমল এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ হওয়ার পরও রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুই পরিসরে তিনি ছিলেন সক্রিয়। তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং আত্মজৈবনিক রচনাগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চার অন্যতম আকর উপাদান।
বাংলাদেশের আরও বহু বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতার মতো আবুল মনসুর আহমদও পাকিস্তান আন্দোলন এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর এমন সব আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, যা দিন শেষে পাকিস্তানকে ভেঙে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটিয়েছিল। ২০-২৫ বছরের মধ্যে দুটি রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আবুল মনসুর আহমদ কীভাবে এই দুটি ঘটনাকে বিচার করেছিলেন, তার সংক্ষিপ্ত অনুসন্ধানে তাঁর দুটি প্রবন্ধের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
পাকিস্তান নামক ধারণা বা কল্পনাকে তিনি কীভাবে দেখেছিলেন, তার সাক্ষ্য পাওয়া যায় ১৯৪২ সালে লিখিত ‘পাকিস্তানের বিপ্লবী ভূমিকা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে; অন্যদিকে ১৯৭২ সালে তাঁর আরেকটা লেখা পাওয়া যায় (শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু বইয়ের ভূমিকা) যেখানে তিনি পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
আবুল মনসুর আহমদ ১৯৪২ সালে ‘পাকিস্তান’কে ‘রাষ্ট্র-বিপ্লব’ এবং ‘ভাব-বিপ্লব’ বলে সাব্যস্ত করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সাম্যবাদের বৈশ্বিক লড়াইয়ের অংশ হিসেবে যেমন পাকিস্তান নামক ধারণাকে দেখেছিলেন, তেমনি দেখেছিলেন ‘অখণ্ড ভারতের’ সাম্রাজবাদী বাসনার প্রতিবাদ হিসেবে। এই সাম্রাজ্যবাদী বাসনাকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ইউরোপের ‘শাসন ও ব্যাপারীগিরি’র প্রবণতার সঙ্গে তুলনা করে।
তাঁর মতে, ভারতবর্ষেও তখন ‘অখণ্ড ভারত’ নামক একটা বিশাল সাম্রাজ্যবাদী মুখও সবাইকে গ্রাস করতে চেয়েছিল। সেই মুখ ‘বর্ণে, চেহারায়, খাদ্যে, পোশাকে, ধর্মে, ভাষায় সম্পূর্ণ গরমিল চল্লিশ কোটি আদম-সন্তানকে “একজাত” বলে ঘোষণা করা হচ্ছে; তাদেরকে রাজধানী থেকে শাসন করার দাবি করা হচ্ছে।’ তারাও এক জায়গার সম্পদ নিয়ে আরেক জায়গায় ইমারত গড়তে চায়, এক জাতির টাকা দিয়ে আরেক জাতিকে চাকরি দিতে চায় এবং এক জাতির মাতৃভাষাকে অপর জাতির রাষ্ট্রভাষারূপে চালিয়ে দিতে চায়। এই জবরদস্তির নাম দেওয়া হয়েছে ‘জাতীয়তা’ ও ‘দেশপ্রেম’।
এই একজাতীয়তার বিরুদ্ধে ‘পাকিস্তান’–এর অবস্থান, আবুল মনসুর আহমদের যুক্তি মোতাবেক, গণতন্ত্র এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁর অবস্থানের সপক্ষে একটি ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও হাজির করেছেন তিনি। তাঁর মতে, ফ্যাসিবাদ ও গণতন্ত্রের বিরোধ যেখানে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ ও সর্বশক্তিধারী স্বৈরশাসকের বিরোধও সেখানে। খোদা দুনিয়াকে একরূপী না করে, ‘পয়দা করেছেন বিচিত্র দুনিয়া, আর বহুরূপী আদমজাতি’। দুনিয়ার স্বৈরশাসক সেই বৈচিত্র্যকে ভেঙে একরূপী করতে চাইলেও, তার ‘একরূপিত্বের সাম্যটা শুধু বাইরের খোলস, আসলে সেটা দাসত্ব’। তাঁর মতে, স্বৈরশাসকের মতলব ‘সাম্য প্রতিষ্ঠা নয়, স্রেফ নকল-নবিসীর প্রতিষ্ঠা। আরো সোজা কথা, গোলামির প্রতিষ্ঠা। অতএব, একরূপিত্বের জবরদস্তী খোদায়ী আইনের—সুতরাং গণতন্ত্রেরও বিরোধী।’
অর্থাৎ ‘অখণ্ড ভারত’ ধারণার মধ্যে যে ‘একরূপিত্বে’র বাসনা আছে, সেটা আবুল মনসুরের মতে, ফ্যাসিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও স্বৈরাচারমূলক। তার বিপরীতে পাকিস্তান ধারণা সাম্যবাদী, ভ্রাতৃত্বমূলক ও গণতান্ত্রিক—সেটা ধর্মীয় বিচারেও। তাঁর মতে, এখানেই আসলে পাকিস্তানের ‘বামপন্থী বিপ্লবী’ ভূমিকা। তাঁর কাছে ‘জাতি’ আসলে নির্মিত এক ধারণা, নানাবিধ প্রপঞ্চের মাপকাঠি বা সাপেক্ষে এটি তৈরি হয়। ফলে যখন পাকিস্তানিরা হিন্দু-মুসলিম দুই ‘জাতি’ত্বের কথা বলেন, তখন সেটাকে কেবল গোড়ার কথা বা সাময়িক যুক্তি দিয়ে না দেখে ‘বিষয়বস্তু ও সম্ভাব্য পরিণাম’ দিয়ে বিচার করাই উচিত বলেই তিনি মনে করেন। পাকিস্তানের মূলকথা শুধু ধর্মীয় ভিত্তি নয়, কেননা ‘ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্টি, ভাষা ও সভ্যতার কথাও অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়ানো রয়েছে’।
আবুল মনসুর আহমদ যখন পাকিস্তানকে ‘বিপ্লব’ বলে ঘোষণা দিচ্ছেন, তাঁর যুক্তি দাঁড়িয়ে আছে ‘অখণ্ড ভারত’-এর কাল্পনিক একরূপিতার জবরদস্তিমূলক শাসনের ওপর। তিনি পাকিস্তানকে কল্পনা করছেন একরূপিতার জবরদস্তিমূলক বন্দোবস্তের বিপরীতে গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী ধারণা হিসেবে।
‘পাকিস্তান’-এর যে কল্পনা আবুল মনসুর আহমদ করেছিলেন, তার ‘অভাব’ই যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভাঙনের কারণ হয়ে উঠেছিল, সেটা তিনি বাহাত্তরের জানুয়ারি মাসে লিখিত প্রবন্ধে বলেছিলেন। তাঁর কাছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কোনো আকস্মিক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এই ‘নবলব্ধ আজদি অতীত সংগ্রামসমূহের সমষ্টিগত ফল’।
কিন্তু এই যে পাকিস্তান ভেঙে গেল, এটা কেন হলো? পাকিস্তান ভাঙার অন্যতম উপাদান হিসেবে তিনি দেখছেন ‘দুনিয়ার জঘন্যতম গণহত্যা ও গৃহযুদ্ধ’। আবুল মনসুর আহমদ যখন ‘পাকিস্তান’ ধারণা নিয়ে ১৯৪২ সালে লেখেন, তখনো গণতন্ত্র ছিল তাঁর অন্যতম চাবিধারণা। ১৯৭২ সালে এরই ধারাবাহিকতায় বলছেন, ‘গণতন্ত্রের অভাবেই ১৯৪৭ সালের পরিকল্পিত “এক অখণ্ড পাকিস্তান” টিকিল না।’
তাঁর মতে, জিন্নাহ পাকিস্তানের গণপরিষদে যে ‘বুনিয়াদী ওসিয়ত সেকিউলার গণতন্ত্রের’ ঘোষণা করেছিলেন, জিন্নাহর মৃত্যু-পরবর্তী শাসকেরা সেই গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিয়েছিলেন বলেই সেখানে স্থান নিয়েছিল আমলাতান্ত্রিক সামরিক শাসন, সাম্প্রদায়িক পীড়ন ও আঞ্চলিক শোষণ। অর্থাৎ গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিই পাকিস্তান ভাঙার অন্যতম কারণ হিসাবে আবুল মনসুর আহমদ চিহ্নিত করেছিলেন।
এরপর তাঁকে আরও তিনটি প্রশ্ন সামাল দিতে হয়েছে। প্রথমত, লাহোর প্রস্তাব কি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে? দ্বিতীয়ত, দেশভাগ বা দেশ বাঁটোয়ারার উদ্দেশ্য কার দোষে ব্যর্থ হয়েছে? এবং তৃতীয়ত, মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্ব কি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে? প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আবুল মনসুর আহমদ জানাচ্ছেন, লাহোর প্রস্তাবে দুটো মুসলিম-মেজরিটি রাষ্ট্রের কথা ছিল। সেটাকে বরখেলাপ করে দুটো রাষ্ট্রকে এক রাষ্ট্র বানিয়ে এবং একটাতে বসে আরেকটা শাসনের যে চেষ্টা করা হয়েছিল, আদতে সেটা ব্যর্থ হয়েছিল। অর্থাৎ প্রথম প্রশ্নের আবুল মনসুর আহমদের জবাব হচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘লাহোর প্রস্তাবের নির্ভুলতা প্রমাণিত হইয়াছে’।
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের এই যে সমালোচনা, ‘একটি রাষ্ট্রে বসিয়া অপরটি শাসন করিবার চেষ্টা’, সেটার সিলসিলা বিয়াল্লিশে তাঁর ‘পাকিস্তান’ কল্পনার মধ্যেই পাওয়া যায়। যে যুক্তিতে তিনি অখণ্ড ভারতের সমালোচনা করেছিলেন, সেই যুক্তির ভেতরেই রয়েছে তার অখণ্ড পাকিস্তানের সমালোচনার বীজ।
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে তিনি জানাচ্ছেন, সাতচল্লিশের দেশভাগ বা ভারত বাঁটোয়ারার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, তাঁর মতে, ‘হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধান’। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকেরা বাঁটোয়ারার এই ‘স্পিরিট’ ও উদ্দেশ্যকে ভুলে গিয়ে সেকুলার গণতন্ত্রের পথ বিসর্জন করেছিলেন। দেশ বাঁটোয়ার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছিল পাকিস্তানের শাসকদের দোষেই। তাঁর মতে, পাকিস্তানের শাসকেরা এই সেক্যুলার গণতন্ত্রের পথ বর্জন করে ইসলামি রাষ্ট্রের স্লোগান দিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের অমুসলমানদের যেমন বিপন্ন করেছিলেন, তেমনি ভারতের মুসলমানদেরকেও বিপন্ন করেছিলেন। ফলে দেশ বাঁটোয়ারার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হলেও তার কারণ উবে যায়নি; এবং এই ‘অসাফল্যের জন্য বাঁটোয়ারা দায়ী নয়, বাঁটোয়ারা প্রয়োগের ত্রুটিই এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী’।
এরপরে আসে তৃতীয় প্রশ্ন: স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে কি ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ মিথ্যা বা ভুল প্রমাণিত হয়েছে? আবুল মনসুর আহমদের উত্তর হচ্ছে, না; দ্বিজাতিতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি, মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে ‘ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র’। ইসলামের দোহাই দিয়ে দূরবর্তী ভৌগোলিক, ভাষিক ও কৃষ্টিক দেশকে এক রাষ্ট্রে বাধার যে চেষ্টা, সেটা ব্যর্থ হয়েছে।
তাঁর মতে, সাতচল্লিশের বাঁটোয়ারাটা ধর্মের ভিত্তিতে হয়নি, ধর্মাবলম্বীদের ভিত্তিতে হয়েছিল। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ নিয়েই দ্বিজাতিতত্ত্ব বলা হতো। এই স্লোগানেও, তাঁর মতে, মুসলিম লীগের ভুল ছিল। কেননা, লাহোর প্রস্তাব ভারতবর্ষকে হিন্দু ও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে ভাগের কথা বললেও, সেখানে ‘তিনটি নেশন স্টেট’–এর কল্পনা ছিল। মুসলিম লীগের নেতারা তিন নেশনের জায়গায় দুই নেশনের থিওরি প্রয়োগ করাই তাদের মতবাদ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে আসলে লাহোর প্রস্তাবই সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
পাকিস্তান আন্দোলন ও বাংলাদেশ আন্দোলন নিয়ে পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠীর যে পৃথক লড়াই ও কল্পনা ছিল, তার খুব স্পষ্ট করেই আবুল মনসুর আহমদের জবানে ধরা পড়ে। ১৯৭১ সালে কলকাতার বিদ্বৎসমাজে এবং বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী প্রভাবশালী ইতিহাসচর্চায় এই দুই আন্দোলনকে পরষ্পরবিরোধী হিসেবে দেখা হয়। কখনো কখনো মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তান আন্দোলনের ভ্রমসংশোধন ও থিসিসি বা অ্যান্টিথিসিস আকারেও দেখা হয়ে থাকে। এমনতর প্রভাবশালী রেওয়াজের বিপরীতে আবুল মনসুর আহমদের ভাষ্য এক নতুন ধরনের ইঙ্গিত প্রদান করছে। বাংলাদেশ নামক জনগোষ্ঠীর পৃথক রাষ্ট্রকল্পনা, এমনকি সেটা পাকিস্তান আন্দোলনের কালেও, বিদ্যায়তনিক জগতেও খুব একটা অস্বীকৃত নয়। আবুল মনসুর আহমদের কাছে দেখা যাচ্ছে, পার্টিশন বা বাঁটোয়ারা বা দ্বিজাতিতত্ত্ব বা পাকিস্তান ধারণা কোনোটাই ভুল ছিল না, বরঞ্চ এগুলো
তৎকালীন সমস্যার সমাধান হিসেবেই হাজির হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র যে ওয়াদা নিয়ে গঠিত হয়েছিল, তা আর ধারণ করতে পারেনি, অথবা পাকিস্তানি শাসকেরা সেই ওয়াদা
রাখতে পারেননি। তার পরিণতি হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
আবুল মনসুর আহমদের এই যে বিচার, সেটাও আচানক নয় আমাদের সাহিত্যে। যদিও বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চায় এই বয়ান এখনো উপেক্ষিত, কিন্তু সে সময়ের প্রায় সব জাতীয়তাবাদী নেতা, অথবা যেসব নেতা ও ব্যক্তিত্বকে পরবর্তী জাতীয়তাবাদীরা উদ্যাপন করেন, তাঁদের মধ্যেও এই ধরনের সুর পাওয়া যায়। যাঁরা পাকিস্তান আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর ধীরে ধীরে বাংলাদেশে আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়েছিলেন, তাঁরা প্রায় সবাই একই ধরনের কথা বলেছিলেন। একটা স্বপ্ন থেকে পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হওয়া এবং ধীরে ধীরে সেই স্বপ্নের ভাঙনের ধারাবিবরণী শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে প্রবলভাবেই পাওয়া যায়।
রণাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধারা, ১৯৭১.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ ব জ ত তত ত ব গণতন ত র র র জন ত ক কর ছ ল ন একর প ত ম সলম ন প রবন ধ হয় ছ ল র র জন
এছাড়াও পড়ুন:
সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর চালুর প্রস্তাব কমিশনের, আলোচনায় উত্তেজনা
সংসদের উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে সদস্য নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ আলোচনায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিনের উদ্দেশে জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২–দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা কটাক্ষ করে বলেন, ‘২৩ সালে কোথায় ছিলেন?’ তাঁর এ মন্তব্যে সংলাপে উত্তেজনা তৈরি হয়। পরে ক্ষমা চান এহসানুল হুদা।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২৩তম দিনের সংলাপের একপর্যায়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারে দেখা গেছে, বেলা ১টা ৫০ মিনিটের পরে পিআর নিয়ে বিএনপির অবস্থান ব্যাখ্যা করে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তাঁরা সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা উচ্চকক্ষের হাতে দিতে চান না।
উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিরা অনির্বাচিত হবেন উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা থাকে না। তিনি বক্তব্য শেষ করার পর এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, ভোটের সংখ্যানুপাতিকের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠিত হলে সেটি তো জনগণের প্রতিনিধিত্বের প্রতিফলন হয়। এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন রাসিন।
তখন সালাহউদ্দিন আহমদ একটি ব্যাখ্যা দেন। তখনই জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২–দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা মাইক ছাড়াই জাবেদ রাসিনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘২০২৩ সালে যখন আন্দোলন হচ্ছিল, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন?’ তখনই জাবেদ রাসিন তাঁর প্রতিবাদ করেন (মাইক ছাড়াই) এবং এ নিয়ে সংলাপে উত্তেজনা তৈরি হয়।
তাঁদের দুজনই মাইক ছাড়া পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেন। তখন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘হুদা ভাই, এর আগেও আপনারা একজনের বক্তব্য নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। তখন আমরা থামিয়েছিলাম। এখানে আমরা কে কেন এসেছি, সে প্রশ্ন তুললে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কারণ, আজকে যদি সে প্রশ্ন করেন, তাহলে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আমাকেও সে প্রশ্ন করতে পারেন। আমরা সে আলোচনায় যাচ্ছি না।’
তারপর এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘তিনি (এহসানুল হুদা) এই কথা বলতেই পারেন না।’ এ সময় সালাহউদ্দিন আহমদ তাঁর পিঠ চাপড়ে থামতে অনুরোধ করেন। আখতার তখন বলতে থাকেন, ‘আমরা বাচ্চাকাল থেকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছি।’
এ পর্যায়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘কারও লোকাস স্ট্যান্ডি (অধিকার/ সামর্থ্য) নিয়ে প্রশ্ন করার দরকার নেই। প্রত্যেকের লোকাস স্ট্যান্ডি আছে বলেই আমরা এই জায়গায় আসতে পেরেছি।’ তখন আখতার বলেন, ‘গায়ের জোরে এসব প্রশ্ন করলে তো আমরা মানব না।’
আলী রীয়াজ তখন বলেন, ‘আমি তো হস্তক্ষেপ করলাম।’ আখতার তখনো বলতে থাকেন, ‘সবাইক নিয়ে আমরা গণ–অভ্যুত্থান করেছি। গোটা অভ্যুত্থানে ছাত্র–জনতা মাঠে নেমে এল, সেটার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। এটার জন্য ওনার ক্ষমা চাওয়া উচিত।’
এ সময় সালাহউদ্দিন আহমদকে বলতে শোনা যায়, ‘আচ্ছা হুদা ভাই, আপনি সরি বলেন।’ এ সময় গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জেনায়েদ সাকি এ বিষয়ে কথা বলতে উঠে দাঁড়ালে আলী রীয়াজ তাঁকে অনুরোধ করে বসিয়ে দেন। তখন জোনায়েদ সাকি কিছু একটা বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু মাইক না থাকায় তা শোনা যায়নি। এ সময় সালাহউদ্দিন আহমদ তখন এহসানুল হুদাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘কেউ যদি মনে কষ্ট পেয়ে থাকে তার জন্য সরি বলেন।’
তখন এহসানুল হুদা মাইক নিয়ে বলেন, ‘আমি বলতে চেয়েছিলাম, ২০২৩ সালে আমরা উচ্চকক্ষের প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তখন সে প্রস্তাবটি (পিআর) কোথায় ছিল? তারপরও কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকে, আমি দুঃখিত।’
এরপরই আলী রীয়াজ মধ্যাহ্নভোজের বিরতি ঘোষণা করেন। বিরতির সময়ে সম্মেলনকক্ষে এহসানুল হুদাকে আবার আখতারের কাছে তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁর সঙ্গে কোলাকুলি করতে দেখা যায়। তখন হুদাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার অনুরোধ, আমরা এটা নিয়ে আর সিনক্রিয়েট না করি। আমার আপনাদেরকে নিয়ে প্রশ্ন করার ইনটেনশন (উদ্দেশ্য) ছিল না।’ তখন পাশ থেকে একজনকে বলতে শোনা যায়, আপনার এটা নিয়ে প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি। পরে আখতার এহসানুল হুদাকে জাবেদ রাসিনের সঙ্গে কোলাকুলি করিয়ে দেন।
আজকে সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগ বিধানসম্পর্কিত বিধান; উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার; রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ; রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব ; তত্ত্বাবধায়ক সরকার; নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণসম্পর্কিত প্রস্তাব এবং রাষ্ট্রের মূলনীতির বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
আজকে আলোচনা শুরুর সময় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করব, দ্রুত চূড়ান্ত সনদ প্রস্তুত করে আপনাদের হাতে তুলে দিতে। এর ভিত্তিতে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও করা হবে।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, আজকের মধ্যেই আলোচনা পর্বের সমাপ্তি টানা সম্ভব হবে। আলোচনা শেষে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে এবং যেসব বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা দ্রুত দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।