ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আমরা সবকিছুই খুব প্রফেশনালভাবে নিষ্পত্তি করতে চাই।

আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’ (দ্বিতীয় খসড়া) এর ওপর একটি মতবিনিময় সভায় আসিফ নজরুল এসব কথা বলেন।


আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন করা হবে। ‘ফরহাদ (ফরহাদ মজহার) ভাই, বারবার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের কথা বলেছেন। ট্রুথ জাস্টিস কমিশন অথবা ট্রুথ রিকনসিলিয়েশন কমিশনের খুব দরকার আছে। এটা সম্ভবত আমাদের দেশে ১৯৭২ সাল থেকে থাকলেই ভালো হতো। আমরা সবকিছুই খুব প্রফেশনালভাবে নিষ্পত্তি করতে চাই। .

..আমরা ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন করব।’ এজন্য প্রধান উপদেষ্টা এবং আমি সাউথ আফ্রিকায় যাব। ফিরে এসে আপনাদের বিস্তারিত জানানো হবে।
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আইন উপদ ষ ট উপদ ষ ট

এছাড়াও পড়ুন:

ব্যাপক এক নৌ হামলা অপারেশন জ্যাকপট

এক ব্যান্ডের রেডিও ঘিরে প্রতীক্ষা করছিলেন শতাধিক সাহসী যুবক। কখন বেজে উঠবে সেই গান, আসবে সেই সংকেত। সবাই এক জায়গায় নয়। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও দাউদকান্দি নৌবন্দরে তাঁদের সতর্ক অবস্থান। প্রতিটি দলের কাছেই আছে রেডিও। সেই রেডিওতে আসবে অভিযান শুরুর সংকেত।

একদিকে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার প্রতীক্ষা, অন্যদিকে অনিশ্চয়তা। সামান্য গড়বড় হলেই নিশ্চিত মৃত্যু।

১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট সকালে আকাশবাণী কলকাতার গানের অনুষ্ঠানে বেজে উঠল ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান, তার বদলে চাই নে কোনো দান।’ এই গানই সংকেত। শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। এরপর ১৫ আগস্ট আরেকটি গান বাজলেই পাওয়া যাবে অভিযানে নামার চূড়ান্ত সংকেত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে খ্যাত।

১৫ আগস্ট আকাশবাণী কলকাতা ‘খ’ কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হলো সেই গান, যার অপেক্ষায় ছিল পুরো কমান্ডো দল। গানটি হলো, ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি।’ নৌ কমান্ডোরা অভিযানে নামতে শুরু করলেন। চারটি বন্দরে একই দৃশ্যের মঞ্চায়ন। মধ্যরাতের পর নৌ কমান্ডোরা গামছা দিয়ে বুকে মাইন বেঁধে নেমে গেলেন পানিতে। পায়ে ফিনস, কোমরে ছুরি। মাঝপথে শত্রুর মুখে পড়লে আত্মরক্ষার জন্য ছিল শুধু ওই ছুরি, কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নয়। তবে গেরিলা যোদ্ধাদের সমর্থনে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন।

সেই অভিযানে কমান্ডোরা প্রায় একই সময়ে চারটি বন্দরে ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দেন। যুদ্ধের ইতিহাসে এটা অনন্য নজির।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাঞ্চলকে যে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়, তার মধ্যে ১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল নৌ কমান্ডো। মূলত সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা, নদী ও সমুদ্রবন্দরসহ বাংলাদেশের সমগ্র জলপথ নিয়ে সেক্টরটি গঠিত হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রপথে পাকিস্তানের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া ছিল নৌ কমান্ডো আক্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য।

অপারেশন জ্যাকপটের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান সরকারের প্রচারণা ভন্ডুল করে দেওয়া। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিক বলে বহির্বিশ্বে প্রচারণা চালাচ্ছিল পাকিস্তান সরকার। কিন্তু নৌ কমান্ডোদের সফল অভিযানের মাধ্যমে তা মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয় এই নৌ অভিযানের খবর। মুক্তিযুদ্ধ বহির্বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি পায়।

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ১৪৮ জন নৌ কমান্ডোকে চারটি দলে ভাগ করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। ১৫ আগস্ট রাত ১২টার পর শুরু হয় অপারেশন জ্যাকপট।

১৫ আগস্ট রাত ১টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দর কেঁপে ওঠে। বন্দরে এমভি হরমুজ এবং এমভি আল-আব্বাস নামে দুটি পাকিস্তানি জাহাজসহ বেশ কয়েকটি বিদেশি বার্জ ও জাহাজ ধ্বংস হয়। এমভি হরমুজে ৯ হাজার ৯১০ টন এবং এমভি আল-আব্বাসে ১০ হাজার ৪১৮ টন সামরিক সরঞ্জাম ছিল। চট্টগ্রাম বন্দর অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।

অন্যদিকে সাবমেরিনার আহসানউল্লাহর নেতৃত্বে ৪৮ জন নৌ কমান্ডো মোংলা বন্দরে অভিযান চালান। বন্দরের ছয়টি জাহাজ মাইনের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়।

চাঁদপুর নৌবন্দর অভিযানে সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে ২০ জন নৌ কমান্ডো সফল হন। তাঁরা ১৫ আগস্ট রাতে একই সময় চাঁদপুর বন্দরে মাইন দিয়ে কয়েকটি জাহাজ ধ্বংস করেন। সেই সঙ্গে সাবমেরিনার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ২০ জনের কমান্ডো দল নারায়ণগঞ্জ এবং শাহজাহান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ৯ জন কমান্ডো দাউদকান্দি নদীবন্দরে সফল অভিযান পরিচালনা করেন।

পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান নৌবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তারা দলত্যাগ শুরু করেন। সেই বাস্তবতায় ভারতীয় নৌবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের তৎকালীন পরিচালক মিহির কুমার রায় নৌ কমান্ডো গঠনের পরিকল্পনা করেন। সেটা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকের কথা। ফ্রান্সের তুঁল নৌবন্দর থেকে পালিয়ে আসা আটজন বাঙালি নৌসেনাকে নিউক্লিয়াস ধরে তিনি মুক্তিবাহিনীর নৌ কমান্ডো দল গঠনের চিন্তা করেন।

আট বাঙালি নৌসেনা হলেন খুলনার সন্তান চিফ পেটি অফিসার গাজী মো. রহমত উল্লাহ, ফরিদপুরের পেটি অফিসার সৈয়দ মো. মোশাররফ হোসেন, কুমিল্লার পেটি অফিসার আমানউল্লাহ শেখ, রংপুরের নাবিক বদিউল আলম, চট্টগ্রামের রেডিও অপারেটর আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, নোয়াখালীর মেকানিক মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ, টাঙ্গাইলের ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক শহীদ আবদুর রকিব মিয়া ও ঢাকার নাবিক আবেদুর রহমান। ফ্রান্সে পাকিস্তানের কেনা সাবমেরিনে তাঁরা প্রশিক্ষণে ছিলেন। মার্চে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরুর খবর পেয়ে তাঁরা পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তবে সেটা সহজ ছিল না। তুঁল থেকে স্পেন, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ভারত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অংশগ্রহণ যেকোনো রোমাঞ্চ কাহিনিকেও হার মানায়।

নৌ কমান্ডো বাহিনীর অন্যতম সদস্য মো. খলিলুল রহমান নৌ কমান্ডো গঠনের স্মৃতিচারণা করেছেন। নিজের মুক্তিযুদ্ধে নৌ–অভিযান বইয়ে লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই আটজন অসমসাহসী নাবিকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ এক বিশিষ্ট ঘটনা। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ফ্রান্স থেকে ভারত পর্যন্ত যাত্রাপথের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা শুনে সত্যই শিহরিত হতে হয়।’

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পলাশীতে প্রশিক্ষণরত নৌ কমান্ডো

সম্পর্কিত নিবন্ধ