ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আমরা সবকিছুই খুব প্রফেশনালভাবে নিষ্পত্তি করতে চাই।

আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’ (দ্বিতীয় খসড়া) এর ওপর একটি মতবিনিময় সভায় আসিফ নজরুল এসব কথা বলেন।


আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন করা হবে। ‘ফরহাদ (ফরহাদ মজহার) ভাই, বারবার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের কথা বলেছেন। ট্রুথ জাস্টিস কমিশন অথবা ট্রুথ রিকনসিলিয়েশন কমিশনের খুব দরকার আছে। এটা সম্ভবত আমাদের দেশে ১৯৭২ সাল থেকে থাকলেই ভালো হতো। আমরা সবকিছুই খুব প্রফেশনালভাবে নিষ্পত্তি করতে চাই। .

..আমরা ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন করব।’ এজন্য প্রধান উপদেষ্টা এবং আমি সাউথ আফ্রিকায় যাব। ফিরে এসে আপনাদের বিস্তারিত জানানো হবে।
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আইন উপদ ষ ট উপদ ষ ট

এছাড়াও পড়ুন:

কেন খালেদা জিয়াতেই বিএনপির ভরসা

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যে ২৩৬টি আসনে প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে, তাতে সবচেয়ে বড় চমক হলো দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্য তিনটি আসন রাখা। আসন তিনটি হলো ফেনী-১, বগুড়া-৭ ও দিনাজপুর-৩। নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। অতীতে এই সংখ্যা ছিল পাঁচ।

এরশাদের শাসনামলে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দুই নেত্রীর ১৫০‍+১৫০ আসনের ফর্মুলা দেন। এরপর নির্বাচন কমিশন পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমিত করে দেয়।

খালেদা জিয়া ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যতগুলো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, সব কটিতেই বিপুল ভোটে জিতেছেন। কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা ব্যতিক্রম ঘটনা। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯১ সালের নির্বাচনে দুটি ও ১৯৯৬ সালে একটি আসনে পরাজিত হন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৯১ সালে জেলে থেকে পাঁচটি আসনে জিতলেও ২০১৪ সালে একটি আসনে পরাজিত হন।

আরও পড়ুনখালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে কেন বিতর্ক১৮ ঘণ্টা আগে

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালে জেলে যাওয়ার পর খালেদা জিয়া রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় নন। বিএনপির দাবি, এই মামলা ছিল পুরোপুরি উদ্দেশ্যমূলক ও ভিত্তিহীন। জেলে যাওয়ার আগেই খালেদা জিয়া দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে যান।

তারেক সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে দেশান্তরি হন এবং লন্ডন থেকেই দল পরিচালনা করে আসছেন। সেখান থেকে নিয়মিত দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বৈঠক করছেন, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন। দলের প্রার্থী মনোনয়নেও তাঁর ভূমিকা ছিল মুখ্য। আগামী মাসে তাঁর দেশে ফেরার কথা।

খালেদা জিয়া বর্তমানে শারীরিকভাবে অসুস্থ। সক্রিয় রাজনীতিতে আছেন, এটাও বলা যাবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সাত বছর তিনি কখনো কারাগারে, কখনো হাসপাতালে ও গৃহে অন্তরিণ ছিলেন। দলের পক্ষ থেকে চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে পাঠানোর ক্রমাগত দাবি জানানো হলেও তৎকালীন সরকার গ্রাহ্য করেনি।

আরও পড়ুনখালেদা জিয়ার ভাষণ যে পার্থক্য দেখাল০৬ মার্চ ২০২৫

চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। গত বছর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হলে খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পান। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সব মামলাও খারিজ হয়ে যায়।

এ অবস্থায় অনেকেই ভেবেছিলেন, খালেদা জিয়া সম্ভবত আর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। কিন্তু দলের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকায় আগের মতো তিনটি আসনে তাঁর নাম রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়ার বর্তমানে যে শারীরিক অবস্থা, তাতে তিনি নিজে নির্বাচনী প্রচারে যেতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। এরপরও দল তাঁর ওপরই ভরসা রাখছে।

এর প্রধান কারণ হলো দলের ভেতরে ও বাইরে খালেদা জিয়ার আপসহীন ভাবমূর্তি। সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি পুরোপুরি সফল, এটা বলা যাবে না। কিন্তু স্বৈরাচারবিরোধী ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁর সাহসী ভূমিকা সবাই স্বীকার করেন।

আমাদের নিত্য বৈরী রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নেতারা একে অপরকে প্রায় প্রতিদিনই বাক্যবাণে জর্জরিত করেন। অতীতের ঘটনা টেনে প্রয়াত নেতাদের বিরুদ্ধেও বিষোদ্‌গার করেন। এসব দেখে খালেদা জিয়া বিরোধী দলে থাকতে একবার সংসদে জাতীয় নেতাদের নিয়ে অহেতুক বিতর্ক না করার প্রস্তাব এনেছিলেন। সরকারি দল সেটা গ্রহণ করেনি। এরপর তো তিনি সংসদের বাইরে ২০১৪ সাল থেকে।

আওয়ামী সরকারের আমলে ক্ষমতাসীনেরা যেভাবে খালেদা জিয়াকে গালাগাল করেছেন, বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন, তাতে তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের সমীহ আরও বেড়েছে। একজন অসুস্থ মানুষকে নিয়ে পরিহাস করাকেও কেউ ভালো চোখে দেখেননি।

আমাদের মতো দেশে ক্ষমতায় থাকতে নেতা–নেত্রীদের জনপ্রিয়তা যাচাই করা কঠিন। এক দল নেতা-কর্মী সব সময় বন্দনা করতে থাকেন। তদুপরি রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র তো আছেই মহিমা প্রচারের জন্য। নেতা-নেত্রীদের প্রকৃত জনপ্রিয়তা যাচাই হয় যখন তাঁরা বিরোধী দলে থাকেন। খালেদা জিয়া সেটা পেরেছেন ধারণা করি।

বিএনপির প্রার্থী তালিকা নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কয়েকটি স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। সড়ক অবরোধ ও আগুন দেওয়ার মহড়াও বাদ যায়নি। বিএনপির নেতৃত্ব যত সহজে পরিস্থিতি সামাল দেবে ভাবছিল, তত সহজ হচ্ছে না। এখানেও শেষ পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্ব খালেদা জিয়াকে হয়তো ‘ত্রাতা’ হিসেবে দেখতে চাইবে। বঞ্চিত মনোনয়নপ্রত্যাশীরা অন্য কারও কথা না শুনলেও তাঁর পরামর্শ অগ্রাহ্য করবেন না।

আমরা লেখক–গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের এক–এগারো: ২০০৭-২০০৮ বই থেকে জানতে পারি, তৎকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা নিরাপদ প্রস্থানের জন্য দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া সে প্রস্তাবে রাজি হননি। তাঁর প্রতিপক্ষ রাজি হয়েছিল। এসব ঘটনাও তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে।

নির্বাচন এলে সব রাজনৈতিক দলই বড় বড় ইশতেহার দেয়। দেশকে সমৃদ্ধির শিখরে নিয়ে যাওয়া এবং আমজনতার জন্য দুধের নহর বইয়ে দেওয়ার বড় বড় বুলি আওড়ায়। জনগণ এসবের প্রতি কম আস্থা রাখে। এরপরও তারা নেতা ও প্রতীক দেখে ভোট দেয়।

এবার বিএনপি নেতৃত্ব মূলত খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তিকে সম্বল করেই নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে চাইছে। তারা মনে করছে, খালেদা জিয়া নিজে নির্বাচনী প্রচার চালাতে না পারলেও তাঁর নাম ও নির্বাচনে অংশগ্রহণই দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিএনপির রাজনীতির যাঁরা কট্টর সমালোচক, তাঁরাও খালেদা জিয়াকে সম্মানের চোখে দেখেন।

এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ৪ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার আসনে আমরা কোনো প্রার্থী দিচ্ছি না। তিনি প্রার্থী হয়েছেন, আমরা তাঁকে স্বাগত জানাই। তাঁর আপসহীন ও লড়াকু নেতৃত্ব বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে।’ গণ অধিকার পরিষদও খালেদা জিয়ার আসনে প্রার্থী না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ না হলেও একজন নেতা বা নেত্রীর প্রতি এ সম্মান প্রদর্শনেরও মূল্য আছে।

বিএনপির প্রার্থী তালিকা নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কয়েকটি স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। সড়ক অবরোধ ও আগুন দেওয়ার মহড়াও বাদ যায়নি। বিএনপির নেতৃত্ব যত সহজে পরিস্থিতি সামাল দেবে ভাবছিল, তত সহজ হচ্ছে না। এখানেও শেষ পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্ব খালেদা জিয়াকে হয়তো ‘ত্রাতা’ হিসেবে দেখতে চাইবে। বঞ্চিত মনোনয়নপ্রত্যাশীরা অন্য কারও কথা না শুনলেও তাঁর পরামর্শ অগ্রাহ্য করবেন না।

বিএনপির অনেক নেতাই বলতে চাইছেন, বড় দলে এ রকম ছোটখাটো সমস্যা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাদের সেই অঘটন কয়েকটি আসনে সীমিত থাকছে না। বেশ কিছু আসনের মনোনয়ন নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তা অযৌক্তিক নয়। বিএনপি কিসের ভিত্তিতে তালিকা করেছে? তারা কি তৃণমূলের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে বসেছে?

একজন বঞ্চিত মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের একজন সাংগঠনিক নেতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি তাঁর বিরোধী শিবিরের বলে আমাকে আলোচনাতেই ডাকা হয়নি।’ অনেক আসনে ত্যাগী নেতা-নেত্রীদের বাদ দিয়ে দখলদারি, চাঁদাবাজির দায়ে অভিযুক্ত নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। যাঁরা আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামলে সংসদের ভেতরে–বাইরে প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়েছেন এবং টিভি টক শোতেও সোচ্চার ছিলেন, তাঁদের বাদ দেওয়াকেও সাধারণ কর্মীরা সুনজরে দেখছেন না।

তিনটি আসনে বিএনপি খালেদা জিয়াকে মনোনয়ন দিয়ে এটাই প্রমাণ করেছে যে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় থেকেও অনেক বেশি সক্রিয়া ভোটারদের মনে। তাঁর নামই দলকে এগিয়ে নেবে, তাঁর ভাবমূর্তিই বিজয় ছিনিয়ে আনবে, এটাই বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ধারণা।

সোহরাব হাসান কবি ও সাংবাদিক

[email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ