Samakal:
2025-06-30@21:10:09 GMT

স্মরিব ‘কাল নিরবধি’

Published: 15th, May 2025 GMT

স্মরিব ‘কাল নিরবধি’

আমার অনেক বন্ধুবান্ধব তাঁর শিক্ষার্থী ছিলেন। আমার অনেক অগ্রজেরও শিক্ষক ছিলেন তিনি। তবু পাঁচ বছর আগে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। যুক্তি ছিল তাঁর একটাই– তাঁর কন্যার শিক্ষককে তিনি ‘তুমি’ বলতে পারেন না। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর কন্যা রুচিরা আমার শিক্ষার্থী ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। বেনু এ নিয়ে অনুযোগ করত, “আপনি আমাকে ‘তুমি’ বলেন, আর ওকে ‘আপনি’ বলেন কেন?” স্মিতহাস্যে তিনি বলতেন, ‘তুমি হলে গিয়ে কবীর ভাইয়ের মেয়ে। তবে তুমি চাইলে তোমাকেও ‘আপনি’ বলতে পারি’। বেনু বিব্রত হতো।
বহু বলা-কওয়ার পরে স্যারের কাছে আমি ‘তুমি’ বাচ্য হলাম সাত বছর আগে ২০১৮ সালে। সে বছর বইমেলাতে প্রকাশিত আমার ‘বেলা-অবেলা’ বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন তিনি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে রমেশ চন্দ্র মজুমদার মিলনায়তনে সে অনুষ্ঠানে অপূর্ব বলেছিলেন তিনি। সত্যি কথা বলতে, যে প্রশংসা করছিলেন তিনি আমার, তাতে আমি লজ্জাই পাচ্ছিলাম। সমালোচনা করতেও তাঁর যেমন কুণ্ঠা ছিল না, প্রশস্তি করতেও তাঁর কোনো দ্বিধা ছিল না। ২০১৮-এর ২১ ফেব্রুয়ারিতেই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। তার ক’দিন আগে গুলশানে তাঁর বাসায় গেলে গল্প জমে উঠেছিল বেবী চাচি আর স্যারের সঙ্গে। চাচির তাড়া থাকায় উঠে গিয়েছিলেন আগেই, কিন্তু স্যারের সঙ্গে তাঁর আমার পারিবারিক গল্প হয়েছিলে অনেক। 
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নাম প্রথম শুনি ষাটের দশকে কিশোর বয়সে। তাঁকে প্রথম দেখি ১৯৬৯ সালে বাংলা একাডেমিতে কোনো এক সভায়। তাঁর লেখা প্রথম পড়ি ১৯৭২ সালে। লেখাটির নাম– মুনীর চৌধুরী, থিয়েটার পত্রিকার ‘মুনীর চৌধুরী’ সংখ্যায় বেরিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যোগদানের পরে পরবর্তী দু’বছরে তাঁর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। প্রতিবারে স্যার আমাকে মুগ্ধ করেছেন তাঁর পাণ্ডিত্যে, বাচনে, ব্যক্তিত্বে। তবে সে সময়ে চেনাজানা হলেও তাঁর সঙ্গে তেমন কোনো নৈকট্য গড়ে ওঠেনি।
আনিস স্যারের সঙ্গে বয়োজ্যেষ্ঠ-বয়ঃকনিষ্ঠ সহকর্মীর একটি হৃদ্যতা গড়ে উঠল আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন আমি উচ্চশিক্ষা শেষে বিদেশ থেকে ফিরে এলাম। তিনটি কারণে আমরা খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। এক, তাঁর ও আমার প্রায়শই যাতায়াত ছিল প্রয়াত অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ও জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর বাড়িতে। সুতরাং সেই সূত্রে গড়ে ওঠা তিনটে ক্ষেত্রতে নানান গল্প-আলোচনায় আমাদের মাঝে একটি সৌহার্দ গড়ে ওঠে।
দুই, আমার লেখালেখির কারণে আমি যখন-তখন তাঁর শরণাপন্ন হতাম। মনে আছে, একদিন বেশ রাতে তাঁকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম, ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন’ রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতার অংশ? বলে দিয়েছেন এক লহমায়। আরেকদিন কলা ভবনের সামনের পথে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ কবে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রশ্ন শেষ করার আগেই উত্তর পেয়েছিলাম। এক জীবন্ত-চলন্ত বিশ্বকোষ ছিলেন তিনি। আর ঈর্ষণীয় ছিল তাঁর স্মরণশক্তি, যার প্রমাণ তাঁর ‘কাল নিরবধি’র প্রতিটি পাতায়। 
একদিন তাঁর বাড়িতে কথা প্রসঙ্গে বেরিয়ে গেল যে বছর আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি, সে বছর যশোর বোর্ডের বাংলার প্রধান পরীক্ষক ছিলেন আনিস স্যার। আমি জানালাম যে সে বছর বোর্ডে বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর ৮৪ পেয়েছিলাম। স্যার একমুহূর্ত ভেবে বললেন, “আপনি দ্বিতীয় পত্রে ‘আমি, বেবী, মঞ্জু আপা’ নামে এক গল্প লিখেছিলেন”। আমি একই সঙ্গে হতবাক ও বিব্রত। হতবাক তাঁর স্মরণশক্তিতে, বিব্রত কারণ রচনা লেখার বদলে সত্যিই এক ত্রিভুজ প্রেমের গল্প ফেঁদেছিলাম অর্বাচীন আমি। তার চেয়েও বড় কথা, গল্পের নামটি আমি চুরি করেছিলাম আমিনুজ্জামানের ‘আমি, বেবী, মঞ্জু আপা’ নামের ছোটগল্প থেকে। আমিনুজ্জামান আনিস স্যারের চাচাতো ভাই, এবং ‘বেবী’ ভাবির ডাকনাম। আমিনুজ্জামানের ছোটগল্পের ভিত্তিতে প্রয়াত সুভাষ দত্ত ‘আয়না ও অবশিষ্টের’ ‘অবশিষ্ট’ পর্বটি করেছিলেন, ‘আয়না’ পর্বটি ছিল প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হকের ছোট গল্প ‘রোকেয়ার মুখ’ অবলম্বনে। তিন, আশির দশকে এরশাদবিরোধী সংগ্রামের কালে নানান সামাজিক আন্দোলনে আমরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। মনে আছে, ‘নাগরিক কমিটি’ গঠিত হলে প্রয়াত অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, আনিস স্যার ও আমি খুব কাছাকাছি থেকে কাজ করেছি। নানান সময়ে নানান বিপদাশঙ্কায় তিনি আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে বেনুকেও ফোন করতেন। একবার ‘স্বৈরাচারের স্বরূপ’ নামে একটি লেখার কারণে আমার বিপদ হতে পারে ভেবে তিনি আমাদের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় চলে এসেছিলেন গাড়ি নিয়ে আমাকে তাঁর বাসায় রাতে থাকার জন্য। বেনু রাজি হয়নি।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু আমার এক গুরু ছিলেন সর্ব অর্থেই। জীবন ও জগতের বহু শিক্ষা তাঁর কাছে, বহুভাবে তিনি ঋদ্ধ করেছেন আমাকে, তাঁর স্নেহধন্য হতে পেরেছিলাম। আমার শিক্ষকতার পঞ্চমুখ ছিলেন তিনি– হয়তো রুচিরার প্রভাবিত হয়ে; সপ্রশংসক পাঠক ছিলেন আমার লেখার– আমার ‘রবীন্দ্রনাথের অর্থনীতি-চিন্তা’র কথা কতজনকে যে বলেছেন; শুনতেন প্রতি পক্ষে ‘যা না বললেই নয়’ শীর্ষক আমার নিয়মিত বেতার কথিকার। যোগ্য ছিলাম না এর কোনো কিছুরই, কিন্তু স্নেহ তো অন্ধ।
আজ যখন ভাবি, কোনো একটি জায়গায় ঠেকে গেলে তাঁর পরামর্শ আর পাব না, কোনো একটি জিনিস জানতে চাইলে তাঁকে আর পাওয়া যাবে না, আমাকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য তিনি আর নেই, তখন বড় অসহায় বোধ করি। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র দশক

এছাড়াও পড়ুন:

প্রযোজককে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি, গ্রেপ্তার ৬

প্রয়াত জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহকে ভালোবেসে নায়কের সবচেয়ে সুপারহিট সিনেমা ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ নামে কয়েক বছর আগে একটি শুটিং স্পট নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র প্রযোজক মো. রাশেদুল ইসলাম রাশেদ। নিয়মিত সেখানে নাটক-সিনেমার শুটিং হয়। সালমান শাহ ভক্ত-প্রযোজক রাশেদকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে পূর্বাচল এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে এই প্রযোজক ও ব্যবসায়ীকে অপহরণ করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন রাশেদ নিজেই।

তিনি বলেন, “২০১৮ সালে একটি ধর্ষণ ও হত্যা মামলা দায়ের করি। সেই মামলা তুলে না নেওয়ায় এই অপরহণ করা হয়। মামলা তুলে নিতে দীর্ঘদিন চাপ সৃষ্টি করে আসছিল এই চক্রটি। মামলাটি তুলে না নেওয়ায় শুক্রবার দুপুরে পূর্বাচল ১৩ নম্বর সেক্টরের অফিস থেকে আমাকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের পর আমার পরিবারের কাছে ৭০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা।”

রাশেদের ভাষ্য অনুযায়ী, পূর্বাচলের কথিত যুবদল নেতা রাসেল আহমেদের নেতৃত্বে ৮-১০ জন যুবক দুপুর আড়াইটার দিকে অফিসে ঢুকে জোরপূর্বক তাকে তুলে নিয়ে যায়। রাসেল ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে আমার চাচাতো ভাই রাকিবের মেয়ে সূর্বনাকে অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে মামলা রয়েছে। সেই মামলা তুলে নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে হুমকি দিয়ে আসছিল অভিযুক্ত চক্রটি। 

জানা যায়, অপহরণের খবর পেয়ে রাশেদের পরিবার দ্রুত পূর্বাচল সেনা ক্যাম্পে অভিযোগ জানায়। এতে অপহরণকারীরা চাপে পড়ে যায় এবং রাশেদকে ‘আওয়ামী লীগ কর্মী’ পরিচয়ে রূপগঞ্জ থানায় সোপর্দ করার চেষ্টা করে। পরে পুলিশ উভয় পক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয়।

রূপগঞ্জ থানার ওসি তরিকুল ইসলাম জানান, এ ঘটনায় অভিযুক্ত যুবদল নেতা রাসেল মিয়াসহ চক্রের ছয় সদস্য— রাসেল, শান্ত, রনি, শিপলু সাব্বির ও রনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

ঘটনার বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মেহেদী ইসলাম বলেন, “তাকে (রাশেদুল ইসলাম রাশেদ) আওয়ামী লীগ কর্মী হিসেবে থানায় সোপর্দ করার চেষ্টা করা হলেও এখন পর্যন্ত তার সে রকম কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রমাণ আমরা পাইনি। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

রাশেদ ‘নিশ্চুপ ভালোবাসা’ নামে সিনেমা প্রযোজনা করেছেন। পাশাপাশি বেশ কিছু নাটক, সিনেমা এবং মিউজিক ভিডিওতে অভিনয় করেছেন। এ ঘটনায় চলচ্চিত্রপাড়ায় ব্যাপক চাঞ্চল্য ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

ঢাকা/রাহাত//

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘রাজনীতি মুক্ত থাকবে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হল’
  • মহানবী (সা.)-কে কটুক্তি: জাবি শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে তদন্ত কমিটি
  • জাবিতে ছাত্রীকে হেনস্তার অভিযোগে রাবি শিক্ষার্থী আটক
  • অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধিমালা গ্রহণের আদেশ স্থগিত, আপিল শুনবেন সর্বোচ্চ আদালত
  • প্রযোজককে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি, গ্রেপ্তার ৬
  • পবিপ্রবির এক অধ্যাপককে ‘সহযোগী অধ্যাপক’ হিসেবে পদাবনতি