মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে পরিচিত। সামরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতায় পুরো মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশকে তারা তোয়াক্কা করেনি। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে দেশটির আয়তন শুধুই বেড়েছে। বছরের পর বছর আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে ফিলিস্তিনি ভূমি দখলের কাজ চালিয়ে গেছে। আরব দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ ও বিজয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু ইরানের সঙ্গে চলমান যুদ্ধ ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইসরায়েলের স্বাতন্ত্র্য ভাবমূর্তির দিন শেষ হয়ে আসছে।
প্রায় দুই বছর ধরে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইসরায়েল প্রতিবেশীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। হামলা ও দ্রুত প্রতিশোধের এই নীতি এই অঞ্চলে দেশটিকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের হামলার পর ইসরায়েল শক্তি দেখাতে শুরু করে। তারা এমন আক্রমণাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা করে যে, দীর্ঘদিনের শত্রু হামাস দুর্বল হতে বাধ্য হয়। এতে যুদ্ধের উত্তেজনা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে হামাস, অন্যদিকে লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে নেতানিয়াহুর বাহিনী। সেই যুদ্ধের শেষ প্রান্ত ইরানে গিয়ে ঠেকেছে। ইরানে গত ১৩ জুন নজিরবিহীন হামলা করে বসে ইসরায়েল।
হামলার গতি এত ক্ষিপ্র ছিল যে, ইরানের প্রথম সারির জেনারেল ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের নিশ্চিহ্ন করে দেয় তারা। এর পরই ইরানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। জবাবে ইরান মুহুর্মুহু পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে থাকে। ইসরায়েল নিজেই যে ইরানকে যুদ্ধের ময়দানে টেনে এনেছে, সেই ইরানই এখন ইসরায়েলের আধিপত্য চূর্ণ করে দিচ্ছে। ইরানের হামলায় তেল আবিবের পরিস্থিতি গাজার মতোই ভয়ানক হয়ে উঠেছে। তেল আবিবের আকাশে এখন সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি অত্যাধুনিক ড্রোনের মিছিল। যুদ্ধের এই উত্তেজনা ইহুদি রাষ্ট্রটিকে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ঠেলে দিয়েছে।
অন্যদিকে ইরান দীর্ঘদিন ধরে ধৈর্য দেখিয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ইসরায়েলের পাশে থাকায় তাদের ভয় ছিল। কয়েক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির উপস্থিতিও এই ভয়ের কারণ। কিন্তু এখন ইরান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এখন তারা ইসরায়েলকেই নিশ্চিহ্ন করার হুমকি দিচ্ছে। এতদিন দুটি কারণে ইসরায়েল আধিপত্য দেখিয়ে এসেছে। একটি যুক্তরাষ্ট্রের অটল সমর্থন এবং অন্যটি নিজস্ব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, সামরিক শক্তি ও অনন্য সামাজিক মডেল। তবে বর্তমানে দ্বিতীয় স্তম্ভটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেশটি ক্রমবর্ধমান নেতিবাচক অভিবাসনের মুখোমুখি হচ্ছে। ২০২৪ সালে ইসরায়েল থেকে ৮২ হাজার ৭০০ নাগরিক দেশ ত্যাগ করে, যা আগের বছরের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি। এখানে আশঙ্কার বিষয় হলো, অদক্ষ বা কর্মহীনরা দেশত্যাগ করছে না। দেশত্যাগ করছে তরুণ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী।
অথচ একটি আধুনিক রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে যাদের প্রয়োজন, তারাই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ইসরায়েলের সংকট বহুমুখী। দেশটি একটি ক্ষয়িষ্ণু নব্য-উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভারে চাপা পড়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ, মহামারিসহ নানা সংকট পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলছে। ক্রমাগত জরুরি অবস্থার মধ্যে দেশ শাসন ও সংঘাতের অবিরাম প্রস্তুতি দেশটিকে এক ভয়ানক ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল পশ্চিমাদের শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যে যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চায়, সেই যুদ্ধের ঘুঁটিতে পরিণত হয়েছে দেশটি।
সংঘাত কেবল একটি কৌশল নয়, ইসরায়েলিদের জীবনযাত্রার একটি অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক বিজয় পেতে যুদ্ধকেই সঙ্গী করে নিয়েছেন নেতানিয়াহু। যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি চীন-রাশিয়ার সঙ্গে আধিপত্য কায়েমের লড়াইয়ে ইসরায়েলকে দিয়েই প্রক্সিযুদ্ধ চালাচ্ছে। স্থায়ী যুদ্ধ পরিস্থিতি বজায় রাখতে ইসরায়েল এখন নিজস্ব সম্পদ ক্ষয় করতে লিপ্ত। প্রযুক্তিগত ও নাগরিক অগ্রগতির এক সময়ের গর্বিত মডেলটি এখন আগের মতো কাজ করছে না। দেশটিকে কেবলই এখন রাজনৈতিক, সামরিক ও আর্থিকভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উপবিভাগ হিসেবে টিকে আছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র
এছাড়াও পড়ুন:
নতুনভাবে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকারীদের প্রত্যাখ্যানের আহ্
নতুনভাবে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায়রত দলগুলোকে প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানিয়ে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে নতুন করে সাজানোর ঘোষণা দিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম।
জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি উদযাপন’ উপলক্ষে মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) রাজধানীর বায়তুল মোকাররম উত্তর গেইটে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আয়োজিত গণমিছিলপূর্ব সমাবেশে তিনি এ ঘোষণা দেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, “আয়না ঘরের কারিগর, গুম-খুন, হত্যার দোসর খুনি হাসিনা ২৪-এর এই দিনে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে। দেশের টাকা যারা বিদেশে পাচার করেছে, তাদের উৎখাতে ছাত্র-জনতা যখন দেশের সব অলিগলিতে আওয়াজ তুলেছিল, আবু সাঈদ দু’হাত উঠিয়ে বুক পেতে দিয়েছিল। এমনকি মা-বোনেরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমেছিল, তখন মুগ্ধের ‘পানি লাগবে’ সেই আওয়াজ এখনো কানে ভাসে।”
তিনি বলেন, “এত ত্যাগ, এত রক্ত, এত জীবন দেওয়ার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল আর কোনো স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট, টাকা পাচারকারী, আয়না ঘর তৈরির কারিগরের জন্ম যেন না হয়। আমরা ঘৃণাভরে ধিক্কার জানাই সেসব ক্ষমতা লোভীদের, যারা চাঁদাবাজির মাধ্যমে, স্ট্যান্ড দখল, জায়গা দখল করে নতুনভাবে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায়রত। তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।”
“তারা কী শিশুদের আত্মচিৎকার শুনতে পায়নি? হাজার হাজার মায়ের কোল খালি হয়েছে, হাজারো মেধাবী ছাত্ররা শহীদ হয়েছে, পূর্বের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য? যারা বিগত দিনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, তাদের দেশবাসী পুনরায় ক্ষমতায় দেখতে চায় না,” যুক্ত করেন আমির।
মুফতি রেজাউল করীম বলেন, “এদেশ আমার, এদেশকে সুন্দর করার দায়িত্বও আমার। আসুন সবাই মিলে সন্ত্রাস, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজদের উৎপাত করি। বিদেশি তাবেদারদের চিরতরে কবর রচনা করতে করি। সবাই একাকার হয়ে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে নতুন করে সাজাই।”
দলের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ ইমতিয়াজ আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, দলের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ।
এছাড়া বক্তব্য দেন, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, যুগ্ম-মহাসচিব ও দলের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, যুগ্ম-মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর উত্তর সভাপতি প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ, মাওলানা এবিএম জাকারিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম, মুফতী রেজাউল করীম আবরার, আলহাজ্ব আলতাফ হোসেন, আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেন, মাওলানা মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম, আব্দুল আউয়াল মজুমদার, ছাত্রনেতা মুনতাসির আহমদ, মুফতী ফরিদুল ইসলাম, মুফতী মাছউদুর রহমান, যুবনেতা হাম্মাদ বিন মোশাররফ, শ্রমিকনেতা হাফেজ শাহাদাত হোসেন প্রধানিয়া।
মাওলানা কেএম শরীয়াতুল্লাহ ও ইঞ্জিনিয়ার মুরাদ হোসেনের সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন, সহকারী মহাসচিব মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ুম, মুফতী কেফায়েতুল্লাহ কাশফী, আলহাজ্ব মনির হোসেন, আমিরুল হক, হাফেজ মাওলানা ইউনুছ ঢালী প্রমুখ।
অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ সেখ বলেন, “১ বছর পূর্বে শত শত মানুষ শহীদ হয়েছিল, মানুষের চোখের পানি ঝড়েছিল, স্বপ্ন ছিল একটি সুন্দর, স্বাধীন বাংলাদেশের। আমরাও আশাবাদী ছিলাম, যারা শাহাদাত বরণ করেছে, তাদের ক্ষমতার লোভ ছিল না, পদের লোভ ছিল না। তাদের চাওয়া ছিলো দেশের মানুষ যেন ভাল থাকে। আসুন সবাই মিলে দেশটাকে ভালভাবে গড়ি। কিছু মানুষ চাচ্ছে দ্রুত চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির বৈধতা। ফ্যাসিস্টদের প্রেতাত্মাদের মধ্যে পিআর-এর কোনো অনুভুতি জাগ্রত হয় না। সংস্কার ও গণহত্যার বিচার তারা চায় না।” তিনি পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের মাধ্যমেই কেবল দেশকে নতুনভাবে গড়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন বলেন, “জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে জনআকাঙ্ক্ষার সঞ্চার হয়েছে। পীর সাহেব চরমোনাই’র নেতৃত্বে রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন হবে। মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত হবে। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটবে।”
মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, “বিগত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ব্যর্থতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুতপ্ত হওয়া উচিত। সব রাজনৈতিক দল মিলেও ফ্যাসিবাদী ও খুনি হাসিনাকে পদচ্যুত করা যায়নি। কিন্তু ছোট ছোট ছাত্ররা তাদের জীবনের বিনিময়ে দেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করেছে। সব কৃতিত্ব ছাত্র-জনতার। আজ যারা ছাত্রদের আন্দোলনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে, তাদের উদ্দেশ্য কেবলই ক্ষমতা।”
প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ বলেন, “জুলাই আন্দোলনের আমাদের মিছিলে সরাসরি গুলি করে আমাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল ফ্যাসিবাদী হাসিনা। আমরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশগড়ার আন্দোলন গড়ে তুলেছি পুনরায় ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য নয়।” তিনি ছাত্র-জনতার চাওয়া পাওয়া বৈষম্যহীন কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
মাওলানা ইমতিয়াজ আলম বলেন, “ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য এবং খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসার মৌলিক অধিকারের জন্য জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছে। যারা দুর্নীতিতে বারবার চ্যাম্পিয়ান হয়েছে, তারা পরীক্ষিত শোষক ও জালেম। তাদের আমলেও মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেনি। এরশাদ, হাসিনা ও খালেদা সবাইকেই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করতে হয়েছে।”
সমাবেশ শেষে একটি বিশাল গণমিছিল মুফতি রেজাউল করীরে নেতৃত্বে বায়তুল মোকাররম, পল্টন মোড়, প্রেসক্লাব কদম ফোয়ারা হয়ে শাহবাগ মোড়ে গিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ও মোনাজাতের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়।
দুপুর আড়াইটা থেকে জুলাই বিপ্লবের ডকুমেন্টরি প্রদর্শন এবং জাতীয় সাংষ্কৃতিক সংগঠন কলরব, মানযিল, সুরের তরীর বরেণ্য শিল্পীদের কণ্ঠে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সবশেষে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত জুলাই যোদ্ধাদের স্মরণে বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এতে দেশবরেণ্য উলামায়ে কেরাম আলোচনা করেন।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/মেহেদী