সিডনির ডেনহ্যাম কোর্ট যেন হয়ে গিয়েছিল নব্বইয়ের ঢাকার একটুকরো নাট্যমঞ্চ। উপলক্ষ ছিল একটা আড্ডা। গত রোববার যাতে মেতে উঠেছিলেন বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের কয়েকজন কুশীলব। কেন্দ্রে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েকে দেখতে সিডনিতে আসা নির্মাতা শিহাব শাহীন, সিডনিতে পরিবার নিয়ে বসবাসরত অভিনেতা মাজনুন মিজান, ‘ঢাকা পদাতিক’-এর একসময়ের প্রধান অভিনেতা জন মার্টিন এবং মঞ্চ ও টেলিভিশন—দুই মাধ্যমে আলো ছড়ানো অভিনেত্রী মৌসুমী মার্টিন। সঙ্গে ছিলেন সিডনিপ্রবাসী বাংলাদেশি চিকিৎসাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড.

সায়েদ আহমেদ ও স্থানীয় নির্মাতা শিমুল শিকদার।

মঞ্চের সোনালি দিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যজীবনের স্মৃতিচারণা দিয়ে আড্ডা শুরু করলেন জন মার্টিন। তিনি বলেন, ‘প্রথম বর্ষেই “ইন্সপেক্টর জেনারেল” নাটকে কাজ করার সুযোগ পাই। এটা বাংলাদেশের প্রথম স্যাটায়ার মিউজিক্যাল কমেডি।’ বলতে বলতে হঠাৎ নাটকের গানের কয়েকটি লাইন আবৃত্তির ঢঙে উচ্চারণ করে ওঠেন, ‘ও তাঁর ডাইনে বুড়ি, বাঁয়ে কুমারী ছুড়ি, কারে ধরি, কারে রাখি, পড়েছি সেই বিষম বিপাকে...।’ মৌসুমী মার্টিন তখন হেসে বলেন, ‘মঞ্চনাটকের গানে এমনভাবে মন ঢুকে যেত যে আসল গান ভুলে গিয়ে সেই নাটকের গানই মনে থাকত। আজও সেসব সুর কানে বাজে।’

আড্ডা শেষে এক ফ্রেমে ডান থেকে শিমুল শিকদার, মৌসুমী মার্টিন, জন মার্টিন, মাজনুন মিজান, শিহাব শাহীন ও সায়েদ আহমেদ। ছবি: প্রথম আলো

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

প্রতিহিংসা বনাম গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরপর আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ ও ক্ষুব্ধ মানুষের তাৎক্ষণিক ক্ষোভের প্রকাশ দেখা যায়। দীর্ঘ দেড় দশকের অনাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আবেগ-উত্তেজনা নানা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে; অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে পুরো পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা শুরুতে সহজ ছিল না। পুলিশ বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তাও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরিতে সহায়ক হয়; তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণে এলেও এখন পর্যন্ত সমাজে যুক্তিবোধশূন্য প্রতিহিংসার যে প্রকাশ আমরা দেখি, তা হতভম্ব করে দেয়।

সংবাদমাধ্যমে এই সংঘবদ্ধ প্রতিহিংসার নাম দেওয়া হয়েছে ‘মব সন্ত্রাস’। গণঅভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ও মাজার লাগাতার ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালীদের বাড়িঘর ভাঙা, লুটপাটের পাশাপাশি দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম সূতিকাগার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি ভাঙা হয়েছে। ৩২ নম্বর ভাঙার সময় নিরাপত্তা বাহিনীর নির্লিপ্ততা ও বুলডোজারের ব্যবহার ছিল হতবিহ্বল হওয়ার মতো। 

সর্বশেষ, রোববার সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে বিএনপি। সমকাল জানাচ্ছে, মামলার কয়েক ঘণ্টা পর সন্ধ্যায় ‘মব’ সৃষ্টি করে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার উত্তরার বাসা ঘেরাও করে স্থানীয় কিছু ‘জনতা’। বাসায় ঢুকে এক দল লোক তাঁকে বের করে আনে এবং জুতার মালা পরিয়ে দেয়। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, উত্তেজিত জনতা তাঁর দিকে ডিম ছুড়ে মারছে; কেউ পরনের গেঞ্জি ধরে টানছে আর কেউ তাঁর (সাবেক সিইসির) গালে জুতা মারছে। অনতিদূরে পুলিশ দাঁড়িয়ে; এর মধ্যে লোকজন কে এম নূরুল হুদাকে জুতা মারার ঘটনার ভিডিও করছে। এসবের মধ্যেই এক পর্যায়ে নূরুল হুদাকে মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নেওয়ার পর বিএনপির দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।  

২.
আওয়ামী লীগ আমলের সর্বশেষ তিন নির্বাচন নিয়ে ছলচাতুরী, জালিয়াতি কারও অজানা নয়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের অন্যতম কারণ জাতীয় নির্বাচনকে একতরফা বানিয়ে নিজেদের মতো ভোট করে নেওয়ার প্রতারণার ঘটনা। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এর তিন নির্বাচন– প্রথমবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, দ্বিতীয়বার দিনের ভোট রাতে হয়ে যাওয়া ও তৃতীয়বার ডামি প্রার্থী বসিয়ে নিজেদের মধ্যে যে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ, তার প্রধান কুশীলব নিঃসন্দেহে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। তাঁর দোর্দণ্ড প্রতাপের একনায়কতান্ত্রিক শাসনামলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে দ্বিমত প্রকাশের আদৌ কোনো সুযোগ ছিল না। অবশ্য সুযোগ থাকলেও আমাদের দেশে শক্তিমানদের মোসাহেবি করবার যে প্রচল সংস্কৃতি, তাতে পদলোভী কেউই ‘মাননীয়’র সিদ্ধান্তে দ্বিমত করতে কখনোই আগ্রহী হন না। বরং শাসকের ইচ্ছেকে আরও বড় করে দেখে কর্তৃত্ববাদকে উস্কে দিতেই তারা অভ্যস্ত। সর্বশেষ তিন নির্বাচনে তা-ই হয়েছে। শেখ হাসিনা তাঁর সহচরবর্গকে নিয়ে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বাস্তবায়ন করেন।
এখানে নির্বাচন কমিশনারদের কোনো দায় নেই? অবশ্যই আছে। ফিরে তাকালেই দেখবেন, তৎকালীন তিন সিইসিকে নিয়েই সংবাদমাধ্যমে প্রচুর সমালোচনামূলক লেখালেখি হয়েছে। তারা প্রত্যেকে সরকারের বশংবদ হয়েছেন। যদিও তাদের পদ সাংবিধানিক ও সরকারের অধীনস্থ ছিল না; তারপরও দলীয় আনুগত্যের কারণে তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারই ছলচাতুরীর নির্বাচনে ক্রীড়নক হিসেবে অংশ নেন। যেখানে সত্যের খাতিরে আর কিছু না হোক, তাদের পদত্যাগ করে জাতিকে সত্য জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।

গত ১৬ জুন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে সরকারপ্রধানের দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া বিতর্কিত তিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে জড়িত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিবদের ভূমিকা তদন্তে অবিলম্বে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস।
এ-ও শোনা যাচ্ছিল, গত তিন নির্বাচনে জড়িত সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে! সবার বিরুদ্ধে? তিন নির্বাচনে একেবারে প্রান্তিক পর্যায় থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পর্যন্ত মোট নিযুক্তির সংখ্যা ৩০ লাখের মতো হতে পারে। এত বিপুল মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করবার সিদ্ধান্ত যেমন যৌক্তিক হতে পারে না, তেমনি ঘটনার প্রধান কুশীলবদের ধরলেই যেখানে রফা হয়ে যায়, সেখানে নিরীহ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মামলায় জড়ানোর কোনো কারণ থাকতে পারে না। সরকারি চাকরিরত অবস্থায় সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়ার কোনো সুযোগই সংশ্লিষ্ট কারও পক্ষে থাকে না। বর্তমানে সরকার যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেখানেও সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কারও সেসবের কোনোটির বিরুদ্ধে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

৩.
বিগত তিন নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চয়ই সংগত। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল জনতা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বাড়ির ভেতরে গিয়ে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নামিয়ে আনবে; তাঁর গালে জুতা মেরে গলায় জুতার মালা পরিয়ে চিৎকার করে জয়োল্লাস করবে– এই দৃশ্য আমরা জগৎবাসীর সামনে উপস্থাপন করে কী প্রমাণ করতে চাইছি? এ দেশে আইন-কানুন বলে কিছু নেই? এই ঘটনা যখন নির্বিকারভাবে ঘটতে থাকে; তখন দেশে সরকার আদৌ কার্যকর আছে কিনা, সেটি নিয়েই সন্দেহ দানা বাঁধে। 
কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে, তার আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকবে– এটাই সভ্য সমাজের বিধি, সেখানে বাড়ি থেকে বের করে গালে জুতা মারার প্রবণতা কেবল যুক্তিবোধশূন্য প্রতিহিংসাই নয়; অন্ধ পেশিশক্তির উপস্থাপনাও বটে। 

কথায় কথায় নিজেদের পেশিশক্তি দেখানোর এই চল অবশ্য এ দেশে নতুন নয়। আওয়ামী লীগ আমলে ছাত্রলীগ শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঘুরিয়েছে; বুয়েটের ছাত্র আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, দলেবলে বিশ্বজিৎকে কুপিয়েছে। এসবই অন্ধ পেশিশক্তির আস্ফালন। সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদার গালে জুতার বাড়ি সে রকমই প্রতিহিংসা প্রদর্শন। আমরা ক্ষমতায় আছি, যা-খুশি করব: এটি গণতান্ত্রিক মানসিকতা নয়। সমাজের গণতান্ত্রিক বিকাশের সঙ্গে এই মানসিকতা সাংঘর্ষিক। আজ প্রতিহিংসার নামে যা হচ্ছে, তা দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে বিনষ্ট করে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া কোনোভাবেই একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশের মানুষের আচরণ হতে পারে না। এ ধরনের প্রতিহিংসামূলক আচরণ সমাজে উস্কে দিয়ে সুযোগসন্ধানীরা প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। তারা ভুলে যাচ্ছে– সমাজে গণতান্ত্রিক বিবেচনাবোধ যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে সামাজিক মূল্যবোধ। প্রত্যেকের নিজস্ব মর্যাদা আছে ও থাকবে। অপরাধী বা নিরপরাধ শনাক্তের দায়িত্ব আইনি প্রতিষ্ঠানের। অপরাধী হিসেবে শনাক্ত হলেও কোনো ব্যক্তিকে রাস্তায় বা এখানে সেখানে আক্রমণ করে অপমানিত বা লাঞ্ছিত করবার অধিকার কোনো ব্যক্তির নেই। ব্যক্তির শাস্তির বিধান করবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রকে তাই কার্যকর ও দায়িত্ববান হতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাই সরকারের দায়িত্ব। জনগণের আকাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রতিহিংসার সংস্কৃতি থেকে দায়িত্বরতদের দ্রুত বেরিয়ে এসে নিজেদের কর্তব্য নৈর্ব্যক্তিকভাবে পালন করতে হবে। জাতির ভবিষ্যতের জন্যই তা অত্যন্ত জরুরি।

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com

সম্পর্কিত নিবন্ধ