‘প্রায় প্রতিদিনই মেয়েকে আমি কলেজে দিয়ে আসতাম। পথে মাঝেমধ্যে একটু-আধটু সমস্যা হলেই মেয়ে আমাকে বলত। কিন্তু কাল যে কী হলো, মোটরসাইকেলের চাকায় মেয়ের বোরকা আটকে গেল, সে কিছুই আমাকে বলতে পারল না। চোখের সামনে আমার হাতের ওপর মেয়েটি চলে গেল।’

গতকাল সোমবার বিকেলে কথাগুলো বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে আসছিল মো. আরিফুল ইসলামের। তিনি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা ইউনিয়নের নতুন সুখচর গ্রামের বাসিন্দা ও পেশায় পল্লিচিকিৎসক। গত রোববার সকালে বাড়ি থেকে কলেজে যাওয়ার পথে তাঁর মোটরসাইকেলের পেছনের চাকায় বোরকা ও ওড়না আটকে সড়কে ছিটকে পড়ে মারা যান মেয়ে ইশরাত জাহান ওরফে শান্তা (১৮)। ইশরাত তখন একাদশ শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তাঁর বাবার সঙ্গে হাতিয়া ডিগ্রি কলেজে যাচ্ছিলেন।

মেয়ের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর থেকেই বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন ইশরাতের মা মিনারা বেগম। যখনই তাঁর জ্ঞান ফিরছে ‘আমার মেয়ে কই? আমার মেয়ে কই? তোমরা আমার মেয়েকে এনে দাও’ বলে চিৎকার করছেন। চিৎকার করতে করতেই আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের কারও সান্ত্বনাই শান্ত করতে পারছে না মিনারা বেগমকে।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইশরাতের বাবা আরিফুল ইসলাম বলেন, ইশরাতকে কলেজে ভর্তি করার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই তিনি নিজে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে দিয়ে আসতেন। আবার ছুটির পর নিয়ে আসতেন। পেছনের চাকার সঙ্গে বোরকা ও ওড়না আটকে কীভাবে যে মেয়েটি মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পাকা সড়কে পড়ে গেলেন, টেরই পাননি আরিফুল। এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।

আরিফুল ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর আশপাশের লোকজনের সহায়তায় রক্তাক্ত অবস্থায় মেয়েকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই। সেখানে চিকিৎসকদের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য জেলা সদরেও পৌঁছাতে পারিনি। তার আগেই অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে একবার বমি করে ইশরাত। সঙ্গে সঙ্গে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। এরই মধ্যে আমার হাতের ওপর মেয়েটা নিস্তেজ হয়ে গেল। আমার কাছ থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে গেল। চোখের সামনে মেয়েকে হারানোর দৃশ্য তো কখনো ভুলতে পারব না। বারবার চোখের সামনে মেয়ের মুখখানা ভেসে উঠছে।’

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, আরিফুল ইসলামের দুই মেয়ে, এক ছেলে। ছোট মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। আর একমাত্র ছেলের বয়স সাত মাস। দুর্ঘটনার পর রোববার রাতে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে ইশরাত জাহানের লাশ দাফন করা হয়েছে। জানাজায় ইশরাতের সহপাঠীসহ এলাকার অনেক মানুষ অংশ নেন।

হাতিয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, কলেজে পরীক্ষা দিতে আসার পথে বাবার মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে তাঁদের ছাত্রীর মৃত্যু হয়। এই খবর শুনে তাঁরা শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী সবাই শোকাহত। ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আহত ছাত্রীর চিকিৎসায় সহায়তা করতে পাঠিয়েছেন। এখন পরীক্ষা চলছে। আরও কয়েক দিন পরীক্ষা চলবে। পরীক্ষা শেষে তাঁরা কলেজে একটি শোকসভা করবেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আর ফ ল ইসল ম পর ক ষ ইশর ত

এছাড়াও পড়ুন:

খেলাপি কারখানা কিনে চালুর উদ্যোগ আকিজ বশির গ্রুপের

চার প্রকৌশলী মিলে ২০১৬ সালে গাজীপুরের শ্রীপুরে গড়ে তোলেন বিদ্যুতের তার ও কেবলস উৎপাদন কারখানা। নাম দেওয়া হয় এমিনেন্স ইলেকট্রিক ওয়্যার অ্যান্ড কেব্‌লস লিমিটেড। তখন প্রকল্পটির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে ন্যাশনাল ব্যাংকের নেতৃত্বে চার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলে প্রতিষ্ঠানটিকে অর্থায়ন করে।

তবে ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতি ও সময়মতো চলতি মূলধন না পাওয়ায় প্রকল্পটি ব্যবসায়িক উৎপাদনই শুরু করতে পারেনি। উৎপাদন শুরুর আগেই শতকোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে। আর তাতে বিপাকে পড়ে প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করা ন্যাশনাল ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লংকাবাংলা ফাইন্যান্স।

এখন পুরো ঋণ ও দায়দেনা পরিশোধ করে প্রকল্পটি কিনে নিচ্ছে আকিজ বশির গ্রুপ। এ জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে চার অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান, আকিজ বশির গ্রুপ ও এমিনেন্স ইলেকট্রিক ওয়্যার অ্যান্ড কেব্‌লস। কারখানাটি কিনে নিতে আকিজ বশির গ্রুপ প্রায় ১১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। ইতিমধ্যে এমিনেন্সকে অর্থায়নকারী চার প্রতিষ্ঠানকে ঋণের একটা অংশ পরিশোধ করে দিয়েছে আকিজ বশির গ্রুপ। আগামী অক্টোবরের মধ্যে পুরো ঋণ শোধ করে কারখানাটির মালিকানা বুঝে নেবে তারা। এর মাধ্যমে আকিজ বশির গ্রুপ দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পণ্য উৎপাদনে বড় পরিসরে যাত্রা শুরুর পরিকল্পনা করছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এই প্রকল্প কিনে আকিজ বশির গ্রুপ নিজেরা লাভবান হয়েছে। পাশাপাশি তারল্যসংকটে পড়া ব্যাংকগুলোও তাতে উপকৃত হয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক এই প্রকল্পে দেওয়া পুরো অর্থ ফেরত পেতে যাচ্ছে। ব্যাংক দুটির কর্মকর্তারা বলছেন, এতে আমানতকারীদের উপকার হবে। ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরও বলেন, দেশে একটা নতুন প্রকল্প প্রস্তুত করতেই কয়েক বছর সময় লেগে যায়। কিন্তু এমিনেন্স কিনে নেওয়ার ফলে আকিজ বশির গ্রুপ এখন চাইলেই কয়েক মাসের মধ্যে উৎপাদন শুরু করতে পারবে।

এ বিষয়ে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়রা আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ঋণের একটা অংশ পেয়ে গেছি। পুরো টাকা কয়েক দিনের মধ্যে পেয়ে যাব। এটা খুবই ভালো হয়েছে। এভাবে বড় শিল্প গ্রুপগুলো এগিয়ে এলে কোনো কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ে থাকবে না।’

প্রকল্পের অবস্থা

অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সূত্রে জানা যায়, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গোদারচালা এলাকায় এমিনেন্স ইলেকট্রিক ওয়্যারস অ্যান্ড কেবলস লিমিটেড বৈদ্যুতিক তার ও কেবল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে। উচ্চমানের অ্যালুমিনিয়াম ও কপার বৈদ্যুতিক কেবল, উচ্চ ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক কেবল এবং খোলা কপার কেবল উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়, যার বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ৬৭ হাজার ১৫০ কিলোমিটার। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ১১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের নেতৃত্বে রূপালী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও লংকাবাংলা ফাইন্যান্স সিন্ডিকেট করে ৬৯ কোটি টাকা অর্থায়ন করে। বাকি টাকার জোগান দেন উদ্যোক্তারা।

প্রকল্পটি যখন পরিকল্পনা করা হয়, তখন ডলারের দাম ছিল ৮০ টাকা। ২০২১ সালে ডলারের দাম বেড়ে হয় ৮৫ টাকা। এর মধ্যে করোনার প্রকোপ শুরু হলে নির্মাণ ব্যয় আরও বেড়ে যায়। ফলে অবকাঠামো সম্পন্ন করতে আরও ৫ কোটি টাকা প্রয়োজন হয় প্রতিষ্ঠানটির। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৭৮ লাখ ডলারের যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলে, যা পরে ফোর্সড ঋণে পরিণত হয়। এর মধ্যে ২০২২ সালে ডলারের বিনিময় হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ফলে ৬৯ কোটি টাকা ঋণ বেড়ে হয় ১১৫ কোটি টাকা। পাশাপাশি চলতি মূলধন না পাওয়ায় বাণিজ্যিক উৎপাদনও শুরু করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এখন কারখানাটি কিনে নিয়ে উৎপাদনে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে আকিজ বশির গ্রুপ।

আকিজ বশির গ্রুপের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মো. খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আগামী নভেম্বর থেকে নতুন এই কারখানায় উৎপাদন শুরু করব। কম ভোল্টেজের তার উৎপাদন দিয়ে শুরু করব। কী নামে এই তার বাজারে আসবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। স্থানীয় চাহিদা বিবেচনা করে বাজারে বড় আকারে আসার পরিকল্পনা আছে আমাদের।’

আকিজ বশির যেভাবে কিনছে

এক বছরের বেশি সময় ধরে এমিনেন্সের উদ্যোক্তারা প্রকল্পটি বিক্রির চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। আকিজ বশির গ্রুপও এই ব্যবসায় আসতে পুরোনো প্রকল্প খুঁজছিল। এর মধ্যে তারা একাধিক তার ও কেব্‌লস উৎপাদন কারখানা কেনার জন্য আলোচনা করে। শেষমেশ এমিনেন্সের সঙ্গে আলোচনা চূড়ান্ত হয়। দুই পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছালে ৬ আগস্ট এ নিয়ে চুক্তিও হয়। এই চুক্তির ফলে আকিজ বশির গ্রুপ এখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের পাশাপাশি এমিনেন্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুবিধা, তাদের সরবরাহকারীদের বিলসহ আরও কিছু দায়দেনা শোধ করবে।

অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটিতে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ ৮৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা, রূপালী ব্যাংকের ১৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা, লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা ও এক্সিম ব্যাংকের ঋণ ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ইতিমধ্যে ঋণের কিছু অর্থ পেয়ে গেছে অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

এক্সিম ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুদা খানম বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ৫ লাখ টাকা পেয়েছি। ৬০ দিনের মধ্যে ঋণের বাকি টাকা পেয়ে যাব। এটা আমাদের জন্য ভালো হয়েছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ