টেলিটকের আধুনিকায়নের পরিকল্পনা, লক্ষ্য উন্নত সেবা
Published: 25th, June 2025 GMT
মোবাইল অপারেটর টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রযুক্তি হালনাগাদের একটি বৃহৎ পরিকল্পনায় হাত দিয়েছে। লক্ষ্য চতুর্থ প্রজন্মের (৪জি) সেবার বিস্তার, ভবিষ্যতের ৫জি প্রস্তুতি এবং নাগরিকদের জন্য আরো উন্নত ও নিরবচ্ছিন্ন ডিজিটাল সংযোগ নিশ্চিত করা।
আধুনিকায়নের ঘোষণা, বাস্তবে বিভ্রাট
টেলিটক গত ২৪ জুন রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত রিচার্জ সেবা সাময়িক বন্ধ থাকবে বলে আগেই জানায়। মূলত ব্যাকএন্ড সার্ভার, বিলিং সিস্টেম ও রিচার্জ মডিউল আপগ্রেডের জন্য এই সময় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সকাল পেরিয়ে দুপুর পর্যন্ত বহু গ্রাহক রিচার্জ করতে না পেরে চরম ভোগান্তিতে পড়ে।
বরিশাল, রংপুর, চট্টগ্রাম ও ঝালকাঠীর মতো এলাকায় একাধিক ব্যবহারকারী অভিযোগ করেন সকাল ৭টায় রিচার্জ করতে চাইলেও কাজ করেনি টেলিটকের সিস্টেম।
আরো পড়ুন:
‘মার্চ ফর গাজা’: সোহরাওয়ার্দীতে অর্ধশতাধিক মোবাইল চুরি
বাবার জানাজায় এসে আইফোন খোয়ালেন মনির খান
ঝালকাঠীর শিক্ষক রুহুল আমিন খান বলেন, “রাতে রিচার্জ বন্ধ থাকবে জেনেই সকাল ৭টার পর চেষ্টা করি। কিন্তু তখনও ব্যর্থ হই। অনলাইন ক্লাস নেওয়ার সময় ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে ক্লাস করতে পারিনি।”
ডেইভেন্টে ভেঙে পড়া সেবা
টেলিটকের ভাষ্য অনুযায়ী, রিচার্জ প্ল্যাটফর্মে ডেইভেন্ট ঘটায় মূল সমস্যার সৃষ্টি হয়। পরিকল্পিত সময়সীমার বাইরেও সেবা বিঘ্নিত থাকায় প্রশ্ন উঠেছে, এত বড় এক আপগ্রেড কেন আরো পরিকল্পিতভাবে সম্পন্ন হলো না।
টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড.
এ বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “টেলিটকের আধুনিকায়ন একটি কৌশলগত পরিবর্তনের অংশ। দেশের প্রতিটি উপজেলায় ৪জি সম্প্রসারণের কাজ চলছে।”
তিনি আরো বলেন, “প্রযুক্তি হঠাৎ ব্যর্থ হতেই পারে, তবে তা যেন গ্রাহকের ক্ষতির কারণ না হয় সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। রাষ্ট্রীয় এই অপারেটরকে আমরা বিশ্বাসযোগ্য প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
আশার আলো
বর্তমানে টেলিটকের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। ‘আগামী’ ও ‘স্বপ্ন’ নামে তরুণ ও শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ চালু করে প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে তরুণ সমাজে আগ্রহ জাগাতে পেরেছে। তবে চ্যালেঞ্জ এখন এই আস্থা ধরে রাখা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শফিক হাসান বলেন, “টেলিটকের আধুনিকায়ন নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী উদ্যোগ। কিন্তু শুরুতেই সেবার ভাঙন এই উদ্যোগের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রাষ্ট্রীয় এই অপারেটর যেন ‘আস্থাহীন ব্র্যান্ড’ হিসেবে না থেকে সত্যিকারের জাতীয় গর্ব হয়ে উঠতে পারে এটাই প্রত্যাশা।”
পুরনো সমস্যা, নতুন সুযোগ
বহুদিন ধরেই টেলিটকের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগ দুর্বল সিগনাল, অ্যাপ ব্যবহারযোগ্য না থাকা, রিচার্জে জটিলতা, অপ্রত্যাশিত ব্যালেন্স কাটাকাটি। এই আধুনিকায়ন প্রক্রিয়াই হতে পারত এক নতুন সূচনা। কিন্তু প্রযুক্তির প্রথম ধাক্কাতেই আবারও ফিরে এল পুরনো শঙ্কা।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি
টেলিটক জানিয়েছে, তারা ধাপে ধাপে দেশব্যাপী ৪জি বিস্তার, ভবিষ্যতে ৫জি রোলআউট, এবং ই-গভর্নেন্স ও শিক্ষা খাতে অংশগ্রহণ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা একটি সম্পূর্ণ অটোমেটেড ও আধুনিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলছি। কিছু কারিগরি জটিলতা থাকলেও তা অস্থায়ী। আমাদের অগ্রাধিকার হলো গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনা।”
তিনি বলেন, “টেলিটকের আধুনিকায়ন নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী উদ্যোগ। তবে সেই প্রযুক্তিগত রূপান্তর কেবল তখনই ফলপ্রসূ হবে, যখন এর প্রয়োগ হবে পরিকল্পিত, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট থাকবে শক্তিশালী, আর ‘গণমানুষের প্রযুক্তি’ হিসেবে আস্থা ফেরাতে পারবে প্রতিষ্ঠানটি। প্রযুক্তি বিকাশের প্রতিটি ধাপেই জনগণের আস্থা অর্জন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রীয় অপারেটর টেলিটক সেই চ্যালেঞ্জ পেরোতে পারবে কি না এখন সেটাই দেখার পালা।”
ঢাকা/এএএম/এসবি
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হলো একটু সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রূপান্তর এগিয়ে নেওয়া। এ জন্য যে ধরনের সংস্কার দরকার, সেই সংস্কার নিশ্চিত করা। আর কয়েক মাস পর নির্বাচন। নির্বাচন ভালোমতো করার জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করার জন্য এখন মনোযোগ দেওয়া দরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করা। পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনা। অথচ এসব দিকে সরকারের মনোযোগ বা সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না।
নির্বাচনের এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে যেটিতে তাদের এখতিয়ার নেই, সেই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতেই সরকারের যত আগ্রহ। রীতিমতো জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে। দেশের মানুষ, বিশেষজ্ঞ—কারও কথা না শুনে, জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা না করে ভয় দেখিয়ে একের পর এক চুক্তি করছে সরকার।
একটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার কোনো এখতিয়ার এ রকম অস্থায়ী সরকারের থাকে না। এসবের জন্য নির্বাচিত সরকার দরকার হয়। শুধু নির্বাচিত সরকারও এভাবে করতে পারে না। নির্বাচিত সরকার এ ধরনের চুক্তি করলে সেগুলো সংসদে তুলতে হবে, সেখানে তর্ক-বিতর্ক হবে, দেশের মানুষ জানবে। আর কয় মাস পর নির্বাচন। এই সময় সরকারের এই ধরনের চুক্তিতে এত আগ্রহ কেন? বন্দর নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি যদি দেশের উন্নয়নের জন্যই হয়, তাহলে এত গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা ও তাড়াহুড়া কেন?
চুক্তি নিয়ে এই সরকারের অতি আগ্রহ বড় সন্দেহের কারণ। মনে হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির কিছু লবিস্ট এই সরকার চালাচ্ছে। তাদের কাজ হলো কোনো না কোনোভাবে বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় গোপনে অস্বচ্ছভাবে চুক্তি করে ফেলা। সেটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, যাতে পরবর্তী কোনো সরকার এসে কিছু করতে না পারে। কিন্তু এই চুক্তির বোঝা বাংলাদেশের মানুষকে ভোগ করতে হবে বহু বছর।
গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, স্বচ্ছতা নিয়মনীতি মেনে কাজ হবে, তার প্রতি এটা বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়। একই সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক দল সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলাপ-আলোচনা করছে, অথচ সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা নিয়ে তারা যে নিশ্চুপ থাকল, সেটার দায়িত্বও তাদের নিতে হবে।
আমরা দেখেছি, এ রকম চুক্তির আগে সব সময় যুক্তি দেওয়া হয়, বিদেশি কোম্পানি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কোম্পানি। আবার মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি করা হয় যে আমরা পারব না। আমাদের পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়। বিদেশিরা এলে কাজ হবে। আবার আমরা থাকলে দুর্নীতি হবে। বিদেশিরা এলে দুর্নীতি হবে না। এই হীনম্মন্যতা তৈরি করে এবং তার ওপর ভর করে বিদেশি কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। বিদেশিদের পক্ষে বিজ্ঞাপনী প্রচার চালাতে থাকে তাদের সুবিধাভোগী দেশি লোকজন। কিন্তু বিদেশিরা এলে যে দুর্নীতি হবে না, সেটার নিশ্চয়তা কীভাবে দেওয়া হয়? আন্তর্জাতিকভাবে কি দুর্নীতি হয় না? চুক্তির আগে মাশুল যে বাড়ানো হলো, এটাও তো দুর্নীতির একটা ধরন।
বিদেশি কোম্পানি যে দক্ষ, আন্তর্জাতিক যে স্বীকৃতি, সেই কোম্পানিগুলো কিন্তু এমনিতেই গড়ে ওঠেনি। জাতীয় সক্ষমতার প্রক্রিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠেছে এসব কোম্পানি। বাংলাদেশকেও জাতীয় সক্ষমতার ওপর দাঁড়াতে হবে। সে জন্য নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। একটা দেশ শক্তভাবে দাঁড়াতে পারে, যখন নিজের সক্ষমতা তৈরি হয়। এই সরকার দেশকে বিপন্ন করে তার উল্টো দিকে যাত্রা করছে।
লেখক পরিচয়: অর্থনীতিবিদ ও সম্পাদক, সর্বজনকথা