ট্রাম্প-এরদোয়ান বৈঠক এবং মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা
Published: 29th, June 2025 GMT
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার বৈঠক করেছেন। জানুয়ারিতে ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা গ্রহণের পর এটি তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। নেদারল্যান্ডসের হেগে অনুষ্ঠিত ন্যাটো সাম্মেলনের পাশাপাশি তাদের এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তুরস্ক-মার্কিন সম্পর্কের এক জটিল মুহূর্তে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুই নেতার এ বৈঠকে আলোচিত বিষয় ছিল: ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি, ইউক্রেন-রাশিয়া আলোচনা, গাজা, সিরিয়া ও এফ-৩৫ ফাইটার জেট কর্মসূচি।
প্রতিটি বিষয় আলাদাভাবে আলোচনার দাবি রাখে। তবে শুরুতেই ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা বিষয়ে তুরস্কের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকা যখন এ অঞ্চলে হামলা চালায়, সেটি আঞ্চলিক ক্ষমতার গতি-প্রকৃতিসহ বৈশ্বিক বাজার এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে শত্রুতা-মিত্রতার ওপর প্রভাব ফেলে। সেদিক থেকে আঙ্কারার প্রতিক্রিয়া কৌতূহলোদ্দীপক বলতে হবে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি যখন তুরস্ক সফরে ছিলেন ঠিক সে সময়েই ইরানে হামলা করে যুক্তরাষ্ট্র। হামলার পরপরই আরাগচি ইস্তাম্বুলে এক সংবাদ সম্মেলন করেন, যেখানে তিনি সরাসরি তুরস্কের সংবাদমাধ্যমকে সম্মোধন করেন। তাঁর সংবাদ সম্মেলনে তুরস্কের কোনো কর্তাব্যক্তি ছিলেন না। ব্যাপারটা এমন যে, তুরস্ক তৃতীয় পক্ষ হিসেবে মধ্যস্থতা করছে। ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে তুরস্ক এখনও সম্ভাব্য সক্রিয় শক্তিগুলোর একটি। তবে আঞ্চলিক বিষয়গুলোতে তুরস্ক যেভাবে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, সেটা হয়তো তার কৌশলগত বিষয়, যেখানে দেশটি কূটনৈতিকভাবে সংকট মোকাবিলার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলার পর একটি শক্তিশালী বিবৃতি দিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু ‘নিন্দা’ শব্দটি উল্লেখ করেনি। তুরস্ক হিসাব করেই শব্দ ব্যবহার করেছে, যাতে ভবিষ্যতে তুরস্ক মধ্যস্থতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে ইরানকে আলোচনার টেবিলে আনার জন্য কাজ করছিল তুরস্ক। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকেও তেহরানে সামরিক হামলা না চালাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়। মধ্য জুনে এরদোয়ান ট্রাম্পের সঙ্গে দুইবার কথা বলেছিলেন, যাতে ইরান- যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু আলোচনা আবার শুরু করা যায়। তিনি বৃহত্তর কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কথাও বলেছিলেন।
ঘোলাটে পরিবেশে আঙ্কারার এ পদক্ষেপ পরিকল্পিত বলেই মনে হয়। তবে আঞ্চলিক পরিস্থিতির ওপর ব্যাপকভাবে এ পদক্ষেপের কার্যকারিতা নির্ভর করে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এরদোয়ানের প্রত্যাশা বিভিন্ন দিক থেকেই অনেক বেশি। প্রথম কথা হলো, তিনি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে হোয়াইট হাউসে গিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে মিটিং করার বিষয়ে কাজ করছেন। তিনি ২০২৬ সালের ন্যাটো সম্মেলনও তুরস্কে আয়োজন করতে চান, যেটি আঙ্কারার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ কূটনৈতিক সুযোগ।
দ্বিতীয়ত, এরদোয়ানের প্রত্যাশা, তুরস্ক হতে পারে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে শান্তি আলোচনার স্থান। এটি উচ্চাভিলাষী কূটনৈতিক লক্ষ্য। কিন্তু ট্রাম্প ইতোমধ্যে বলেছেন, তিনি এ ধরনের আলোচনায় বসতে পারেন, যদি পুতিন রাজি হন।
তৃতীয়ত, ওয়াশিংটনের সঙ্গে গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বিষয়ে তুরস্ক আলোচনা করতে খুবই আগ্রহী। এই বিষয় ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ ও সিরিয়া পরিস্থিতির ডামাডোলে ঢাকা পড়েছে। গাজার এই অমানবিক ট্র্যাজেডি বন্ধে তুরস্ক ওয়াশিংটনকে রাজি করাতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
চতুর্থ বিষয়, তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের মধ্যে সিরিয়া এক জটিল অবস্থানে রয়েছে। সিরিয়ার ওপর অবরোধ তুলে নেওয়ার বিষয়ে আমেরিকার সিদ্ধান্তকে এরদোয়ান স্বাগত জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সকে সমর্থন দিয়ে আসছে, সেই বাহিনীকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তুরস্ক তার জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে দেখে। এই সাহায্য তুরস্কের জন্য অস্বস্তির কারণ।
তুরস্কের দিক থেকে আরেকটি অগ্রাধিকার হলো, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চিরস্থায়ী হওয়া। তাৎক্ষণিক বিষয় হিসেবে ট্রাম্পের সঙ্গে এরদোয়ানের ৪৫ মিনিটের মিটিংয়ে এই বিষয়ই জোর পেয়েছে। চূড়ান্তভাবে এরদোয়ান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফ-৩৫ ফাইটার জেট পাওয়ার আশা তিনি ছাড়ছেন না। পূর্বে রাশিয়া থেকে এ বিমান লাভের পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে তুরস্ক এবং দেশটি সামরিক শিল্প বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্কের সহযোগিতা চুক্তি ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর প্রত্যাশা করছে।
গাজা, সিরিয়া থেকে এফ-৩৫ বিমান এবং যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার কূটনীতি তা কোনো বিষয়ই রাতারাতি সমাধানযোগ্য নয়। এ জন্য উভয় পক্ষ থেকে বাস্তবিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পারস্পরিক বোঝাপড়া দরকার। তুরস্ক-আমেরিকার সম্পর্ক স্পষ্টতই বাস্তব পরিকল্পনা ও নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর পর্যায়ে রয়েছে। সময়ের সঙ্গে তা নতুনরূপে দেখা যেতে পারে।
ড.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ক টন ত ক ত রস ক র এরদ য় ন ইসর য় ল র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হলো একটু সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রূপান্তর এগিয়ে নেওয়া। এ জন্য যে ধরনের সংস্কার দরকার, সেই সংস্কার নিশ্চিত করা। আর কয়েক মাস পর নির্বাচন। নির্বাচন ভালোমতো করার জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করার জন্য এখন মনোযোগ দেওয়া দরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করা। পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনা। অথচ এসব দিকে সরকারের মনোযোগ বা সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না।
নির্বাচনের এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে যেটিতে তাদের এখতিয়ার নেই, সেই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতেই সরকারের যত আগ্রহ। রীতিমতো জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে। দেশের মানুষ, বিশেষজ্ঞ—কারও কথা না শুনে, জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা না করে ভয় দেখিয়ে একের পর এক চুক্তি করছে সরকার।
একটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার কোনো এখতিয়ার এ রকম অস্থায়ী সরকারের থাকে না। এসবের জন্য নির্বাচিত সরকার দরকার হয়। শুধু নির্বাচিত সরকারও এভাবে করতে পারে না। নির্বাচিত সরকার এ ধরনের চুক্তি করলে সেগুলো সংসদে তুলতে হবে, সেখানে তর্ক-বিতর্ক হবে, দেশের মানুষ জানবে। আর কয় মাস পর নির্বাচন। এই সময় সরকারের এই ধরনের চুক্তিতে এত আগ্রহ কেন? বন্দর নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি যদি দেশের উন্নয়নের জন্যই হয়, তাহলে এত গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা ও তাড়াহুড়া কেন?
চুক্তি নিয়ে এই সরকারের অতি আগ্রহ বড় সন্দেহের কারণ। মনে হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির কিছু লবিস্ট এই সরকার চালাচ্ছে। তাদের কাজ হলো কোনো না কোনোভাবে বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় গোপনে অস্বচ্ছভাবে চুক্তি করে ফেলা। সেটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, যাতে পরবর্তী কোনো সরকার এসে কিছু করতে না পারে। কিন্তু এই চুক্তির বোঝা বাংলাদেশের মানুষকে ভোগ করতে হবে বহু বছর।
গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, স্বচ্ছতা নিয়মনীতি মেনে কাজ হবে, তার প্রতি এটা বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়। একই সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক দল সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলাপ-আলোচনা করছে, অথচ সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা নিয়ে তারা যে নিশ্চুপ থাকল, সেটার দায়িত্বও তাদের নিতে হবে।
আমরা দেখেছি, এ রকম চুক্তির আগে সব সময় যুক্তি দেওয়া হয়, বিদেশি কোম্পানি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কোম্পানি। আবার মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি করা হয় যে আমরা পারব না। আমাদের পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়। বিদেশিরা এলে কাজ হবে। আবার আমরা থাকলে দুর্নীতি হবে। বিদেশিরা এলে দুর্নীতি হবে না। এই হীনম্মন্যতা তৈরি করে এবং তার ওপর ভর করে বিদেশি কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। বিদেশিদের পক্ষে বিজ্ঞাপনী প্রচার চালাতে থাকে তাদের সুবিধাভোগী দেশি লোকজন। কিন্তু বিদেশিরা এলে যে দুর্নীতি হবে না, সেটার নিশ্চয়তা কীভাবে দেওয়া হয়? আন্তর্জাতিকভাবে কি দুর্নীতি হয় না? চুক্তির আগে মাশুল যে বাড়ানো হলো, এটাও তো দুর্নীতির একটা ধরন।
বিদেশি কোম্পানি যে দক্ষ, আন্তর্জাতিক যে স্বীকৃতি, সেই কোম্পানিগুলো কিন্তু এমনিতেই গড়ে ওঠেনি। জাতীয় সক্ষমতার প্রক্রিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠেছে এসব কোম্পানি। বাংলাদেশকেও জাতীয় সক্ষমতার ওপর দাঁড়াতে হবে। সে জন্য নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। একটা দেশ শক্তভাবে দাঁড়াতে পারে, যখন নিজের সক্ষমতা তৈরি হয়। এই সরকার দেশকে বিপন্ন করে তার উল্টো দিকে যাত্রা করছে।
লেখক পরিচয়: অর্থনীতিবিদ ও সম্পাদক, সর্বজনকথা