চিকুনগুনিয়া একটি মশাবাহিত ভাইরাল রোগ। ডেঙ্গুর মতো। এর লক্ষণগুলো অনেকটা ফ্লুর মতো হওয়ায় অনেক সময় ভুল হতে পারে। তবে কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ দেখে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করা সম্ভব।
চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ
চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে সাধারণত লক্ষণ প্রকাশ পায়। প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
তীব্র জ্বর: হঠাৎ করে ১০২-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত জ্বর উঠতে পারে, যা দুই থেকে সাত পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
তীব্র গাঁটে ব্যথা (আর্থ্রাইটিস): এটি চিকুনগুনিয়ার সবচেয়ে প্রধান এবং কষ্টদায়ক লক্ষণ। শরীরের ছোট-বড় প্রায় সব গাঁটে তীব্র ব্যথা হতে পারে, বিশেষ করে হাত, পা, কব্জি এবং গোড়ালির গাঁটে। ব্যথা এত তীব্র হতে পারে যে হাঁটাচলা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই ব্যথা কয়েক সপ্তাহ থেকে মাস, এমনকি বছরখানেকও থাকতে পারে।
মাথাব্যথা: তীব্র মাথাব্যথা একটি সাধারণ লক্ষণ।
পেশি ব্যথা: শরীরজুড়ে পেশিতে ব্যথা অনুভব হতে পারে।
ত্বকে ফুসকুড়ি: জ্বর আসার দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে শরীরজুড়ে ছোট ছোট লালচে ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।
ক্লান্তি: প্রচণ্ড দুর্বলতা এবং ক্লান্তি অনুভব হতে পারে।
বমি বমি ভাব বা বমি: কিছু ক্ষেত্রে বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
চোখে ব্যথা: চোখের পেছনে ব্যথা অনুভব হতে পারে।
শিশুদের ক্ষেত্রে জ্বর, ফুসকুড়ি এবং গাঁটে ব্যথা তুলনামূলকভাবে কম তীব্র হতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে গাঁটে ব্যথা এবং ক্লান্তি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা
চিকুনগুনিয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা নেই। এর চিকিৎসা মূলত লক্ষণভিত্তিক এবং সহায়ক। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো ব্যথা এবং জ্বর কমানো এবং রোগীকে আরাম দেওয়া।
বিশ্রাম: পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া খুবই জরুরি, বিশেষ করে জ্বর এবং ব্যথার সময়।
জ্বর ও ব্যথা কমানো: জ্বর এবং গাঁটে ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল (Paracetamol) ব্যবহার করা যেতে পারে।
পর্যাপ্ত তরল পান: ডিহাইড্রেশন এড়াতে প্রচুর পরিমাণে জল, ফলের রস, স্যুপ এবং ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন পান করতে হবে।
জয়েন্টে ব্যথা ব্যবস্থাপনা: গাঁটে তীব্র ব্যথার জন্য গরম বা ঠান্ডা সেঁক ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে ফিজিওথেরাপি নেওয়া যেতে পারে, যা গাঁটের কার্যকারিতা পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করে।
চিকুনগুনিয়া হলে রোগীকে নিম্নলিখিত ধরনের খাবারগুলো খেতে উৎসাহিত করা হয়
প্রচুর পরিমাণে তরল পানীয়: চিকুনগুনিয়ায় জ্বর এবং দুর্বলতার কারণে শরীর ডিহাইড্রেশন হতে পারে। এ কারণে প্রচুর পরিমাণে তরল গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
ডাবের পানি: এটি প্রাকৃতিক ইলেকট্রোলাইট এবং পুষ্টি উপাদানের ভালো উৎস, যা শরীরের দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করে।
ফলের রস: তাজা ফলের রস যেমন কমলা, মাল্টা, আনারস, আপেল, পেঁপে, আঙুর, ডালিম ইত্যাদির রস পান করতে পারেন। ভিটামিন সিসমৃদ্ধ ফল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
স্যুপ: বিভিন্ন সবজির স্যুপ, মুরগির স্যুপ, অথবা ডালের স্যুপ শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে এবং হজমে সহায়তা করে।
সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর খাবার: শরীর দুর্বল থাকায় হজমে সমস্যা হতে পারে। সহজে হজম হয় এমন খাবার খাওয়া উচিত।
জাউ ভাত বা নরম খিচুড়ি: এগুলো শরীরে শক্তি জোগায় এবং হজমে সহজ।
পর্যাপ্ত প্রোটিন: শরীরের কোষ মেরামত
এবং শক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রোটিন জরুরি। মাছ, মুরগির মাংস (চর্বিহীন), ডিম, মসুর
ডাল, ছোলা, সয়াবিন ইত্যাদি প্রোটিনের ভালো উৎস।
ভিটামিন ও খনিজসমৃদ্ধ খাবার
সবুজ শাকসবজি: পালংশাক, কচুশাক, মিষ্টি কুমড়া, গাজর ইত্যাদি ভিটামিন ও খনিজসমৃদ্ধ, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এগুলো সহজে হজম হয় এবং শরীরকে পুষ্টি জোগায়।
সাইট্রাস ফল: লেবু, কমলা, মাল্টা ইত্যাদি ভিটামিন সি-এর চমৎকার উৎস, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং দ্রুত আরোগ্যে সাহায্য করে।
বাদাম, চিয়া বীজ, জলপাই তেল: এগুলোতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা প্রদাহ কমাতে এবং হাড়ের কার্যকারিতা উন্নত করতে সহায়ক।
চিকিৎসকের পরামর্শ: লক্ষণ দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। কারণ সঠিক রোগ নির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস প্রতিরোধ
চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের মূল উপায় হলো মশা নিয়ন্ত্রণ এবং মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা।
মশার কামড় থেকে সুরক্ষা
l দিনের বেলা এবং সন্ধ্যায় মশা বেশি সক্রিয় থাকে, তাই এই সময়ে মশার কামড় থেকে বাঁচতে ফুলহাতা জামা ও লম্বা প্যান্ট পরুন।
l মশা তাড়ানোর স্প্রে বা লোশন ব্যবহার করুন।
l ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করুন, বিশেষ করে যদি এলাকায় চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব থাকে।
l ঘরের দরজা-জানালায় মশারোধী নেট ব্যবহার করুন।
l মশা মারার স্প্রে বা কয়েল ব্যবহার করতে পারেন, তবে শিশুদের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন।
চিকুনগুনিয়া একটি কষ্টদায়ক রোগ হলেও, সঠিক যত্ন এবং প্রতিরোধের মাধ্যমে এর বিস্তার রোধ করা সম্ভব। আপনার বা আপনার পরিচিত কারও মধ্যে যদি চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ
দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। v
[শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ; ফয়সল হাসপাতাল, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ]
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর স হ য য কর চ ক ৎসক র র পর ম র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হলো একটু সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রূপান্তর এগিয়ে নেওয়া। এ জন্য যে ধরনের সংস্কার দরকার, সেই সংস্কার নিশ্চিত করা। আর কয়েক মাস পর নির্বাচন। নির্বাচন ভালোমতো করার জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করার জন্য এখন মনোযোগ দেওয়া দরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করা। পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনা। অথচ এসব দিকে সরকারের মনোযোগ বা সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না।
নির্বাচনের এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে যেটিতে তাদের এখতিয়ার নেই, সেই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতেই সরকারের যত আগ্রহ। রীতিমতো জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে। দেশের মানুষ, বিশেষজ্ঞ—কারও কথা না শুনে, জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা না করে ভয় দেখিয়ে একের পর এক চুক্তি করছে সরকার।
একটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার কোনো এখতিয়ার এ রকম অস্থায়ী সরকারের থাকে না। এসবের জন্য নির্বাচিত সরকার দরকার হয়। শুধু নির্বাচিত সরকারও এভাবে করতে পারে না। নির্বাচিত সরকার এ ধরনের চুক্তি করলে সেগুলো সংসদে তুলতে হবে, সেখানে তর্ক-বিতর্ক হবে, দেশের মানুষ জানবে। আর কয় মাস পর নির্বাচন। এই সময় সরকারের এই ধরনের চুক্তিতে এত আগ্রহ কেন? বন্দর নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি যদি দেশের উন্নয়নের জন্যই হয়, তাহলে এত গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা ও তাড়াহুড়া কেন?
চুক্তি নিয়ে এই সরকারের অতি আগ্রহ বড় সন্দেহের কারণ। মনে হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির কিছু লবিস্ট এই সরকার চালাচ্ছে। তাদের কাজ হলো কোনো না কোনোভাবে বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় গোপনে অস্বচ্ছভাবে চুক্তি করে ফেলা। সেটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, যাতে পরবর্তী কোনো সরকার এসে কিছু করতে না পারে। কিন্তু এই চুক্তির বোঝা বাংলাদেশের মানুষকে ভোগ করতে হবে বহু বছর।
গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, স্বচ্ছতা নিয়মনীতি মেনে কাজ হবে, তার প্রতি এটা বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়। একই সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক দল সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলাপ-আলোচনা করছে, অথচ সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা নিয়ে তারা যে নিশ্চুপ থাকল, সেটার দায়িত্বও তাদের নিতে হবে।
আমরা দেখেছি, এ রকম চুক্তির আগে সব সময় যুক্তি দেওয়া হয়, বিদেশি কোম্পানি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কোম্পানি। আবার মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি করা হয় যে আমরা পারব না। আমাদের পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়। বিদেশিরা এলে কাজ হবে। আবার আমরা থাকলে দুর্নীতি হবে। বিদেশিরা এলে দুর্নীতি হবে না। এই হীনম্মন্যতা তৈরি করে এবং তার ওপর ভর করে বিদেশি কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। বিদেশিদের পক্ষে বিজ্ঞাপনী প্রচার চালাতে থাকে তাদের সুবিধাভোগী দেশি লোকজন। কিন্তু বিদেশিরা এলে যে দুর্নীতি হবে না, সেটার নিশ্চয়তা কীভাবে দেওয়া হয়? আন্তর্জাতিকভাবে কি দুর্নীতি হয় না? চুক্তির আগে মাশুল যে বাড়ানো হলো, এটাও তো দুর্নীতির একটা ধরন।
বিদেশি কোম্পানি যে দক্ষ, আন্তর্জাতিক যে স্বীকৃতি, সেই কোম্পানিগুলো কিন্তু এমনিতেই গড়ে ওঠেনি। জাতীয় সক্ষমতার প্রক্রিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠেছে এসব কোম্পানি। বাংলাদেশকেও জাতীয় সক্ষমতার ওপর দাঁড়াতে হবে। সে জন্য নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। একটা দেশ শক্তভাবে দাঁড়াতে পারে, যখন নিজের সক্ষমতা তৈরি হয়। এই সরকার দেশকে বিপন্ন করে তার উল্টো দিকে যাত্রা করছে।
লেখক পরিচয়: অর্থনীতিবিদ ও সম্পাদক, সর্বজনকথা