রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার কোনো চেষ্টাই যেন কাজে আসছে না। সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া নগদ সহায়তা এবং উদ্যোক্তাদের নানা উদ্যোগের পরও পরিস্থিতির উন্নতি নেই। বরং রপ্তানি আয়ে গুটি কয়েক পণ্যের ওপর নির্ভরতা যেন বাড়ছেই। মূলত আট পণ্যে আটকে আছে দেশের রপ্তানি খাত।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যবহৃত বিশ্ব শুল্ক সংস্থার (ডব্লিউসিও) পণ্য শনাক্তকরণ নম্বর হারমোনাইজড সিস্টেম বা এইচএস কোড অনুযায়ী রপ্তানির তালিকায় বাংলাদেশের মৌলিক পণ্যের সংখ্যা ৭৫১। ৬ কিংবা ৮ সংখ্যার এইচএস কোড অনুযায়ী পণ্যের সংখ্যা অন্তত ১০ হাজার। এসব পণ্যের মধ্যে মাত্র আট পণ্য থেকে রপ্তানি আয় আসে প্রায় ৯২ শতাংশ। বাদবাকি ৯ হাজার ৯৯২ পণ্য থেকে আসে মাত্র ৮ শতাংশের মতো।
সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের উপাত্ত বলছে, অর্থবছরটিতে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় এসেছে ৪ হাজার ৮২৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে আট পণ্যের অবদানই চার ৪১৬ কোটি ডলার। বাকি পণ্যের অবদান ৪১৩ কোটি ডলার। প্রধান আট পণ্য হচ্ছে– তৈরি পোশাকের নিট বা গেঞ্জি জাতীয় পণ্য, ওভেন বা শার্ট, প্যান্ট জাতীয় পণ্য, হোম টেক্সটাইল, কৃষিজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ এবং প্রকৌশল পণ্য ।
প্রথম অবস্থানে নিট পোশাক
রপ্তানি খাতে নিট পোশাকের অবস্থান প্রথম। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা যায়, গত অর্থবছরে মোট রপ্তানিতে নিট পোশাকের অবদান ৪৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। রপ্তানির পরিমাণ ২ হাজার ১১৬ কোটি ডলারের মতো, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় আসে ১ হাজার ৯২৮ কোটি ডলার।
ওভেনের অবস্থান দ্বিতীয়
মোট রপ্তানিতে পোশাক খাতের ওভেনের অবদান নিটের তুলনায় কিছুটা কম ৩৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। রপ্তানির পরিমাণ ১ হাজার ৮১৯ কোটি ডলারের মতো। এ আয় গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৮ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছর ওভেন থেকে রপ্তানি আয় আসে ১ হাজার ৬৮৭ কোটি ডলার।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য
রপ্তানি আয়ের দিক থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং পাদুকার অবস্থান তৃতীয়। মোট রপ্তানিতে এ পণ্যের অবদান এখন ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত অর্থবছর এ খাতে রপ্তানি বেড়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি। রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১১৫ কোটি ডলারের। আগের অর্থবছর যা ছিল ১০৪ কোটি ডলারের কিছু কম।
কৃষিজাত পণ্যের অবস্থান চতুর্থ
মোট রপ্তানি আয়ে এ খাতের হিস্যা ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে রয়েছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, তাজা ও হিমায়িত সবজি, ফলমূল ইত্যাদি। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মধ্যে মসলা, চানাচুর, ঝালমুড়ি, বিস্কুট, সস, জেলি, আলুপুরি, পাঁপড়, নুডলস, চকলেট, বিভিন্ন ধরনের আচার, জুস, ফ্রুট ড্রিঙ্ক, চিপসসহ বিভিন্ন পণ্য। গত অর্থবছর এ খাতের রপ্তানি বেড়েছে ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০১ কোটি ডলার। আগের অর্থবছর এ পরিমাণ ছিল ৯৮ কোটি ডলার।
হোম টেক্সটাইল
পোশাক খাতের সমজাতীয় পণ্য হোমটেক্স বা হোম টেক্সটাইল। রপ্তানি খাতে হোম টেক্সটাইলের অবস্থান তৃতীয়। সরাসরি পোশাকের অংশ না হলেও গৃহসজ্জার বিভিন্ন সামগ্রী, যেমন– বিছানার চাদর, বালিশের কভার, পর্দা, কার্পেট, টেবিল ক্লথ, কুশন, টাওয়েল ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত। রপ্তানি খাতে এ হোম টেক্সটাইলের অবদান ২ শতাংশের মতো। গত অর্থবছর এ খাতের রপ্তানি বেড়েছে আড়াই শতাংশের মতো। রপ্তানি হয় ৮৭ কোটি ডলারের বিভিন্ন হোম টেক্সটাইল পণ্য। আগের অর্থবছর এ খাতের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮৫ কোটি ডলারের কিছু বেশি। অবশ্য অতিমারি করোনাকালে হোম কোয়ারেনটাইনের কারণে বিশ্বব্যাপী ২০২০-২১ অর্থবছর হোম টেক্সাইল পণ্যের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যায়। ওই অর্থবছর প্রথমবারের মতো ১০০ কোটি ডলারের ঘর ছাড়ায় হোম টেক্সটাইল খাত। মোট রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১১৩ কোটি ডলার। পরের অর্থবছর প্রায় ১৫০ কোটি ডলারের এ ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়। এতে রপ্তানি আয়ের হিসাবে তৈরি পোশাকের পরই দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি পণ্যের মর্যাদা পায় হোম টেক্সটাইল পণ্য। এ সুবাদে দেশের মোট রপ্তানি আয়ে এ খাতের অবদান এখন ৩ শতাংশের বেশি। তবে দেশে গ্যাসের সংকটে হোম টেক্সটাইল পণ্যের রপ্তানি আবার কমতে থাকে।
পাটের অবস্থান ষষ্ঠ
একসময় রপ্তানি খাতের প্রধান পণ্য ছিল পাট ও পাটপণ্য। মোট রপ্তানির ৯৭ শতাংশই আসত খাতটি থেকে। সেই সূত্রে স্বর্ণসূত্র বা সোনালি আঁশ বলা হতো পাটকে। ক্রমেই খাতটি রপ্তানিতে গৌরব হারায়। সমাপ্ত অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের বিবেচনায় পাট ও পাটপণ্যের হিস্যা কমে মাত্র ১ দশমিক ৭০ শতাংশে নেমে আসে। রপ্তানি হয় ৮২ কোটি ডলারের পাটপণ্য, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪ শতাংশ কম। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাট ও পাটপণ্যের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮৬ কোটি ডলারের মতো।
প্রকৌশল পণ্য
প্রকৌশল পণ্য রপ্তানি খাতে খুব বেশি দিনের নয়। তবে ইতোমধ্যে খাতটি সম্ভাবনা জাগাতে সক্ষম হয়েছে। সমাপ্ত অর্থবছর রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৫৪ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। ওই অর্থবছর রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৯ কোটি ডলার। ইপিবির তথ্যমতে, বাংলাদেশ বর্তমানে যেসব প্রকৌশল পণ্য রপ্তানি করছে, তার মধ্যে আছে আয়রন-স্টিল, তামার তার, স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি সামগ্রী, প্রকৌশল যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রিক পণ্য, বাইসাইকেল এবং অন্যান্য পণ্য।
অষ্টম অবস্থানে মাছ
রপ্তানি খাতে একসময় হিমায়িত ও জীবন্ত মাছের প্রাধান্য ছিল। রপ্তানি তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল রূপালি সোনাখ্যাত খাতটি। তবে বিভিন্ন কমপ্লায়েন্স শর্ত পরিপালন ইস্যুতে খাতটি পিছিয়ে পড়ে। গত অর্থবছর এ খাতে রপ্তানি বেড়েছে ১৭ শতাংশ। পরিমাণে রপ্তানি দাঁড়ায় ৪৪ কোটি ডলারে। মোট রপ্তানি আয়ে এ খাতের অবদান এখন ১ শতাংশেরও কম।
নানামুখী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রপ্তানি পণ্যে কেন বৈচিত্র্য আসছে না, সে বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.
দেশে রপ্তানি সংক্রান্ত সেবা দিয়ে থাকে ১৪টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সেবায় কী ধরনের দুর্বলতা আছে, তা জানার চেষ্টা করছে ইপিবি। ইপিবির একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জরিপের ভিত্তিতে রপ্তানি সংক্রান্ত দুর্বলতা চিহ্নিত করার পাশাপাশি সমস্যা সমাধানে একটি কর্মকৌশল নির্ধারণের কথা রয়েছে।
জানতে চাইলে ইপিবির পণ্য উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ শাহজালাল সমকালকে বলেন, জরিপের সুপারিশের ভিত্তিতে নেওয়া কর্মকৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে রপ্তানি সংক্রান্ত নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করা সহজ হবে। বিশেষ করে পণ্য উৎপাদন, মোড়কীকরণ ও রপ্তানি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার মতো সামর্থ্য নেই– এমন ক্ষুদ্র এবং অদক্ষ উদ্যোক্তাও খুব সহজে রপ্তানি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবেন। ফলে রপ্তানি ঝুড়িতে অনেক পণ্য যুক্ত হবে। বৈচিত্র্য আসবে রপ্তানি খাতে। রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কোনো কোনো পণ্যে বিভিন্ন হারে নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ইপিবির এক জেলা এক পণ্য, বিশেষ পণ্য উন্নয়ন, বিদেশে মেলা-প্রদর্শনীতে উদ্যোক্তাদের অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়াসহ বেশ কিছু উদ্যোগ আছে।
আট পণ্য সীমিত থাকলেও রপ্তানি তালিকায় সম্ভাবনাময় পণ্য অনেক। অনেক দিন ধরে এসব পণ্যের সম্ভাবনার কথা শোনা যায়। আশার কথা হচ্ছে, কয়েক বছর ধরে এ ধরনের কিছু পণ্যের রপ্তানি বাড়ছে। সর্বশেষ গত অর্থবছর আগের অর্থবছরের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে এমন পণ্যের তালিকায় রয়েছে কাগজ ও কাগজ পণ্য, ইলেকট্রিক পণ্য, জাহাজ, চা, স্পেশালাইজড টেক্সটাইল, হ্যান্ডিক্রাফটস, রাবার, গলফ সাফট, তামাক, কার্পেট, বাইসাইকেল, নিট ফেব্রিকস, ক্যাপ, সিরামিক প্রডাক্টস, জুট সকস অ্যান্ড ব্যাগ, ক্র্যাবস, ওষুধ, কেমিক্যাল প্রডাক্টস, উইগস ও মানুষের চুল, কপার ওয়্যার, প্লাস্টিক দ্রব্যাদি, পেট্রোলিয়াম বাই প্রডাক্টস ইত্যাদি। অন্যদিকে সম্ভাবনা কাজে লাগছে না এ রকম পণ্যের সংখ্যাও কম নয়। আগের অর্থবছরের চেয়ে গত অর্থবছর রপ্তানি কমেছে এমন পণ্যের তালিকায় রয়েছে সিমেন্ট, শাকসবজি, প্রকৌশলী যন্ত্রাংশ, চামড়া, জুট ইয়ার্ন অ্যান্ড টোয়াইন, চামড়াজাত পণ্য, শুকনো খাবার, কাঁচা পাট, টেরি টাওয়েলস, ফার্নিচার, গুঁড়া মসলা ইত্যাদি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ম ণ ছ ল র অবস থ ন প রক র য় র অবদ ন প টপণ য র র মত ধরন র দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে, দেশে সুফল কম
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে কমেছে। কিন্তু দেশে কমেছে সামান্যই; বরং বেশি দাম রাখার কারণে সরকারের কোম্পানি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মুনাফা বেড়েছে।
বিপিসি গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) ৪ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যা আগের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ছিল ৩ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে (২০২৪ সালের মার্চ) বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে দেশে প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের (ডিজেল, পেট্রল, অকটেন ও কেরোসিন) দাম নির্ধারণ শুরু হয়। ভর্তুকি থেকে সরে আসে ওই সরকার। তখন ‘অব্যবস্থাপনা ও লুটপাটের’ কারণে অর্থনীতি সংকটে পড়েছিল।
বিপিসি জ্বালানি তেল থেকে শুধু বড় অঙ্কের মুনাফাই করছে না, সরকারের আয়ও অনেক। জ্বালানি তেলের ওপর শুল্ক–কর আরোপ করে সরকার প্রতি অর্থবছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। আরও পড়ুনবাড়ল সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম৩০ নভেম্বর ২০২৫বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০২৪ সালের মার্চে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বা ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের ব্যারেলপ্রতি (১৫৯ লিটার) দর ছিল ৮৫ মার্কিন ডলারের কিছু বেশি। গত অক্টোবরে এই দর নেমেছে ৬৪ ডলারের কাছাকাছিতে। ফলে তখনকার তুলনায় দর এখন ২৫ শতাংশ কম। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, এ সময়ে ডলারের দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ। সরকার ডিজেলের দাম কমিয়েছে ৪ শতাংশের মতো।
বিপিসি জ্বালানি তেল থেকে শুধু বড় অঙ্কের মুনাফাই করছে না, সরকারের আয়ও অনেক। জ্বালানি তেলের ওপর শুল্ক–কর আরোপ করে সরকার প্রতি অর্থবছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। বিপিসির নিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শুল্ক–কর বাবদ সরকারের আয় ছিল ১৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা।
বিপিসি বছরে প্রায় ৬৮ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করে। এর মধ্যে ৬২ শতাংশ পরিবহন ও ১৫ শতাংশ কৃষি খাতে ব্যবহার করা হয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে পরিবহন ভাড়া ও কৃষির উৎপাদন খরচ অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে অন্যান্য কারণে বাড়ে দ্রব্যমূল্য। ফলে মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। ওই অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি প্রাণ দিয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, আয়করের মতো প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে না পেরে, ধনী ও সচ্ছলদের কাছ থেকে যথেষ্ট কর আদায় করতে না পেরে এবং বড় বড় প্রকল্প নিয়ে বিপাকে থাকা বিগত সরকার রাজস্ব আয়ের জন্য জ্বালানি তেলের মতো খাতকে বেছে নিয়েছিল। সে অবস্থার পরিবর্তন তেমন একটা হয়নি।আরও পড়ুনবিশ্ববাজারে তেলের দাম বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে, দেশে কমে না কেন২৭ নভেম্বর ২০২৫অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে মূল্যস্ফীতি কমেছে, তবে তা এখনো ৮ শতাংশের বেশি। ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশ পারেনি। অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, জ্বালানি তেলের দাম কমালে পরিবহন ভাড়া ও উৎপাদন খরচ কমানোর সুযোগ তৈরি হতো। এতে মানুষ সুফল পেত। জ্বালানি তেল একটি কৌশলগত পণ্য। এর ব্যবসা সরকারের হাতে রাখা হয় মুনাফা নয়, বরং নিরাপত্তা ও জনগণের জন্য সাশ্রয়ী মূল্য নিশ্চিত করতে। যদিও বিগত সরকার একে আয়ের বড় উৎস বানিয়ে ফেলেছিল। এখনো সেটাই চলছে।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, আয়করের মতো প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে না পেরে, ধনী ও সচ্ছলদের কাছ থেকে যথেষ্ট কর আদায় করতে না পেরে এবং বড় বড় প্রকল্প নিয়ে বিপাকে থাকা বিগত সরকার রাজস্ব আয়ের জন্য জ্বালানি তেলের মতো খাতকে বেছে নিয়েছিল। সে অবস্থার পরিবর্তন তেমন একটা হয়নি।
অবশ্য জ্বালানি তেলে মুনাফা করলেও বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে বড় ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে হয়েছে প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা। বিগত সরকারের সময় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মাশুল দিতে হচ্ছে। এ সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ায়নি। জ্বালানি তেলের দাম না কমানোর ক্ষেত্রে যুক্তি হলো, দাম কমালে প্রতিবেশী দেশে তেল পাচারের শঙ্কা থাকে। আবার বিপিসির মুনাফার টাকা দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নও করা হয়।
বিপিসির মুনাফা কারও বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বরং উন্নয়নকাজে বিনিয়োগের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। জ্বালানি তেল পরিশোধন সক্ষমতা বাড়াতে নতুন শোধনাগার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে বিপিসি অর্থায়ন করবে।মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টাবিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, বিপিসির মুনাফা কারও বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বরং উন্নয়নকাজে বিনিয়োগের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। জ্বালানি তেল পরিশোধন সক্ষমতা বাড়াতে নতুন শোধনাগার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে বিপিসি অর্থায়ন করবে।
বিপিসির নতুন শোধনাগারের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১২ সালে। তখন তারা লোকসানে ছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে মুনাফা শুরু করে বিপিসি। গত এক দশকে জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে করপোরেশনটি। এর মধ্যে শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরে তারা লোকসান করে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, প্রকল্প এখন পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে।
২০২৪ সালেও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের গড় দাম ৭০ ডলারের ঘরে ছিল। আর এখন এটি নেমে এসেছে ৬২ থেকে ৬৪ ডলারে।আরও পড়ুনতেল চুরি বন্ধে জ্বালানি বিভাগের ৩ নির্দেশনা২৮ অক্টোবর ২০২৫বিশ্ববাজারে দাম কমেছেজ্বালানি তেল আমদানি ও বিক্রির একমাত্র সরকারি কোম্পানি বিপিসি। এর অধীনে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নামে তিনটি কোম্পানি ডিলারদের মাধ্যমে তেল বিক্রি করে।
বিগত কয়েক বছরে জ্বালানি তেলের দামে বড় রকমের উত্থান-পতন দেখেছে বিশ্ব। করোনা মহামারির প্রভাবে তেলের দাম ব্যাপক হারে কমে যায়। ২০২০ সালে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল গড়ে ৪২ মার্কিন ডলার। পরের বছর অস্থির হয়ে ওঠে জ্বালানি তেলের বাজার।
তেলের দামে বড় উল্লম্ফন ঘটে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর। ২০২২ সালে তেলের গড় দাম ব্যারেলে ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। ওই বছর সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল ১৩৯ ডলার পর্যন্ত। এ কারণে বিশ্বজুড়ে জিনিসপত্রের দামও বাড়তে থাকে। ওই বছর আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ সাড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ওই মাসে মাত্র ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ দাম কমানো হয়েছিল (প্রতি লিটারে কমেছিল ৫ টাকা)। এরপর প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিন ১০৯ টাকা, পেট্রল ১২৫ টাকা এবং অকটেন বিক্রি হয় ১৩০ টাকায়।
২০২৪ সালেও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের গড় দাম ৭০ ডলারের ঘরে ছিল। আর এখন এটি নেমে এসেছে ৬২ থেকে ৬৪ ডলারে।
বাজারদরের কথা বললেও তা এড়িয়ে সুবিধামতো মূল্য নির্ধারণের স্বয়ংক্রিয় সমন্বয়ের সূত্র তৈরি করা হয়েছে। সূত্রে ৯টি জায়গায় দুর্বলতা জানানোর পর বর্তমান সরকার দুটি সংশোধন করেছে। তাই বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ভোক্তা বাড়তি দামে কিনছে, আর বিপিসি মুনাফা করছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়।খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিপিডির গবেষণা পরিচালকদেশে এখন ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১০৪ টাকা, পেট্রল ১২০ টাকা এবং অকটেন ১২৪ টাকা। সবশেষ এ মাসেই প্রতি লিটারে ২ টাকা করে বাড়ানো হলো জ্বালানি তেলের দাম।
বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলেই সঙ্গে সঙ্গে প্রভাব পড়ার সুযোগ নেই। তেল কেনার পর দেশে আসতে এক মাস সময় লেগে যায়। গত ২১ অক্টোবর থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত দামের গড় কর দেশে দাম সমন্বয় করা হয়েছে। ওই সময় বিশ্ববাজারে দাম বর্তমানের চেয়ে বেশি ছিল।
অবশ্য বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত বছর নভেম্বরেও বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিল, বাজারদর অনুযায়ী নির্ধারণ করলে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা কমানো সম্ভব। উল্লেখ্য, একটি সূত্র অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার মাসে মাসে দাম নির্ধারণের কথা বলেছিল। যদিও সেই সূত্রের পুরোটা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, বাজারদরের কথা বললেও তা এড়িয়ে সুবিধামতো মূল্য নির্ধারণের স্বয়ংক্রিয় সমন্বয়ের সূত্র তৈরি করা হয়েছে। সূত্রে ৯টি জায়গায় দুর্বলতা জানানোর পর বর্তমান সরকার দুটি সংশোধন করেছে। তাই বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ভোক্তা বাড়তি দামে কিনছে, আর বিপিসি মুনাফা করছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, তেল পাচারের যুক্তি হাস্যকর। সীমান্তের অজুহাতে দেশের ভোক্তাকে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই।
বিপিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে জ্বালানি তেল চুরি, দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগ রয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, চুরি, দুর্নীতি ও অদক্ষতা কমাতে পারলে জ্বালানি তেলের দাম কমানো যাবে।আরও পড়ুনতেল চুরি শুরু জাহাজ থেকে, বিজ্ঞান জানে চোরেরা২০ অক্টোবর ২০২৫বিপিসির আন্তর্জাতিক নিরীক্ষার দাবিঅকটেন ও পেট্রল বিক্রি করে সব সময় মুনাফা করে বিপিসি। মূলত ডিজেলের ওপর বিপিসির লাভ-লোকসান নির্ভর করে। দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশই ডিজেল। দেশের একমাত্র শোধনাগারটি থেকে পাওয়া যায় ৬ লাখ টন ডিজেল, বাকিটা আমদানি করতে হয়।
বিপিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে জ্বালানি তেল চুরি, দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগ রয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, চুরি, দুর্নীতি ও অদক্ষতা কমাতে পারলে জ্বালানি তেলের দাম কমানো যাবে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক দশক আগেই বিপিসির আন্তর্জাতিক নিরীক্ষার দাবি তোলা হয়েছে। আজও তা হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘সারা দুনিয়ার নিয়ম হলো সরকার সেবা দেবে, মুনাফা করবে না। অথচ শুল্ক–করের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব নিয়েও উন্নয়নে বিনিয়োগ করে না সরকার। বিনিয়োগের নামে বাড়তি মুনাফা করছে বিপিসি।’
আরও পড়ুন‘তেল চুরি’, ব্রাজিল বাড়ি ও তাঁদের আয়েশি জীবন১৮ অক্টোবর ২০২৫