কুমিল্লায় শচীনকর্তার স্মরণ হয় ‘আনুষ্ঠানিকতায়’, বছরজুড়ে থাকেন ‘অবহেলায়’
Published: 30th, October 2025 GMT
উপমহাদেশের কালজয়ী সংগীতজ্ঞ শচীন দেববর্মন। ‘আমি টাকডুম টাকডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’, ‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে’, ‘তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেন আসোনি’, ‘শোনো গো দখিনো হাওয়া প্রেম করেছি আমি’—এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা কুমিল্লায়। তবে কুমিল্লার রত্ন হয়েও কালজয়ী এই সংগীতজ্ঞ বছরজুড়ে জন্মস্থানেই থাকেন অবহেলা আর অনাদরে।
শচীন দেববর্মন কুমিল্লা নগরের দক্ষিণ চর্থায় জন্মগ্রহণ করেন। সেই বাড়িকে শচীন কমপ্লেক্স বা সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স করার দাবি জানানো হলেও সেটি বাস্তবায়ন করা হয়নি। তবে জেলা প্রশাসন বলছে, সম্প্রতি বাড়িটিতে সংগীত জাদুঘর স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর তিনি ভারতে মারা যান।
একই মাসে জন্ম ও মৃত্যু হওয়ায় ২০১৮ সাল থেকে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কালজয়ী এই সংগীতজ্ঞের বাড়িটিতে আয়োজন করা হয় শচীন মেলার। এবার দুই দিনব্যাপী মেলা বসেছে তাঁর বাড়িতে। আজ বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বেলুন উড়িয়ে ও শোভাযাত্রা করে এই মেলার উদ্বোধন করা হবে। আগামীকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে এই মেলা।
গতকাল বুধবার সরেজমিনে দেখা গেছে, শচীন মেলা উপলক্ষে অবহেলায় পড়ে থাকা শচীন দেববর্মনের বাড়িটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ চলছে। বাড়ির আঙিনায় চলছে প্যান্ডেল ও মঞ্চ তৈরির কাজ। ২০১৯ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ভবনটির সামনে তাঁর ম্যুরাল স্থাপন করা হয়।
শচীনকর্তার বাড়িতে গানের জলসায় অনেক খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ আসতেন বলে উল্লেখ করেছেন কুমিল্লার ইতিহাস–গবেষক আহসানুল কবীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘শচীনকত্তা’র বাড়িতে অনেকবার গানের জলসায় অংশ নেন। নজরুলের বেশ কয়েকটি গানেও সুর দিয়েছেন তিনি।
কুমিল্লার রত্ন হলেও জন্মস্থানে শচীন দেববর্মনকে সেভাবে ধারণ ও লালন করা হয়নি উল্লেখ করে আহসানুল কবীর বলেন, তাঁকে নিয়ে কুমিল্লায় অনেক কিছু করার ছিল বা এখনো আছে। কুমিল্লার নাগরিক সমাজের পক্ষে শচীনকর্তার বাড়িটিতে পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স বা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার দাবি জানান তিনি।
দক্ষিণ চর্থা এলাকার বাসিন্দা মামুনুর রশীদ বলেন, মেলার কারণে বাড়িটি এখন সাজানো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। কিন্তু বছরের প্রায় পুরোটা সময় বাড়িটি থাকে অবহেলিত। এখানে শুধু রাতে নয়, দিনেও মাদকসেবী ও সন্ত্রাসীদের আড্ডা বসে। প্রধান ফটকের লোহার গেট ও বাড়ির অংশ কিছু খুলে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন মাদকসেবীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর শচীন দেববর্মনের বাড়িটি পরিত্যক্ত ছিল। বাড়িটি দখলে নিয়ে সরকারি মুরগির খামার গড়ে তোলা হয়। কুমিল্লার সাংস্কৃতিক সংগঠকদের দাবি ও আন্দোলনের মুখে ২০১৪ সালে বাড়িটির একাংশ উদ্ধার করা হয়। এরপর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় সোয়া এক কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়িটি সংস্কার করা হয়। ২০১৮ সালে সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার পর অযত্নে ফেলে রাখায় বাড়িটির অবস্থা আবার বেহাল হয়ে পড়ে। চুরি হয়ে গেছে বাড়ির অনেক মালামাল। জেলা প্রশাসনের নিযুক্ত একজন পাহারাদার বাড়িটি পাহারা দেওয়ার কথা থাকলেও প্রায়ই বাড়িটি থাকে অরক্ষিত।
জেলা প্রশাসনের নিযুক্ত ওই পাহারাদারের নাম মো.
সাংস্কৃতিক সংগঠন ঐতিহ্য কুমিল্লার পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল বাড়িটি রক্ষায় শুরু থেকেই আন্দোলন করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংস্কারের পর থেকেই বাড়িটিকে শচীন কমেপ্লেক্স করার কথা ছিল। তবে এখনো সেটি হয়নি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, জেলা প্রশাসনের অনেক কাজের ভিড়ে বাড়িটির দিকে কেউ মনোযোগ দিতে চান না।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসনের চেষ্টায় বাড়িটিতে সংগীত জাদুঘর স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত ১৫ সেপ্টেম্বর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের একটি দল বাড়িটি পরিদর্শন করেছে। তারা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। প্রতিবছর জেলা প্রশাসন শচীন মেলার আয়োজন করছে।
শচীন দেববর্মনের বাবা ছিলেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার রাজপরিবারের সন্তান সংগীতশিল্পী নবদ্বীপ চন্দ্র দেব। তিনি পরে সপরিবার কুমিল্লা চলে আসেন। শচীন দেব কুমিল্লায় ছিলেন ১৯২৪ সাল পর্যন্ত। ১৯ বছর বয়সে তিনি চলে যান কলকাতায়, সেখানে ছিলেন ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত। পরে তিনি পরিবার নিয়ে মুম্বাই চলে যান। তিনি বলিউডের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক। তিনি গায়ক হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত করে। গীতিকার ও সংগীতশিল্পী মীরা দেবীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবনে তাঁদের সন্তান রাহুল দেববর্মনও (আর ডি বর্মন) একজন সংগীতজ্ঞ ছিলেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক র উদ য গ পর ব র অবহ ল
এছাড়াও পড়ুন:
কুমিল্লায় শচীনকর্তার স্মরণ হয় ‘আনুষ্ঠানিকতায়’, বছরজুড়ে থাকেন ‘অবহেলায়’
উপমহাদেশের কালজয়ী সংগীতজ্ঞ শচীন দেববর্মন। ‘আমি টাকডুম টাকডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’, ‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে’, ‘তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেন আসোনি’, ‘শোনো গো দখিনো হাওয়া প্রেম করেছি আমি’—এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা কুমিল্লায়। তবে কুমিল্লার রত্ন হয়েও কালজয়ী এই সংগীতজ্ঞ বছরজুড়ে জন্মস্থানেই থাকেন অবহেলা আর অনাদরে।
শচীন দেববর্মন কুমিল্লা নগরের দক্ষিণ চর্থায় জন্মগ্রহণ করেন। সেই বাড়িকে শচীন কমপ্লেক্স বা সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স করার দাবি জানানো হলেও সেটি বাস্তবায়ন করা হয়নি। তবে জেলা প্রশাসন বলছে, সম্প্রতি বাড়িটিতে সংগীত জাদুঘর স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর তিনি ভারতে মারা যান।
একই মাসে জন্ম ও মৃত্যু হওয়ায় ২০১৮ সাল থেকে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কালজয়ী এই সংগীতজ্ঞের বাড়িটিতে আয়োজন করা হয় শচীন মেলার। এবার দুই দিনব্যাপী মেলা বসেছে তাঁর বাড়িতে। আজ বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বেলুন উড়িয়ে ও শোভাযাত্রা করে এই মেলার উদ্বোধন করা হবে। আগামীকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে এই মেলা।
গতকাল বুধবার সরেজমিনে দেখা গেছে, শচীন মেলা উপলক্ষে অবহেলায় পড়ে থাকা শচীন দেববর্মনের বাড়িটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ চলছে। বাড়ির আঙিনায় চলছে প্যান্ডেল ও মঞ্চ তৈরির কাজ। ২০১৯ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ভবনটির সামনে তাঁর ম্যুরাল স্থাপন করা হয়।
শচীনকর্তার বাড়িতে গানের জলসায় অনেক খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ আসতেন বলে উল্লেখ করেছেন কুমিল্লার ইতিহাস–গবেষক আহসানুল কবীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘শচীনকত্তা’র বাড়িতে অনেকবার গানের জলসায় অংশ নেন। নজরুলের বেশ কয়েকটি গানেও সুর দিয়েছেন তিনি।
কুমিল্লার রত্ন হলেও জন্মস্থানে শচীন দেববর্মনকে সেভাবে ধারণ ও লালন করা হয়নি উল্লেখ করে আহসানুল কবীর বলেন, তাঁকে নিয়ে কুমিল্লায় অনেক কিছু করার ছিল বা এখনো আছে। কুমিল্লার নাগরিক সমাজের পক্ষে শচীনকর্তার বাড়িটিতে পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স বা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার দাবি জানান তিনি।
দক্ষিণ চর্থা এলাকার বাসিন্দা মামুনুর রশীদ বলেন, মেলার কারণে বাড়িটি এখন সাজানো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। কিন্তু বছরের প্রায় পুরোটা সময় বাড়িটি থাকে অবহেলিত। এখানে শুধু রাতে নয়, দিনেও মাদকসেবী ও সন্ত্রাসীদের আড্ডা বসে। প্রধান ফটকের লোহার গেট ও বাড়ির অংশ কিছু খুলে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন মাদকসেবীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর শচীন দেববর্মনের বাড়িটি পরিত্যক্ত ছিল। বাড়িটি দখলে নিয়ে সরকারি মুরগির খামার গড়ে তোলা হয়। কুমিল্লার সাংস্কৃতিক সংগঠকদের দাবি ও আন্দোলনের মুখে ২০১৪ সালে বাড়িটির একাংশ উদ্ধার করা হয়। এরপর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় সোয়া এক কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়িটি সংস্কার করা হয়। ২০১৮ সালে সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার পর অযত্নে ফেলে রাখায় বাড়িটির অবস্থা আবার বেহাল হয়ে পড়ে। চুরি হয়ে গেছে বাড়ির অনেক মালামাল। জেলা প্রশাসনের নিযুক্ত একজন পাহারাদার বাড়িটি পাহারা দেওয়ার কথা থাকলেও প্রায়ই বাড়িটি থাকে অরক্ষিত।
জেলা প্রশাসনের নিযুক্ত ওই পাহারাদারের নাম মো. ফরহাদ মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে ডিসি অফিস থেকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা দেয়। সেটিও নিয়মিত নয়। এই টাকা পেতে হলে মাসে চার দিন আবার ডিসি অফিসে ডিউটি করতে হয়। এই বেতনে আমি কী পাহারা দেব, বলেন? পরিবার চালাতে আমাকে বিকল্প কাজ করতে হয়।’
সাংস্কৃতিক সংগঠন ঐতিহ্য কুমিল্লার পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল বাড়িটি রক্ষায় শুরু থেকেই আন্দোলন করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংস্কারের পর থেকেই বাড়িটিকে শচীন কমেপ্লেক্স করার কথা ছিল। তবে এখনো সেটি হয়নি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, জেলা প্রশাসনের অনেক কাজের ভিড়ে বাড়িটির দিকে কেউ মনোযোগ দিতে চান না।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসনের চেষ্টায় বাড়িটিতে সংগীত জাদুঘর স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত ১৫ সেপ্টেম্বর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের একটি দল বাড়িটি পরিদর্শন করেছে। তারা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। প্রতিবছর জেলা প্রশাসন শচীন মেলার আয়োজন করছে।
শচীন দেববর্মনের বাবা ছিলেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার রাজপরিবারের সন্তান সংগীতশিল্পী নবদ্বীপ চন্দ্র দেব। তিনি পরে সপরিবার কুমিল্লা চলে আসেন। শচীন দেব কুমিল্লায় ছিলেন ১৯২৪ সাল পর্যন্ত। ১৯ বছর বয়সে তিনি চলে যান কলকাতায়, সেখানে ছিলেন ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত। পরে তিনি পরিবার নিয়ে মুম্বাই চলে যান। তিনি বলিউডের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক। তিনি গায়ক হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত করে। গীতিকার ও সংগীতশিল্পী মীরা দেবীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবনে তাঁদের সন্তান রাহুল দেববর্মনও (আর ডি বর্মন) একজন সংগীতজ্ঞ ছিলেন।