লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উন্মোচিত হচ্ছে: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
Published: 27th, November 2025 GMT
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দীর্ঘদিন লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উন্মোচিত হচ্ছে। বেরিয়ে আসছে প্রভিশন ঘাটতির পাশাপাশি তারল্য ঘাটতির চিত্রও। একে একে অর্থনীতির সব অসুখ প্রকাশ্যে আসছে বলে জানান তিনি। তাঁর মতে, একসঙ্গে উঠে আসা এত সব দুর্বলতা দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও প্রয়োজনীয় সংস্কার হয়নি। নীতি নির্ধারণে এখনো রয়েছে স্বচ্ছতার ঘাটতি। সার্বিক বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। আর বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি তো সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
এভাবেই আজ এক অনুষ্ঠানে অর্থনীতির চিত্র সম্পর্কে এসব কথা তুলে ধরলেন এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে অনলাইন নিউজ পোর্টাল অর্থসূচক আয়োজিত ‘অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
অর্থনীতিবিদ, গবেষক, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের লেখা নিয়ে চন্দ্রাবতী একাডেমি প্রকাশিত এ বই সম্পাদনা করেছেন অর্থসূচকের সম্পাদক জিয়াউর রহমান। অনুষ্ঠানে সাংবাদিক, লেখক, সাবেক আমলারা উপস্থিত ছিলেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। এ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ঋণগুলো লুকানো ছিল। এখন প্রকাশ পেয়েছে। আসলে আপনার শরীরে যে এত রোগ ছিল তা আপনি জানতেনই না। রোগ জানার ফলে আপনি এখন বিচলিত হয়ে গেছেন।
তিনি আরও বলেন, রোগ নিরাময় করার জন্য সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে? পাঁচ ব্যাংক এক করা, কিছু ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ করা এবং ব্যাংক কোম্পানি আইনকে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ ছাড়া কিছুই করা হয়নি।
তাঁর মতে, বিনিয়োগ এত যে খারাপ অবস্থায় আছে এবং ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসেছে, তাকে তেজি করার ক্ষেত্রে সুদের হারসহ অন্যান্য ব্যবস্থা তারা (সরকার) কি নিচ্ছে, তা হচ্ছে বড় বিষয়।
আমলাতন্ত্র গত সরকারকে চৌর্যবৃত্তিতে সমর্থন দিয়েছে
আমলাতন্ত্র গত সরকারকে চৌর্যবৃত্তি করার জন্য সমর্থন দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যখন সাংবাদিকদের ঢুকতে দিচ্ছিল না, তখন আমি এখানে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম যে ডালমে কুছ কালা হে। ঢুকতে না দেওয়ার বড় কারণ হলো তারা স্বচ্ছতা চায়নি। তারা চায়নি যে সাংবাদিকেরা সত্যটা জানুন।
তিনি বলেন, ‘আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলছি আমলাতন্ত্র গত সরকারকে চৌর্যবৃত্তি করার জন্য সমর্থন দিয়ে গেছে। দুই-তিনজন মানুষের কথা বললেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান হবেন, এ জন্য অন্যতম অভিযুক্ত। আমি সেদিনও দাঁড়িয়ে এ কথা বলেছিলাম।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী সমাজের ভেতরেও বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন অর্থনৈতিক সাংবাদিকেরা। দেড় দশকের স্বৈরশাসনের সময় এবং তার আগে সামরিকতন্ত্রের ভেতরে যখন আমরা ছিলাম, প্রত্যাশা থাকত অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের মাধ্যমে গণতন্ত্রের আকুতি প্রকাশ করব। অর্থনৈতিক সাংবাদিকেরা আমাদের হতাশ করেননি।’
তিনি বলেন, রাজনৈতিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে ঘাটতি হয়েছে তা পূরণ করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা। বেনামি ঋণের আলোচনা করতে গিয়েই এর পেছনের বড় বড় মানুষগুলোকে আবিষ্কার করেছি। টাকা পাচারের প্রতিবেদন থেকেই জানা গেল পেছনের মানুষগুলো, তাদের রাজনৈতিক সংশ্লেষ এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশগুলো।
সামাজিক-রাজনৈতিক ‘ভূমিকম্প’ নিয়ে আশঙ্কা
প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া হঠাৎ বিদেশি বিনিয়োগ ঘোষণা ও নীতিগত অস্পষ্টতা বিনিয়োগ পরিবেশ আরও দুর্বল করছে বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতির পথ রুদ্ধ করছে এবং প্রাকৃতিক ভূমিকম্পের পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক ‘ভূমিকম্প’ নিয়েও আশঙ্কা আছে তাঁর।
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডসি) থেকে উত্তরণের পর বন্দর ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন দরকার বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তবে তিনি এ–ও বলেন, বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ ঘোষণায় তাড়াহুড়া করা হয়েছে। কোনো সংস্কার ছাড়া মাত্র ১৩ দিনে বিশাল বিদেশি বিনিয়োগ আনার ঘোষণা বাস্তবসম্মত নয়। অপ্রকাশযোগ্য চুক্তির (এনডিএ) আড়ালে এমন সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতার ঘাটতি তৈরি হয়। তাঁর মতে, অংশীজনের অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতা ছাড়া বড় সিদ্ধান্ত টেকে না। আগের সরকারের সময় যেসব বৈষম্যমূলক চুক্তি হয়েছে, সেগুলোর স্বচ্ছতা না থাকায় মানুষের সন্দেহ আরও বেড়েছে।
পলিসি রেট কমানো প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, তবে সংকোচনমূলক নীতি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমিয়েছে। এখন স্থিতিশীলতা থেকে প্রবৃদ্ধির দিকে যাওয়ার সময় হলেও জ্বালানি, গ্যাস, ব্যাংক খাতের তারল্য ও ব্যবসায়িক প্রতিবন্ধকতা—এসব বড় সংস্কার পিছিয়ে আছে। কেবল চাহিদা ব্যবস্থাপনা নয়, সরবরাহের দিকেও সমর্থন দরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব সমর্থন পায়নি।
সাবেক সচিব ফারুক হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ইংরেজি দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সাবেক সভাপতি শামসুল হক জাহিদ, ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল হক। বইয়ের সম্পাদক জিয়াউর রহমান এতে স্বাগত বক্তব্য দেন। এ ছাড়া বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান, দৈনিক সমকালের সহযোগী সম্পাদক জাকির হোসেন, ইআরএফের সভাপতি দৌলত আক্তার ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন র জন ত ক র র জন ব দ কত প রক শ সরক র র সময় ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
সিদ্ধিরগঞ্জে ভুমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ ৬টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা
গত ২১ নভেম্বর সারা দেশে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ভুমিপল্লী এলাকায় ক্ষতিগ্রস্থ বেশ কয়েকটি ভবন পরিদর্শন করেছে রাজউক।
ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ ও রাজউকের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা সহ একটি প্রতিনিধি দল বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভবনগুলো পরিদর্শন করেন।
এসময় ভূমিকম্পে হেলে পড়া তিনটি ভবন সহ ছয়টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিটি ভবনে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেন তারা। একই সঙ্গে বাসিন্দাদের সরিয়ে ভবনগুলো দ্রুত খালি করতে বাড়ির মালিকদের নির্দেশ দেন প্রতিনিধি দলের উর্ধতন কর্মকর্তারা।
পরিদর্শন শেষে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ (আইআইবি) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী এ টি এম তানভীরুল হাসান তমাল সাংবাদিকদের বলেন, “ক্ষতিগ্রস্থ তিনটি ভবন আমরা ঘুরে দেখলাম।
প্রতিটি ভবনের ক্ষতিগ্রস্থের ধরণ একই রকম। আমাদের কাছে পরিলক্ষিত হয়েছে সয়েল সেটেলমেন্টের জন্য টল্টিং হয়েছে। তবে ভেতরে স্ট্রাকচার কোন ক্র্যাক আমরা দেখিনি। ফাউন্ডেশন অপ্রতুলতার কারণে এটা হয়েছে”।
তিনি আরও বলেন, “আমাদের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে ভবনগুলো নির্মানের সময় ফাউন্ডেশন, বেজমেন্ট ও পায়লিং দূর্বল থাকায় ভূমিকম্পে হেলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্থ ও ভেতরে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। আরও গভীর পায়লিং করা উচিত ছিল। কিন্তু সেটা করা হয় নি।
তাই পায়লিংয়ের নীচের যেসব স্থানগুলো দূর্বল ছুল সেসব স্থান হেলে কাত হয়ে পড়েছে। আমরা ম্যাজারমেন্ট করে রিপোর্ট আকারে রাজউককে জানিয়ে দেবো। রাজউক ও মিনিস্ট্রির পক্ষ থেকে কি ব্যবস্থা নেয়া যায় সে ব্যাপারে রিপোর্ট দিয়ে রাজউককে আমরা সহযোগিতা করব”।
রাজউক নারায়ণগঞ্জ জোন-৮ এর অথোরাইজড অফিসার প্রকৌশলী রংগন মন্ডল বলেন, “হাউজিংয়ে পরিদর্শন করে আমরা দেখলাম তিনটি ভবন পাশের তিনটি ভবনের উপর হেলে পড়েছে। অর্থাৎ ছয়টি ভবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এই ছয়টি ভবন নিরাপদ নয়। আমরা এই ছয়টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছি।
পরবর্তীতে বুয়েট সহ সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ ভবনগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করবেন। যতোক্ষণ পর্যন্ত নিরাপদ বলে বিবেচিত না হবে, আমরা সেইফ রিপোর্ট না পাবো সে পর্যন্ত ভবনগুলো ব্যবহার করা যাবে না”।
তিনি আরও বলেন, “আজকে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি ভবন মালিক ও বসবাসকারিরা অনেকেই ভবনগুলো খালি করছেন। আমাদের দিক নির্দেশনা তারা মেনে চলছেন। বিষয়গুলো আমরা জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়কে জানিয়েছি।
ভবনগুলো খালি করা হলে পুনরায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে উর্ধতন কতৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। সে পর্যন্ত ভবনগুলো ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা অনুযায়ি ভবনগুলোর বিষয়ে আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করব”।