গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হতে পারে চুক্তি
Published: 15th, January 2025 GMT
কাতারের দোহায় দীর্ঘ আলোচনার পর বুধবার (১৫ জানুয়ারি) গাজায় যুদ্ধবিরতির চূড়ান্ত বিবরণ চূড়ান্ত করার কাছাকাছি পৌঁছেছেন আলোচকরা। মধ্যস্থতাকারী কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের নেতারা আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
দোহায় আট ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা রুদ্ধদ্বার আলোচনায় আশাবাদ তৈরি হয়েছে। মধ্যস্থতাকারী কাতার, মিসর এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইসরায়েল এবং গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসের কর্মকর্তারা বলেছেন, অবরুদ্ধ গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তির জন্য চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি আগের চেয়ে অনেক বেশি সম্ভাবনার পথে রয়েছে। খবর রয়টার্সের।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারী এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, উভয় পক্ষকে একটি লিখিত বিবৃতি দেওয়া হয়েছে এবং চূড়ান্ত বিবরণ নিয়ে আলোচনা চলছে।
আরো পড়ুন:
গাজায় প্রাণহানি ৪৬ হাজার ৫০০ ছাড়াল
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৫ শিশুসহ ৪৯ জন নিহত
তবে, একজন সিনিয়র হামাস কর্মকর্তা মঙ্গলবার রাতে রয়টার্সকে জানিয়েছেন, হামাস এখনো তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কারণ গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীকে কীভাবে সরিয়ে নেয়া হবে সেই বিষয়ে স্পষ্ট রূপরেখা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে হামাস।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, চুক্তি স্বাক্ষর প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে। বাইডেন প্রশাসন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একজন প্রতিনিধিকে সঙ্গে রেখে আলোচনা করছে।
মঙ্গলবার জো বাইডেন ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি আলোচনার অগ্রগতির বিষয়ে কথা বলেছেন।
দুই নেতার ফোনালাপের পর হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে বলেছে, “উভয় নেতা আগামী কয়েক ঘণ্টা সরাসরি এবং তাদের টিমের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দুই প্রেসিডেন্ট একটি চুক্তি কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।”
হামাস জানিয়েছে, আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং তারা আশা করছে এই শেষ রাউন্ডের আলোচনায় চুক্তিটি চূড়ান্ত হবে।
ইসরায়েলি একজন কর্মকর্তা বলেছেন, “আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যদিও কিছু বিবরণ নিয়ে এখনো কাজ করা প্রয়োজন। আমরা কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছেছি, তবে এখনো চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাইনি।”
মঙ্গলবার রোম সফররত ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিয়ন সার বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে জোটের কট্টর জাতীয়তাবাদী দলগুলার তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও, যদি চূড়ান্তভাবে একমত হয় তবে ইসরায়েলের জোট সরকারের বেশিরভাগ অংশই গাজা চুক্তিকে সমর্থন করবে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চূড়ান্ত আলোচনাটি যদি সফল হয়, তাহলে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধবিরতির আলোচনা সফল হওয়ার পাশাপাশি গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ, হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা, ছিটমহলের বেশিরভাগ জনসংখ্যাকে গৃহহীন করা এবং এখনও প্রতিদিন কয়েক ডজন মানুষকে হত্যা করা যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে।
এর ফলে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমতে পারে, যেখানে যুদ্ধ পশ্চিম তীর, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং ইরাকে সংঘাতের ইন্ধন জোগাচ্ছে এবং ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে।
এছাড়া, ইসরায়েল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হাতে আটককৃতদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন অবশিষ্ট জিম্মিকে উদ্ধার করতে পারবে। বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দীরাও মুক্তি পাবে।
শিশু ও নারী বন্দীদের প্রথমে মুক্তি দেওয়া হবে
সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, “এই চুক্তি.
যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর আলোচনার মধ্যেও মঙ্গলবার গাজার দেইর আল-বালাহ এবং রাফাহতে ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হয়েছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
এদিকে জাতিসংঘ জানিয়েছে, সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির আওতায় গাজায় মানবিক সহায়তা সম্প্রসারণের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। কিন্তু সীমান্ত প্রবেশাধিকার এবং নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা এখনও বাধা হিসেবে রয়ে গেছে।
ইসরায়েলে জিম্মিদের পরিবার আশা এবং হতাশার দোলাচলে আটকে আছে। তারা বলছেন, “আমরা এই সুযোগটি মিস করতে পারি না। এটিই শেষ সুযোগ; আমরা তাদের বাঁচাতে পারি।”
একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চুক্তির প্রথম পর্যায়ে হামাস ৩৩ জন জিম্মিকে মুক্তি দেবে, যার মধ্যে শিশু, নারী, কিছু নারী সৈন্য, ৫০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ এবং আহত ও অসুস্থ ব্যক্তিরা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ইসরায়েল ধীরে ধীরে এবং আংশিকভাবে কিছু সেনা প্রত্যাহার করবে।
একটি ফিলিস্তিনি সূত্র জানিয়েছে, ইসরায়েল ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে ১ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেবে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মতে, ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবরে ফিলিস্তিনের হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলি সীমান্ত অতিক্রম করার পর ইসরায়েল গাজায় আক্রমণ শুরু করে। হামাসের হামলায় ১ হাজার ২০০ জন ইসরায়েলি নিহত এবং ২৫০ জনেরও বেশি মানুষকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, তখন থেকে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় ৪৬ হাজারেও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।
২০ জানুয়ারি ট্রাম্পের অভিষেককে এখন ব্যাপকভাবে যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য একটি কার্যত সময়সীমা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ঢাকা/ফিরোজ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইসর য় ল র জন য পর য য় ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
বিমানবিধ্বংসী কামান থেকে বের হচ্ছিল সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী
পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন সাংবাদিক পিটার আর কান ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় ছিলেন। ওই সময় প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রে লেখা পাঠানোর সুযোগ না পেয়ে দিনপঞ্জি রাখতে শুরু করেন তিনি। কয়েক দিনের দিনপঞ্জি একসঙ্গে পাঠালে তা প্রকাশ করত ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ওয়াল স্টিট জার্নাল তাঁর ৩ ডিসেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বরের দিনপঞ্জি প্রকাশ করে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য আজ তাঁর ৩ ডিসেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বরের দিনপঞ্জি তুলে ধরা হলো।
৩ ডিসেম্বর, শুক্রবার
ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এলিভেটরে ঢোকার সময় আরেক প্রতিবেদক দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যুদ্ধ যে চলছে, তা কি শুনেছ?’ সময় তখন রাত আটটা বাজার একটু আগে। এলিভেটরে থাকা একটি বিজ্ঞপ্তিতে লেখা: হ্যাপি আওয়ারস সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত আটটা, শুক্রবার ব্যতীত। বাকি সন্ধ্যাটা অন্যান্য সাংবাদিকের সঙ্গে শর্টওয়েভ রেডিওর আশপাশে জটলা বাধিয়েই কেটে গেল।
স্পষ্টতই, আজ দুপুরের পরই ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। ভারত বলছে, পাকিস্তান এটি শুরু করেছে; পাকিস্তান বলছে, ভারত। কে জানে? কিন্তু ভারত গত ১০ দিনই পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় সীমিত আকারে আক্রমণ চালানো জারি রেখেছে। যখন একটি যুদ্ধ শুরু হয় এবং কেবল অফিস বন্ধ থাকে, তখন আপনার কী করার থাকে? পোকার খেলা। ঘুমিয়ে যাওয়া।
৪ ডিসেম্বর, শনিবার
সকাল সকালই দিন শুরু হলো। বিমানবন্দর এলাকায় পাকিস্তানের বিমানবিধ্বংসী কামানের সৌজন্যে আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভারতীয় বিমান হামলা নাকি বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলা? প্রশ্ন উঠছে, কারণ সকালের জলখাবারের সময়, ভারতীয় মিগগুলোকে রানওয়েতে নিয়মিত রকেট হামলা চালাতে দেখা গেল। দেখলে আপনার আলোকচিত্রী হওয়ার খায়েশ জাগবে। পরিষ্কার নীল আকাশে মিগগুলো ঝাঁপ দিচ্ছিল। বিমানবিধ্বংসী কামান থেকে বের হচ্ছিল ছোট ছোট সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী। এমনকি হোটেলের ওপর দিয়ে বিমানের কিছু অমীমাংসিত ডগ ফাইটও হলো। বেশ কয়েকটি ভারতীয় বিমান ধ্বংস হলো। কিন্তু প্রত্যেক পর্যবেক্ষণকারীর হিসাব ভিন্ন ভিন্ন। টেলিভিশনের একজন বললেন, ‘পার্ল হারবারের চেয়ে ভালো।’ বাকি দিনটা ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিমান হামলা চলল।
কেউ একজন মানচিত্র দেখল এবং আবিষ্কার করল যে পূর্ব দিকে মাত্র ৬০ মাইলের কম দূরত্বে ভারতীয় সীমান্ত আছে। ঢাকায় থাকা পশ্চিমা নাগরিকেরা ইন্টারকন্টিনেন্টালে জড়ো হয়েছেন।খেজুরগাছের পাতা ও আরও হরেক রকমের গাছের পাতা দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা কিছু সামরিক যান ছাড়া ঢাকার রাস্তাগুলো জনশূন্য। রাস্তায় থাকা পুলিশের সদস্যদেরও মাথার টুপিতেও গাছের পাতা দেখা গেল। ঢাকার কূটনৈতিক কোরের ডিন, নেপালি কনসালের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, সংকটের ওপর কূটনৈতিক কোরের একটি কনফারেন্স তিনি ডেকেছিলেন, কিন্তু সংকটের কারণে তা বাতিল করা হয়েছে।
৫ ডিসেম্বর, রোববার
নিরুত্তাপ দিন। গতকালের আকাশে যে অসাধারণ দৃশ্য দেখা গিয়েছিল, তার সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা চলে না। প্রচুর গুজব চারপাশে ঘুরছে। এর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় হলো ঢাকা থেকে মাত্র ৬০ মাইল দূরত্বে আছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। কেউ একজন মানচিত্র দেখল এবং আবিষ্কার করল যে পূর্ব দিকে মাত্র ৬০ মাইলের কম দূরত্বে ভারতীয় সীমান্ত আছে। ঢাকায় থাকা পশ্চিমা নাগরিকেরা ইন্টারকন্টিনেন্টালে জড়ো হয়েছেন। পানশালায় হওয়া সন্ধ্যার বৈঠকে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা ব্যাংককের উদ্দেশে সংস্থাটির ত্রাণ ফ্লাইটের গুজবের বিষয়টি নিশ্চিত করলেন। গ্রেগরি পেকের একটি দৃশ্য যেন—পাকা চুলের মর্যাদাবান জাতিসংঘের কর্মকর্তা কথা বলছেন নারী ও শিশুদের প্রথমে সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে। কিছু ব্যক্তি হোটেল বার থেকে স্কচ কিনলেন বোতলপ্রতি ৩৫ ডলার খরচ করে। এটি দিনের মজুত তৈরির ব্যাপার।
‘সার্ত্রে এখানে প্রাসঙ্গিক হওয়া উচিত’, এক প্রতিবেদক বললেন।
‘কেন?’
‘বের হওয়ার কোনো পথ নেই।’
৬ ডিসেম্বর, সোমবার
ঢাকা থেকে ৫০ মাইল পশ্চিমে শিবালয়ে সড়কপথে যাওয়ার চেষ্টা চলল। অনুভূতি: একমাত্র রসদের কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান হারাতে বাধ্য। ছোট ছোট সেনাবহর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আরও আছে অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া রেডিয়েটর এবং অন্যান্য যান্ত্রিক সমস্যা। যখন বহর দাঁড়িয়ে পড়ে, তখন বাঙালি কৃষকেরা পার্শ্ববর্তী খেত থেকে পালিয়ে যান। এখন পর্যন্ত সামরিক ট্রাকগুলোকে পাঠানোর অর্থ মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের খুঁজে বের করা, গ্রামে আগুন লাগানো, বেসামরিক হত্যাযজ্ঞ। সেনাবাহিনীর সেসব করার মতো পর্যাপ্ত সময় নেই। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো সাধারণ যুদ্ধ শুরু হওয়ায় বাঙালিরা সম্ভবত এখন আগের চেয়ে বেশি নিরাপদ।
আজ রাতেই দ্য ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফিরেছি। হোটেলে সন্ধ্যার বৈঠকে আলোচিত হয় ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার ১০ মিনিট পর জাতিসংঘের বিমানের ফিরে আসার বিষয়টি। কারণ ছিল, আগে থেকে নির্ধারিত অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার একটু আগে বিমানবন্দরে হওয়া ভারতীয় বিমান হামলা এবং বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে জেনারেল রাও ফরমান আলী বলেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী রসদ সরবরাহ নিয়ে সমস্যায় আছে। আপাতত কিছু সময়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রসদ সরবরাহ বন্ধ থাকবে এবং কিছু সময়ের জন্য রক্ষণাত্মক কৌশল নেওয়া হবে। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ রক্ষণাত্মক কৌশল হচ্ছে ক্রমে অগ্রসরমাণ ভারতীয়দের হাতে ধীরে ধীরে কিছু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া। গত সপ্তাহে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জেনারেল নিয়াজি বলেছিলেন, সবচেয়ে ভালো রক্ষণ হলো আক্রমণাত্মক হওয়া। কিন্তু সময় বদলায়।
৭ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার
যুদ্ধের সঙ্গে কীভাবে বাস করতে হয়, মনে হচ্ছে তা শিখতে শুরু করেছে ঢাকা বা হয়তো যুদ্ধের হুমকির সঙ্গে, কারণ ভারতীয়রা শহরের উপকণ্ঠের অল্প কিছু সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করছে। কিন্তু মানুষ আকাশের দিকে এখনো ভীতভাবে তাকাচ্ছে। জাতিসংঘ একটি ফ্লাইট চালানোর জন্য ফের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান উপকূল এলাকায় বিমানটিতে নৌ কামানের গোলা আঘাত হেনেছিল, ধারণা করা হচ্ছে, সেটি ভারতীয়। যেসব বিদেশি নাগরিক এখানে আটকা পড়ে আছে, তাদের খুব কম মানুষেরই হৃদয় জিততে পেরেছে ভারতীয়রা। হোটেল লবিতে থাকা কিছু আমেরিকান জানতে চাইছিল, কেন মেরিন সেনারা এখানে এসে তাঁদের উদ্ধার করছে না। একজন বলল, ‘আমরা কঙ্গোতে এটি করেছিলাম।’ আরেকজন বলল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু এটি তো কঙ্গো নয়।’ প্রথম জন তখন বলল, ‘শিগগিরই এটি হবে।’
পাকিস্তানের যোগাযোগ বিভাগের কথা অনুযায়ী, সামরিক পরিস্থিতি এখনো ‘অস্পষ্ট’। একজন আমেরিকান কূটনীতিক বলেছেন, পাকিস্তান শাঁখের করাতের মধ্যে পড়েছে।বিমান হামলার সাইরেন বন্ধ হওয়ার পর আমি বিমানবন্দরের কাছে গিয়েছিলাম। মাঠের পাশ দিয়ে দৌড়েছিলাম এবং শিয়ালের একটি বাসা চিহ্নিত করি। একই কাজ করেছিল চারজন রিকশাওয়ালা। তাই আমরা সবাই শিয়ালের বাসাটির কাছেই চুপচাপ অবস্থান নিই—কেউই প্রথম জন হিসেবে শিয়ালের বাসায় ঢুকতে চায় না। ওই বাসায় তিনের বেশি কারও থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু বিমান চলে গেল এবং আমরা সবাই মিলে একটি সিগারেট ভাগাভাগি করলাম।
পাকিস্তানের যোগাযোগ বিভাগের কথা অনুযায়ী, সামরিক পরিস্থিতি এখনো ‘অস্পষ্ট’। একজন আমেরিকান কূটনীতিক বলেছেন, পাকিস্তান শাঁখের করাতের মধ্যে পড়েছে। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের পশ্চিম পাকিস্তানি এক বৈমানিকের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম, তিনি এখানে আটকা পড়েছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি কী করার পরিকল্পনা করছেন?’ তিনি বলেন, ‘এখানে মরব।’ প্রায় সবাই ভাবছে, শিগগিরই এখানে আরেকটি রক্তগঙ্গা বইবে। তখন সংখ্যালঘু অবাঙালি (বিহারি) ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগীদের ওপর প্রতিশোধ নেবে বাঙালিরা। যদি এটা চোখের বদলে চোখ তোলার নীতি হয়, তবে অনেক বিহারিকেই চোখ হারাতে হবে।
গুজব আছে, হোটেলের খাদ্য সরবরাহ শেষের দিকে। মেনুর আকার কিছুটা ছোট হয়েছে, কিন্তু খাবারের মান এখনো ভালো আছে এবং সব সময়ই অনেক মাখন পাওয়া যাচ্ছে। একটি ড্যানিশ ডেইরি প্রকল্প থেকে হোটেল কর্তৃপক্ষ মাখন কিনেছিল, যেটি কিনা যুদ্ধের ঠিক আগে আগে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছিল। এক বিদেশির জিজ্ঞাসা, ‘কিন্তু মানুষ কি শুধু মাখন খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে?’
বিকেলে আরও ভারতীয় বিমান হামলা হলো। অনেক উঁচু থেকে বোমাবর্ষণ করা হলো। এখন হোটেলের ছাদ সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীতে পরিপূর্ণ। একজন ক্যামেরাম্যানের পরনে আছে স্নানের পোশাক, যিনি কিনা সদ্যই সুইমিংপুল থেকে উঠে এসেছেন। আরেক প্রতিবেদক একটি চেয়ার এনেছেন। ছাদে এক কূটনীতিক বললেন, বিহারিরা নাকি খালি বাড়ি লুট করছে। তিনি আরও বলেন, ‘তারা যেখানে যাচ্ছে, সেখানে এগুলো সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবে না।’ সাধারণ ভাবনা এটি, যত দিন চলবে, তত দিন বিহারিরা এ থেকে মজা নেবে। এখানে একজন বেশ শান্তভাবেই আলোচনা করছিলেন গণহত্যার বিষয়ে। পূর্ব পাকিস্তান এখন একটি স্পঞ্জের মতো, যা দুর্গতিতে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। ওই কূটনীতিক বললেন, ‘আপনি পূর্ব পাকিস্তানে বায়াফ্রা ফেলুন এবং ফের এটি আর খুঁজে পাবেন না।’
৮ ডিসেম্বর, বুধবার
সকালের গুজব হলো, জেনারেল নিয়াজি গত রাতে একটি ছোট বিমানে করে বার্মায় পালিয়ে গেছেন। গত সপ্তাহে তিনি বলেছিলেন, ‘যত বেশি ভারতীয় আসবে, তত বেশি ভারতীয়কে হত্যা করা যাবে, আমি ততটাই খুশি হব।’ পালিয়ে যাওয়ার এই প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে যদিও সন্দেহ আছে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে হয়তো তিনি এটাই চাইবেন।
সামরিক অবস্থা এখনো বেশ অস্পষ্টই আছে, কিন্তু খবর আছে, ভারতের অগ্রসরমাণ দল ঢাকা থেকে ৩৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে আছে। একটি দূতাবাস সূত্র বলেছে, ‘আমরা যতটা আশঙ্কা করেছিলাম, সামরিক পরিস্থিতি তার চেয়েও খারাপ হয়েছে।’ একজন বাঙালির সঙ্গে দেখা হলো, বোঝা গেল পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে তিনি উল্লসিত। স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হওয়া সম্ভবত আর এক সপ্তাহের ব্যাপার, এর বেশি নয়।
রেডিওর সংবাদে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেছেন, যুদ্ধে সংবেদনশীল মধ্যস্থতা হচ্ছে, যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘কার্যকর স্বায়ত্তশাসন’-এর দিকে নিয়ে যেতে পারে।জাতিসংঘ যে ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল, তা মাঝপথে আটকে গেছে বলে মনে হচ্ছে। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা সব সময়ই কনফারেন্সে থাকেন। একটি বিষয় কৌতূহল-জাগানিয়া যে ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটকে থাকা কয়েক শ বিদেশি নাগরিকের দুর্দশার প্রতি আমরা সবাই কত মনোযোগ দিচ্ছি। এক কোটি বা তার বেশি সীমান্তবর্তী শিবিরে আটকে পড়ে দুর্দশায় আছে। কী কারণে কয়েক শ পশ্চিমা নাগরিকের জীবন এতটা মূল্যবান হয়ে উঠল?
ছাদে থাকা বিমান হামলা দেখার মানুষের ভিড় কিছুটা পাতলা হয়েছে। গুজব আছে, একজন ক্যামেরাম্যান পেছন থেকে বিমানবিধ্বংসী বন্দুকের শার্পনেল দিয়ে আঘাত পেয়েছেন। ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকা পশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক ব্যক্তিরা সশস্ত্র অবস্থায় রয়েছেন, যা অন্য অতিথিদের অস্বস্তিতে ফেলছে। রেডিওর সংবাদে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেছেন, যুদ্ধে সংবেদনশীল মধ্যস্থতা হচ্ছে, যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘কার্যকর স্বায়ত্তশাসন’-এর দিকে নিয়ে যেতে পারে। গত মার্চে বাঙালিরা ‘কার্যকর স্বায়ত্তশাসন’ দাবি করেছিল। সে ক্ষেত্রে কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। টেলিভিশন প্রতিনিধিদের কাছে গোপন তথ্য আছে, ছোট পাকিস্তানি বিমান রাতে বার্মায় একটি গোপন যাত্রা করতে পারে এবং বৈমানিক কিছু ফিল্ম ও মুদ্রিত সংবাদপত্রের সংখ্যা সঙ্গে নিতে ইচ্ছুক। ফিল্ম একটি স্যুটকেসে ভরা হয়েছে এবং যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।
সপ্তাহের সবচেয়ে বিসদৃশ ঘটনা হচ্ছে, সন্ধ্যায় আমরা একটি পোকার টেবিলে মোমবাতির চারপাশে মার্শম্যালো রোস্ট করলাম।
৯ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার
সকালের খাবার খাওয়ার সময় এক আমেরিকান ব্যবসায়ী বললেন, ‘ক্রিসমাসের আগে কেনাকাটার জন্য আর মাত্র ১০ দিন বাকি।’ সংকটের মহোৎসব চলছেই। আরেকজন আমেরিকান কনস্যুলেটে যাওয়ার জন্য বের হলেন। কারণ, তিনি সেখান থেকে আয়করের ফরম তুলতে চান। তিনি বললেন, ‘আমি হয়তো একজন আশাবাদী, কিন্তু এতে কিছু কাজ তো করা হলো।’ কিন্তু সেখানে কিছু বিভ্রান্তজনও আছেন। হোটেলে মা-বাবার সঙ্গে একটি ধূসর খেলনা কুকুর দাঁড়িয়ে আছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই সেটি প্রশান্তিতে আছে।
নিশ্চিতভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। জেনারেল নিয়াজিসংক্রান্ত গুজব ছড়াচ্ছেই। খবর আছে, ভারতীয় দলগুলো ঢাকা থেকে ২০ মাইল দূরে আছে। ভারতীয় রেডিও বলছে, ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান প্রধান সব শহরের পতন হয়েছে। পাকিস্তান রেডিও এটি প্রত্যাখ্যান করেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অধীনদের বলা হচ্ছে সেনানিবাস ছেড়ে দিতে এবং শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে। তারা কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা দেওয়া একটি হাসপাতাল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে এবং রোগীদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। আমরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছি এবং কিছু সেনাসদস্যকে দেখেছি, কিন্তু আমরা এ-ও দেখেছি, একজন পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ সদস্য এক বাঙালিকে একটি লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এগুলো ধারাবাহিকভাবেই চলছে।
ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেষ রক্ষার লড়াই করবে কি না, তা নিয়ে সবারই সন্দেহ আছে। পাকিস্তানের সেনাসদস্যদের পূর্ব পাকিস্তানে শর্ত সাপেক্ষে আত্মসমর্পণের পরিকল্পনার বিষয়ে জাতিসংঘের কিছু কর্মকর্তা আলোচনা করছিলেন। শর্তটি হয়তো হবে নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরা। কিন্তু কে তা নিশ্চিত করবে?
আবাসিক এলাকা দেখতে গিয়েছিলাম, যেখানে গত রাতে তিনটি বোমা আঘাত হেনেছিল। সাধারণত সেখানে একটি এতিমখানা পরিচালিত হতো, কিন্তু এখন সেখানে মাটি ও ধ্বংসস্তূপে ঘেরা তিনটি বড় বড় গর্ত আছে শুধু। কাদামাটি খুঁড়ে ছোট ছোট দেহ বের করা দেখলাম। নিহত এতিমদের দেহ গুনে দেখা যায় সংখ্যা দুই শতাধিক।
ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও একটি হাসপাতালকে ‘নিরপেক্ষ এলাকা’ ঘোষণায় সফল হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস (জেনেভা)। আজ সন্ধ্যায় রেডক্রসের একদল কর্মকর্তা ও সাংবাদিক কক্ষে কক্ষে গিয়ে নানা অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করেন, বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের অতিথিদের কাছে এগুলো পাওয়া যায়। নারীদের শৌচাগার থেকে কয়েক প্যাকেট বিস্ফোরক পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলো হোটেলের লনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বালুর বস্তা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল। ফলে সুইমিংপুল বন্ধ ছিল।
* ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনটি আবার প্রকাশ করা হলো।