চট্টগ্রামে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি চালানো ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই কর্মীকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গতকাল মঙ্গলবার হাজির করা হলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। 

এর আগে গত সোমবার রাতে নগরের চান্দগাঁওয়ের বেপারিপাড়া শ্যামলী আবাসিক এলাকা থেকে ছাত্রলীগ কর্মী ঋভু মজুমদার ও যুবলীগ কর্মী মো. জামালকে গ্রেপ্তার তরা হয়। তারা নগরের চান্দগাঁও ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এসরারুল হকের অনুসারী।

পুলিশ জানায়, নগরের বহদ্দারহাটে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি চালানো তৌহিদুল ইসলাম ফরিদকে গত ২২ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ঋভু ও জামালের নাম আসে। পরে ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখা যায়, দু’জন দুটি বিদেশি পিস্তল হাতে গুলি করছেন। 

চান্দগাঁও থানার ওসি আফতাব উদ্দিন বলেন, তৌহিদ, ঋভু, জামাল তিনজনই সাবেক কাউন্সিলর এসরারুলের সহযোগী। বহদ্দারহাটে হামলা চালানোর সময় তিনজন একসঙ্গে এসেছিলেন। তৌহিদের হাতে ছিল পাকিস্তানি শুটারগান। বাকি দু’জনের হাতে দুটি বিদেশি পিস্তল। আমরা অস্ত্রগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করছি। 

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

সহ্যশক্তি মানে শুধু কষ্ট করা নয়, ভেঙে পড়েও উঠে দাঁড়ানো

(দৃঢ় মনোবল ও প্রচেষ্টা থাকলে কোনো বাধা পেরোনোই কঠিন নয়। দরকার ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস ও কঠোর পরিশ্রম। আমাদের আশপাশে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের জীবনগাথায় লিখে চলেছেন অদম্য জয়ের গল্প। তাঁদের সেই সাফল্য ব্যক্তিগত অর্জনের সীমানা পেরিয়ে সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতাকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। তেমনই কয়েকজনের গল্প নিয়ে ধারাবাহিক এ আয়োজন। আজ জানব রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জের চৌডালা ইউনিয়নের দক্ষিণ হাউসনগর গ্রামের বাসিন্দা মনোয়ারা খাতুনের জীবনের গল্প।)

আমি মনোয়ারা খাতুন। রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক সবুজ সুন্দর গ্রামে আমার জন্ম। চৌডালা ইউনিয়নের দক্ষিণ হাউসনগর গ্রামটির বাসিন্দাদের সেভাবে আর্থিক সচ্ছলতা নেই বললেই চলে। আমার বাবার উপার্জন ছিল অনিয়মিত। এক ভাই ও তিন বোন মিলে আমাদের সংসার। বড় দুই বোনের বয়স ১৮ পেরোনোর আগেই বিয়ে হয়ে যায়। অভাবের সংসার কত দূর আর টানা যায়! আমি ক্লাস ফাইভ পেরোতেই মা স্কুলে যেতে নিষেধ করেন। মেয়েদের লেখাপড়া করে লাভ নেই—এই বলে মা আমার স্কুলে যাওয়া মানা করে দেন।

আমার সহপাঠীরা যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে, আমি ঘরে বসে থাকি। কিছুদিন যেতেই পড়াশোনার জন্য কান্নাকাটি শুরু করি। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিই। হাল ছেড়ে দিইনি। বাবাকে জোর করি, আমাকে স্কুলে ফিরিয়ে দিতে। এসব দেখে বাবার মন গলে। এক পড়শির কাছ থেকে ২০ টাকা ধার করে আবার আমাকে স্কুলে ভর্তি করান। এক বছর বিরতি দিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া শুরু করি। কোনোরকমে বই–খাতা জোগাড় হলেও স্কুলের ইউনিফর্ম ও পরীক্ষার ফি—কোনো কিছুর টাকা ছিল না। লেখাপড়ায় আমার প্রবল আগ্রহ দেখে স্কুলের হেডমাস্টার আমাকে অনেক সাহায্য করেন।

আমার গ্রামের পাশেই ছিল একটি ‘কিশোরী ক্লাব’। সহপাঠীরা একদিন আমাকে সেখানে নিয়ে যায়। আমি মাঝেমধ্যে লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়ি, খেলাধুলা করি। যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, তখন ক্লাবে একটি দায়িত্ব পেলাম। পাশাপাশি পেলাম জুনিয়র ক্লাসের ছাত্রী পড়ানোর কাজ। এভাবে আমার লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

নিজের পড়ার খরচ নিজেই সামাল দেওয়ার চেষ্টা করি। মা আমার পড়ালেখায় আগ্রহ দেখে আগের ধারণা থেকে সরে আসেন। আমার প্রতি যত্নশীল হন। আমার জন্য অল্প অল্প করে টাকা জমানো শুরু করেন। নবম শ্রেণিতে যখন পড়তাম, তখন জানতে পারি, ফরম ফিলআপের জন্য ৩০০ টাকা লাগবে। মাসিক ৩০ টাকা চুক্তিতে প্রাইভেট টিউশনি শুরু করি। মা দুই–তিন মাইল দূর থেকে হেঁটে প্রতিদিন তিন–চার কলসি পানি এনে প্রতিবেশীদের কাছে বিক্রি করতেন। এই আয়ে আমার লেখাপড়ার খরচ চলত।

তখন দেখতাম ব্র্যাকের এক আপা প্রায়ই মোটরসাইকেল চালিয়ে আমাদের গ্রামে আসতেন। জানতে পারি, এসএসসি পাস করলে এ রকম ‘ব্র্যাক আপা’ হওয়া যায়। স্বপ্ন দেখতে শুরু করি, একদিন ‘ব্র্যাক আপা’ হয়ে আমার মায়ের সব কষ্ট দূর করব। মোটরসাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে যাব। এই সংকল্প অনেক কাজে দিয়েছিল। আমি এসএসসি পরীক্ষায় ‘এ’ গ্রেড নিয়ে উত্তীর্ণ হলাম। আমার কৃতিত্বে গ্রামবাসী সবাই আনন্দিত হয়। কারণ, এর আগে গ্রামের কেউ এই ফল আনতে পারেনি। পাস করার আনন্দে আমি ও মা সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। কষ্টের গল্প করতে গিয়ে দুজনে কেঁদেছি আবার আনন্দে নতুন স্বপ্ন বুনেছি।

এত কিছুর পরেও কিন্তু সংসার থেকে অভাব দূর হয়নি। রাত যেমন দীর্ঘস্থায়ী নয়, তেমনি কোনো কষ্টও বেশি দিন থাকে না। ব্র্যাকের এক জরিপে আমার মায়ের লড়াই ও দারিদ্র্যের কথা উঠে আসে। আমার মা ব্র্যাকের আলট্রা–পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামে যুক্ত হন। হাঁস–মুরগি ও গবাদি পশু পালনের প্রশিক্ষণ নেন। মা লেখাপড়া জানতেন না। একদিন দেখলাম, স্বাক্ষর করতে পারছেন। মায়ের এমন আগ্রহ ও পরিবর্তন আমাকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী করে। তাহলে আমি কেন পারব না? মা ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকেন। বাড়ির আঙিনায় শাকসবজি চাষ করেন। বাড়িতে হাঁস–মুরগি পালন করেন। বাজারে ডিম বিক্রি করেন। গরু পালন শুরু হয়। এগুলো থেকে আয় হতে শুরু হলো। সংসারে যে অভাব স্থায়ী রূপ নিয়েছিল, তা দূর হতে থাকে।

মায়ের পরিবর্তন ও সংসারের উন্নতির দৃষ্টান্ত আমাকে ব্র্যাকের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। আমি ব্র্যাকের আপা–ভাইদের সঙ্গে আলাপ করি। আমাকে তাঁরা উৎসাহ দেন। কিশোরী ক্লাবের সেলিনা আপাও পরামর্শ দেন মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করে আবেদন করতে। আমি তৈরি হতে থাকি। বাবার বয়স হয়ে যাওয়ায় কাজ করতে পারেন না। মা একা কত দিক সামলাবেন! এই চিন্তা আমাকে সব সময় উদ্বিগ্ন করত। তারপরও আমি পূর্ণ উদ্যমে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিই। পরীক্ষার মাঝামাঝি সময়ে শুনতে পাই বাবা অনেক অসুস্থ, বাড়ি এসে দেখি বাবা আর নেই। চোখের পানি আর একবুক হাহাকার নিয়ে পরীক্ষার টেবিলে বসি। কয়েক দিন না যেতেই মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবার মায়ের কাছে ছুটে গেলাম। বোনকে মায়ের কাছে রেখে পরীক্ষা দিতে গিয়ে শুনি মা নেই। এক মাসের মধ্যে আমার লড়াইয়ের সঙ্গী মা–বাবাকে হারালাম। তখন ভেঙে না পড়ে নিজেকে শক্ত রাখি। আমি যদি মাস্টার্স ভালোভাবে পাস না করতে পারি, তাহলে সব চেষ্টা বৃথা যাবে।

একদিন অভাবের কারণে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল—এখন আমি মাস্টার্স পাস। ভালো ফল নিয়ে মাস্টার্স পাস করেছি। এই অনুভূতির আস্বাদ নিতে আমাকে যে কত চড়াই–উতরাই পার হতে হয়েছে, তা মনে হলে এখনো অবিশ্বাস্য লাগে। বাড়ি বসে একদিন জানতে পারি, ব্র্যাক কর্মী নেবে। বিজ্ঞপ্তির যোগ্যতা আমার সঙ্গে মিলে যায়। আবেদন করি। ভাইভা বোর্ডে আমাকে প্রশ্ন করা হয়, ইউপিজি প্রোগ্রাম সম্পর্কে কতটুকু জানি। আমি তখন আবেগ ধরে রাখতে পারিনি—কোনোরকমে কাঁদতে কাঁদতে বলতে পেরেছিলাম, প্রোগ্রাম আমার মাকে স্বাবলম্বী করেছে, সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়েছে। আমাকে মাস্টার্স পাস করিয়েছে। আজ আমি এ কারণে আপনাদের মুখোমুখি হয়েছি।

নারীস্বাস্থ্য ও বাল্যবিবাহের মতো বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিরসনে সচেতনতা তৈরিতে বাড়ি বাড়ি যান মনোয়ারা। আশাহত নারীদের দুর্দশার গল্প শোনেন, তাঁদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন নিজের গল্প

সম্পর্কিত নিবন্ধ