বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান গ্রেফতারআগরতলা বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে ভিসা সেবা চালু হচ্ছে কালফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সভা অনুষ্ঠিতরমজানে দুর্নীতিমুক্ত ত্রাণ প্যাকেজ চালু করবে পাকিস্তানরিমান্ড শেষে কারাগারে সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামানজেনিথ ইসলামী লাইফের সব সূচকেই প্রবৃদ্ধি১৫ বছরের জঞ্জাল পরিষ্কার করেই নির্বাচন হতে হবে: গোলাম পরওয়াররমজানে কম লাভ করে জনগণের পাশে দাঁড়াতে ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টারগুচ্ছভর্তি পরীক্ষায় থাকছে ২০ বিশ্ববিদ্যালয়জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কমে ৯.
উৎস: SunBD 24
এছাড়াও পড়ুন:
অ্যামোলিয়া হার্ডশন অথবা খোদেজা খাতুন
গল্পকার ও অনুবাদক জিয়া হাশানকে চিনি বহু বছর। শাহবাগের আজিজ মার্কেটে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তাঁর ‘টালা মরিচের হইচই’ গল্পটি সম্ভবত: ২০০৯-এ পড়ে একটু অবাকই হয়ে যাই। অবাক হওয়ার কারণ ভাষায় বেশ নির্ভার ও স্বচ্ছন্দ একটি আয়াস এবং বরিশালের বিস্তীর্ণ ভূপ্রকৃতি ও জনজীবনের কিছু পরিচয়ের স্বাক্ষর তাঁর লেখায় আছে।
এ বছরের বইমেলায় ‘ঐতিহ্য’ প্রকাশ করেছে তাঁর গল্প সংকলন ‘প্রিয় ১৫ গল্প’। প্রথম গল্প ‘একটি রিট পিটিশনের জন্মবৃত্তান্ত’র বিষয়টি বাংলাদেশের মতো দেশের সামাজিক বাস্তবতায় প্রায় অসম্ভব। তবে এর ভেতরেও তাঁর গদ্যের সপাট বর্ণনাশক্তি হেলা করার মতো নয়,’... তাতে দেখি—দেশের দীর্ঘাঙ্গী স্রোতধারা হিসেবে নাক উঁচু করা মেঘনার বুকে গতর তুলে চারদিকে হাত–পা ছড়ানো ভূভাগ আবুইল্যার চর।
‘পোয়াতি বানানোর খেলা’ গল্পটি অসাধারণ যদিও এর সমাপ্তি বিশ্বাস করে ওঠাটা কঠিন। ‘খুদি’ নামের এক বিধবা ও শ্বশুরবাড়ি থেকে আশ্রয়চ্যুত মা, যে পোশাক কারখানায় শ্রমিক এবং তার চৌদ্দ বছরের মেয়ে সিতুও মায়ের কারখানাতেই কাজ করে। তার বয়স চৌদ্দ হলেও এক ‘সাদা মাগী’ কারখানা পরিদর্শনে এসে অপুষ্টি-অনাহারে বড় হওয়া সিতুকে দেখে ‘শিশু’ ভেবে কারখানায় শিশুশ্রম বন্ধের জন্য মালিকপক্ষকে চাপ দেয়। কারখানা কর্তৃপক্ষও সেই নোটিশ টাঙায়। অথচ মেয়ে সিতুকে এখনই বিয়ে না দিয়ে মা-মেয়ের যৌথ আয়ে গ্রামের বাড়িতে সামান্য জমি কেনার স্বপ্ন দেখছিল খুদি। বিধবা খুদিকে গার্মেন্টসের ফ্লোর ম্যানেজার রাকিব ভাই পরামর্শ দেয় গ্রামে গিয়ে মেয়ের জন্মনিবন্ধন সনদ আনতে পারলে তিন মাসের ভেতর ‘শিশু শ্রমিক’ হিসেবে তার কর্মচ্যুতি ঠেকানো সম্ভব।
কিন্তু গ্রামে গিয়ে প্রথমেই ভাশুরের দুর্ব্যবহার শুধু নয়, স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ অন্য নেতারাও বিরক্তি প্রকাশ করে তাদের মিছিল-মিটিং-নির্বাচনী প্রচারণার সময় না এসে এত দিন পর মেয়ের জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে আসায়! খুদির এক ভ্রাতুষ্পুত্র বিশ-ত্রিশ হাজার টাকার বদলে জন্মসনদ করে দেবে বললেও অত টাকা খুদির নেই।
শেষে আছিয়া খালা নামের এক বয়োজ্যেষ্ঠার পরামর্শ: ‘সিতুরে পোয়াতি বানাইয়্যা দে। প্যাডে তরল বীজ রুইয়্যা দে। তারপর দ্যাখ হের জাদু। দুই দিনে গোশত-মাংসরে ডাইকা আইনা অর গায়ে বসত দেবে। সাত দিনে উঁচা-লম্বার পথে নামাইবে। আর মাস গেলে তো অরে চল্লিশের বুড়ি বানাইয়্যা দেবে।’ আছিয়া খালা আরও বুদ্ধি দেয় যে শহরে ফিরে ফ্যাক্টরির সবাইকে খুদি যদি বলে যে মেয়েকে গ্রামে বিয়ে দিয়ে এনেছে, তবে জামাই এখন ফসল রোপণের মৌসুমে কাজে ব্যস্ত, তাহলেই সবার মুখে তালা পড়ে যাবে।’
‘কিন্তু ফ্যাক্টরি তো পোয়াতি রাখব না। দুই দিন পর খেদাইয়া দিবে।’
‘পয়সা হজম হইয়া গেলে আর খেল দেখাইয়া লাভ কী? চাকরি পাকা অইয়া গেলে আর রাখবি ক্যান? ফ্যাক্টরির স্যাররা টের পাওয়ার আগে ফালাইয়া দিবি। আইজকাইল কত রহমের বড়ি বাইরাইছে।’
হতভম্ব খুদি আছিয়া খালার পরামর্শেই অবিবাহিত সিতুকে ‘গর্ভবতী’ করতে কারখানার পরিচিত যুবকদের অনুনয় করতে থাকে। প্রায় কোনো যুবকই এত ‘পুঁচকে’ মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে যেতে রাজি হয় না। সুন্দরী তরুণী না হলে তারা সম্পর্কে যাবে কেন? অবশেষে সাইদুল নামে একজন রাজি হয়। তবে, দেহে এখনো শিশু রয়ে যাওয়া সিতুকে গর্ভবতী করার পরিশ্রমের মজুরি হিসেবে চায় এখনো ‘যুবতী দর্শনা’ খুদি তথা সিতুর মাকেই।
এটা প্রায় শিউরে ওঠার মতো গল্প! গল্পের শেষের মোচড় আরও ভয়াবহ।
‘গাড়ি-গণকের গাথা’ গল্পে লেখক প্রতিটি বাস দুর্ঘটনার পর কীভাবে কিছু মানুষ দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়িতে ঢুকে পড়ে আহত বা মৃতপ্রায় যাত্রীদের টাকাপয়সা, গয়না বা মোবাইল ছিনিয়ে নেয়, এমন ভয়ানক বিবরণ এঁকেছেন। ‘প্রাণ প্রোডাক্ট’ গল্পে বরিশালের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে ইট ভাটাশিল্পে ভালো ও সুন্দরদর্শন ইট গড়ার জন্য সমাজের প্রান্তিক নারীদের ব্যবহার থেকে শুরু করে শিশু হত্যা করে ভাটিতে ছুড়ে দেওয়া যেন ভালো মাপের ইট হয়—বেশ দুঃস্বপ্নের মতো।
‘খেয়ালি ভুঁই’ গল্পটি মজার এবং আগেই পড়া। ‘খেরালী’ নামের এক চাষা জমিতে বুনল হয়তো রসুনের বীজ, কিন্তু ফলল পেঁয়াজ। শাক ফলাতে গিয়ে ফলে গাঁজা। প্রকৃতির বিচিত্র খেলা বা কৌতুকের বয়ান হাজির হয়েছে এই গল্পে।
‘প্রিয় ১৫’র যে গল্প বাস্তবিকই পাঠককে আর্দ্র করে তুলবে, সেটি হলো ‘দুপুরের পাড়ে পুকুরের আড়ে’। নামে অ্যামোলিয়া হার্ডশন এক ব্রিটিশ তরুণী যাকে দেখতে তামাটে রঙের এক এ দেশীয় মেয়ে বলেই মনে হয়, তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছে। ‘আমি’ সর্বনামে কাহিনির কথক জনৈক জাহিদ ভাইয়ের ট্রাভেল এজেন্সিতে মাঝেমধ্যেই এমন এ দেশে সফরে আসা বিদেশিদের সঙ্গে কয়েক দিন দোভাষীর কাজ করে, ভালোই অর্থ উপার্জন করে। প্রথমে বাদামি নারী হিসেবে এই অ্যামোলিয়াকে তত পাত্তা না দিলেও দেখা গেল সে সবচেয়ে বেশি অর্থ অগ্রিম পরিশোধ করল এই দোভাষী যুবককে। কথায় কথায় জানা গেল যে অ্যামোলিয়ার নাম ছিল খোদেজা। গরিব বাবা ও বিমাতা বেশি মুখ খাওয়াতে পারবে না বলে খোদেজাকে ঢাকার এই জনারণ্যে ছেড়ে দিলেও ভাগ্যক্রমে এক লোক তার কান্নাকাটিতে গলে গিয়ে হাতের কাছের একটি এনজিওর হারিয়ে যাওয়া শিশুদের ড্রপ-ইন সেন্টারে ছেড়ে দেয়। সেখানে কয়েক মাস ‘এ ফর অ্যাপল, বি ফর বল’ শেখার পর ব্রিটেনের এক নিঃসন্তান হার্ডশন পরিবার খোদেজাকে দত্তক হিসেবে নিয়ে যায়। সেখানে পালক মা–বাবার সব সম্পত্তিরও সে অধিকারী হয়েছে। তবু আজ এত বছর পর অ্যামোলিয়া অথবা খোদেজা বাংলাদেশে এসেছে। না; হারিয়ে যাওয়া পিতা বা পরিবারের কাউকে খুঁজতে নয় বরং নিজ গ্রামের একটি পুকুরের ঘ্রাণ নিতে। এই তিনটি কাঁঠালতলা গ্রামকে খোঁজা, প্রথম দুই গ্রামকে বাতিল করে দেওয়া এবং শেষ গ্রামটিকে নিজ গ্রাম হিসেবে শনাক্ত করতে পারার পর কী করল অ্যামোলিয়া? হ্যাঁ; এত বছর পরও সে নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকে শনাক্ত করতে পারছে কোন গ্রামটি তার হারিয়ে যাওয়া গ্রাম এবং কোনটি নয়? কিন্তু কেন অ্যামোলিয়া বাংলাদেশে এল? কারণ সে নিজেই বলে, ‘হোয়াইট সোসাইটি আমাকে মনেপ্রাণে অ্যাকসেপ্ট করে নাই। অন্তর দিয়া আমাকে মেনে নেয়নি।... দেন ব্রাউনরা আবার আমাকে বিশ্বাস করে না।’
অ্যামোলিয়া চরিত্রে এই দ্বিধাবিভক্ত অন্তরের সংকট ও সংলাপে বারবার সৈয়দ শামসুল হকের ‘বালিকার চন্দ্রযান’ উপন্যাসের কথা মনে পড়বে। লেখক হিসেবে জিয়া হাশান এখানে কি হক দ্বারা প্রভাবিত? কাহিনির অন্তিমে অ্যামোলিয়া তার গ্রামের হারিয়ে যাওয়া পরিবার নয়, সেই পুকুরের জলেই তার অন্তিম আশ্রয় নেয়: ‘গাজীপুরে মাওনার কাছে পুকুরে ডুবে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ তরুণীর মৃত্যু’।
নিজস্ব লেখার পাশাপাশি হার্তা মুলার, মো ইয়ান ও হারুকি মুরাকামির উপন্যাস অনুবাদ করেছেন জিয়া হাশান। জিয়া হাশানের বড় শক্তি বরিশাল অঞ্চলের কথ্য ভাষার সরস প্রয়োগ, গোটা বরিশালের ভূপ্রকৃতি হাতের তালুর মতো চেনায়। জিয়া হাশানের দুর্বলতা? মাঝেমধ্যেই মনে হয় যেন জোর করে অশ্লীলতা টেনে আনছেন!
প্রিয় ১৫ গল্প
জিয়া হাশান
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রকাশক: ঐতিহ্য
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
পৃষ্ঠা: ২১৬
মূল্য: ৪৭০ টাকা