তিনতলার বারান্দা থেকে তাকিয়ে দেখা রাস্তার দৃশ্যগুলো কেমন সিনেমার মতন। আর্ট ফিল্ম, সাদাকালো সময়ের মতন। রেলিং থেকে উপচে পড়া সাদা আর রানী রঙের বাগানবিলাস ফুলগুলোর ফাঁক দিয়ে আমি এখন যাকে দেখছি তাকে কল্পনা করে নিয়েছি আর্ট ফিল্মের সেই বেকার নায়ক হিসেবে। উশকোখুশকো চুলে এগোচ্ছে এগোচ্ছে, আজ হয়তো তার ইন্টারভিউ। এই শোষিত সমাজে সে চাকরির মতন এক দাসত্ব মেনে নেবে কিনা ভাবতে ভাবতে ত্রস্ত পায়ে হাঁটছে। কিন্তু ডানদিকের কোনায় এসে খলিলের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একদলা থুথু ফেলে নাকের ময়লা ঘুঁটে খুঁটে সেই হাতে চায়ের কাপটা নিয়ে নির্বিকার চুমুক দিচ্ছে যখন, তখন মোহভঙ্গের বেদনায় আমি ঝুপ করে বেতের চেয়ারে বসে পড়ি, মট করে একটা শব্দ হয়। বুঝি চেয়ারের বামদিকের পাটা ভাঙছে। আর তখনই “তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সানাম” সুরে বাঁশির আওয়াজওয়ালা বিদঘুটে কলিংবেলটা বেজে ওঠে। কতবার ভাবি এই পিলে চমকানো কলিংবেল বদলাতে হবে, ভুলে যাই। ময়নার মা কানে তালা লাগিয়ে কাজ করছে এখন, দরজা খুলবে না, পাটায় মরিচ কিংবা জিরা বাটছে, নয়তো ভাতে গড় দিচ্ছে। আমি বাড়ি থাকলে আব্বা-আম্মা কষ্ট করে হেঁটে এসে দরজা খুলতে চায় না। এই দুপুরের মুখে পেপার পড়তে পড়তে এবং লাউশাকের আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে ঢুলছে তাদের ক্লান্ত শরীর। দরজার ওপাশে যে দাঁড়িয়ে, তার নাম ফেরদৌস। এবং তার চোখের কালো সানগ্লাস আর লম্বা দোহারা শরীরের কারণে তাকে দিব্যি গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদের ছোট ভাই বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। এ লোককে আমি চিনি না।
দরজা খোলার পর সে বলল, আমি ফেরদৌস।
আমি বললাম, কাকে চাই?
মিলি ম্যাডাম।
বলেন।
আপনি মিলি ম্যাডাম?
হুঁ।
আপনার চিঠি।
আমার!
হাত বাড়িয়ে চিঠিটা দেয় লোকটা। পুরোনো দিনের হলুদ খামে চিঠি। খামটা নতুন। এই খাম এখনও পাওয়া যায় জানতাম না! খামের ওপরে ফাঁকা, কিছু লেখা নেই।
কে পাঠিয়েছে?
আমার স্যার।
কে সে?
চিঠিতে লেখা আছে। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি ম্যাডাম। আপনি চিঠি পড়েন। উত্তর দিতে চাইলে আমার হাতে দিতে পারেন।
হলুদ খামের মোহে চিঠিটা উপেক্ষা করা হলো না। হতে পারে চিঠিতে বিষ মাখানো, চিঠি খুললে বিষের ঘ্রাণে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। ডাকাতের দল বাড়ির সব লুট করে চলে যাবে। নইলে হত্যার হুমকি। কিন্তু এমন কিছু কেন হবে! কার এত প্রয়োজন এই অযথা আমাকে মেরে ফেলবার! প্রেমপত্র তো নয়! মেসেঞ্জার হোয়াটসআপ ফেলে কেউ হলুদ খামে প্রেম জানাবে না, নিশ্চিত। দরজার ওপাশে ফেরদৌস সাহেব। দরজা আটকে ওই আধাভাঙা পায়ের বেতের চেয়ারে যেয়ে বসি। চিঠিটা টাইপ করা, হাতে লেখা নয়।
মিলি,
আশা করি, তুমি আমাকে চিনতে পারবে। বহু বছর আগে আমাদের পরিচয় ছিল। এতদিন পর আবার যোগাযোগ করলাম। অনেকদিন যোগাযোগ হয়নি, তোমার খবরও জানি না। একটা বিশেষ প্রয়োজনে তোমাকে খুঁজছি, শুনলাম তুমি বাড়ি এসেছ। থাকবে কিছুদিন? আমি একটা বিপদে পড়েছি। তুমি হয়তো সাহায্য করতে পারবে।
যদি অসুবিধা না হয়, ফেরদৌসকে তোমার উত্তর লিখে দিও। ফেরদৌস আমার খাসলোক। তোমার উত্তর পেলে বাকি কথা লিখব।
ইতি
রকি ফ্রম তেজকুনিপাড়া
রকি ফ্রম তেজকুনিপাড়া! আহারে। টানা বারান্দাটায় রোদ নেমেছে, আমি কখন সে রোদমাখা মেঝেতে শরীর মেলে দিয়েছি, কে জানে! চিঠি আমার হাতের মুঠোয়, নাকি বুকের কাছে? কতক্ষণ কেটে গেল জানি না তো, এক বেখাপ্পা হাঁচির শব্দে ছন্দপতন হয়, বাগানবিলাসের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখি, সেই আর্ট ফিল্মের নায়ক ভেবে ভুল করা খ্যাংরাকাঠি লোকটা ঝেড়ে হাঁচি দিচ্ছে। আহা, রকি ফ্রম তেজকুনিপাড়া! মনে পড়ে মরিচবাতি, গুঁড়ো গুঁড়ো মরিচবাতি। অদ্ভুত রঙের মরিচবাতিতে এই বাড়িটা মোড়ানো ছিল সেদিন। আমি চোখ বন্ধ করে দেখতে পারি তা। এখনও পারছি, এই যে।
ফেরদৌস সাহেব জানাল, রকি ফ্রম তেজকুনিপাড়া তার বস। বসের গলা বসে গেছে। কথা বলতে পারছে না। সে বসের হয়ে চিঠি আদানপ্রদানের কাজ করছে।
আমি আব্বার ঘর থেকে নীল একটা পুরোনো বলপয়েন্ট ঘষে ঘষে লেখার চেষ্টা করি। কেমন আছেন রকি ভাই? লেখার পর সে কালি হাওয়া। একটা কালো কলম খুঁজে পেলাম। সেটা দিয়ে বাকিটা লিখলাম।
কেমন আছেন রকি ভাই? অনেকদিন পর! আমি বাড়িতেই আছি এখন। কোথাও যাচ্ছি না। কী দরকার জানাবেন, চেষ্টা করব সাহায্য করতে। ফোনও করতে পারেন। আমার ফোন নম্বর– ০৭৪৮৫০০০৬৩২।
ইতি
মিলি
দুই রঙের কালি দিয়ে লেখা চিঠিটা বেশ ক’বার পড়লাম। আমার উদ্বেলতা বোঝা যাচ্ছে না তো! নির্লিপ্ততা ঠিকঠাক প্রকাশ পাচ্ছে তো!
দ্বিতীয় চিঠিটা এলো ঠিক দুই ঘণ্টা পর। ফেরদৌস সাহেব চিঠি নিয়ে এলো আবার। সন্ধ্যা নামছে, এখনও তার চোখে সানগ্লাস।
ফোন দিতে পারত তো রকি ভাই, কিংবা মেসেজ। নম্বর দিয়েছি তো চিঠিতে।
জানি না ম্যাডাম, চিঠি পড়েন।
ঘরে এসে বসেন।
জি না। বাইরে দাঁড়াই।
আজ্ঞাবহ প্রাণহীন দূতের মতন ফেরদৌস সাহেব বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিবার। আর আমি! টানা বারান্দায় বসে চিঠি পড়ে যাই। নতুন দুটো কলম কিনেছি নীল রঙের। তা দিয়ে চিঠির উত্তর লিখি।
মিলি,
তোমার সাথে আমার তো একটা সম্পর্ক ছিল, প্রেমের সম্পর্ক। সে তো অনেক আগের কথা। দশ বছর হবে, তাই না? সেই সূত্রেই তোমার কাছে আমার এই চিঠি লেখা। একটা সাহায্য লাগবে। করবে?
রকি
আমি লিখি,
রকি ভাই,
দশ না বারো বছর আগে। আচ্ছা, আপনি কেন চিঠি টাইপ করে পাঠান? হাতে লেখেন না কেন? ফোন করতে পারেন, কিংবা মেসেজ। গলা কি এখনও ব্যথা?
মিলি
কখনও একই দিনে উত্তর আসে। কখনও দিন পেরিয়ে যায়, এক দিন দুই দিন। আবার কোনো এক দুপুরে নিয়ম আলোহীন ল্যাম্পপোস্টের মতন সানগ্লাস পরা ফেরদৌস সাহেব হাতে চিঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির সামনে।
আমার সময় যেন পদ্মবিল। চিঠিগুলো ফুল হয়ে ফুটে উঠছে। সেই যে কাজের কথার সূত্র ধরে চিঠি দেওয়া-নেওয়া, সেখানে যেয়ে পৌঁছোনো হয়নি এখনও। রকি ফ্রম তেজকুনিপাড়া এখনও ইনিয়ে বিনিয়ে সূত্র খুঁজছে মূল গল্পে ঢোকার। আর আমি আদি প্রেমের আবেশে পদ্ম ফোটাচ্ছি।
তেজকুনিপাড়ার বস্তির পাশ দিয়ে ঘেঁষা প্রথম ডান রাস্তার শেষে আমাদের হলুদ বাড়িটা, যার তিনতলায় দাঁড়িয়ে বাগানবিলাস ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে আমি রাস্তার মানুষের আর্ট ফিল্ম দেখি, এই বাড়িটা তখনও ছিল, চৌদ্দ বছর আগে। তার আগেও ছিল। ত্রিশ বছর আগে তৈরি এই বাড়ি। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমিতে আমার আব্বার তৈরি সাধারণ হলদে বাড়ি। পাঁচতলা, বাকি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া, তিনতলার পুরোটা জুড়ে আমরা থাকি। আজ থেকে পাক্কা চৌদ্দ বছর আগে আমজাদ রহমান ও তার পরিবার দোতলার বাম দিকের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল। পেশায় ডাক্তার। লিবিয়াতে থাকত একসময়। দেশে ফিরে জায়গাজমি কিনেছে, নিজেদের বাড়ি হচ্ছে আমতলীতে। ততদিন পর্যন্ত এই ভাড়া বাসায় থাকবে। আমজাদ সাহেবের স্ত্রী পারভীন সুলতানা ইঞ্জিনিয়ার। কোনো বেসরকারি বড় কোম্পানিতে চাকরি করে। আম্মা-আব্বার জীবন যেন সার্থক হয়ে উঠল, এমন নামিদামি ঝকঝকে সবুজ এক টয়োটা করোলা গাড়ির মালিক এই বাড়ির ভাড়াটিয়া! তাদের জীবন আরও আলো আলো হয়ে উঠল যখন আমজাদ সাহেবের দুই পুত্র রকি-রুমির সাথে পরিচয় হলো। রকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করছে তখন আর রুমি নামওয়ালা এক ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। বেশ মনে আছে আমার ছোট ভাই আর আমার জীবন আব্বা-আম্মা ত্যানাত্যানা করে দিল, রকি-রুমির মেধা আর ঝাঁ চকচকে রূপের সাথে তুলনা করতে করতে। আমি আর আমার ছোট ভাই আড়ালে বসে গুলতানি করতাম, আমাদের বাপ-মায়ের অমন নতুন গাড়ি থাকলে আমরাও রকি-রুমির মতন স্মার্ট হতাম। যাদের অমন ভাঙা গাড়ি প্রতি মাসে গ্যারেজে যায়, তাদের ছেলেমেয়েরা তো খ্যাত হবেই।
রকি ভাইকে আমি যেদিন প্রথম দেখি, সেদিন ছিল ভরদুপুর। আমি বাড়ির সামনের ছোট্ট বাগানে আলসি বসে ছিলাম। যখন দেখলাম তাকে, কেউ আমাকে বলে দেয়নি, কিন্তু আমি নিশ্চিত বুঝেছি এ রকি। লম্বা পাতলা তিন কোনা মুখ সিল্কি রাহুল কাট চুল উড়িয়ে গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসা, সুগন্ধিতে ভরপুর, সাদা ফিনফিনে শার্ট আর আকাশি জিন্স পরা ছেলেটা রকি, আর অন্য কেউ নয়। সেদিন থেকে আমি কেমন বোকা হয়ে গিয়েছিলাম, বোকা হয়েই আছি। গভীর রাতে বাপের সবুজ গাড়ি চালিয়ে রকি যখন বাড়ি ফেরে আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম প্রতিদিন। তখন এখানে বাগানবিলাস গাছটা ছিল না, একটা গোলাপ গাছ ছিল, ফুল ফুটত না তাতে। রাতের খাওয়া শেষে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রকি কার সাথে যেন ফোনে কথা বলত। আমার সামনে তখন ইন্টারমিডিয়েট টেস্ট পরীক্ষা। পড়া শেষ করে মুখে চারটা ভাত গুঁজে রাতে ছুটে যেতাম বাগানে চারতলার সুবর্ণাকে নিয়ে। আম্মা খেপে উঠত, এত রাতে কোথায় যাস? আমি ছুটতে ছুটতে বলতাম, একটু হাঁটাহাঁটি না করলে রাতে, মাথায় পড়া বসে না। আমি কাঁধ বাঁকা করে হাঁটতাম যাতে হালকা করে দোতলার বারান্দায় চোখ রাখতে পারি। সুবর্ণা বলত, দেখ দেখ রকি ভাই ফোনে কথা বলতে বলতে তোমার দিকে তাকাচ্ছে।
এমন করতে করতে কেটে গেল এক-দু’বছর। রকি ভাই হাঁটে আমিও পেছন পেছন হাঁটি। মরা গোলাপ গাছের ফাঁক দিয়ে, রেলিঙে ঝুঁকে ঝুকে আমি রকি ভাইকে দেখি, আসা-যাওয়া, ঠোঁটের কোণে সিগারেট আর নির্লিপ্ত হেঁটে যাওয়া। এমন করেই আমাদের কী যেন হয়ে গেল। এত বছর আমি জানতাম প্রেম বটে, তবে প্রেমটা আমার একার। সেদিন যখন চিঠিতে রকি ভাই লিখল, তোমার সাথে আমার তো একটা সম্পর্ক ছিল, প্রেমের সম্পর্ক। ভাবি, সত্যিই ছিল দুজনের প্রেম! আগে বুঝিনি কেন? বুঝলে কি সব অন্যরকম হতো? সেদিনের সেই অদ্ভুত মরিচবাতির রং কি পাল্টে যেত!
রকি ভাই চিঠি লেখে, তার সংসারের কথা। আমি লিখি আমার সংসার ভেঙে যাওয়ার কথা। উনি এখন উনাদের আমতলীর ফ্ল্যাটে নিজ পরিবার নিয়ে থাকে। ফেসবুক খুলে আমি এই বারো বছরে রকি ভাইকে খুঁজেছি বহুবার, একটা প্রোফাইল বেকার পড়ে আছে। সেই পুরোনো আমলের এক প্রোফাইল ছবি, ফেসবুক থেকে তার জীবনের কোন খবর পাওয়া যায়নি কখনও।
রকি ভাই একদিন লেখে,
মিলি,
তোমার সাথে অল্প কিছুদিনের একটা সম্পর্ক ছিল। আসলে সম্পর্কটা কেমন ছিল? মানে আমরা কি কোথাও ঘুরতে গিয়েছি। ফোনে কথা হতো মনে আছে। বাইরে দেখা হতো? আমার না মনে নেই। জানা খুব দরকার।
রকি
আমি ভাবি, রকি ভাইয়ের স্মৃতি হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে। আমার কথা আমাদের কথা ভুলে যাচ্ছে! ভারী কষ্ট হয়। আমি লিখি, উবু হয়ে বসে নীল কলমে কেটে কেটে চিঠি লিখি,
রকি ভাই,
আমরা ফোনে কথা বলতাম। ওই যে ফ্রি টকটাইম ছিল রাতজুড়ে। স্টিকি ফিঙ্গারে খেতে গিয়েছি আমরা তিনবার। আপনার প্রিয় ছিল চিকেন ব্রোস্ট আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। আমি যেবার ইউনিভার্সিটি ভর্তি হলাম, আপনি আমার সাথে ক্যাম্পাসে এসেছিলেন পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে। আমার বন্ধুরা ছিল সেদিন সাথে। আপনার কিছু মনে নেই? আপনি টাইপ করে চিঠি লেখেন কেন? আচ্ছা ফেরদৌস সাহেবের হাতে চিঠি পাঠান, উনি যদি চিঠি পড়ে ফেলে?
মিলি
রকি ভাই তার উত্তরে জানায়, ফেরদৌস সাহেব চোখে ঝাপসা দেখে। এক চোখে প্রায় দেখেই না বললে চলে। চিঠি সে পড়বে না কিংবা পড়তে পারবে না। তারপর আর চিঠি আসে না। সপ্তাহ ঘুরে যায়। আমি নানারকম চিঠি লিখে রাখি। লিখি, রকি ভাই, আপনি কি সব ভুলে যাচ্ছেন? আপনি কি এখনও কাটা বেছে মাছ খেতে পারেন না? এলআরবির গান শোনেন এখনও? গিটারটা আছে? ডাস্ট এলার্জি কমেছে? মনে আছে, শিল্পকলার এক এক্সিবিশনে জলরঙে আঁকা একটা ছবি দেখে কি মুগ্ধ হয়েছিলেন, একটা গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা লোক তার ছোট্ট মেয়েটার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে? পুরো শহর খুঁজেছিলেন সেই গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি। পেয়েছিলেন? আছে আপনার এখন সেই গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি?
চিঠিগুলো পাঠানো হয় না, ঠিকানা জানি না যে। দেড় সপ্তাহ পরে চিঠি নিয়ে আসে ফেরদৌস সাহেব। বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে নির্বিকার।
মিলি,
ভণিতা না করে বলেই ফেলি। তোমার সাথে আমার ফোনে কথা হতো, আর রেস্টুরেন্টে গিয়েছি কয়েকবার। এর বেশি কিছু হয়নি তো, না? বাঁচা গেল। মানে চুমুটুমু খাইনি, না? না মানে খেলেও সমস্যা নাই। একটা প্রেমের সম্পর্ক যখন ছিল, তখন এসব হতেই পারে। কিন্তু আমার মনে নাই কিছু। চুমুর চেয়ে বেশি কিছু হয়নি তা মনে আছে। কিন্তু কিস ব্যাপারটা হয়নি তুমি নিশ্চিত, তাই তো? আসলে তোমার পরে আমার সম্পর্ক হয়েছিল, তানিয়া আর সুমির সাথে। আমাদের পাড়াতেই থাকত। তুমি চেনো তো ওদের। আসলে কার সাথে কী হয়েছে মনে করতে পারি না আর আলাদা করে। বিয়ে করেছি তন্বীকে। আব্বা-আম্মার পছন্দে। তুমি দেখেছ তো আমার বউকে। তন্বী খুব স্মার্ট আর বুদ্ধিমান মেয়ে। হয়েছে কী, খুলেই বলি, আমার এক বিশাল সমস্যা হয়েছে। অসুখও বলতে পারো। আমি না আর চুমু খেতে পারি না। অনেক বছর ধরে। বিয়ের পর কখনও তন্বীকে চুমু খেতে পারিনি। তন্বীও প্রথম দিকে মেনেই নিচ্ছিল। কিন্তু এখন বড় সমস্যা। একটা বাচ্চা আছে আমাদের, তবু শান্তি নাই। চুমু খেতে গেলে বা কাউকে চুমু খাবার কথা ভাবলে আমার ঠোঁট কেমন বেঁকে যায়। ডাক্তাররাও কিছু সমাধা করতে পারল না। আমার বউ খুব কষ্টে আছে। বোঝোই তো। একটা বেসিক নিড চুমু আমি সেটা পূরণ করতে পারছি না। আমাদের শারীরিক-মানসিক সম্পর্ক খুব বাজে জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে। আমি ভাবতাম চুমু না খেতে পারলে কী ক্ষতি হবে? শরীরের চাহিদা মেটালেই হলো। তুমি বিশ্বাস করো মিলি, চুমুর ক্ষমতা না থাকলে তুমি আর কিচ্ছু করতে পারবে না, হবেই না। আমি আগের কথা আর তেমন মনে করতে পারি না। টাইপ করে চিঠি লিখি, যাতে বউয়ের হাতে ধরা না খাই। বোঝোই তো সে খুব কষ্টে আছে। তোমার সাথে চুমু হয়নি বলছো? যদি হয়ে থাকে, মনে করতে পারো আমাকে একটু জানিও প্লিজ, কেমন ছিল সে চুমু? কবে থেকে চুমুর ক্ষমতা করিয়েছি মনেও করতে পারছি না। আমি খুব যন্ত্রণায় আছি, চুমুর অভাবে।
রকি
বারো বছর আগে পহেলা বৈশাখে ক্যাম্পাসের ডোবার পাশ ধরে হাঁটতে যেয়ে সেদিন আমি হোঁচট খাচ্ছিলাম বারবার, শাড়ির আঁচল বাতাসে এলোমেলো। রকি ভাই সেই আঁচল গুছিয়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। হাত বাড়িয়ে এত কাছে চলে এসেছিল যে, আরেকটু হলেই একটা চুমু হয়ে যায়। আমি সরে গিয়েছিলাম একটু। থাক পরে কখনও। “পরে কখনও” এক সময়ের অপেক্ষায় আমি বেঁচে থাকতাম, বেঁচে ছিলাম। কিন্তু এক ভোরে ঘুম ভেঙে শুনি, দোতলার রকি ভাইয়ের বিয়ে। অদ্ভুত মরিচবাতির রঙে তেজকুনিপাড়ার এই হলদে সাধারণ বাড়িটা যেদিন ঝলমল করছিল। বিয়ের নিমন্ত্রণে আব্বা গেল, আম্মা গেল আমার ছোট ভাই, চারতলার সুবর্ণা, সবাই গেল। আমি যাইনি। এই বারান্দায় তখন বাগানবিলাসের গাছ ছিল না। শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ গাছের ফাঁকে মুখ লুকিয়ে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি স্থির, কিন্তু মরিচবাতিগুলো কেমন কাঁপছিল। গোলাপি শাড়ি পরা টুকটুকে বউয়ের হাত ধরে রকি ভাই বিয়ের পরদিন এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, আমি এই মরা গোলাপ গাছের আড়ালেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকে কেউ দেখেনি, আমি সব দেখেছি। নিভে যাওয়া ক্লান্ত মরিচবাতিগুলো তখনও বাড়িটার গায়ে জড়ানো। সেদিন বিনা উত্তরে ফিরিয়ে দেই ফেরদৌস সাহেবকে, চিঠির উত্তর লিখতে ইচ্ছে করছে না যে। এতদিনের এলোমেলো লিখে রাখা চিঠিগুলো ময়নার মায়ের ঝাড়ুর বাড়িতে উড়ে উড়ে যায়। আমি কেমন সহজ চোখে সেই উড়ে যাওয়া দেখতে থাকি। পরদিন ঘুম ভেঙে জেগে দেখি রোদ মাখা পুরোনো আচারের মতন জমিয়ে রাখা আমার প্রথম প্রেমটা হারিয়ে গিয়েছে। কিচ্ছু মনে করতে পারছি না। মরিচবাতির কথা মনে পড়ছে শুধু। অনেক অনেক মরিচবাতি ফুটেছিল বারো বছর আগে। কিন্তু তার সেই অদ্ভুত রংটা, আমি আর মনে করতে পারছি না।
ফেরদৌস সাহেব প্রায়ই এসে এসে ঘুরে যায়।
“স্যার কী যেন জানতে চেয়েছিল আপনার কাছে চিঠিতে, সেদিন তো উত্তর দিলেন না। আজ দিবেন?”
আমি বলি, “না।”
ফেরদৌস সাহেব এসে দাঁড়িয়ে থাকে, আমি মুখ ঘুরিয়ে হেঁটে যাই। মুখ ফিরিয়ে বলি, “আমার যে কিছু মনে নাই আর।”
বাগানবিলাসের ফাঁক দিয়ে আমি রাস্তা দেখি। সেই আর্ট ফিল্মের নায়ক মার্কা চ্যাংড়া ছেলেটা খলিলের দোকানে বসে প্রায়ই চা খায় আর এদিক ওদিক থুথু ফেলে। আরও ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যায় অন্ধপ্রায় ফেরদৌস সাহেব হনহন করে একটা চিঠি হাতে হেঁটে যায়, কখনও তানিয়ার বাড়ি, কখনও সুমির বাড়ি। তার বস ওরফে রকি ফ্রম তেজকুনিপাড়ার পুরোনো চুমুর খোঁজে বোধহয়। আর আমি অবাক হয়ে ভাবি, এক ভুল দুপুরে পাওয়া হলুদ খামের চিঠি আমার একান্ত প্রথম প্রেমটা কেমন হুশ করে নিয়ে চলে গেল।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গল প আর ট ফ ল ম হল দ খ ম আম র স এই ব ড় আম দ র র জ বন র স মন প রথম আপন র র মতন
এছাড়াও পড়ুন:
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনীতি-সমাজ ও সংস্কৃতির আকাঙ্ক্ষা
গণঅভ্যুত্থান সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। কেননা এটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, বৈষম্য ও অনিয়মের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের প্রকাশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিল দীর্ঘদিনের সামাজিক হতাশা ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার বহিঃপ্রকাশ। এই গণআন্দোলনের অভিঘাত শুধু রাজনীতিতেই নয়, সমাজ ও সংস্কৃতির ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রতিবাদের অভিঘাত কেবল শাসনব্যবস্থা নয়, সমাজ ও সংস্কৃতির গভীর তলদেশেও অনুরণন তুলেছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির অবস্থা ও আকাঙ্ক্ষাগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।
গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছুটা হলেও মোড় ঘুরেছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর ওপর জনগণের আস্থা কমে যাওয়ার ফলে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, যার ফাঁকে নতুন নেতৃত্ব ও বিকল্প রাজনৈতিক চিন্তার উত্থান ঘটছে। অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আগের সরকার ব্যবস্থার পতন ঘটে। নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা পূরণের অঙ্গীকার দিয়ে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের মূল লক্ষ্য সুষ্ঠু নির্বাচন, রাষ্ট্রীয় সংস্কার তথাপি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার কাঁধে দায়িত্ব নিয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম দিকে ‘আস্থা ফেরানোর সরকার’ হিসেবে বিবেচিত হলেও বছর শেষে তার সাফল্য মিশ্র। স্বচ্ছ নির্বাচনি রূপরেখা, প্রশাসনের দলীয়করণ রোধ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এই তিনটি অঙ্গীকারের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন প্রক্রিয়া আংশিক অগ্রগতি পেলেও, বাকিগুলোতে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। প্রশাসনের মধ্যে পুরোনো গোষ্ঠীগত আনুগত্য এখনো প্রবলভাবে কাজ করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক সাফল্য হিসেবে বলা যায়- দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মেরুকরণ ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের পর অন্তর্বর্তী সরকার একটি ‘সততা ও স্বচ্ছতার বার্তা' দিয়েছে। তাদের কিছু কর্মকাণ্ড জনগণের আস্থার ভিত্তি গড়েছে। মানুষ রাস্তায় কথা বলছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভয়হীনভাবে লেখালেখি করছে, শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা-সমাবেশ করছে যা ২০২৪ সালের তুলনায় এক বিশাল পরিবর্তন। এটি প্রমাণ করে, অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত ‘শ্বাস নেওয়ার সুযোগ’ তৈরি করেছে।
আরো পড়ুন:
শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ
বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের পথে সরকার কতটা এগুলো?
দেশের তরুণরা রাজনীতি নিয়ে ভাবছে, কিছু নতুন রাজনৈতিক দল জন্ম নিয়েছে। এতে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ‘নেতৃত্বশূন্যতা’র ফাঁকা জায়গায় আলো দেখা যাচ্ছে। এরা দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতার দাবিকে কেন্দ্র করে নিজেদের কর্মসূচি সাজাচ্ছে। অনেক তরুণ, বিশেষ করে যারা সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে, তারা এই নতুন বিকল্পের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের সংলাপে অংশগ্রহণ করলেও, পুরোনো দলগুলো বারবার অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ফলে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়তে সরকার সফল হয়নি। বিচার ও জবাবদিহিতায় স্পষ্ট অগ্রগতি নেই, জনগণ চেয়েছিল, র্যাব, ডিবি বা পুলিশকে আরও মানবিক ও নিরপেক্ষ করা হোক। কিন্তু বাহিনীগুলোর আচরণ ও কাঠামোয় দৃশ্যমান কোনো সংস্কার আসেনি। বরং কিছু এলাকায় এখনও পুরোনো ভীতি বজায় রয়েছে। জনগণ চেয়েছিল, সব রাজনৈতিক শক্তি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একমত হয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করুক। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা, পাল্টাপাল্টি দোষারোপ এবং সংলাপে অনীহার কারণে জনগণের এই প্রত্যাশা আদৌও পূরণ হবে কি না, তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে! এই সংস্কারপ্রক্রিয়া জনগণের সম্পূর্ণ আশা পূরণ করতে পারবে— এমন প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু এটি একটি ভাঙা সিস্টেমে ‘আস্থার সূচনা’ করতে পেরেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য হয়ত বড় পরিবর্তনের ভিত্তি হতে পারে।
গণআন্দোলনের পর মানুষ যে ‘শুদ্ধিকরণ ও ন্যায়বিচার’-এর স্বপ্ন দেখেছিল তা এখনও অসম্পূর্ণ। এখনও প্রশাসনের দলীয় আনুগত্য ভাঙা যায়নি। তৃণমূল পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের দলীয় আনুগত্য বা গোষ্ঠীস্বার্থ এখনও বহাল আছে। অনেক স্থানে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘অস্থায়ী’ ভেবে আগের অভ্যাসেই চলছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ এশীয় কয়েকটি রাষ্ট্র অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উদ্যোগ (বিশেষত নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি) প্রশংসা করেছে। তবে বিচারিক স্বচ্ছতা এবং মানবাধিকার কমিশনের অকার্যকারিতার বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
এই অভ্যুত্থান এক ধরনের শ্রেণিচেতনাকে সামনে নিয়ে আসে। সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর (যেমন: দিনমজুর, পরিবহনশ্রমিক, রিকশাচালক, পোশাকশ্রমিক, হিজড়া জনগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সম্প্রদায়) ওপর রাষ্ট্র ও প্রশাসনের নিপীড়ন এবার মিডিয়া ও আন্দোলনে বেশি করে চিত্রিত হয়। গণঅভ্যুত্থান একটি বৃহত্তর নাগরিক জাগরণ সৃষ্টি করে। শিক্ষক, চিকিৎসক, পরিবেশকর্মী, আইনজীবী; যারা এতদিন নিঃশব্দ ছিলেন, তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে আওয়াজ তোলেন। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী আমরা ন্যায়ভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক সমাজ আমরা চাই যেখানে রাষ্ট্র ও প্রশাসন আইনের শাসনের প্রতি বাধ্য থাকবে, গরিব-বড়লোক, ক্ষমতাবান-সাধারণ কেউই আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না, গায়েবি মামলা, ক্রসফায়ার, হয়রানি, বিনাবিচারে আটক এসবের কোনো স্থান থাকবে না। সরকার নয়, ন্যায় হবে সবচেয়ে বড় কর্তৃপক্ষ। আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মর্যাদাবোধসম্পন্ন সমাজ চাই, যেখানে ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণি, জাতি, অঞ্চল, ভাষা কিংবা রাজনৈতিক মতভেদ কখনো নাগরিক অধিকার কেড়ে নেবে না, হিজড়া, দলিত, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু, পাহাড়ি সবার জন্য থাকবে সমান সুযোগ। আমরা চাই মর্যাদা-ভিত্তিক নাগরিকত্ব, করুণার নয়।
গণঅভ্যুত্থানের প্রাণ ছিল তরুণরা। তাই আমরা চাই, একটি জিজ্ঞাসু সমাজ, যেখানে প্রশ্ন করা 'অপরাধ' নয়। শিক্ষা হবে কেবল সার্টিফিকেটের জন্য নয়, মানুষ গড়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুক্ত চিন্তার কেন্দ্র, ছাত্রাবাস হবে নিপীড়নের স্থান নয়। অভ্যুত্থানের সময় আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমরা চাই, সেই সহানুভূতির চর্চা আমাদের সমাজব্যবস্থায় স্থায়ী হোক। একজন রিকশাচালকের মৃত্যু যেন কেবল 'সংখ্যা' না হয় বরং দায়বদ্ধতার প্রশ্ন উঠুক; দুর্যোগে সাহায্য, প্রতিবাদে সংহতি, শোকেও ভাগাভাগি হোক। কারও বাড়িতে ‘সোয়া দুই কোটি টাকার চেক’ আবার কেউ চিকিৎসার খরচ জোগাতে পারে না। আমরা এই বৈষম্যমূলক চর্চার বাইরে সমাজটিকে দেখি। শ্রমিকের ঘামে যে অর্থনীতি চলে, সে অর্থনীতির মালিকও শ্রমিকই হবে,সব নাগরিকের জন্য ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা ও স্বাস্থ্যসেবা থাকবে। আমরা শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন চাই না, আমরা ‘ন্যায়ভিত্তিক উন্নয়ন’ চাই।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সংস্কৃতির চেহারায় এক নতুন জাগরণ প্রত্যাশিত। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক গোঁজামিল, ফ্যাসিবাদের ছায়া এবং দমন-পীড়নের সংস্কৃতি সংস্কারপ্রবণ সমাজে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে গণমানুষের অংশগ্রহণ, প্রশ্ন করার সাহস এবং নতুন এক নৈতিক বোধের উন্মেষ। শিল্প, সাহিত্য, নাটক ও সংগীতে পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা জাগছে। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং মুক্তির ভাষা ফিরে আসছে কবিতায়, গান ও চিত্রকলায়। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র মানুষ এখন সংস্কৃতিকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং মতপ্রকাশ ও সামষ্টিক চেতনার বাহক হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। তবে কোথাও কোথাও সংস্কৃতির চিন্তা রুদ্ধ হয়েছে। মাজার ভাঙা, সংগীত-নাটকে বাধার ঘটনাও ঘটেছে। এরকম চর্চা অনাকাঙ্ক্ষিত।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সংস্কৃতি সবসময়ই ছিল প্রগতির বাহক, বৈচিত্র্য ও মানবিকতার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক ধারার বিপরীতে একটি শক্তি দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থেকেছে। তাদের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট: সমাজকে একমাত্রিক, সংকীর্ণ ও অচল চিন্তার খাঁচায় আবদ্ধ করা, যেখানে প্রশ্ন নেই, ভিন্নমত নেই, কল্পনা বা সৃজনশীলতার জায়গা নেই। মৌলবাদের আঘাত প্রথম আসে চিন্তার ওপর। তারা সাহিত্যে ‘অশ্লীলতা’ খোঁজে, চিত্রকলায় ‘অবমাননা’ খুঁজে বেড়ায়, গানকে ‘নিষিদ্ধ’ করে, নাটককে ‘পাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা চায় না, মানুষ স্বতন্ত্রভাবে ভাবুক, ইতিহাস জানুক, নিজের পরিচয় ও মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলুক। এই আঘাত শুধু মননে নয়, কখনো কখনো প্রাণঘাতীও হয়েছে মঞ্চে হামলা, শিল্পীর ওপর হামলা এ সব কিছু তার প্রমাণ।
মৌলবাদী আঘাতের আরেকটি দিক হলো সংস্কৃতির বিকৃতি। তারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে এবং সেই নামে প্রচলিত লোকসংস্কৃতিকে অস্বীকার করে। বাউল, কবি, সংস্কৃতি মেলা- সবকিছুকেই তারা খারিজ করে দিতে চায়। এতে করে সংস্কৃতি শুধু সংকুচিতই হয় না, জনগণের ঐতিহ্যবাহী আত্মপরিচয়ও হারাতে বসে। তবে আশার কথা হলো, প্রতিবাদ তো হচ্ছে। প্রতিবাদী কবিতা, বিকল্প চলচ্চিত্র, তরুণদের নেতৃত্বে সংস্কৃতির নতুন জাগরণ আশাবাদী হতে শেখাচ্ছে আমাদের। সংস্কৃতি হলো মানুষের মনের আয়না, যা কখনোই একরৈখিক শাসনের কাছে পরাজিত হয় না।
এই নবজাগরণে তরুণরা পুরোনো দাসত্বমনা সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে, নতুন মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। সামাজিক গণমাধ্যম, ছোট পত্রিকা, পথনাটক এবং বিকল্প সাহিত্যমাধ্যম এখন তাদের হাতিয়ার। একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সংস্কৃতি নিয়ে নতুন করে ভাবনা শুরু হয়েছে; তথ্য, ইতিহাস ও স্মৃতি রচনার দায়িত্বের প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন আনেনি, বরং সংস্কৃতিতে দিয়েছে নতুন ভাষা ও মননচর্চার দিগন্ত। এখন প্রশ্ন, এই জাগরণ কতটা টিকে থাকবে এবং কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে? তবে এটুকু নিশ্চিত যে, নিপীড়ন আর আত্মবিক্রয়ের সংস্কৃতি ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ এগোচ্ছে এক নতুন সাংস্কৃতিক দিগন্তের দিকে।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে জনগণের সংস্কৃতি হবে অধিকতর সচেতন, অংশগ্রহণমূলক ও আত্মমর্যাদাশীল। দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন ও ভয়ভীতির আবহে যে সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা জনগণের সচেতন অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ভরাট হতে শুরু করেছে। মানুষ এখন আর সংস্কৃতিকে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কিছু বলে মনে করে না, বরং তারা নিজেরাই হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির নির্মাতা। সবচেয়ে বড় কথা, এই নতুন জনগণের সংস্কৃতি হবে রাষ্ট্রনির্ভর নয়, বরং জনগণনির্ভর। এর উৎস থাকবে জনগণের সংগ্রামে, সাহসে, এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার সংকল্পে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
তারা//