‘পৃথিবীকে আগের চেয়ে স্বচ্ছভাবে দেখতে পাই’
Published: 19th, June 2025 GMT
আগামী ২৩ জুন ২০২৫ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ৯০তম বছরে পদার্পণ করবেন। জন্মদিনকে সামনে রেখে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিল কালের খেয়া। কথা বলেছেন হামিম কামাল
কালের খেয়া: স্যার, কেমন আছেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বয়স বাড়ছে। বয়সের বোঝা বহন করা একটু কঠিন হয়ে উঠছে। তবে মানসিকভাবে আমি শক্তই আছি এবং একটা বিষয় আমি উপলব্ধি করেছি– আমার ভেতরের যে দৃষ্টিশক্তি, তা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে, এখনও বাড়ছে। পৃথিবীকে আমি আগের চেয়ে স্বচ্ছভাবে দেখতে পাই। স্বচ্ছভাবে দেখতে পাওয়ার বিষয়টি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলছিল এবং এখনও বজায় আছে। এখন আগের চেয়েও ভালোভাবে বুঝতে পারি।
l পেছনের দিকে তাকালে নিজের জীবনের কোন প্রবণতা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে?
ll প্রবণতা প্রশ্নে, দুটো বিষয় আমি আমার ভেতর দেখেছি। একটি স্পর্শকাতরতা আমার ভেতর আছে। আবার সংবেদনশীলতাও আছে। স্পর্শকাতরতা আমাকে সংকীর্ণ করে, ধাক্কা দেয়। সংবেদনশীলতা আমাকে প্রসারিত করে। ক্রমশ আমার ভেতর সংবেদনশীলতাই বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে স্পর্শকাতরতার তুলনায়। এমনিতে আমি স্বভাবের দিক থেকে একটু লাজুক প্রকৃতির ছিলাম। এখনও আছি। মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে খুব একটা পারি না। আমার বাবা ভাবতেন, শিক্ষকতার কাজ আমি পারব না। কিন্তু পেরেছিলাম। কী করে পারলাম সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। সংবেদনশীলতা আমাকে ক্রমশ সামাজিক করেছে, সজীব করে রেখেছে, সচল রেখেছে আমার লেখা ও সাংস্কৃতিক কাজ। লেখাকে আমি সাংস্কৃতিক কাজের অংশ হিসেবে দেখেছি এবং সেই সাংস্কৃতিক কাজ একটা সামাজিক কাজও বটে।
শিক্ষকতার কাজ আমি কী করে করতে পারলাম, তার কারণ খুব সম্ভব এই যে–ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক কাজে আমি যোগ দেওয়ায় গণের সামনে আমি বোধহয় স্বচ্ছন্দ ছিলাম। আমাদের পাড়াতে নাটক করেছি। আজিমপুর কলোনিতে বড় হয়েছি আমরা। নাটক, আবৃতি, বিতর্ক করেছি, কলেজেও আমি নাটক করেছি–তখন নটর ডেম কলেজে পড়ি। দ্বিতীয় বর্ষে শেকসপিয়ারের মূল টেমপেস্ট (ইংরেজি) নাটকে অভিনয় করেছি আমরা। আরেকটা কাজ আমি উপভোগ করতাম। এখন যেখানে বোরহানউদ্দিন কলেজ, সেখানে ছিল রেডিও স্টেশন। রেডিও স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। সেখানে যারা প্রযোজক ছিলেন তাদের বয়স আমাদের থেকে কিছু বেশি ছিল, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। রেডিওতে অনেক অনুষ্ঠান করেছি। যখন টেলিভিশন শুরু হলো, সেখানেও অনেক অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিয়েছি। অর্থাৎ গণের সামনে উপস্থিত হতে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। ব্যক্তিগত পর্যায়ের লোকের সঙ্গে পরিচিত হতে আমার ভেতরে কেমন সংকোচ কাজ করত, এখনও করে।
l বেড়ে ওঠার কালে আপনার কাছে আদর্শ কিংবা বিশেষ প্রিয় লেখক কারা ছিলেন?
ll আমার তিনজন প্রিয় লেখক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রতি অনুরাগ তো সাধারণ। এর বাইরে তিনজন প্রিয় লেখকের প্রভাব আমার ওপর পড়েছে, বিশেষ করে আমার রচনারীতির ওপরে। তারা প্রমথ চৌধুরী, বুদ্ধদেব বসু ও শিবরাম চক্রবর্তী। আমি সেইন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়েছি। সেখানে আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন, বাংলার, সতীশ চক্রবর্তী। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে সতীশ চক্রবর্তী ছিলেন বুদ্ধদেব বসুর সমসাময়িক, সহপাঠী। তিনি বাংলায় পড়েছিলেন, অপরদিকে বুদ্ধদেব বসু ইংরেজিতে। সাহিত্যপাঠে তিনি আমাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। বসুর লেখা তিনি আমাদের পড়ে শোনাতেন। ঢাকার ওপরে লেখা, আত্মজৈবনিক লেখা, ছোট ছোট প্রবন্ধ। সেসব লেখার যে ভাষা ও ভঙ্গি সেটা তখন রপ্ত হলো। এরপর প্রমথ চৌধুরীর যে বাগবৈদগ্ধ সেটিও আমাকে আকর্ষণ করেছে। শিবরাম চক্রবর্তীর লেখাও আমাকে আকর্ষণ করেছে। তাঁর রসবোধ আমাকে আকৃষ্ট করেছে। এই তিন লেখক কিন্তু একরকম নন, তাদের আবার পরস্পরবিরোধীও বলা যায়। বুদ্ধদেব বসুকে আমি পুরো গ্রহণ করেছি তা না, তাঁর সমালোচনাও আমি করেছি। কারণ তাঁর যে জীবনদৃষ্টি সেটি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তাঁর সাহিত্যরীতি আমাকে উপকৃত করেছে।
l এমন কোনো গ্রন্থ আছে কী যা এখনো লিখে ওঠা হয়নি, কিন্তু প্রতিনিয়ত তাড়না অনুভব করছেন?
ll এখন আমি ভেতর থেকে তাড়না অনুভব করছি আত্মজীবনী লেখার। এ নিয়ে চারপাশ থেকেও বেশ চাপের মুখে আছি বলা যায়। আমার একটি অসুবিধা হচ্ছে, তরুণ বয়েসে দিনলিপি আমি তেমন লিখিনি। তবে আশার কথা হচ্ছে, অনেক আত্মজৈবনিক রচনা আমার আছে, স্বনামে ও ছদ্মনামে লেখা। গাছপাথর, নাগরিক প্রভৃতি ছদ্মনামে। সেগুলো কিছুটা বিক্ষিপ্ত, তবে আছে। আর আছে সাক্ষাৎকার। এই যেমন তোমাকে দিচ্ছি। এমন সাক্ষাৎকার আমাকে অনেক দিতে হয়েছে। পত্রিকা ও গ্রন্থাকারে সেসব প্রকাশিত হয়েছে। অনেকেই আশা করছেন, আমার জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো আমি ধারাবাহিকভাবে জানাব। আমি কী দেখলাম, কী বুঝলাম, তা আমিও ব্যক্ত করতে চাই, এবং সেই কাজ শুরুও করেছি। স্মৃতিশক্তি দুর্বল আমার এমনিতেই। এখন আরও দুর্বল হয়েছে। অনেক কিছুই এখন আর মনে করতে পারি না। এবং কোনো ঘটনা আমার সমসাময়িক যাদের সঙ্গে আলাপ করে যাচাই করে নিতে পারি, তেমন অনেকেই এখন আর নেই। তবু আমার ভরসার জায়গা এরইমাঝে প্রকাশিত লেখা ও সাক্ষাৎকারগুলো। আমার বিশ্বাস ওখানে আমি অনেক তথ্য ও সূত্র পাব। সময়সাপেক্ষ কাজ হবে। পত্রিকাতে আমি ধারাবাহিকভাবে লিখব। আসছে সংখ্যা থেকেই শুরু করছি। আমি অন্য কাজ কমিয়ে এখন সেই কাজেই বেশি মনোযোগ দিয়েছি।
l স্যার এবার একটা প্রিয় ও বিষণ্ন প্রসঙ্গে যেতে চাই। আপনার সহধর্মিণী নাজমা জেসমিন চৌধুরীর প্রসঙ্গ। ওনার দেওয়া প্রেরণা আপনি এখনও যেভাবে বহন করে চলেন, তা নিয়ে শুনতে চাইছি।
ll অনেক বছর আগে ও আকস্মিকভাবে মারা যায় (১৯৮৯)। তখন তার বয়স পঞ্চাশও হয়নি। নাজমার সঙ্গে যে বিষয়টিতে আমার মিল হয়েছিল, সেটি ছিল মতের মিল। নাজমা একটি পিএইচডি গবেষণা করেছিল, বাংলা উপন্যাস ও রাজনীতি বিষয়ে। পড়তে গিয়ে লেখকদের লেখা, ভাষ্য বিশ্লেষণ করে একটি উপলব্ধিতে পৌঁছেছিল। তা হলো–মানুষের মধ্যে মনের মিল জরুরি, কিন্তু তার চেয়েও জরুরি মতের মিল। এবং মতের মিল না হলে মনের মিল বজায় থাকে না। সেই যে মতের মিল, সেটি তার সঙ্গে আমার ছিল। ওর মৃত্যুর পর আমি একটি বই লিখেছিলাম, বন্ধুর মুখচ্ছবি। সেখানেই ওই কথাটিই বলেছি। আরেকটি বিষয়। আমার অভিজ্ঞতার জগৎটি খুব সংকীর্ণ। সে কারণেই আমার শিক্ষকতার, প্রতিবেশ ও পরিপাশের শিল্প-সংস্কৃতির মানুষের ভেতরই আমার বৃত্ত আবদ্ধ। এর বাইরে যে একটি জগৎ আছে, সামাজিক জগৎ, নারীর জগৎ এবং সাংসারিক মানুষের জগৎ– সেই জগতের সঙ্গে আমার পরিচয় সামান্য। নাজমা সেই জগৎকে জানত। তার লেখার ভেতর সেগুলো আছে। বেশি লিখতে পারেনি। অল্প বয়েসে চলে গেছে। গল্প, উপন্যাস, টেলিভিশন নাটক, শিশুদের জন্য নাটক– সবকিছুতেই সেই সামাজিক জগৎটা ফুটে উঠেছিল, যে জগৎ আমার বৃত্তের বাইরে। নাজমার অভিজ্ঞতা ও কৌতূহল ছিল, এবং সেই অভিজ্ঞতা ও কৌতূহল আমার মাঝেও সঞ্চারিত হয়েছে, আমি সমৃদ্ধ হয়েছি।
l স্পর্শকাতরতা থেকে সংবেদনশীলতার দিকে যে যাত্রা, সেখানে তাঁর ভূমিকা অনুভব করতে পারছি।
ll অবশ্যই তার ভূমিকা আছে। এবং আরেকটি বিষয়, বিয়ের আগে আমি তো ছিলাম আমার পারিবারিক বলয়ে। যেখানে আমার মা বাবা ভাই বোন ছিলেন। বিয়ের পর পরিবারের বাইরের একজন মানুষের সঙ্গে পরিবার রচনা করা, বিষয়টিতে সংবেদনশীলতার একটি জন্ম-অধ্যায় হয়েছে।
l এবার আমরা ভাবাদর্শের দিকে যেতে চাই স্যার। জানতে চাই কখন আপনার মনে সমাজতান্ত্রিক চৈতন্য জন্ম নিয়েছিল?
ll আমরা কিন্তু সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ নিয়ে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাইনি। তখন আমরা ওই ধরনের সাহিত্যও পাঠ করিনি। নিজেদের স্বদেশীয় সাহিত্যের জগতেই নিবিষ্ট ছিলাম। তখন ব্যক্তির বিকাশের প্রসঙ্গটি মনে জাগত। আমার প্রথম গ্রন্থের নাম অন্বেষণ। ১৯৬৫ সালে বেরিয়েছে। ওই গ্রন্থের প্রথম লেখাটি হচ্ছে, স্বাতন্ত্র্যের দায়। আমার তখন মনে হতো, একজন মানুষকে সবার আগে স্বতন্ত্র হতে হবে। কিন্তু স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করাই তো কঠিন। এখানে সবাই সংকীর্ণ হয়ে যাই। স্বতন্ত্রকে আক্রমণ করে। বলা হয়, খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এখানেই ছিল আমার সঙ্গে বিরোধ। আমি খাপ খাইয়ে নেওয়া, মিশে যাওয়া পছন্দ করতাম না। আমার জীবনের বাঁক বদলের মুহূর্তটি এলো যখন আমি ইংল্যান্ডে গেলাম। আমি গিয়েছি ১৯৫৯ সালে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গল প মত র ম ল প রসঙ গ ক কর ছ আম র ব গ রন থ আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনীতি-সমাজ ও সংস্কৃতির আকাঙ্ক্ষা
গণঅভ্যুত্থান সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। কেননা এটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, বৈষম্য ও অনিয়মের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের প্রকাশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিল দীর্ঘদিনের সামাজিক হতাশা ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার বহিঃপ্রকাশ। এই গণআন্দোলনের অভিঘাত শুধু রাজনীতিতেই নয়, সমাজ ও সংস্কৃতির ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রতিবাদের অভিঘাত কেবল শাসনব্যবস্থা নয়, সমাজ ও সংস্কৃতির গভীর তলদেশেও অনুরণন তুলেছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির অবস্থা ও আকাঙ্ক্ষাগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।
গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছুটা হলেও মোড় ঘুরেছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর ওপর জনগণের আস্থা কমে যাওয়ার ফলে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, যার ফাঁকে নতুন নেতৃত্ব ও বিকল্প রাজনৈতিক চিন্তার উত্থান ঘটছে। অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আগের সরকার ব্যবস্থার পতন ঘটে। নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা পূরণের অঙ্গীকার দিয়ে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের মূল লক্ষ্য সুষ্ঠু নির্বাচন, রাষ্ট্রীয় সংস্কার তথাপি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার কাঁধে দায়িত্ব নিয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম দিকে ‘আস্থা ফেরানোর সরকার’ হিসেবে বিবেচিত হলেও বছর শেষে তার সাফল্য মিশ্র। স্বচ্ছ নির্বাচনি রূপরেখা, প্রশাসনের দলীয়করণ রোধ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এই তিনটি অঙ্গীকারের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন প্রক্রিয়া আংশিক অগ্রগতি পেলেও, বাকিগুলোতে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। প্রশাসনের মধ্যে পুরোনো গোষ্ঠীগত আনুগত্য এখনো প্রবলভাবে কাজ করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক সাফল্য হিসেবে বলা যায়- দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মেরুকরণ ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের পর অন্তর্বর্তী সরকার একটি ‘সততা ও স্বচ্ছতার বার্তা' দিয়েছে। তাদের কিছু কর্মকাণ্ড জনগণের আস্থার ভিত্তি গড়েছে। মানুষ রাস্তায় কথা বলছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভয়হীনভাবে লেখালেখি করছে, শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা-সমাবেশ করছে যা ২০২৪ সালের তুলনায় এক বিশাল পরিবর্তন। এটি প্রমাণ করে, অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত ‘শ্বাস নেওয়ার সুযোগ’ তৈরি করেছে।
আরো পড়ুন:
শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ
বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের পথে সরকার কতটা এগুলো?
দেশের তরুণরা রাজনীতি নিয়ে ভাবছে, কিছু নতুন রাজনৈতিক দল জন্ম নিয়েছে। এতে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ‘নেতৃত্বশূন্যতা’র ফাঁকা জায়গায় আলো দেখা যাচ্ছে। এরা দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতার দাবিকে কেন্দ্র করে নিজেদের কর্মসূচি সাজাচ্ছে। অনেক তরুণ, বিশেষ করে যারা সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে, তারা এই নতুন বিকল্পের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের সংলাপে অংশগ্রহণ করলেও, পুরোনো দলগুলো বারবার অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ফলে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়তে সরকার সফল হয়নি। বিচার ও জবাবদিহিতায় স্পষ্ট অগ্রগতি নেই, জনগণ চেয়েছিল, র্যাব, ডিবি বা পুলিশকে আরও মানবিক ও নিরপেক্ষ করা হোক। কিন্তু বাহিনীগুলোর আচরণ ও কাঠামোয় দৃশ্যমান কোনো সংস্কার আসেনি। বরং কিছু এলাকায় এখনও পুরোনো ভীতি বজায় রয়েছে। জনগণ চেয়েছিল, সব রাজনৈতিক শক্তি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একমত হয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করুক। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা, পাল্টাপাল্টি দোষারোপ এবং সংলাপে অনীহার কারণে জনগণের এই প্রত্যাশা আদৌও পূরণ হবে কি না, তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে! এই সংস্কারপ্রক্রিয়া জনগণের সম্পূর্ণ আশা পূরণ করতে পারবে— এমন প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু এটি একটি ভাঙা সিস্টেমে ‘আস্থার সূচনা’ করতে পেরেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য হয়ত বড় পরিবর্তনের ভিত্তি হতে পারে।
গণআন্দোলনের পর মানুষ যে ‘শুদ্ধিকরণ ও ন্যায়বিচার’-এর স্বপ্ন দেখেছিল তা এখনও অসম্পূর্ণ। এখনও প্রশাসনের দলীয় আনুগত্য ভাঙা যায়নি। তৃণমূল পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের দলীয় আনুগত্য বা গোষ্ঠীস্বার্থ এখনও বহাল আছে। অনেক স্থানে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘অস্থায়ী’ ভেবে আগের অভ্যাসেই চলছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ এশীয় কয়েকটি রাষ্ট্র অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উদ্যোগ (বিশেষত নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি) প্রশংসা করেছে। তবে বিচারিক স্বচ্ছতা এবং মানবাধিকার কমিশনের অকার্যকারিতার বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
এই অভ্যুত্থান এক ধরনের শ্রেণিচেতনাকে সামনে নিয়ে আসে। সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর (যেমন: দিনমজুর, পরিবহনশ্রমিক, রিকশাচালক, পোশাকশ্রমিক, হিজড়া জনগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সম্প্রদায়) ওপর রাষ্ট্র ও প্রশাসনের নিপীড়ন এবার মিডিয়া ও আন্দোলনে বেশি করে চিত্রিত হয়। গণঅভ্যুত্থান একটি বৃহত্তর নাগরিক জাগরণ সৃষ্টি করে। শিক্ষক, চিকিৎসক, পরিবেশকর্মী, আইনজীবী; যারা এতদিন নিঃশব্দ ছিলেন, তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে আওয়াজ তোলেন। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী আমরা ন্যায়ভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক সমাজ আমরা চাই যেখানে রাষ্ট্র ও প্রশাসন আইনের শাসনের প্রতি বাধ্য থাকবে, গরিব-বড়লোক, ক্ষমতাবান-সাধারণ কেউই আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না, গায়েবি মামলা, ক্রসফায়ার, হয়রানি, বিনাবিচারে আটক এসবের কোনো স্থান থাকবে না। সরকার নয়, ন্যায় হবে সবচেয়ে বড় কর্তৃপক্ষ। আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মর্যাদাবোধসম্পন্ন সমাজ চাই, যেখানে ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণি, জাতি, অঞ্চল, ভাষা কিংবা রাজনৈতিক মতভেদ কখনো নাগরিক অধিকার কেড়ে নেবে না, হিজড়া, দলিত, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু, পাহাড়ি সবার জন্য থাকবে সমান সুযোগ। আমরা চাই মর্যাদা-ভিত্তিক নাগরিকত্ব, করুণার নয়।
গণঅভ্যুত্থানের প্রাণ ছিল তরুণরা। তাই আমরা চাই, একটি জিজ্ঞাসু সমাজ, যেখানে প্রশ্ন করা 'অপরাধ' নয়। শিক্ষা হবে কেবল সার্টিফিকেটের জন্য নয়, মানুষ গড়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুক্ত চিন্তার কেন্দ্র, ছাত্রাবাস হবে নিপীড়নের স্থান নয়। অভ্যুত্থানের সময় আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমরা চাই, সেই সহানুভূতির চর্চা আমাদের সমাজব্যবস্থায় স্থায়ী হোক। একজন রিকশাচালকের মৃত্যু যেন কেবল 'সংখ্যা' না হয় বরং দায়বদ্ধতার প্রশ্ন উঠুক; দুর্যোগে সাহায্য, প্রতিবাদে সংহতি, শোকেও ভাগাভাগি হোক। কারও বাড়িতে ‘সোয়া দুই কোটি টাকার চেক’ আবার কেউ চিকিৎসার খরচ জোগাতে পারে না। আমরা এই বৈষম্যমূলক চর্চার বাইরে সমাজটিকে দেখি। শ্রমিকের ঘামে যে অর্থনীতি চলে, সে অর্থনীতির মালিকও শ্রমিকই হবে,সব নাগরিকের জন্য ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা ও স্বাস্থ্যসেবা থাকবে। আমরা শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন চাই না, আমরা ‘ন্যায়ভিত্তিক উন্নয়ন’ চাই।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সংস্কৃতির চেহারায় এক নতুন জাগরণ প্রত্যাশিত। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক গোঁজামিল, ফ্যাসিবাদের ছায়া এবং দমন-পীড়নের সংস্কৃতি সংস্কারপ্রবণ সমাজে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে গণমানুষের অংশগ্রহণ, প্রশ্ন করার সাহস এবং নতুন এক নৈতিক বোধের উন্মেষ। শিল্প, সাহিত্য, নাটক ও সংগীতে পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা জাগছে। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং মুক্তির ভাষা ফিরে আসছে কবিতায়, গান ও চিত্রকলায়। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র মানুষ এখন সংস্কৃতিকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং মতপ্রকাশ ও সামষ্টিক চেতনার বাহক হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। তবে কোথাও কোথাও সংস্কৃতির চিন্তা রুদ্ধ হয়েছে। মাজার ভাঙা, সংগীত-নাটকে বাধার ঘটনাও ঘটেছে। এরকম চর্চা অনাকাঙ্ক্ষিত।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সংস্কৃতি সবসময়ই ছিল প্রগতির বাহক, বৈচিত্র্য ও মানবিকতার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক ধারার বিপরীতে একটি শক্তি দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থেকেছে। তাদের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট: সমাজকে একমাত্রিক, সংকীর্ণ ও অচল চিন্তার খাঁচায় আবদ্ধ করা, যেখানে প্রশ্ন নেই, ভিন্নমত নেই, কল্পনা বা সৃজনশীলতার জায়গা নেই। মৌলবাদের আঘাত প্রথম আসে চিন্তার ওপর। তারা সাহিত্যে ‘অশ্লীলতা’ খোঁজে, চিত্রকলায় ‘অবমাননা’ খুঁজে বেড়ায়, গানকে ‘নিষিদ্ধ’ করে, নাটককে ‘পাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা চায় না, মানুষ স্বতন্ত্রভাবে ভাবুক, ইতিহাস জানুক, নিজের পরিচয় ও মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলুক। এই আঘাত শুধু মননে নয়, কখনো কখনো প্রাণঘাতীও হয়েছে মঞ্চে হামলা, শিল্পীর ওপর হামলা এ সব কিছু তার প্রমাণ।
মৌলবাদী আঘাতের আরেকটি দিক হলো সংস্কৃতির বিকৃতি। তারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে এবং সেই নামে প্রচলিত লোকসংস্কৃতিকে অস্বীকার করে। বাউল, কবি, সংস্কৃতি মেলা- সবকিছুকেই তারা খারিজ করে দিতে চায়। এতে করে সংস্কৃতি শুধু সংকুচিতই হয় না, জনগণের ঐতিহ্যবাহী আত্মপরিচয়ও হারাতে বসে। তবে আশার কথা হলো, প্রতিবাদ তো হচ্ছে। প্রতিবাদী কবিতা, বিকল্প চলচ্চিত্র, তরুণদের নেতৃত্বে সংস্কৃতির নতুন জাগরণ আশাবাদী হতে শেখাচ্ছে আমাদের। সংস্কৃতি হলো মানুষের মনের আয়না, যা কখনোই একরৈখিক শাসনের কাছে পরাজিত হয় না।
এই নবজাগরণে তরুণরা পুরোনো দাসত্বমনা সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে, নতুন মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। সামাজিক গণমাধ্যম, ছোট পত্রিকা, পথনাটক এবং বিকল্প সাহিত্যমাধ্যম এখন তাদের হাতিয়ার। একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সংস্কৃতি নিয়ে নতুন করে ভাবনা শুরু হয়েছে; তথ্য, ইতিহাস ও স্মৃতি রচনার দায়িত্বের প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন আনেনি, বরং সংস্কৃতিতে দিয়েছে নতুন ভাষা ও মননচর্চার দিগন্ত। এখন প্রশ্ন, এই জাগরণ কতটা টিকে থাকবে এবং কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে? তবে এটুকু নিশ্চিত যে, নিপীড়ন আর আত্মবিক্রয়ের সংস্কৃতি ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ এগোচ্ছে এক নতুন সাংস্কৃতিক দিগন্তের দিকে।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে জনগণের সংস্কৃতি হবে অধিকতর সচেতন, অংশগ্রহণমূলক ও আত্মমর্যাদাশীল। দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন ও ভয়ভীতির আবহে যে সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা জনগণের সচেতন অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ভরাট হতে শুরু করেছে। মানুষ এখন আর সংস্কৃতিকে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কিছু বলে মনে করে না, বরং তারা নিজেরাই হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির নির্মাতা। সবচেয়ে বড় কথা, এই নতুন জনগণের সংস্কৃতি হবে রাষ্ট্রনির্ভর নয়, বরং জনগণনির্ভর। এর উৎস থাকবে জনগণের সংগ্রামে, সাহসে, এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার সংকল্পে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
তারা//