আগামী ২৩ জুন ২০২৫ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ৯০তম বছরে পদার্পণ করবেন। জন্মদিনকে সামনে রেখে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিল কালের খেয়া। কথা বলেছেন হামিম কামাল 

কালের খেয়া: স্যার, কেমন আছেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বয়স বাড়ছে। বয়সের বোঝা বহন করা একটু কঠিন হয়ে উঠছে। তবে মানসিকভাবে আমি শক্তই আছি এবং একটা বিষয় আমি উপলব্ধি করেছি– আমার ভেতরের যে দৃষ্টিশক্তি, তা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে, এখনও বাড়ছে। পৃথিবীকে আমি আগের চেয়ে স্বচ্ছভাবে দেখতে পাই। স্বচ্ছভাবে দেখতে পাওয়ার বিষয়টি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলছিল এবং এখনও বজায় আছে। এখন আগের চেয়েও ভালোভাবে বুঝতে পারি। 
l পেছনের দিকে তাকালে নিজের জীবনের কোন প্রবণতা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে?
ll প্রবণতা প্রশ্নে, দুটো বিষয় আমি আমার ভেতর দেখেছি। একটি স্পর্শকাতরতা আমার ভেতর আছে। আবার সংবেদনশীলতাও আছে। স্পর্শকাতরতা আমাকে সংকীর্ণ করে, ধাক্কা দেয়। সংবেদনশীলতা আমাকে প্রসারিত করে। ক্রমশ আমার ভেতর সংবেদনশীলতাই বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে স্পর্শকাতরতার তুলনায়। এমনিতে আমি স্বভাবের দিক থেকে একটু লাজুক প্রকৃতির ছিলাম। এখনও আছি। মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে খুব একটা পারি না। আমার বাবা ভাবতেন, শিক্ষকতার কাজ আমি পারব না। কিন্তু পেরেছিলাম। কী করে পারলাম সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। সংবেদনশীলতা আমাকে ক্রমশ সামাজিক করেছে, সজীব করে রেখেছে, সচল রেখেছে আমার লেখা ও সাংস্কৃতিক কাজ। লেখাকে আমি সাংস্কৃতিক কাজের অংশ হিসেবে দেখেছি এবং সেই সাংস্কৃতিক কাজ একটা সামাজিক কাজও বটে। 
শিক্ষকতার কাজ আমি কী করে করতে পারলাম, তার কারণ খুব সম্ভব এই যে–ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক কাজে আমি যোগ দেওয়ায় গণের সামনে আমি বোধহয় স্বচ্ছন্দ ছিলাম। আমাদের পাড়াতে নাটক করেছি। আজিমপুর কলোনিতে বড় হয়েছি আমরা। নাটক, আবৃতি, বিতর্ক করেছি, কলেজেও আমি নাটক করেছি–তখন নটর ডেম কলেজে পড়ি। দ্বিতীয় বর্ষে শেকসপিয়ারের মূল টেমপেস্ট (ইংরেজি) নাটকে অভিনয় করেছি আমরা। আরেকটা কাজ আমি উপভোগ করতাম। এখন যেখানে বোরহানউদ্দিন কলেজ, সেখানে ছিল রেডিও স্টেশন। রেডিও স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। সেখানে যারা প্রযোজক ছিলেন তাদের বয়স আমাদের থেকে কিছু বেশি ছিল, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। রেডিওতে অনেক অনুষ্ঠান করেছি। যখন টেলিভিশন শুরু হলো, সেখানেও অনেক অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিয়েছি। অর্থাৎ গণের সামনে উপস্থিত হতে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। ব্যক্তিগত পর্যায়ের লোকের সঙ্গে পরিচিত হতে আমার ভেতরে কেমন সংকোচ কাজ করত, এখনও করে।
l বেড়ে ওঠার কালে আপনার কাছে আদর্শ কিংবা বিশেষ প্রিয় লেখক কারা ছিলেন?
ll আমার তিনজন প্রিয় লেখক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রতি অনুরাগ তো সাধারণ। এর বাইরে তিনজন প্রিয় লেখকের প্রভাব আমার ওপর পড়েছে, বিশেষ করে আমার রচনারীতির ওপরে। তারা প্রমথ চৌধুরী, বুদ্ধদেব বসু ও শিবরাম চক্রবর্তী। আমি সেইন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়েছি। সেখানে আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন, বাংলার, সতীশ চক্রবর্তী। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে সতীশ চক্রবর্তী ছিলেন বুদ্ধদেব বসুর সমসাময়িক, সহপাঠী। তিনি বাংলায় পড়েছিলেন, অপরদিকে বুদ্ধদেব বসু ইংরেজিতে। সাহিত্যপাঠে তিনি আমাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। বসুর লেখা তিনি আমাদের পড়ে শোনাতেন। ঢাকার ওপরে লেখা, আত্মজৈবনিক লেখা, ছোট ছোট প্রবন্ধ। সেসব লেখার যে ভাষা ও ভঙ্গি সেটা তখন রপ্ত হলো। এরপর প্রমথ চৌধুরীর যে বাগবৈদগ্ধ সেটিও আমাকে আকর্ষণ করেছে। শিবরাম চক্রবর্তীর লেখাও আমাকে আকর্ষণ করেছে। তাঁর রসবোধ আমাকে আকৃষ্ট করেছে। এই তিন লেখক কিন্তু একরকম নন, তাদের আবার পরস্পরবিরোধীও বলা যায়। বুদ্ধদেব বসুকে আমি পুরো গ্রহণ করেছি তা না, তাঁর সমালোচনাও আমি করেছি। কারণ তাঁর যে জীবনদৃষ্টি সেটি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তাঁর সাহিত্যরীতি আমাকে উপকৃত করেছে। 
l এমন কোনো গ্রন্থ আছে কী যা এখনো লিখে ওঠা হয়নি, কিন্তু প্রতিনিয়ত তাড়না অনুভব করছেন?
ll এখন আমি ভেতর থেকে তাড়না অনুভব করছি আত্মজীবনী লেখার। এ নিয়ে চারপাশ থেকেও বেশ চাপের মুখে আছি বলা যায়। আমার একটি অসুবিধা হচ্ছে, তরুণ বয়েসে দিনলিপি আমি তেমন লিখিনি। তবে আশার কথা হচ্ছে, অনেক আত্মজৈবনিক রচনা আমার আছে, স্বনামে ও ছদ্মনামে লেখা। গাছপাথর, নাগরিক প্রভৃতি ছদ্মনামে। সেগুলো কিছুটা বিক্ষিপ্ত, তবে আছে। আর আছে সাক্ষাৎকার। এই যেমন তোমাকে দিচ্ছি। এমন সাক্ষাৎকার আমাকে অনেক দিতে হয়েছে। পত্রিকা ও গ্রন্থাকারে সেসব প্রকাশিত হয়েছে। অনেকেই আশা করছেন, আমার জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো আমি ধারাবাহিকভাবে জানাব। আমি কী দেখলাম, কী বুঝলাম, তা আমিও ব্যক্ত করতে চাই, এবং সেই কাজ শুরুও করেছি। স্মৃতিশক্তি দুর্বল আমার এমনিতেই। এখন আরও দুর্বল হয়েছে। অনেক কিছুই এখন আর মনে করতে পারি না। এবং কোনো ঘটনা আমার সমসাময়িক যাদের সঙ্গে আলাপ করে যাচাই করে নিতে পারি, তেমন অনেকেই এখন আর নেই। তবু আমার ভরসার জায়গা এরইমাঝে প্রকাশিত লেখা ও সাক্ষাৎকারগুলো। আমার বিশ্বাস ওখানে আমি অনেক তথ্য ও সূত্র পাব। সময়সাপেক্ষ কাজ হবে। পত্রিকাতে আমি ধারাবাহিকভাবে লিখব। আসছে সংখ্যা থেকেই শুরু করছি। আমি অন্য কাজ কমিয়ে এখন সেই কাজেই বেশি মনোযোগ দিয়েছি। 
l স্যার এবার একটা প্রিয় ও বিষণ্ন প্রসঙ্গে যেতে চাই। আপনার সহধর্মিণী নাজমা জেসমিন চৌধুরীর প্রসঙ্গ। ওনার দেওয়া প্রেরণা আপনি এখনও যেভাবে বহন করে চলেন, তা নিয়ে শুনতে চাইছি।
ll অনেক বছর আগে ও আকস্মিকভাবে মারা যায় (১৯৮৯)। তখন তার বয়স পঞ্চাশও হয়নি। নাজমার সঙ্গে যে বিষয়টিতে আমার মিল হয়েছিল, সেটি ছিল মতের মিল। নাজমা একটি পিএইচডি গবেষণা করেছিল, বাংলা উপন্যাস ও রাজনীতি বিষয়ে। পড়তে গিয়ে লেখকদের লেখা, ভাষ্য বিশ্লেষণ করে একটি উপলব্ধিতে পৌঁছেছিল। তা হলো–মানুষের মধ্যে মনের মিল জরুরি, কিন্তু তার চেয়েও জরুরি মতের মিল। এবং মতের মিল না হলে মনের মিল বজায় থাকে না। সেই যে মতের মিল, সেটি তার সঙ্গে আমার ছিল। ওর মৃত্যুর পর আমি একটি বই লিখেছিলাম, বন্ধুর মুখচ্ছবি। সেখানেই ওই কথাটিই বলেছি। আরেকটি বিষয়। আমার অভিজ্ঞতার জগৎটি খুব সংকীর্ণ। সে কারণেই আমার শিক্ষকতার, প্রতিবেশ ও পরিপাশের শিল্প-সংস্কৃতির মানুষের ভেতরই আমার বৃত্ত আবদ্ধ। এর বাইরে যে একটি জগৎ আছে, সামাজিক জগৎ, নারীর জগৎ এবং সাংসারিক মানুষের জগৎ– সেই জগতের সঙ্গে আমার পরিচয় সামান্য। নাজমা সেই জগৎকে জানত। তার লেখার ভেতর সেগুলো আছে। বেশি লিখতে পারেনি। অল্প বয়েসে চলে গেছে। গল্প, উপন্যাস, টেলিভিশন নাটক, শিশুদের জন্য নাটক– সবকিছুতেই সেই সামাজিক জগৎটা ফুটে উঠেছিল, যে জগৎ আমার বৃত্তের বাইরে। নাজমার অভিজ্ঞতা ও কৌতূহল ছিল, এবং সেই অভিজ্ঞতা ও কৌতূহল আমার মাঝেও সঞ্চারিত হয়েছে, আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। 
l স্পর্শকাতরতা থেকে সংবেদনশীলতার দিকে যে যাত্রা, সেখানে তাঁর ভূমিকা অনুভব করতে পারছি। 
ll অবশ্যই তার ভূমিকা আছে। এবং আরেকটি বিষয়, বিয়ের আগে আমি তো ছিলাম আমার পারিবারিক বলয়ে। যেখানে আমার মা বাবা ভাই বোন ছিলেন। বিয়ের পর পরিবারের বাইরের একজন মানুষের সঙ্গে পরিবার রচনা করা, বিষয়টিতে সংবেদনশীলতার একটি জন্ম-অধ্যায় হয়েছে। 
l এবার আমরা ভাবাদর্শের দিকে যেতে চাই স্যার। জানতে চাই কখন আপনার মনে সমাজতান্ত্রিক চৈতন্য জন্ম নিয়েছিল?
ll  আমরা কিন্তু সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ নিয়ে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাইনি। তখন আমরা ওই ধরনের সাহিত্যও পাঠ করিনি। নিজেদের স্বদেশীয় সাহিত্যের জগতেই নিবিষ্ট ছিলাম। তখন ব্যক্তির বিকাশের প্রসঙ্গটি মনে জাগত। আমার প্রথম গ্রন্থের নাম অন্বেষণ। ১৯৬৫ সালে বেরিয়েছে। ওই গ্রন্থের প্রথম লেখাটি হচ্ছে, স্বাতন্ত্র্যের দায়। আমার তখন মনে হতো, একজন মানুষকে সবার আগে স্বতন্ত্র হতে হবে। কিন্তু স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করাই তো কঠিন। এখানে সবাই সংকীর্ণ হয়ে যাই। স্বতন্ত্রকে আক্রমণ করে। বলা হয়, খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এখানেই ছিল আমার সঙ্গে বিরোধ। আমি খাপ খাইয়ে নেওয়া, মিশে যাওয়া পছন্দ করতাম না। আমার জীবনের বাঁক বদলের মুহূর্তটি এলো যখন আমি ইংল্যান্ডে গেলাম। আমি গিয়েছি ১৯৫৯ সালে। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গল প মত র ম ল প রসঙ গ ক কর ছ আম র ব গ রন থ আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে: সালাম 

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম বলেছেন, বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে। বিএনপি জনগণের ওপর নির্ভরশীল একটি দল। বিএনপির এতো নেতাকর্মীকে জেলে নিয়েছে, হত্যা করেছে, গুম করেছে, পঙ্গু করেছে তারপরও বিএনপি গণতান্ত্রিক পথে থাকার চেষ্টা করেছে।

আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজশাহী নগরীর চন্দ্রিমা থানা বিএনপির কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

আব্দুস সালাম বলেন, শেখ হাসিনার বাবা এক সময় বাংলাদেশের রাজনীতিকে মাটির নিচে পাঠিয়ে দিয়েছিলো আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্সে। এক দল বাকশাল করেছিলো, শেখ হাসিনা অঘোষিত বাকশাল করেছিলেন যেনো এ দেশে কোন গণতন্ত্র না থাকে। কেউ কথা বলতে পারবে না, কেউ নির্বাচন করতে পারবে না। উনি যাই বলবে; তাই হবে। উনি বুক ফুলিয়ে বলেছেন, এ দেশে একটা বিরোধী দল পাইলাম না। অর্থাৎ বিরোধী দলটা উনি বানাতে চায়। সরকার উনি নিজেই, আর বিরোধী দল তার মন মতো হবে। আমরা ওই গণতন্ত্র বিশ্বাস করি না। এ কারণে এখনও আমরা বলি, সব রাজনীতি সবাই করুক আর মানুষ ঠিক করবে কে ক্ষমতায় যাবে আর কে যাবে না। 

তিনি আরও বলেন, অনেকেই বলে হাসিনার মতো, বিএনপি খালি ভোট ভোট করে। খালি নির্বাচনের কথা বলে। আমরাতো নির্বাচনের কথাই বলবো। আমরাতো ভোটের কথাই বলবো। কারণ, পাঁচ বছরে একবার মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়। এই ভোটের অধিকারটাও কেড়ে নিয়েছিলো। এই ভোট দরকার ছিলো না শেখ হাসিনার। শেখ হাসিনার দরকার ছিলো ভারতের। ভারত তাকে রক্ষা করবে, ভারত তাকে ক্ষমতায় আনবে এবং আজীবন তাকে পুষে বড় করবে। দেশ আমার আপনার, আর ভারত ঠিক করতে এইটা আমরা আগেও মানিনি এখনও মানি না।

সম্মেলনে চন্দ্রিমা থানা বিএনপির আহ্বায়ক ফাইজুল হক ফাহির সভাপতিত্বে প্রধান বক্তা ছিলেন রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী এশা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তেহরানে আছেন যারা, কেমন আছেন তারা
  • রকি ফ্রম তেজকুনিপাড়া
  • ইরানে হামলা নিয়ে ট্রাম্পের রহস্যজনক বার্তা 
  • বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে: সালাম 
  • ট্রুথ কমিশন গঠনের বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি: আইন মন্ত্রণালয়
  • ইরানি হামলায় ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষতি
  • ইসরায়েলে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছে ইরান
  • ইসরায়েলে উল্লেখযাগ্য ক্ষতি করেছে ইরান
  • তেহরান থেকে হঠাৎ ওমানে গেল ৩ উড়োজাহাজ