আগামী ৪ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির মেয়রপদে নির্বাচন। এ পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতা অর্জন করেছেন ৩৩ বছর বয়সী মুসলিম রাজনীতিবিদ জোহরান মামদানি। এখনো মেয়র নির্বাচিত না হলেও ভোটার থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম—সবাই জোহরানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। 

ইকনোমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন জোহরান। রাজনীতিতে একেবারেই নবাগত জোহরানের দুটি বিষয় সবার নজর কেড়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, অন্য রাজনীতিকদের মতো তিনি অতটা ধনী নন। অন্যটি হলো, জোহরানের অনন্য পারিবারিক ঐতিহ্য।

নির্বাচিত হলে জোহরান হবেন নিউইয়র্ক নগরের সবচেয়ে কমবয়সী মেয়র। সেই সঙ্গে প্রথম মুসলিম মেয়রও হবেন তিনি। জোহরান শুধু অশ্বেতাঙ্গ নন, তিনি একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম। জোহরানের জন্ম উগান্ডার কাম্পালায়। সাত বছর বয়সে বাবা-মায়ের সঙ্গে নিউইয়র্কে আসেন তিনি। তার মা ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মিরা নায়ার। বাবা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নামজাদা অধ্যাপক মাহমুদ মামদানি জন্মগতভাবে ভারতীয়।

বামঘেঁষা ডেমোক্র্যাট জোহরান। নিউইয়র্ক শহরকে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অধিক বসবাসযোগ্য করে তোলার স্বপ্ন দেখিয়ে বাজিমাত করেছেন তিনি। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ন্যায্য মূল্যের মুদিদোকান খোলা, স্বল্পআয়ের মানুষের জন্য নতুন দুই লাখ অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ, ভাড়ানিয়ন্ত্রিত অ্যাপার্টমেন্টে আগামী চার বছর ভাড়া বাড়ানো নিষিদ্ধ করা, নিখরচায় শিশু পরিচর্যার ব্যবস্থা, বিনা ভাড়ার সরকারি বাসের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়ে ভোটারদের মনোযোগ কেড়েছেন জোহরান।

একে অশ্বেতাঙ্গ, তার ওপর তরুণ মুসলিম হিসেবে জোহরানের এমন এজেন্ডা নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের মধ্যে বিপুল সাড়া ফেলেছে। সে কথা মাথায় রেখেই জোহরান এবং নিউইয়র্কের একমাত্র নির্বাচিত বাঙালি কাউন্সিলর শাহানা হানিফ যৌথভাবে বাংলায় একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করেছেন। ২৪ জুন বাছাইপর্বে শাহানা ডেমোক্রেটিক পার্টির কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন।

এদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুমোর মতো বাঘা রাজনীতিককে পেছনে ফেলে প্রার্থিতা নিশ্চিত করার পর জোহরান তাঁর সমর্থকদের ধন্যবাদ দিতে ভোলেননি। ২৪ জুন মধ্যরাতের পর সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া এক বক্তব্যে জোহরান তাঁর হয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচারণায় অংশ নেওয়া ‘বাংলাদেশি আন্টিদেরও’ ধন্যবাদ দেন।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন উইয র ক ন উইয়র ক স ট ন উইয়র ক র জন ত কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

জোহরান মামদানি যেভাবে ইতিহাস বদলে দেওয়ার পথে

২৪ জুন রাত। নিউইয়র্কের জ্যামাইকার মুসলিম সেন্টারের সামনে মানুষের জটলা। তরুণ, যুবক ও বয়স্ক মানুষও আছেন। সবাই উচ্ছ্বসিত ও আনন্দিত। কয়েক দিন ধরে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন তাঁরা। সেই চিন্তার অবসান হয়েছে। নিউইয়র্ক সিটি মেয়র নির্বাচনের প্রাথমিক পর্বে তাঁদের প্রার্থী জোহরান মামদানি জয়ী হয়েছেন। তাঁদের এত দিনের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।

কিছু দিনের জন্য সন্তানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি। আছি নিউইয়র্কেই। ফলে নিউইয়র্ক সিটির নির্বাচনের এই উত্তাপ ও উত্তেজনা দেখার সুযোগ হলো। এবারের সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে শুরু থেকেই আলোচনা তৈরি করেছিলেন জোহরান। ধীরে ধীরে বিশ্ব মিডিয়ায় শিরোনাম হয়ে যান তিনি। এখন তো নিউইয়র্ক সিটির মেয়র হওয়ার একেবারেই দ্বারপ্রান্তে তিনি। মুসলিম কাউকে এ প্রথম মেয়র হিসেবে পেতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ শহর।  

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে কথা বললাম। তাদের বিশাল একটি অংশ জোহরান মামদানিকেই সমর্থন দিয়েছেন। জোহরানের প্রায় নিশ্চিত বিজয় নিয়ে তাদের ভাবনা কী?

জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক ও জেনারেল সেক্রেটারি মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা আফতাব উদ্দিন মোহাম্মদ মান্নান বলেন, ‘খুব ভালো লাগছে। আমরা সবাই এই বিজয়ের অংশীদার। এর মাধ্যমে একটি নতুন ইতিহাস রচিত হলো। জোহরান মামদানি একজন প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাট এবং বর্তমানে একজন সিটি কাউন্সিলর। আমরা তাঁর পক্ষ নিয়েছি। কারণ, তিনি সব সময় ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলেছেন। তাঁদের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে আসছেন। তিনি ন্যায়ের পক্ষে। নির্বাচনে তাঁর পক্ষে ৪০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ করেছেন। মেয়র প্রার্থী হিসেবে তাঁর অঙ্গীকারগুলোও আমাদের আকৃষ্ট করেছে।

তিনি পরিচ্ছন্ন সাবওয়ের কথা বলেছেন। সবার জন্য সাশ্রয়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করার কথাও বলেছেন এবং নিউইয়র্কের শ্রমজীবী মানুষের জন্য বেতন বাড়ানোর বিষয়টিকে তিনি খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি নিরাপদ ও মাদকমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন বলেও অঙ্গীকার করেছেন। এসব চিন্তা এখানকার মুসলমানদের আকৃষ্ট করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি একজন ভালো মুসলিম, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা উচ্চশিক্ষিত আইনজীবী ও তাঁর বাবা হার্ভার্ডের শিক্ষক।’

আফতাবের কথায় নিউইয়র্কের মুসলমান সম্প্রদায়ের কথার প্রতিফলন ঘটেছে। জোহরান মামদানি নামটি কয়দিন আগেও আমার কাছে অপরিচিত ছিল। বাংলাদেশে তাঁর নাম আগে শুনিনি। কিন্তু আফতাবের কথায় বুঝলাম, জোহরান এখানে খুব জনপ্রিয় এবং এখানকার রাজনীতিতে বেশ প্রভাবশালী। প্রাথমিক পর্বে তাঁর জয় এখানকার রাজনীতির ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত চিহ্নিত হচ্ছে। এটি যেন এখানকার মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি নীরব বিপ্লব।

জোহরান মামদানির বিজয়কে কেন এত গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন মুসলমানরা? কেন একে মাইলফলক ভাবছেন? তার বেশ কয়েকটি কারণ আছে। প্রধান কারণ হলো, তিনি একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তিনি একজন মুসলমান ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ। এমন পরিচয়ের একজন মানুষ নিউইয়র্ক সিটির মেয়র হতে চলেছেন, মানে একটি বিশ্বখ্যাত মহানগরের শীর্ষ পদে আসীন হবেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ রকম আগে কখনো ঘটেনি। এবারই প্রথম। আর এ ঘটনা শুধু নিউইয়র্ক সিটির রাজনীতি নয়, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় উঠেছে। মার্কিন রাজনীতি ও সামাজিকভাবে মুসলমানদের একটা স্বস্তি ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যাবে বলে অনেকের ধারণা।

নাইন–ইলেভেনের পর থেকে মার্কিন সমাজে মুসলমানেরা ‘সন্দেহভাজন’ হয়ে দিন যাপন করছে। মুসলমানেরা হয়ে উঠেছে আতঙ্কের মতো। মুসলিম পরিচয়টাই যেন হয়ে উঠেছিল একটি উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার বিষয়। সেই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সন্দেহের দেয়াল ভেঙে সামনে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম সমাজ। তাদের এগিয়ে যাওয়া প্রথম প্রত্যক্ষ করা গেছে দুজন নারীর মাধ্যমে। তাঁরা হলেন মিনেসোটার ইলহান ওমর ও মিশিগানের রাশিদা তালিব। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে প্রথম মুসলিম নারী সদস্য রাশিদা তালেব ও ইলহান ওমর। তাঁরা দুজনই ২০১৯ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাশিদা তালেব মিশিগান থেকে এবং ইলহান ওমর মিনেসোটা থেকে নির্বাচিত হন।

দুজনই মার্কিন কংগ্রেসে মুসলিম নারীদের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে নতুন ইতিহাস তৈরি করেছেন। তাঁদের নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।

মামদানির বিজয়ও এ রকম একটি বড় ঘটনা হতে চলেছে। সবচেয়ে বড় কথা, মামদানির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বা রাজনৈতিক ভাবনাগুলো শুধু তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষকে ঘিরে বিকশিত হয়নি। তিনি উদারনৈতিক মানুষ। তাঁর পরিচয় বা কর্ম শুধু নিজের ধর্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। মুসলমানদের জন্য আলাদা কোনো কর্মসূচি বা এজেন্ডা তাঁর নেই। তিনি নিউইয়র্ক সিটির সব মানুষের সাধারণ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন, যেমন বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা, পুলিশের সংস্কার করা, জলবায়ু ন্যায়বিচার ইত্যাদি। তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় এগুলোই প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। এ জন্য তিনি শুধু মুসলমানদের প্রতিনিধি নন, সব নাগরিকের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। আর এ রকম মনোভাবই তাঁকে এগিয়ে নিয়েছে বলে এখানকার ভোটারদের বিশ্বাস।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি প্রবাসী বলেন, শুধু নিজের সম্প্রদায়গত চিন্তা আর কর্মকাণ্ড দিয়ে মানুষ নেতা হতে পারেন না। মামদানি সেটা করেননি বলেই, নিজের গণ্ডির বাইরে চিন্তা করেছেন বলেই তিনি এগিয়ে গেছেন। তিনি আরও বলেন, একটা সময় ছিল এখানে মুসলমানরা ভোটার হিসেবে উপেক্ষিত ছিল। সেই মুসলমানরা এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বে আসছে। এটা কম কথা নয়।

মামদানির বিজয় এখানকার মুসলমানদের জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো, আটলান্টা, ডেট্রয়েট, হিউস্টনের মতো বিশাল সিটিগুলোয় মুসলিম তরুণেরা উৎসাহিত হচ্ছেন। তাঁরা স্থানীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে রাজ্য পর্যায়ের রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন। ফলে সামাজিক হীনম্মন্যতা মুছে তাঁরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

আগামী ৪ নভেম্বর চূড়ান্ত অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে জোহরান মামদানি লড়বেন ও জিতে আসবেন—এ ব্যাপারে বিশ্লেষকেরা প্রায় নিশ্চিত। তাঁর এ বিজয় শুধু একজনের বিজয় নয়, এতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। এটি শুধু রাজনৈতিক বিজয় নয়, মুসলমানদের প্রতি এখানকার সমাজের আস্থার পুনর্নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তরও রচিত হবে যুক্তরাষ্ট্রে।

ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জোহরান মামদানির নিউইয়র্ক জয় যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনপন্থী রাজনীতিকে চাঙা করছে
  • জোহরান মামদানি যেভাবে ইতিহাস বদলে দেওয়ার পথে
  • নিউইয়র্কে ইতিহাস গড়া জোহরান কেন ‘বাংলাদেশি আন্টিদের’ ধন্যবাদ দিলেন
  • জোহরানকে ‘পাগল কমিউনিস্ট ও ভয়ংকর’ বলে বিদ্রুপ করলেন ট্রাম্প
  • ঠিকানা টিভিতে আসছে ‘ফ্রাইডে নাইট উইথ জায়েদ খান’
  • নিউইয়র্কে ইতিহাস গড়লেন জোহরান মামদানি
  • সাবেক গভর্নর কুমোর হার, নিউইয়র্কের সম্ভাব্য মেয়র মুসলিম তরুণ মামদানি
  • নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী বাছাইয়ে কে এগিয়ে
  • তপন চৌধুরী, নাসিম মঞ্জুর ও জারিন মাহমুদ এমটিবির পরিচালক