ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে: আলী রীয়াজ
Published: 12th, July 2025 GMT
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের শাসনকে ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ। তিনি বলেছেন, ‘ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে।’
আলী রীয়াজ আরও বলেন, ‘আমাদের আকাঙ্ক্ষা, জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা। আমাদের আকাঙ্ক্ষা, এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির ঊর্ধ্বে থাকবে, তাঁকে (ব্যক্তিকে) নিয়ন্ত্রণ করবে। আমরা চাই, ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হবে।’ সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ হচ্ছে বলে জানান তিনি।
আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
‘ছাত্র শ্রমিক জনতার গণ–অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি-বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক এ সভার আয়োজন করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিষদ নামের একটি সংগঠন।
আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতিনিধিত্ব করে এখানে কথা বলছি না। বক্তব্যগুলো আমার, দায়িত্বও আমার।’
আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলছি। এই লড়াই গত বছরের জুলাই থেকে শুধু নয়; গত ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ বলেছে, “গণতান্ত্রিক অধিকার চাই।” দেশের মানুষ গত ১৬ বছর ধরে ফ্যাসিবাদী শাসন মোকাবিলা করেছে, তা নয়। বাংলাদেশে একসময় একদলীয় ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে মানুষ লড়াইয়ের চেষ্টা করেছে।’
অধ্যাপক রীয়াজ মনে করেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, এমন সব প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, যা ব্যক্তির ঊর্ধ্বে উঠে ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রের স্বার্থকে সামনে রেখে জাতিকে নেতৃত্ব দেবে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, ‘আপনি পার্লামেন্ট তৈরি করবেন এ কারণে নয় যে ব্যক্তির বন্দনা হবে। আপনি পার্লামেন্ট এ কারণে তৈরি করবেন না যে নির্বাহী বিভাগের সব অত্যাচার–নিপীড়নকে রাবার স্ট্যাম্প দেবেন। আপনাকে তৈরি করতে হবে সেই পার্লামেন্ট, যেখানে শুধু ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য থাকবে না।’
নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা নিরূপণ করা আইনসভার কাজ। আইনসভা থেকেই নির্বাহী বিভাগ তৈরি হচ্ছে পার্লামেন্টারি সিস্টেমে (সংসদীয় ব্যবস্থায়)। নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতাকে আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত না নজরদারির মধ্যে রাখতে পারবেন (ততক্ষণ গণন্ত্রের বিকাশ হবে না) এবং সেটা করবে কে, জনপ্রতিনিধিরা করবেন’, বলেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘আপনার আমার ভোটে যিনি নির্বাচিত হবেন, তিনি নির্বাহী বিভাগ নিযন্ত্রণ করবেন এটাই স্বাভাবিক, সেই প্রতিষ্ঠান আমাদের তৈরি করতে হবে। তা না হলে গণন্ত্রের বিকাশ হবে না।’
আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে বিএনপির নেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, যতটুকু বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তা যথেষ্ট। বাকিটা জনগণের ওপর ছেড়ে দিন। তিনি বলেন, ‘সরকারের প্রথম দায়িত্ব ছিল, বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা, কিন্তু সরকার তা না করে আরও বিভক্তি তৈরি করেছে।’
সরকার কার্যকরভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন কাজে লাগাতে পারেনি বলে আলোচনা সভায় মন্তব্য করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা বিষয়ে তিনি বলেন, বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ আর পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী সোহাগকে হত্যার মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। এই ঘটনা আওয়ামী জাহেলিয়াতকে মনে করিয়ে দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্দেশ করে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘আর যা–ই করেন, আমাদের কর্মকাণ্ড যেন আওয়ামী জাহেলিয়াতকে অতিক্রম করে না যায়। যদি যায়, তাহলে আমরা বারবার রক্ত দেব, কিন্তু আমাদের কোনো সমস্যার সমাধান হবে না।’
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, বাসদের সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক পরিষদ সদস্য আকবর খান, আহত জুলাই যোদ্ধা ফায়েজুর রহমান মনির, বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়কারী মাসুদ রানা ও বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আবদুল মাজেদ আতাহারী প্রমুখ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক ব যবস থ ঐকমত য আম দ র করব ন ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অন্তঃসারশূন্য
জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর বক্তৃতায় সনদের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনেছেন। প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তৃতায় আলংকারিক বাহুল্য ও শ্রেষ্ঠত্ববাদী অহমিকার চর্বিতচর্বণ ছাড়া আর কিছুই নেই। মোটাদাগে তাঁর এই অন্তঃসারশূন্য বক্তব্য জাতিকে আশার আলো দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।
আজ রোববার সকালে এক বিবৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এসব কথা বলে।
অনৈক্যের প্রভাব খোদ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা এমন এক আপত্তিজনক ও বিতর্কিত বিষয়ের অবতারণা করেছেন, যা রাজনৈতিকভাবে তো বটেই, সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল। তিনি দুইবার তাঁর বক্তৃতায় ‘বর্বরতা’ ও ‘সভ্যতা’র যে মেরুকরণ করেছেন, তা নিন্দনীয় ও বিদ্বেষমূলক হয়েছে বলে আমরা মনে করি।
শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে এ সনদ প্রণীত হয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, জুলাই সনদে নারী, লৈঙ্গিক পরিচয়ে সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ব্যাপারে কোনো আশার আলো নেই। এ সনদ স্বাক্ষর দিবসে সব রাজনৈতিক দল উপস্থিত না থাকলেও সরকার ও ঐকমত্য কমিশন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এই আয়োজন করতে ব্যতিব্যস্ত ছিল বলে মনে হয়েছে। এমতাবস্থায় জুলাই সনদ ঐক্যের ডাক দিতে ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে, যা অদূর ভবিষ্যতে নতুন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করবে।
বিবৃতিতে শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, মহাসমারোহে ‘জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর’ আয়োজনের ঢাকঢোল পেটানো হলেও শুরু থেকেই জুলাই সনদ তৈরির প্রক্রিয়া ও পরিসর নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ছিল। তাই এই অনুষ্ঠান নিয়ে মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আগ্রহ ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কার কমিশন ও ঐকমত্য কমিশন প্রতিষ্ঠা, সংস্কার নিয়ে আলাপচারিতা ও সর্বোপরি জুলাই সনদ প্রস্তুত করার লক্ষ্যে যেভাবে অগ্রসর হয়েছে, তা অভ্যুত্থানের বহু অংশীজনকেই আশাহত করেছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, সরকার এতটাই জনবিমুখ হয়ে পড়েছে যে বহু অংশীজনের স্বর এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতসহ জনগণের আকাঙ্ক্ষা উঠে আসেনি সংস্কারের সুপারিশমালা ও চূড়ান্ত জুলাই সনদে। বিশেষত, নারী, লিঙ্গীয় পরিচয়ে সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ব্যাপারে এই সনদে কোনো আশার আলো নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে খুশি করতে গিয়ে বিভিন্ন পক্ষকে এই সনদ চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় দূরে রাখা হয়েছে। অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় অংশীদার শিক্ষার্থীদের অভিপ্রায়কে (চাওয়া) গুরুত্ব না দিয়ে যে ‘ঐক্যে’র কথা প্রচার করা হয়েছে, সেখানে যে ফাঁক রয়েছে, তা সনদ স্বাক্ষরের দিনই দেখা গেছে। জুলাই যোদ্ধাদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং পুলিশ তাঁদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক মনে করে, ব্রিটিশ ও পশ্চিমা ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদীরা উপনিবেশিত জাতিগুলোকে ‘অসভ্য’ ও ‘বর্বর’ সাব্যস্ত করে তাদের ওপর তথাকথিত ‘মর্ডানিটি’ (আধুনিকতা) ‘এনলাইটমেন্ট’ (আলোকায়ন), ‘সিভিলাইজেশন’ (সভ্যতা), ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’ (শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ) চাপিয়ে দিয়েছিল। তেমনি প্রধান উপদেষ্টা ক্ষমতার মসনদে বসে অবিবেচনাপ্রসূত ঔপনিবেশিক অপরায়নের ছাঁচেই কথা বলেছেন। মনে রাখা দরকার, তিনি একটি সরকারের প্রধান নির্বাহী হলেও এটি তাঁর অস্থায়ী পরিচয়। সারা বিশ্বেই তিনি একজন স্বনামধন্য একাডেমিশিয়ান ও সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে সমাদৃত। এমন এক বর্ণিল একাডেমিক পরিচয় থাকার পরও তিনি কী করে উপনিবেশজাত শব্দসম্ভারে তাঁর বক্তৃতা রাখতে পারলেন, তা আমাদের কাছে বিস্ময়কর লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এমন শব্দচয়নের বিরোধিতা করে তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।