জলবায়ু সংকটে কেন মুসলমানদের কর্তব্য অনেক
Published: 3rd, August 2025 GMT
পৃথিবী আমাদের জন্য আল্লাহর আমানত। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘শান্তিশৃঙ্খলা স্থাপিত হওয়ার পর পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৫৬)
জলবায়ু পরিবর্তন এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় হুমকি, যা আমাদের খাদ্য, পানি ও অস্তিত্বকে বিপন্ন করছে। জাতিসংঘের আন্তসরকারি জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেল (আইপিসিসি) জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষতি অপরিবর্তনীয় হতে পারে। তবে আমরা এখনো পদক্ষেপ নিয়ে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারি। ইসলাম আমাদের পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হতে শেখায়।
যে ব্যক্তি শুষ্ক, অনুর্বর জমি পুনরুদ্ধার করে এবং চাষ করে, আল্লাহ তার জন্য পুরস্কার লিখবেন।আল–মুনাওয়ী, ফায়যুল কাদির, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩৯এই নিবন্ধে আমরা মুসলমানদের জন্য সাতটি ব্যবহারিক পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করব, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়ক হবে।
জলবায়ু সংকটের গুরুত্বজলবায়ু পরিবর্তন হলো পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, যা গ্রিনহাউস গ্যাসের (যেমন কার্বন ডাই–অক্সাইড ও মিথেন) অতিরিক্ত নির্গমনের ফলে ঘটছে। এর কারণে সমুদ্রের পানির স্তর বাড়ছে, ফসল উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, বনাঞ্চলে আগুন বাড়ছে এবং বন্যা–খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব সরাসরি লক্ষণীয়, সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন একটি জরুরি সমস্যা।
ইসলামে পৃথিবীকে আমানত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘সাত আসমান এবং পৃথিবী ও এতে যা কিছু আছে, তা তাঁর মহিমা ঘোষণা করে।’ (সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ৪৪)
নবীজি (সা.
এই শিক্ষাগুলো আমাদের পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়।
আরও পড়ুনযে ৬টি কাজ সমাজ–জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করে ২১ মে ২০২৪জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বব্যাপী দৃশ্যমান। ২০১৮ সালে ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষ, ২০১৭ ও ২০১৯ সালে বাংলাদেশে বন্যা এবং অস্ট্রেলিয়ায় বনাঞ্চলের আগুন জলবায়ু পরিবর্তনের উদাহরণ। এই পরিবর্তনগুলো খাদ্য ও পানির সংকট সৃষ্টি করছে, যা দরিদ্র সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর। আমাদের দেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ছে, যা কৃষি ও পানীয় জলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
যে ব্যক্তি একটি গাছ রোপণ করে, যা থেকে মানুষ, প্রাণী বা পাখি উপকৃত হয়, তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৫৫৩পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, যা থেকে তোমরা পান করো এবং গাছপালা জন্মায়।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ১০-১১)
এই নেয়ামত রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।
মুসলমানরা কী পদক্ষেপ নিতে পারেনজলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় মুসলমান হিসেবে আমরা বেশ কিছু সহজ ও ব্যবহারিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি, যা ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করা সম্ভব।
১. হাঁটা বা সাইকেল চালানো
কাছাকাছি গন্তব্যে, যেমন মসজিদ বা বন্ধুর বাড়ি, গাড়ির পরিবর্তে হাঁটা বা সাইকেল চালানোর অভ্যাস গড়ুন। এটি কেবল কার্বন নির্গমন কমায় না; বরং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। নবীজি (সা.) প্রায়ই হাঁটতেন। হাঁটা একটি সুন্নাহ আমল। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত হাঁটা মানসিক চাপ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে (জার্নাল অব মেন্টাল হেলথ, ২০১৯, খণ্ড ২৮, পৃষ্ঠা ৪৫৬)।
আমাদের দেশে যেখানে ট্রাফিক জ্যাম একটি বড় সমস্যা, সাইকেল ব্যবহার জ্বালানি খরচ ও দূষণ কমাতে পারে।
হাঁটা একটি সুন্নাহ আমল। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত হাঁটা মানসিক চাপ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে।২. গাড়ি ভাগাভাগি করা
কর্মস্থল বা বাইরে যাওয়ার সময় বন্ধু বা সহকর্মীদের সঙ্গে গাড়ি ভাগ করে নিন। একটি গাড়ি বছরে গড়ে ৪ দশমিক ৬ টন কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গত করে। গাড়ি ভাগাভাগি এই নির্গমন কমায় এবং জ্বালানি সাশ্রয় করে। ইসলামে সম্পদের অপচয় নিষেধ: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৩১)
৩. প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো
প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য বোতল, ব্যাগ ও পাত্র ব্যবহার করুন। প্লাস্টিক সূর্যের তাপে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে। বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণ নদী ও সমুদ্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যা জেলে সম্প্রদায়ের জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলছে।
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি একটি গাছ রোপণ করে, যা থেকে মানুষ, প্রাণী বা পাখি উপকৃত হয়, তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৫৫৩)
প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আমরা এই সুন্নাহের অনুসরণ করতে পারি।
আরও পড়ুনমহানবী (সা.) যেভাবে সমালোচনা মোকাবেলা করতেন২৫ জুন ২০২৫৪. যেখানে–সেখানে ময়লা ফেলা বন্ধ করা
আবর্জনা সঠিকভাবে ফেলুন এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও অপুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য আলাদা করুন। রাস্তায় বা নদীতে ময়লা ফেলা বায়ু, মাটি ও পানিদূষণ করে, যা প্রাণী ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশে নদীদূষণ একটি মারাত্মক সমস্যা, যা জলজ প্রাণী ও মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে।
স্থানীয়ভাবে আবর্জনা পরিষ্কারের উদ্যোগে অংশ নেওয়া হতে পারে একটি দারুণ কাজ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘স্বহস্তে নিজেদের ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না এবং কল্যাণকর কাজ করে যাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৫)
৫. পরিবেশবান্ধব ব্যবসা সমর্থন
পরিবেশবান্ধব পণ্য ও পরিষেবা প্রদানকারী দোকান, রেস্তোরাঁ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে সমর্থন করুন। যেসব প্রতিষ্ঠান পরিবেশের ক্ষতি করে, তাদের বর্জন করুন। আমাদের দেশে কিছু স্থানীয় ব্র্যান্ড পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্যাকেজিং ব্যবহার শুরু করেছে। এই পদক্ষেপ কার্বন পদচিহ্ন কমায় এবং ইসলামের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
স্বহস্তে নিজেদের ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না এবং কল্যাণকর কাজ করে যাও।’সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৫৬. শক্তি দক্ষতা বৃদ্ধি
শক্তি–সাশ্রয়ী সামগ্রী ব্যবহার করুন। যেমন এলইডি বাল্ব, কম শক্তি খরচকারী ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনার। অপ্রয়োজনীয় আলো, টিভি বা ইলেকট্রনিক যন্ত্র বন্ধ রাখুন এবং ওয়াশিং মেশিনের তাপমাত্রা কমান। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরতা বেশি, তাই শক্তি–সাশ্রয় পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ইসলামে অপচয় নিষিদ্ধ এবং এই পদক্ষেপ আমাদের সেই শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখে।
৭. টেকসই দান–সদকা
আপনার জাকাত বা সদকা এমন দাতব্য সংস্থায় দিন, যারা টেকসই উন্নয়নের জন্য কাজ করে, যেমন পরিষ্কার পানি সরবরাহ, বৃক্ষরোপণ বা পুনর্ব্যবহার প্রকল্প। বাংলাদেশে বেশ কিছু স্থানীয় এনজিও পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে কাজ করছে।
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি একটি খেজুরগাছ রোপণ করে, তা থেকে যা কিছু উৎপন্ন হয়, তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (মুসনাদ আল-বাযযার, হাদিস নং ২৭৭৩)
সারকথাজলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করা কেবল পরিবেশগত কাজ নয়; বরং এটা আমাদের ধর্মীয় দায়িত্বও। পৃথিবী আল্লাহর আমানত এবং এটি রক্ষা করা প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য। ওপরের সাতটি পদক্ষেপ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সহজেই প্রয়োগ করা যায়। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এরই মধ্যে দৃশ্যমান, সেখানে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুনবিরে রুমা: মদিনার পানির সংকট দূর করেছে যে কুয়া০৩ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র ক র ব যবহ র ত র ক রআন ত র জন য আম দ র দ র জন য স পর ব শ র ম সলম ন পদক ষ প ক র বন আল ল হ ক জ কর জলব য র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
বঙ্গোপসাগরে অনুপ্রবেশের দায়ে ১৪ ভারতীয় জেলে আটক
বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকারের অভিযোগে ১৪ ভারতীয় জেলেকে আটক করেছে নৌবাহিনী। এ সময় তাদের বহনকারী ট্রলার জব্দ করা হয়।
শনিবার (২ আগস্ট) রাতে মোংলা বন্দরের অদূরে ফেয়ারওয়ে বয়া সংলগ্ন গভীর বঙ্গোপসাগর থেকে তাদের আটক করা হয়। আটককৃত ট্রলারসহ জেলেদের নিয়ে মোংলার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে নৌবাহিনীর সদস্যরা।
মোংলা থানার ওসি মো. আনিসুর রহমান বলেন, “সমুদ্রসীমা লঙ্ঘন করে বেআইনিভাবে বাংলাদেশের জলসীমায় মাছ শিকারের দায়ে ১৪ ভারতীয় জেলেকে আটক করেছে নৌবাহিনী। তাদের মোংলায় আনা হচ্ছে। মামলা করে সোমবার (৪ আগস্ট) তাদের আদালতে পাঠানো হবে।”
আরো পড়ুন:
কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে এল দুই লাশ
সাগরে ট্রলারডুবি: চার দিন ভেসে থাকার পর উদ্ধার ৯ জন, নিখোঁজ ৬
তিনি আরো বলেন, “নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বানৌজা বিষখালী অভিযানে অংশ নিয়ে জেলেসহ ট্রলারটি আটক করে। ‘এফবি পারমিতা’ নামের ওই ট্রলারটিতে বিপুল পরিমাণ ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ ছিল, যা পরবর্তীতে নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হবে। আটক জেলেদের বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায়।”
ঢাকা/শহিদুল/মাসুদ