আন্দোলনরত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দাবি নিয়ে কী ভাবছে সরকার, দাবি পূরণে কত টাকা দরকার
Published: 15th, October 2025 GMT
মূল বেতনের ২০ শতাংশ (ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা) বাড়িভাড়াসহ তিন দফা দাবিতে টানা চার দিন ধরে রাস্তায় আন্দোলন করছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। কখনো জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায়, কখনো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বা হাইকোর্টের সামনের সড়কে কর্মসূচি পালন করছেন। সর্বশেষ আজ দুপুরের পর দাবি পূরণ করে প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন তাঁরা।
যখন ঢাকায় চলছে এমন কর্মসূচি, তখন একই দাবিতে সারা দেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতিও চলছে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাবর্ষের শেষ সময়ে এসে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ক্ষতির মুখে পড়েছে। আর রাস্তার আন্দোলনে শিক্ষকদের যেমন কষ্ট হচ্ছে, তেমনি সাধারণ মানুষকেও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
তবে এমন পরিস্থিতি চললেও সরকারের পক্ষ থেকে তা নিরসনে এখন পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। গত ৩০ সেপ্টেম্বর এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়ার ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা বাড়ানোর বিষয়ে অর্থ বিভাগের সম্মতিপত্র প্রকাশের পর শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ বেড়েছে। তাঁদের ভাষ্য, এই ‘সামান্য’ ভাতা বৃদ্ধি শিক্ষকদের জন্য লজ্জার। শতাংশের হারে বাড়িভাড়া চাওয়ার পেছনে তাঁদের আরেকটি যুক্তি হলো, এটি করা হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশেষ করে পরবর্তী নতুন বেতন স্কেল করার সময় তা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে।
এখন শিক্ষক-কর্মচারীদের অন্য দুটি দাবি হলো উভয়ের জন্য চিকিৎসা ভাতা দেড় হাজার টাকা এবং কর্মচারীদের উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশ করা।
কী ভাবছে সরকারশিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন চায় শতাংশের হিসেবেই বাড়িভাড়ার ভাতা বাড়ানো উচিত। এ জন্য ৫০০ টাকা বাড়ানোর বিষয়ে অর্থ বিভাগের সম্মতিপত্র দিলেও সেটি কার্যকরের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশাসনিক আদেশ জারি করেনি। বরং মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য চার ধরনের হার ঠিক করে তাতে কত টাকা লাগবে, তার প্রাক্কলন করে অর্থ বিভাগকে দিয়েছে। সেখান থেকে সরকারের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ বিভাগ যেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করে, তার অনুরোধ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অর্থ বিভাগের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন। এখন সিদ্ধান্ত দেবে অর্থ বিভাগ।
জানা গেছে, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও অর্থ বিভাগের সচিব মো.
আবার, সরকারি পর্যায়ের কেউ কেউ মনে করেন চলতি বছরের বাজেট বাস্তবায়ন চলছে। এখন মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া বাড়ানো বেশ কঠিন বিষয়। আবার ৫ বা ১০ শতাংশ হারে বাড়ালে আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা মানবেন কি না, সেটিও আরেকটি আশঙ্কার বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ চান এটি পরবর্তী নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করুক।
যদিও আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা হুমকি দিয়েছেন এবার দাবি আদায় না করে তাঁরা বাড়ি ফিরবেন না। প্রয়োজনে আমরণ অনশন করবেন।
বর্তমানে সারা দেশে ছয় লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত। তাঁরা সরকার থেকে মূল বেতনসহ কিছু ভাতা পান। কিন্তু শিক্ষক-কর্মচারীরা বলে আসছেন তাঁরা যে বেতন-ভাতা পান তা দিয়ে বর্তমান বাজারমূল্যে জীবনসংসার চালানোই তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
আজ শাহবাগ মোড়ে অবরোধ কর্মসূচিতে এসেছিলেন ঢাকার উত্তরখান হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক মো. ইসমাইল হোসেন। সেখানেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। বর্তমানে সাকল্যে বেতন পান ১৮ হাজার ৩০০ টাকা। এর মধ্যে মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা। বাকিগুলো বিভিন্ন ভাতা। স্কুল থেকে আলাদা কোনো বেতন পান না। এখন এক রুমে (ভাড়া) তিনজন থাকেন। ভাড়া পনেরো হাজার। তাঁকে দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। বললেন বর্তমান বেতন দিয়ে চলতে কষ্ট হয়। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময়ে পাশে থাকা অন্য একাধিক শিক্ষক বললেন কৃষিশিক্ষাসহ কয়েকটি বিষয়ে বেতন একটু বেশি। কিন্তু সাধারণ বিষয়ের শিক্ষকের শুরুর মূল বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা।
শিক্ষক–কর্মচারীদের এই অবস্থা থেকে জীবনমান উন্নয়নে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। এখন বাড়িভাড়া বাড়ানোসহ তিন দফা দাবিতে গত রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেছিলেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। এতে সারা দেশ থেকে আসা বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী অংশ নেন। কিন্তু লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান থেকে পানি ছুড়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও সংহতি জানান। এর মধ্যে গতকাল তাঁরা ‘মার্চ টু সচিবালয়’ কর্মসূচি শুরু করলেও হাইকোর্টের সামনে পুলিশ আটকে দেয়। আজ শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়েছেন।
কত টাকা দরকারশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, প্রথমে শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার) গত ৭ আগস্ট অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে আধা সরকারিপত্র দিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া এক হাজার থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা ও চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করার জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা অনুরোধের কথা মনে করিয়ে দেন। এ ছাড়া কর্মচারীদের উৎসব ভাতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করা হয়। এ জন্য সব মিলিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অতিরিক্ত ৭৬৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা প্রয়োজন বলেও আধা সরকারি পত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল।
অবশ্য পরে সেখান থেকে সরে আসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শতাংশের হারে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৫ অক্টোবর বাড়িভাড়া দেওয়ার বিষয়ে অর্থ বিভাগকে আরেকটি অনুরোধপত্র পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া দিলে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, ১৫ শতাংশ হারে দিলে ২ হাজার ৪৩৯ কোটি, ১০ শতাংশ হারে দিলে ১ হাজার ৭৬৯ কোটি এবং ৫ শতাংশ হারে দিলে ১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা প্রয়োজন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অর থ ব ভ গ র শ ক ষকদ র ৫০০ ট ক ন করছ ন র জন য র ধ কর র স মন অবস থ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বাড়িভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনরত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতি জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসের সংহতি
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া বৃদ্ধিসহ তিন দফা দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস ও ইনকিলাব মঞ্চ। তারা সরকারকে শিক্ষকদের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান।
আজ সোমবার বিকেলে এসব রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের প্রতিনিধিরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে সেখানে অবস্থান নেওয়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। এরপর তাঁরা বক্তব্য দেন।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য শিক্ষকদের যে ভূমিকা, তাঁরা যে চেষ্টা করে থাকেন, এটা গোটা জাতির জন্য বিরাট একটা আমানতস্বরূপ। কিন্তু আজকে শিক্ষকদের যদি রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয়, তাঁদের দাবি যদি না মানা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা কারও জন্য কল্যাণকর হবে না।’
শিক্ষক–কর্মচারীদের আন্দোলন ঘিরে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো পরিবেশ তৈরি হলে সেই দায় সরকারকে বহন করতে হবে বলে উল্লেখ করেন মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সরকার ও উপদেষ্টাদের মূল কাজ হলো সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। তার জন্য শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে, তাঁদের সহযোগিতা নিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসেই নির্বাচন করতে হবে। সে জন্য এখন যদি তাঁদের দাবি মানা না হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে অন্যভাবে কোনো পরিবেশ তৈরি হলে সেটার জন্য দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে।’
মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া দেওয়া, শিক্ষক ও কর্মচারী উভয়ের জন্য চিকিৎসা ভাতা দেড় হাজার টাকা করা এবং কর্মচারীদের উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশ করা—এই তিন দফা দাবিতে গতকাল রোববার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেখানে তারা বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান থেকে পানি ছুড়ে শিক্ষক–কর্মচারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। পরে তাঁরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে অবস্থান নেন। ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোট’–এর ব্যানারে তাঁরা এই কর্মসূচি পালন করছেন।
শিক্ষক–কর্মচারীদের অবস্থান কর্মসূচিতে সংহতি জানায় জামায়াত–সমর্থিত শিক্ষক সংগঠন ‘বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশন’। সংগঠনটির সেক্রেটারি জেনারেল এ বি এম ফজলুল করিম বলেন, শিক্ষক–কর্মচারীদের দাবি পূরণ না হলে আন্দোলন আরও বেগবান হবে।’
শিক্ষকদের দাবির প্রতি সমর্থন জানান ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন। তিনি বলেন, ‘আপনাদের আন্দোলনের প্রতি আমাদের সমর্থন আছে। আপনাদের দাবি আমাদেরও দাবি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই শিক্ষকেরা আর ঘরে ফিরে যাবেন না।’
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদী বলেন, ‘আমরাও শিক্ষকের সন্তান। তাই শিক্ষকদের কষ্ট দেখার জন্য পত্রপত্রিকা দেখতে হয় না। এই কষ্ট দেখতে দেখতেই আমরা বড় হয়েছি।’ তিনি অবিলম্বে শিক্ষক–কর্মচারীদের তিন দফা দাবি মেনে নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এ সময় আরও বক্তব্য দেন খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন। তিনি বলেন, শিক্ষকেরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। অথচ তাঁদের দাবি আদায়ে রাস্তায় নামতে হয়, পুলিশ লাঠিপেটা করে। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক।’ তিনি দ্রুত সময়ে শিক্ষকদের দাবি পূরণের আহ্বান জানান।
অবস্থান কর্মসূচি থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোটের সদস্যসচিব দেলাওয়ার হোসেন আজিজী ঘোষণা দেন, রাতের মধ্যে পূরণ না হলে আগামীকাল দুপুর ১২টায় শহীদ মিনার থেকে মার্চ টু সচিবালয় কর্মসূচি পালন করবেন তাঁরা।