জুলাই সনদ: আশার স্বাক্ষর, অনিশ্চয়তার ছায়া
Published: 17th, October 2025 GMT
আজ শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকাল ৪টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় শুরু হতে যাচ্ছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ‑২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। এটি ব্যাপক আলোচনায় পরিণত একটি রাজনৈতিক নির্দেশক দলিল, যার বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি নানা ধরনের প্রশ্ন ও অবস্থান নিয়ে উত্তাল অবস্থানে রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেবেন। ঐকমত্য কমিশন এ সনদকে একটি ‘নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। যদিও স্বাক্ষর আজ সম্পন্ন হওয়ার কথা, এই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, আইনগত ভিত্তি ও গণভোটসহ আরো অনেক দিক এখনো বিতর্কের তালিকায় আছে।
আরো পড়ুন:
জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
খালেদা-তারেককে জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ
ঐকমত্য কমিশন ও প্রস্তুতি
ঐকমত্য কমিশন বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে এসেছে। ১৩টি কমিশন থেকে প্রাপ্ত সুপারিশ জাতীয় ঐকমত্য প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। খসড়া ছক, ভাষাগত ও শব্দগঠন সংশোধনের জন্য দলগুলোর নোট অব ডিসেন্ট গ্রহণ করে সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে সংসদ ভবন এলাকায় ড্রোন ওড়ানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সুসভা ও আয়োজন প্রস্তুতি সম্পন্ন বলে দাবি করা হয়েছে, তবু দলের অংশগ্রহণ ও স্বাক্ষর নিয়ে সন্দেহ ও দ্বিধা রয়েছে।
এ বিষয়ে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “আজ যদি কোনো দল স্বাক্ষর না করতে পারে, তারপরও তারা পরবর্তী সময়ে স্বাক্ষর করতে পারবে।”
উল্লেখ ছিল, আদেশ ও আইনগত ভিত্তি নির্ধারণ করা হবে কমিশনের মেয়াদকালের মধ্যে। মেয়াদ বাড়িয়ে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত করা হয়েছে।
দলগুলোর অবস্থান ও আপত্তি
বিএনপি ও মিত্র দলসমূহ: বিএনপি–মিত্র গোষ্ঠী স্বাক্ষরের ব্যাপারে সহমত প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি, নোট অব ডিসেন্ট হিসেবে যেসব আপত্তি রয়েছে সেগুলো যদি সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তারা স্বাক্ষর করবে।
এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, “কোন প্রশ্নের উত্তরে শুক্রবার (আজ) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ আগেই বলেছিলেন, বিএনপি স্বাক্ষরের পক্ষে রয়েছে। তবে চূড়ান্ত অনুমোদন আজ হবে।
জামায়াত: জামায়াত বলেছে, তারা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে কিন্তু স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি।
দলেরসেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “সনদে স্বাক্ষর করার আগে তার আইনগত ভিত্তি স্পষ্ট হওয়া উচিত।”
এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি): এনসিপি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের অংশীদার হবে না, যদি আইনগত ভিত্তি দেওয়া না হয়।
এ বিষয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “আইনি ভিত্তি ছাড়া স্বাক্ষর হলে এটি মূল্যহীন হবে। স্বাক্ষরের আগে খসড়া আদেশ এবং বিধানগুলোর বিষয়বস্তু প্রকাশ করা উচিত।”
বাম জোট (সিপিবি, বাসদ, বাসদ- মার্ক্সবাদী, জাসদ): এই চার দল একসঙ্গে ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা আজ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নেবে না এবং সনদে সই করবে না।
তাদের অভিযোগ, খসড়ায় তাদের দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট যথাযথভাবে স্থান দেওয়া হয়নি এবং ইতিহাস, স্বাধীনতা ঘোষণা, সংবিধান সংশোধন বিষয়গুলো যথাযথভাবে প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
বিতর্ক ও প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়সমূহ: গণভোট কখন হবে? দলগুলোর মধ্যে দ্বিধা রয়েছে যে গণভোটের সময়সূচি সংসদ নির্বাচন সংযুক্ত করা হবে না বা নভেম্বরেই আলাদা হবে।
সংবর্ধনা ও আইনগত ভিত্তি: এনসিপি দাবি করছে, যেকোনো আদেশ বা আইনগত ভিত্তি ছাড়া স্বাক্ষর করা হলে সনদ শূন্য হবে।
নোট অব ডিসেন্টের গুরুত্ব: বিএনপি, বাম দল ও অন্যরা দাবি করছে, তাদের আপত্তি সনদে সন্নিবেশিত করতে হবে যেন স্বাক্ষর কার্যকর হয়।
সংবিধান সংশোধন ও সনদ প্রক্রিয়া: বাম দলগুলোর অভিযোগ, স্বাধীনতা ঘোষণা ও ইতিহাস বিষয় সম্বন্ধে কিছু অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। যেমন ৬ষ্ঠ ও ৭ম তফসিল, ১০৬ অনুচ্ছেদ ইত্যাদি।
পরবর্তী স্বাক্ষর সুযোগ: কমিশন বলেছে, আজ স্বাক্ষর না করলেও পরে সব দল স্বাক্ষর করতে পারবে।
নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ প্রভাব: প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে; সেটি পরিবর্তনযোগ্য হবে না।”
সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী বলেছেন, “সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে দেশ একটি উৎসবমুখর নির্বাচনের দিকে যাত্রা শুরু করবে। যদি সনদ এবং তার বাস্তবায়ন একসাথে না এগোয়, তাহলে রাজনৈতিক স্থবিরতা ও নতুন বিতর্কের উদ্ভব ঘটতে পারে।”
সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও ঢাকা-৮ আসনের ভোটার মো.
তিনি বলেন, “সকল দল যদি স্বাক্ষর করে, তাহলে এই সনদ একটি নতুন যুগের সূচনা হতে পারে। আবার কোনো বড় দল যদি সই না করে, তাহলে উদ্যোগের গ্রহণযোগ্যতা ও কার্যকারিতা প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে পড়ে যাবে।”
ঢাকা/এএএম/এস
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ল ই গণঅভ য ত থ ন ন ট অব ড স ন ট আইনগত ভ ত ত র অন ষ ঠ ন প রক র য় র জন ত ক দলগ ল র উপদ ষ ট আপত ত ই সনদ ব এনপ এনস প
এছাড়াও পড়ুন:
রাষ্ট্র সংস্কার কি সরকারের কাছে শুধুই ফাঁকা বুলি, প্রশ্ন টিআইবির
‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুপারিশ বাদ দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন অধ্যাদেশ চূড়ান্ত অনুমোদন করায় গভীর হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) জবাবদিহির বাইরে রাখার মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কার কেবলই ফাঁকা বুলি কি না, এ প্রশ্নও তুলেছে টিআইবি।
আজ শুক্রবার এক বিবৃতিতে টিআইবি বলেছে, ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিতে কেবল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত দুদকের উত্তরণের লক্ষ্যে ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুপারিশ করা হয়েছিল। এই সুপারিশ বাদ দেওয়া শুধু হতাশাজনক নয়, সরকারের অভ্যন্তরে প্রায় সব ক্ষেত্রে সংস্কারবিরোধী মহলের ষড়যন্ত্রের কাছে রাষ্ট্র সংস্কারের অভীষ্টের জিম্মিদশারও পরিচায়ক।
জুলাই সনদে স্বাক্ষরকারী সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সম্মতির পরও চূড়ান্ত অধ্যাদেশে এই সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকারের অনাগ্রহের ইঙ্গিত বলে মনে করে টিআইবি।
দুদককে প্রকৃত অর্থে একটি জবাবদিহিমূলক, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার এই কৌশলগত সুপারিশটি অনুধাবনে সরকার ব্যর্থ হয়েছে, যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বলে উল্লেখ করে টিআইবি আরও বলেছে, রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের জন্য এটি স্ববিরোধী ও সংস্কারপরিপন্থী নজির।
ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ও ১১টি সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা দুদককে জবাবদিহির বাইরে রাখার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলসহ দেশবাসীকে কি এই বার্তা দিতে চাইছেন যে রাষ্ট্র সংস্কার কেবলই ফাঁকা বুলি—এ প্রশ্নও বিবৃতিতে তুলেছে টিআইবি।
বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিগত দুই দশকের অভিজ্ঞতা, অংশীজনদের মতামত, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রেক্ষিত বিবেচনায় দুদক যাতে ক্ষমতাসীনদের হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে চলমান না থাকে, সে লক্ষ্যে দুদক সংস্কার কমিশন ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ গঠনের সুপারিশ করেছিল। জন্মলগ্ন থেকে দুদক যেভাবে জন–আস্থার সংকটে ভুগছে এবং স্বার্থান্বেষী মহলের ক্রীড়নক হিসেবে ক্ষমতাসীনদের সুরক্ষা আর প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, তা থেকে উত্তরণ ঘটাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ প্রস্তাবটি করা হয়েছিল।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন, ‘নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে অন্তত সাতজন উপদেষ্টা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। অথচ তাঁরা জানেন যে এই প্রস্তাবে জুলাই সনদে স্বাক্ষরকারী সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। জুলাই সনদ লঙ্ঘনের এরূপ উদাহরণ সৃষ্টি করার আগে সরকার কেন ভাবছে না যে এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলকে তারা নিজেরাই জুলাই সনদ লঙ্ঘনে উৎসাহিত করছে? তাহলে কেন এত রক্তক্ষয়ী আত্মত্যাগ? দুর্নীতির কার্যকর নিয়ন্ত্রণের উপায় রুদ্ধ করে কীসের রাষ্ট্র সংস্কার?’
অধ্যাদেশটির যে খসড়াটি টিআইবির দেখার সুযোগ হয়েছিল, তা অনেকাংশে বিদ্যমান আইনের তুলনায় উন্নত মানের হওয়ায় টিআইবি সরকারকে সাধুবাদ জানাচ্ছে। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্যানুযায়ী, চূড়ান্ত অধ্যাদেশে উল্লিখিত বিষয়টির পাশাপাশি আরও কিছু ঐকমত্য-অর্জিত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুপারিশ বাদ দেওয়া হয়েছে, যা সরকারের অভ্যন্তরে স্বার্থান্বেষী ও প্রভাবশালী মহলের দুর্নীতি-সহায়ক ও সংস্কার-পরিপন্থী অবস্থান ছাড়া আর কিছু হতে পারে না বলে উল্লেখ করেছে টিআইবি।