ইংল্যান্ডের রাজা জন ১২১৫ সালের ১৫ জুন একটি দলিলে সই দেন। এটি ছিল রাজা ও বিদ্রোহী ব্যারনদের মধ্যে একটি চুক্তি, যা রাজার ক্ষমতা সীমিত ও প্রজাদের অধিকার নিশ্চিত করে। এর ফলে ইংল্যান্ডে সাংবিধানিক শাসনের সূচনা হয়। এই চুক্তি ইতিহাসে ‘ম্যাগনাকার্টা’ নামে খ্যাত। এটি একটি লাতিন শব্দ, যার অর্থ ‘মহান সনদ’ (গ্রেট চার্টার)। এটি ইংরেজদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ দলিল।
১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এর মাধ্যমে ১৩টি ব্রিটিশ উপনিবেশ নিজেদের মুক্ত ঘোষণা করে এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র নামে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করে। তারা কেন স্বাধীনতা চাইছে, এই ঘোষণাপত্রে তার কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
আমেরিকার এই পালাবদলের এক দশক পরে ইউরোপে পরিবর্তনের হাওয়া বয়ে যায়। রাজতন্ত্র উৎখাত করে প্রথম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় ফ্রান্সে। ফরাসি বিপ্লবের মূল ঘোষণাপত্রে ছিল মানুষ ও নাগরিকের অধিকারের অঙ্গীকার, যা ১৭৮৯ সালের ২৬ আগস্ট প্রকাশিত হয়। এই দলিলে ফরাসি জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব মানুষের সহজাত, অবিচ্ছেদ্য ও সর্বজনীন অধিকারগুলোর উল্লেখ ছিল, যেমন স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার আন্দোলনের ওপর যুগান্তকারী প্রভাব ফেলে। আমেরিকার সংবিধান ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ফরাসি বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
অনেকটা আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আলোকেই লেখা হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যা প্রথম পাঠ করা হয় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। কী কারণে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হলো, তার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে ফরাসি বিপ্লবের আদলে ঘোষণা করা হয় রাষ্ট্রের মূলনীতি—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার।
এতগুলো উদাহরণ দিলাম এ জন্য যে ওপরের তিনটি দেশে ঘোষিত লক্ষ্য ওই দেশের নাগরিকেরা অর্জন করেছেন। সেসব দেশে জনগণের সরকার আছে। তারা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। সেখানে উন্নতি ও সমৃদ্ধির খবর আমরা রাখি। আমরা সেসব দেশে আমাদের সন্তানদের পাঠাতে পারলে স্বস্তি পাই।
আমরা আমাদের দেশটা গোছাতে পারিনি। এখানেই প্রশ্ন, আমরা কেন পারিনি? আমরা কেউ গাল দিই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে, কেউ মন্দ বলি পাকিস্তানি শাসকদের, কথায় কথায় আলোচনায় আনি মীর জাফর। মীর জাফর মরে ভূত হয়ে গেছে আড়াই শ বছর আগে। কোম্পানির শাসন শেষ হয়েছে ৭৮ বছর আগে, পাকিস্তানের থাবা সরে গেছে ৫৪ বছর হলো। তারপরও আমাদের কেন এই ব্যর্থতা, কেন এত আক্ষেপ, কেন এই হতাশা? আর কতকাল আমরা অতীতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নিজেদের আড়াল করে রাখব? আমাদেরই তো সবকিছুর দায় নিতে হবে।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ বাস্তবায়ন আর গণভোটের রাজনীতি১৮ ঘণ্টা আগেঅনেক আশা নিয়ে দেশটা স্বাধীন হলো। গুটিকয় পরিবার ছাড়া স্বাধীনতার জন্য সবাই মূল্য দিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার ফল পকেটে পুরেছে কিংবা আঁচলে বেঁধেছে হাতে গোনা কিছু পরিবার ও গোষ্ঠী। আমরা গণতন্ত্র চাই, নাকি সমাজতন্ত্র, নাকি খেলাফত—এ নিয়ে এখনো বাহাস করি। ১৭ কোটি মানুষের কাঁধে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসেছে গুটিকয় অলিগার্ক, যারা নিজ নিজ ডকট্রিন নিয়ে আস্ফালন করছে। সেখানে শুধু তারাই আছে, মানুষ নেই। মানুষ এখানে কখনো কামানের খোরাক, কখনো ক্ষমতায় আরোহণের কাঁচামাল।
রাজনৈতিক দলের সিন্ডিকেট আর ব্যক্তিশাসনের বিরুদ্ধে ইতিহাসে একবারই এ দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো এককাট্টা হয়েছিল। ১৯৯০ সালে আমরা পেয়েছিলাম একটি সনদ, যেটি ‘তিন জোটের রূপরেখা’ নামে পরিচিত। সেখানে কী ছিল? মূল কিছু দিক উল্লেখ করছি।
১.
২. একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সার্বভৌম জাতীয় সংসদ গঠনের ব্যবস্থা করা।
৩. গণমাধ্যমকে সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ রাখতে রেডিও-টেলিভিশনসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করা।
৪. জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে অসাংবিধানিক কোনো পথে ক্ষমতা দখল প্রতিরোধ করা।
৫. জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা।
৬. মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সব আইন বাতিল করা।
৭. ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা ও অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকা, সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় না দেওয়া এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা সমবেতভাবে প্রতিরোধ করা (সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)।
আমাদের এখানে ১৯৪৯ সালের চীন কিংবা ১৯৫৮ সালের কিউবার আদলে পালাবদল হবে না। পরিবর্তনের একটি মডেল কখনোই আরেকটি মডেলকে হুবহু অনুসরণ করে না। এখানে ড্রয়িংরুম বিহারি কিছু শৌখিন স্বপ্নবিলাসী ছাড়া সম্ভবত সবাই বহুদলীয় সরকারব্যবস্থা চান। কিন্তু আমরা সাড়ে পাঁচ দশক ধরে এমন একটা ব্যবস্থার চর্চা করেছি, যেটি নাগরিকের শাসনকে টেকসই করার দিকে যায় না। বরং পয়দা করে ‘নমরুদ’। এ থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়?প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। দলগুলোর মধ্যে আন্তরিকতার অভাব ছিল। প্রধান দুই দলের দুই নেত্রী এই সনদে সই দেননি। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন বৃথা যায়। আমরা ফিরে যাই আগের অবস্থায়। সাংঘর্ষিক রাজনীতির পটভূমিতে জন-আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করে ২০০৭ সালে আসে এক-এগারো। সেটিও মুখ থুবড়ে পড়ে বছর না যেতেই। তারপর আমরা এ দেশের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম স্বৈরশাসকের দেখা পাই, যার তুলনা আছে কেবল মধ্যযুগে।
এই জগদ্দল পাথরকে রুখে দেয় চব্বিশের জুলাই আন্দোলন। আমরা দেখা পাই নতুন এক ডিজিটাল প্রজন্মের—জেনারেশন জেড। এদের বয়স ১৩ থেকে ৩০। এদের অস্ত্র মুঠোফোন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, সমাজসচেতনতা, দেশের প্রতি ভালোবাসা আর মৃত্যুভয় জয়ের অদম্য সাহস। আমরা মাও সে-তুংয়ের লেখায় পড়েছি, একটি স্ফুলিঙ্গ কীভাবে বিরাট একটি দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। আমরা সেটি দেখলাম চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে, যা ‘৩৬ জুলাই’ তারিখটিকে ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছে। কিন্তু তারপর?
আরও পড়ুনজুলাই সনদ সই হলে বাস্তবায়নের পথ কতটা মসৃণ২২ ঘণ্টা আগেএখানে এসেই আমরা বারবার হোঁচট খাচ্ছি। আমাদের এখানে ১৯৪৯ সালের চীন কিংবা ১৯৫৮ সালের কিউবার আদলে পালাবদল হবে না। পরিবর্তনের একটি মডেল কখনোই আরেকটি মডেলকে হুবহু অনুসরণ করে না। এখানে ড্রয়িংরুম বিহারি কিছু শৌখিন স্বপ্নবিলাসী ছাড়া সম্ভবত সবাই বহুদলীয় সরকারব্যবস্থা চান।
কিন্তু আমরা সাড়ে পাঁচ দশক ধরে এমন একটা ব্যবস্থার চর্চা করেছি, যেটি নাগরিকের শাসনকে টেকসই করার দিকে যায় না। বরং পয়দা করে ‘নমরুদ’। এ থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়? আমরা তো কারও ভাষণ কিংবা ইশতেহারে আস্থা রাখতে পারছি না? সে জন্য দরকার একটি চুক্তি, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো নাগরিকদের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতি দেবে। তিন জোটের রূপরেখার পরিণতি দেখার পর লিখিত অঙ্গীকারের মাধ্যমে একটি সনদের দাবি উঠেছে। এটাই হচ্ছে প্রস্তাবিত জুলাই সনদের পটভূমি।
জুলাই সনদে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব আছে, যার মধ্যে যে ৪৭টি সংবিধান-সম্পর্কিত, এগুলো করবে নির্বাচিত সংসদ। যেসব প্রস্তাবে দলগুলোর ভিন্নমত আছে, প্রস্তাবের পাশেই সেগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। সনদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সাত দফা অঙ্গীকারনামা, যার তৃতীয় দফায় বলা হয়েছে, এই সনদের বৈধতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে দলগুলো কোনো আদালতে প্রশ্ন তুলবে না। আর অঙ্গীকারনামার শেষ দফায় বলা হয়েছে, জুলাই সনদে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, অন্তর্বর্তী সরকার সেগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে।
আরও পড়ুনজুলাই সনদ: গণভোটে বাড়বে বিভাজনের ঝুঁকি০৫ অক্টোবর ২০২৫অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োজিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনার পর জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া তাদের কাছে পাঠিয়েছে ১৪ অক্টোবর। আজ এই সনদে তাদের সই দেওয়ার কথা। কিন্তু শেষ সময়ে এর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে গোল বেধেছে।
এই মতভেদ দূর করার জন্য হাতে খুব বেশি সময় নেই। কয়েকটি বাম দল এরই মধ্যে সনদে সই না করার ঘোষণা দিয়েছে। কিছু দলের অবস্থান এখনো অস্পষ্ট। এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নানামুখী চাপ আছে। কারণ, জুলাই সনদ প্রশ্নে কোনো কোনো দলের অবস্থানের যৌক্তিক দিক আছে। আবার কোনো কোনো দল হয়তো ঘোঁট পাকাচ্ছে। আমরা দেখি, শেষ পর্যন্ত আজ কী হয়।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র স ব ধ নত জ ল ই সনদ আম র ক র প রস ত ব ব যবস থ দলগ ল র ই সনদ র জনগণ র আম দ র র শ সন র র জন সরক র র একট
এছাড়াও পড়ুন:
কয়েকজন উপদেষ্টা একটি বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করছে
পিআর পদ্ধতিসহ পাঁচ দফা দাবিতে রাজধানীতে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলী পর্যন্ত এ কর্মসূচি পালন করেন দলটির নেতাকর্মীরা। মৎস ভবনের সামনে মানববন্ধনে যোগ দেন জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরসহ সিনিয়র নেতারা।
আরো পড়ুন:
জামায়াতের ধারণা তারা ক্ষমতায় গেছে: দুলাল
নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে ‘না’, নভেম্বরে গণভোট চায় জামায়াত
এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, “আমি সরকারকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, আজ হুঁশিয়ারি দিতে চাই না। আজকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। প্রশাসনের যে অবস্থা এবং যে ষড়যন্ত্র চলছে, এটাকে বন্ধ করুন। নিরপেক্ষ সৎ লোকদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করুন। আর যদি না হয়, কোন কোন উপদেষ্টার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, আমাদের কাছে নাম আছে। তাদের কণ্ঠ রেকর্ড আছে। মিটিংয়ে তারা কী বক্তব্য দেন, এর খবর আছে। আমরা জনগণের কাছে আপনাদের এখন প্রকাশ করছি না। সুযোগ করে দিতে চাই। আপনাদের সংশোধনের জন্য সময় দিতে চাই। যদি সময়মতো সাবধান না হন, তাহলে জনসমক্ষে নাম প্রকাশ করা হবে।”
একটি দলের লোকদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনে বসিয়ে নীলনকশার নির্বাচন করার ষড়যন্ত্র চলছে জানিয়ে ডা. তাহের বলেন, “প্রশাসনে একটি দলের অনুগত লোকদের বসিয়ে প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে আমাদেরকে আশ্বস্ত করা হয়েছে—কোনো দলের অনুগত ব্যক্তিকে জনপ্রশাসন সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে না। কিন্তু দেখা গেছে, বাস্তব চিত্র তার উল্টো। যাকে জনপ্রশাসন সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত একজন ব্যক্তি, যিনি একটি দলের প্রতি সরাসরি অনুগত।”
প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে তাহের বলেন, “আপনি বিশ্বব্যাপী একজন গ্রহণযোগ্য মানুষ। কিন্তু যারা আপনাকে ব্যবহার করে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে, তাদেরকে সরিয়ে দিন। নতুবা আপনার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। আপনি যদি তাদেরকে চিহ্নিত করতে না পারেন, আমাদের কাছে তালিকা আছে—আপনি চাইলে আমরা তালিকা দিতে প্রস্তুত আছি। নতুবা আমরা জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে বাধ্য হবো। পরবর্তীতে আপনাকেই এর সব দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। আপনি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও জাতির ভবিষ্যৎ স্থায়ীভাবে শান্তিপূর্ণ করতে ৫ দফা দাবি মেনে নিন। এতে শুধু জামায়াতে ইসলামীর নয়, জাতির মঙ্গল হবে।”
তাহের বলেন, “হাজার হাজার মানুষ সড়কে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করার পরও যদি সরকারের কানে না যায়, সরকার যদি জনগণের চোখের ভাষা, মুখের ভাষা না বোঝে, তবে সরকার যেই ভাষা বুঝতে চায়—জনগণের দাবি আদায়ে সেই ভাষায় দাবি আদায় করা হবে।”
তিনি বলেন, “জামায়াতে ইসলামী শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। কিন্তু সরকার যদি সড়ক অবরোধ চায়, সরকার যদি রাজপথ উত্তাল দেখতে চায়, তবে জামায়াতে ইসলামী ইচ্ছার বিরুদ্ধেও সেই কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হবে।”
জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন চায় দাবি করে তাহের বলেন, “জামায়াতে ইসলামী ব্যক্তি বা পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি করে না; দলীয় স্বার্থের রাজনীতি করে না। জামায়াতে ইসলামী গণমানুষের কল্যাণে রাজনীতি করে। একটি দল ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই জনগণ তাদের পতন চায়। ৫ আগস্ট পরবর্তী ঐ দল ক্ষমতায় না থেকেও নিজেদেরকে ক্ষমতাসীন মনে করে সারা দেশে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, লুটপাট ও দখলদারিত্ব শুরু করেছে।তাদের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ। ঐ দলটি কথায় বলে তারা সংস্কার চায়, কিন্তু ঐক্যমত্য কমিশনে বসলে নানা রকম টালবাহানা করে। দলীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা হাসিনা মার্কা প্রহসনের নির্বাচন চায়। মনে রাখতে হবে, এ দেশে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আর কোনো নির্বাচন হতে পারবে না। জনগণ এখন সজাগ ও সতর্ক রয়েছে।”
গণভোট জাতীয় নির্বাচনের টেস্ট ম্যাচ হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, “যারা জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চায় না, মেনে নিতে পারছে না—তারা যুক্তি দেখাচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট হলে যদি কোনো সমস্যা হয়, তাহলে জনগণ ভোটের প্রতি আস্থা হারাবে, যার প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে।”
গণভোটে সমস্যা কারা করবে—প্রশ্ন রেখে ডা. তাহের বলেন, “এজন্যই তো জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট হওয়া জরুরি। কারণ যারা সমস্যা সৃষ্টি করবে, তারা জনগণ ও সরকারের কাছে চিহ্নিত হবে। তাদেরকে চিহ্নিত করতে হলেও গণভোটকে জাতীয় নির্বাচনের টেস্ট ম্যাচ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।”
নভেম্বরের মধ্যে গণভোট এবং ফেব্রুয়ারিতে জুলাই সনদের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানান তিনি।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে এবং কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিমের পরিচালনায় রাজধানীর মৎস্য ভবনের সামনে আরো বক্তব্য রাখেন দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, মাওলানা আব্দুল হালিম, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমির অ্যাডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সহকারী সেক্রেটারি ইয়াছিন আরাফাত, কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি মো. শামছুর রহমান।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ আব্দুর রব, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন্দসহ বিভিন্ন সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতা ও জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় এবং মহানগরী উত্তর ও দক্ষিণের দায়িত্বশীল নেতারা।
সভাপতির বক্তব্যে নুরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, “জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচন, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ, ফ্যাসিস্ট সরকারের জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার নিশ্চিত করা এবং স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও বিচারের মুখোমুখি করা—গণমানুষের দাবি। সরকার যদি গণমানুষের দাবি উপেক্ষা করে গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন একদিনে করতে চায়, তাহলে বুঝতে হবে সরকার একটি দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। নভেম্বরে গণভোট এবং ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন দিতে সরকার গড়িমসি করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাও করতে জনগণ বাধ্য হতে পারে।”
তাই সরকারকে শান্তিপূর্ণভাবে ৫ দফা দাবি মেনে নিতে তিনি আহ্বান জানান।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এসবি