ঢাকার কোলাহল পেরোনোর পর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনায় গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল এক সবুজস্বপ্ন: ‘ড্রিম স্কয়ার রিসোর্ট’। ৩০০ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা রিসোর্টটিতে রয়েছে প্রাণপ্রকৃতির ছোঁয়া, নান্দনিকতার মিশেলে আধুনিকতার সমন্বয়ে দারুণ সব সুযোগ-সুবিধা। যা অতিথিকে দেয় ‘দ্বিতীয় বাড়ির’ অনুভূতি।

এখানে প্রবেশ করলেই পালটে যায় মেজাজ। রিসোর্টের প্রবেশদ্বার থেকেই মেলে সবুজের শীতলতা। শান্ত সবুজ মাঠ, ফুলের বাগান, লেক, গাছপালা আর দূর থেকেই শোনা যায় পানিপ্রবাহের সুর। সব মিলিয়ে আলাদা এক পরিবেশ, যা গ্রাহককে নিয়ে যায় স্বপ্নের ঠিকানায়। কোলাহলমুক্ত পরিবেশে প্রকৃতির সান্নিধ্যে এখানে ডুব দিতে পারেন যে কেউ। ট্র্যাফিক-শহরের ধুলামাখা ঘামঝরা দিনটিকে পেছনে রেখে এখানে খুব সহজেই মেলে স্থির-শীতল এক সময়ে। 

রিসোর্টটিতে বিলাসবহুল কক্ষ ও আধুনিক সব সুবিধা রয়েছে। ১৩০টি কক্ষের রিসোর্টের প্রতিটি কক্ষেই এলইডি টিভি, হাই-স্পিড ব্রডব্যান্ড ওয়াই-ফাই, এসি ও গিজারসহ সুসজ্জিত বাথরুম রয়েছে। কক্ষের সাজসজ্জা সরল, তাজা ও উষ্ণ; শহুরে নকশা ও আরামের সুষম মিশেলে অতিথি যেন সানন্দে উপভোগ করতে পারেন তার সময় সেদিকে রাখা হয়েছে বিশেষ দৃষ্টি। আছে মাটির ঘর (থাকছে এসি ও সকল সুযোগ-সুবিধা) প্রেসিডেন্ট সুইট, অসংখ্য টাওয়ার বিল্ডিং, ভিলা, কটেজ ও সবচেয়ে আকর্ষণ ওয়াটার ভিলা। ডে-লং প্যাকেজ বা রাত কাটানোর সুবিধা—দুই-ই অনায়াসে মেটানো যায় এখানে।

ড্রিম স্কয়ারের অন্যতম বিশেষত্ব হলো প্রকৃতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা। রিসোর্টজুড়ে রয়েছে বহু লেক যেখানে নৌকা চালানো যায়, করা যায় ফিশিং। পুরো জায়গাটা দেখাশোনা করতে গেলে গড়িয়ে যাবে একদিন; অবশ্য এটা কোনো বড় সমস্যা নয়, রিসোর্টে আছে ছোট ইলেকট্রিক ভেহিকেল ও বাগী যা নিয়ে ঘুরে আসা যায় সহজে। চাইলে নিজেও চালাতে পারবেন।

দ্বিতীয় আশ্চর্য বিষয় হলো, এখানে আছে নিজস্ব খামার—গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি, মাছ, সবজি এমনি কি ধানও মেলে!খামার থেকেই সংগৃহীত তাজা উপকরণ ব্যবহার করে অতিথিদের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পরিবেশন করা হয় এখানে।

মসজিদসহ, খেলাধুলা ও রিল্যাক্সেশনের সব ব্যবস্থা রয়েছে রিসোর্টে। সুবিশাল চমৎকার মসজিদ, ফুটবল মাঠ, ক্রিকেট মাঠ, টেনিস কোট, সুইমিংপুল, বিশাল ওয়াটার পার্ক, সুবিশাল জাকুজি, বাচ্চাদের জন্য আলাদা পুল, স্পা, স্বাস্থ্য ও ফিটনেস সেন্টারসহ আছে আরো অনেক কিছু। শিশুদের জন্য আলাদা খেলার জায়গা, ও নিরাপদ ব্যবস্থা থাকায় পরিবার নিয়ে ভ্রমণও হয় ঝামেলামুক্ত। 

আয়োজনে অভিজাত ব্যাঙ্কোয়েট ও এমপি থিয়েটার। ব্যাঙ্কোয়েট হলের পাশেই  কনফারেন্স—সেমিনার, সভা, কর্পোরেট ইভেন্ট, টিম বিল্ডিং, বিয়েসহ যে কোনো আয়োজনের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। আরো রয়েছে ৬-৭টি হল যেখানে ছোট থেকে বড় মিটিং—সব কিছুরই আয়োজন করা সম্ভব। এমপি থিয়েটার ওপেন একটি জায়গা যা অনেকটা রবীন্দ্র সরোবরের মত, এখানে নানা আয়োজন করা যায়। রিসোর্টের একাধিক ভিলা, টাওয়ার বিল্ডিং ও প্রেসিডেনশিয়াল সুইট বিভিন্ন আয়ের অতিথির চাহিদা মেটায়।

রিসোর্টটি ‘অল-ইনক্লুসিভ’ অভিজ্ঞতা দেয়—ওয়েলকাম ড্রিংকস, বুফে ব্রেকফাস্ট, বুফে লাঞ্চ, বুফে ডিনার, ইভিনিং স্যাক্স, ইন-রুম মিনারেল ওয়াটার, কফি–চা, আনলিমিটেড ওয়াই-ফাই এবং ২৪ ঘণ্টা রুম সার্ভিসসহ। পরিবার, বন্ধু কিংবা অফিসের আউটিং, কর্পোরেট অনুষ্ঠান, পারিবারিক অনুষ্ঠানসহ সব ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত প্যাকেজ আছে। গ্রীষ্মকালীন বা বিশেষ ছুটির দিনে বুকিং-সংকট এড়াতে আগে থেকেই রিজার্ভেশন করা যাবে। 

নিরাপত্তা, খাদ্যের মান এবং অতিথি সেবায় এখানে কোনো আপস করা হয় না। রিসোর্টের জেনারেল ম্যানেজার শামীম চৌধুরী বলেন, ‘ড্রিম স্কয়ার মানুষের মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসা তৈরি করেছে। ঢাকার পাশে এলিট ও পর্স রিসোর্ট খুঁজলে ড্রিম স্কয়ারই মুখ্য পছন্দ। আমরা কখনো সেবা, খাদ্যমান এবং নিরাপত্তায় আপস করি না। আমরা গড়ে তুলেছি সবুজের রাজ্য, আমরা আমাদের ২৫০ জন স্টাফকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সবসময় সর্বোচ্চ সেবা প্রদানে বদ্ধপরিকর।’

সহকারী ম্যানেজার (মার্কেটিং ও কমিউনিকেশন) মুজাহিদ বিল্লাহ যোগ করেন, ‘দীর্ঘ ছুটির দিনে যেখানে রুম পাওয়া যায় না, আবার অনেক রিসোর্টে থাকে নানা সমস্যা, সেখানে ড্রিম স্কয়ারে আমরা অতিথিদের পাঁচ তারকা মানের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করি। নিরাপত্তা, সেবা ও স্মার্ট ব্যবস্থায় আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সম্পূর্ণ পারিবারিক পরিবেশে বিনোদন নিশ্চিত করি। সম্পূর্ণ নিরাপদ নির্মল বিনোদন আমাদের লক্ষ্য।’ 

গাজীপুরে শত রিসোর্ট অথবা ঢাকার আশেপাশে অনেক রিসোর্টের ভিড়ে যদি কোনো একটিই সরাসরি ‘এলিট, নান্দনিক ও আধুনিক বিলাসবহুল’ অভিজ্ঞতা দিতে পারে সেটি ড্রিম স্কয়ার বলেন তিনি। সবুজ উপবনের কোলে, লেকের কূলে কিংবা ব্যক্তিগত ভিলার বা ওয়াটার ভিলার বারান্দায় বসে দিন কাটালে বুঝবেন এটি শুধুই অবকাশ নয়—এক ধরনের পুনরুজ্জীবন।

ডে-লং প্যাকেজ, কর্পোরেট রেট বা বিবাহ ও অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বুকিং এবং বিস্তারিত জানার জন্য: 01401-020202 

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ড র ম স কয় র অন ষ ঠ ন ব যবস থ পর ব শ র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

মুক্তিযুদ্ধে লোকশিল্পী ও চারণকবিদের সাংস্কৃতিক ভূমিকা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনায় যে বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি আলোকপাত হয়, তা হলো একদিকে সশস্ত্র যুদ্ধ, অন্যদিকে এক ব্যাপক সামাজিক জাগরণ। শহর, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজনৈতিক দল, আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং যুদ্ধকৌশল নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও, সেভাবে আলোচিত হয়নি গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ ও চারণকবিদের সাংস্কৃতিক ভূমিকা, যা মুক্তিযুদ্ধের অনানুষ্ঠানিক তথ্যপ্রবাহ, আবেগ-উদ্দীপনা, জনমত, প্রতিরোধচেতনা গঠনে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল।

মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করতেন। তাঁদের কাছে রেডিও, সংবাদপত্র বা রাজনৈতিক বক্তব্য তত সহজলভ্য ছিল না। যে মাত্রার ভয়াবহতা পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রামাঞ্চলে চালিয়েছিল—লুটতরাজ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা—সেগুলো প্রত্যক্ষভাবে প্রথম নথিভুক্ত করেছেন লোকগানের স্রষ্টা ও চারণকবিরা। চারণকবিদের গান ও কবিতা কেবল আবেগের প্রকাশ নয়, এগুলো হলো মৌখিক ইতিহাসের দলিল, গ্রামীণ সংস্কৃতির অভ্যন্তরভূমি থেকে লিখিত বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের অনুষঙ্গ, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

চারণকবিদের শ্রেণিগত পরিচয় ছিল সাধারণত কৃষক, জেলে, মাঝি, খেতমজুর, কামার, কুমার ও নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ। তাঁরা একদিকে লোকশিল্পী, অন্যদিকে ছিলেন গ্রামের স্মৃতিরক্ষক, অর্থাৎ কমিউনিটির ‘সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার’। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁদের রচনাগুলো রাষ্ট্রীয় ইতিহাস, বুদ্ধিজীবী রচনা, গবেষকনির্ভর বিশ্লেষণের বাইরে গিয়ে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে।

চারণকবিদের গান ও কবিতা কেবল আবেগের প্রকাশ নয়, এগুলো হলো মৌখিক ইতিহাসের দলিল, গ্রামীণ সংস্কৃতির অভ্যন্তরভূমি থেকে লিখিত বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের অনুষঙ্গ, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার গ্রামাঞ্চল কেবল যুদ্ধক্ষেত্র ছিল না, তা ছিল প্রতিরোধ, প্রেরণা ও সৃজনশীলতারও উর্বর ভূমি। সেই গ্রামবাংলায়, যেখানে মাঠের ধান পুড়ে ছাই, নদীর জল লাল হয়ে উঠেছে রক্তে আর ঘরহারা মানুষ অন্ধকারের ভেতর খুঁজে ফিরছে আলোর দিশা—সেখানেই একদল অকৃত্রিম চারণকবি, জারি-সারি ও পল্লিগানের গায়ক তাঁদের নিজস্ব ভাষায় সৃষ্টি করেছিলেন স্বাধীনতার মহাকাব্য। এই কবিরা শহরের নামকরা সাহিত্যিক ছিলেন না, তাঁদের ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, প্রকাশক বা মঞ্চ—তবু তাঁদের কণ্ঠ ছিল মানুষের কণ্ঠ, তাঁদের ছন্দে ছিল গ্রামের মাটির স্পন্দন।

চারণকবিরা মুক্তিযুদ্ধের সময় রচনা করেছেন অসংখ্য গান ও কবিতা। গ্রামের প্রকৃতি যেমন সজীব ও বৈচিত্র্যময়, তেমনি এখানকার মানুষও আবেগপ্রবণ ও শিল্পমনস্ক। তাই কৃষক, জেলে, কামার, কুমার, বয়নশিল্পী কিংবা নৌকার মাঝি—সবার ভেতরেই যেন লুকিয়ে ছিল একেক জন কবি। তাঁরা তাঁদের জীবনের গল্প, দুঃখ, লড়াই, হারানো স্বপ্ন আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে সুরে-ছন্দে বেঁধে তুলেছেন লোকগানের আকারে। এই গানগুলো ছিল কখনো শোকের, কখনো প্রতিবাদের আবার কখনো মুক্তির আহ্বানে দীপ্ত।

পাকিস্তানি সেনারা যখন গ্রাম দখল করে গণহত্যা চালাচ্ছিল, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই যখন আগুন ও রক্তের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছিলেন, তখনই চারণকবিরা তাঁদের সৃষ্টিতে মানুষের মনে সাহস জাগিয়েছেন। তাঁদের গান অস্ত্রের চেয়ে কম শক্তিশালী ছিল না। মুক্তিকামী মানুষ যখন ভয় আর হতাশায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল, তখন গ্রামের কবিরা তাঁদের কণ্ঠে তুলেছিলেন যুদ্ধের ডাক—‘জয় বাংলা’, ‘মুক্তির গান’, ‘দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ দে রে ভাই’—এসব আহ্বান প্রতিধ্বনিত হয়েছিল মাঠে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ও শরণার্থীশিবিরে। সুতরাং যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে লোকগান হয়ে ওঠে আবেগের ভাষা, সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক চেতনা, মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক জ্বালানি এবং মৌখিক ‘সংস্কৃতি–ডকুমেন্টেশন’।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, সাধারণ মানুষের যুদ্ধ। গ্রামের অনেক মানুষ সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, আবার অনেকে যুদ্ধ না করলেও খাবার, আশ্রয়, তথ্য, গোপন পথ দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দমননীতি গ্রামের মানুষের ওপর ছিল চরম। তবু তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গোপনে যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন—এই অবস্থান তৈরি করতে চারণকবিদের গানের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।

চারণকবি লাল মামুদের ‘বড়ইতলা গণহত্যা’ কবিতায় রয়েছে নির্দিষ্ট একটি গ্রামের নাম, হত্যার দিন, সময়, নিহতদের সংখ্যা, অসহায় নারীদের আর্তনাদ, ঘর পোড়ানো, কাটা ধানের আঙিনায় রক্তের দাগ—সব মিলিয়ে মৃত্যুর বাস্তব রেকর্ড।

পল্লিকবি শাহাব উদ্দিনের দীর্ঘ কবিতা ‘এহিয়ার হত্যাকাণ্ড’ একটি অসাধারণ দলিল। এ গীতিকবিতায় পাকিস্তানের ২৩ বছরের বৈষম্য, পূর্ব বাংলার মানুষের ভাষা, অধিকার, শোষণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, পশ্চিম পাকিস্তানের দমননীতি সবই উঠে এসেছে। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা এই লোকগানে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। শ্রোতারা বুঝতে পারে রাষ্ট্রকাঠামো কীভাবে আমাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করেছিল। আগরতলা মামলা ও ’৬৯-এর গণ–অভ্যুত্থান লোকগানের ভাষায় অত্যন্ত তীব্রভাবে উপস্থাপিত হয়েছে—

‘... হায়রে দুঃখের কথা (২) মনে ব্যথা
          ঝরে দুই নয়ন,
      বাঙালির উপর রাখল
          সামরিক শাসন।

দেখেন কেমন করে (২) শেখ সাবেরে
            নিল কারাগারে,
          আগরতলা ষড়যন্ত্রে
            ফেলিয়া তাহারে।

কত বেত মারে (২) যুক্তি করে
         ফাঁসি কাষ্ঠে দিতে,
     সংগ্রামী নেতারা তখন
          নামে সংগ্রামেতে।

জাগে ছাত্র শ্রমিক (২) কৃষক যুবক
          নেতাগণ মিলিয়া,
    শেখ সাবেরে বাহির করলো
         জেলখানা ভাঙ্গিয়া।…”
(এহিয়ার হত্যাকাণ্ড/ শাহাব উদ্দিন) 

এরপর তিনি ২৫ মার্চের ভয়াবহ রাত ও গণহত্যার কথা বর্ণনা করেন, এই অংশে শিল্পের চেয়ে ইতিহাসের তীব্রতা বেশি—আগুন, ট্যাংকের গর্জন, বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ড, নদীতে লাশ ভাসা এসব বিষয় লোকগানে এমনভাবে বলা হয়েছে, যা মানুষের স্মৃতি চিরদিন বহন করে। শাহাব উদ্দিনের কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে দেবচরিত্র নয়—একজন সংগ্রামী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানুষের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।

তাঁদের অনেকেই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী—নিজ চোখে দেখেছেন গণহত্যা, গ্রাম পোড়ানো, ধর্ষণ, শরণার্থীর মিছিল। এসব দেখেই তাঁরা লিখেছেন হৃদয়ের রক্তে ভেজা গান, যেখানে বেদনা ও প্রতিবাদ মিলেমিশে গেছে।

চারণকবি লাল মামুদের ‘বড়ইতলা গণহত্যা’ কবিতায় রয়েছে নির্দিষ্ট একটি গ্রামের নাম, হত্যার দিন, সময়, নিহতদের সংখ্যা, অসহায় নারীদের আর্তনাদ, ঘর পোড়ানো, কাটা ধানের আঙিনায় রক্তের দাগ—সব মিলিয়ে মৃত্যুর বাস্তব রেকর্ড। তাঁর ভাষা এমন যেন ঘটনাটি ঘটছে চোখের সামনে, যেন শ্রোতারা নিজেরাই আগুনের গন্ধ পাচ্ছেন। লাল মামুদের এই কবিতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরগঞ্জ জেলার সদর থানার বড়ইতলা গ্রামে সংঘটিত এক ভয়াবহ গণহত্যার প্রত্যক্ষ ও আবেগময় লোকবয়ান। এটি একটি লোকগাথা, যেখানে যুদ্ধের নৃশংসতা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা, রাজাকার-আলবদরদের নিষ্ঠুরতা এবং সাধারণ মানুষের অসহায়তা একসঙ্গে ধরা পড়েছে। প্রতিটি চরণই যেন বেদনামাখা জনপদের ইতিহাস:

‘… ডাকে লাল মামুদে (২) এই সভাতে
           করুণ কাহিনী
     এইসব কথা মনে হলে
        চোখে আসে পানি।

হায়রে কিশোরগঞ্জে (২) সদর থানা
        বড়ইতলা গ্রাম।
সাড়ে তিন শ মানুষ মারছিন
      এহিয়া বেইমান।

দারুণ অক্টোবরে (২) তের তারিখ
       বুধবাইরা দিন
বড়ইতলায় হইয়া গেল
    কারবালারও চিন।

… সাথে আল বদরে (২) অস্ত্র ধরে
              ভয় দেখাইয়া
       সাড়ে তিনশ মানুষ নিল
       বন্দুক দেয়া গুতাইয়া।

নিয়া বড়ই তলা (২) কইরা দলা
           কাতারে বসাইয়া
     মিশিনগানের গুলি ছাড়ে
           পশুর মত বইয়া।…’
(বড়ইতলা গণহত্যা/ লাল মামুদ) 

লোকগানে মুক্তিযুদ্ধের সহিংসতা উঠে আসে এভাবে—আগুন ও ধ্বংসের চিত্র, গ্রামের পর গ্রাম, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, গরু–ছাগল লুট, নারীদের ওপরে বর্বরতা। এসব গান, কবিতা নারী নির্যাতনের দলিল, এখানে নারীর আর্তি সরাসরি উচ্চারিত হয়েছে—এগুলো ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নথি। এ ছাড়া আছে শরণার্থীসংকট—মাইলের পর মাইল হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া, ক্ষুধার্ত শিশু, অনিশ্চয়তা, চারণকবিরা এগুলোকে স্রেফ তথ্য নয়—অভিজ্ঞতা হিসেবে রূপান্তর করেছেন। যুদ্ধকালীন সময়ে এইসব ভয়াবহ অমানবিক কর্মকাণ্ড লোকগানের মর্মস্পর্শী ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে—

‘… এইরূপ উনিশ জিলা (২) হত্যালীলা
       কত বলব ভাই,
সারা বাংলা আগুন দিয়া পুইড়া
        করলো ছাই।

আগুন নারায়ণগঞ্জে (২) মুন্সিগঞ্জে
       পুড়িল জিনজিরা,
        চট্টগ্রাম বরিশাল
       পুড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

পুড়ে কিশোরগঞ্জ (২) করিমগঞ্জ
         পুড়ে বাজিতপুর,
ময়মনসিংহ দিনাজপুর পুড়ে
          মধুপুরের গড়।

ছাতক সুনামগঞ্জ (২) কটিয়াদি
    পুড়িল মঠখোলা,
হারি মাষ্টারের বাড়ি পুড়ে
      চর মান্দালিয়া

এইরূপ গ্রামে গ্রামে (২) আগুন দিয়া
     হানাদারের জাতে,
জ্যাতা মানুষ ধইরা নিয়া
     ফেলে আগুনেতে।…’
(এহিয়ার হত্যাকাণ্ড/ শাহাব উদ্দিন)

চারণকবিরা কেবল গান রচনা করেননি, তাঁরা ছিলেন সেই সময়ের সংবাদদাতা, ইতিহাসলিপিকার এবং জনগণের প্রেরণাদাতা। তাঁদের অনেকেই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী—নিজ চোখে দেখেছেন গণহত্যা, গ্রাম পোড়ানো, ধর্ষণ, শরণার্থীর মিছিল। এসব দেখেই তাঁরা লিখেছেন হৃদয়ের রক্তে ভেজা গান, যেখানে বেদনা ও প্রতিবাদ মিলেমিশে গেছে। তাঁরা শাসকগোষ্ঠীর অবিচার ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছেন, সাধারণ মানুষকে সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের গান শোনা মানে ছিল সংগ্রামের আহ্বান শোনা, তাঁদের শব্দ-ছন্দে ছিল আগুন, কণ্ঠে ছিল স্বাধীনতার বিশ্বাস।

তাঁরা প্রমাণ করেছেন—সত্যিকার ইতিহাস শুধু বইয়ে লেখা হয় না, তা লেখা হয় মানুষের মুখে, গানে, অশ্রুতে, আর মাটির গন্ধে। তাঁরা আমাদের সাধারণ মানুষের কবি, অজ্ঞাত অথচ অমর।

লোককবিদের বিশেষত্ব ছিল তাঁদের সহজ ভাষা ও অন্তরঙ্গ বর্ণনা। তাঁরা বক্তৃতার ভঙ্গিতে ইতিহাস বলেন না, বলেন হৃদয়ের স্বরে। যেমন কোনো মা তার সন্তানকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর আগে কাঁদতে কাঁদতে আশীর্বাদ করেন, তেমনি এই কবিতাগুলিতেও মিশে আছে মায়ের অশ্রু, প্রেমিকার প্রতীক্ষা, বন্ধুর বিদায় ও যোদ্ধার মৃত্যুবেদনা। একেকটি গান যেন একেকটি জীবন্ত দলিল—যেখানে দেখা যায় গ্রামের অগ্নিদগ্ধ ঘর, নদীতে ভেসে থাকা লাশ কিংবা শহীদের রক্তে ভেজা মাটি।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে যখন দেশ স্বাধীন হলো, তখনো এই চারণকবিরা থেমে থাকেননি। তাঁরা তাঁদের প্রত্যক্ষ করা ঘটনার স্মৃতি ধরে রাখতে, সেই দিনগুলোর ভয়াবহতা ও গৌরব নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে গেয়ে চলেছেন নতুন গান। তাঁদের কণ্ঠে ইতিহাস বেঁচে আছে, তাঁদের ছন্দে এখনো বাজে মুক্তির মন্ত্র। গ্রামের হাটবাজারে, যাত্রাপালায়, মেলায় আজও সেই গান শোনা যায়—যে গান একসময় ছিল যুদ্ধের প্রেরণা, এখন তা স্মৃতির রক্ষক, চেতনার ধারক।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় এই চারণকবিরা এক অমূল্য সম্পদ। তাঁদের গান ও কবিতা থেকে আমরা পাই মানুষের ইতিহাস, প্রান্তিক জীবনের কণ্ঠস্বর আর স্বাধীনতার সেই অপরিশ্রান্ত আকাঙ্ক্ষা, যা বইছে আমাদের লোকসংস্কৃতির ধমনিতে। তাঁরা প্রমাণ করেছেন—সত্যিকার ইতিহাস শুধু বইয়ে লেখা হয় না, তা লেখা হয় মানুষের মুখে, গানে, অশ্রুতে, আর মাটির গন্ধে। তাঁরা আমাদের সাধারণ মানুষের কবি, অজ্ঞাত অথচ অমর। তাঁদের সৃষ্টিই দেখিয়ে দেয়, মুক্তিযুদ্ধ শুধু বন্দুকের লড়াই নয়—এটি ছিল গান ও কবিতারও এক বিপুল সংগীতযুদ্ধ, যেখানে প্রতিটি চারণকবি ছিলেন একেকজন অজানা সৈনিক, স্বাধীনতার চেতনার মশালবাহক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ