দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা। সেখানে শিক্ষার মান, ব্যবস্থাপনা, শিক্ষকদের মূল্যায়ন, বরাদ্দসহ বিভিন্ন জায়গায় নানা অবহেলা বিদ্যমান। মাধ্যমিক শিক্ষার সংকট নিয়ে লিখেছেন নজরুল ইসলাম

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্য হলো মাধ্যমিক শিক্ষার প্রতি সরকারের অবহেলা। প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি স্কুলের প্রাধান্য বিরাজ করে। এ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ৬৭ দশমিক ১ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং বাকি ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করে।

উচ্চশিক্ষা (তথা ব্যাচেলর ও মাস্টার ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষার) দিকে তাকালে আমরা দেখি, ব্যক্তি খাতে ১০৮টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত। যদি মাধ্যমিক (এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ের) শিক্ষার দিকে তাকাই, তাহলে দেখি, মাত্র ৭ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী সরকারি প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত এবং বাকি ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করে। এ বৈপরীত্যের কারণ বুঝতে হলে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসে যেতে হবে। কিন্তু কথা হলো, ইতিহাস যাই হোক না কেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও মাধ্যমিক শিক্ষার প্রতি এরূপ বৈষম্য কেন অব্যাহত থাকছে?

এ প্রশ্নের উত্তরে সরকারি মহল থেকে নিঃসন্দেহে বলা হবে যে উপর্যুক্ত পরিসংখ্যান মাধ্যমিক শিক্ষায় সরকারের ভূমিকা সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে না। কারণ, বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পারিতোষিকের একটি অংশ সরকারি তহবিল থেকে প্রদান করা হয়। এ বন্দোবস্তের নাম ‘মান্থলি পে অর্ডার (এমপিও)’ বাংলায় বলা যেতে পারে ‘মাসিক বেতন আদেশ (মাবেআ) ’। এমপিও বন্দোবস্তে সরকারের অধীন নিবন্ধিত মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মূল বেতন সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হয় এবং তাঁদের পারিতোষিকের বাকি অংশ (ভাতা, অন্যান্য সুবিধাদি) এসব প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব তহবিল থেকে প্রদান করতে হয়। সরকারসূত্রের মূল বেতন পাওয়ার জন্য এই শিক্ষকদের ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন এবং প্রত্যয়নকারী কর্তৃপক্ষ’–এর অধীন নিবন্ধিত হতে হয়।

এমপিও ব্যবস্থার একটি প্রত্যক্ষ ফল হলো বৈষম্য। কারণ, সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের তুলনায় এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষকেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি পান এবং অনেক সময় পানও না। সামগ্রিকভাবে এ বন্দোবস্তের ফলে মাধ্যমিক শিক্ষকদের মধ্যে একটি শ্রেণি বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে, যা বাঞ্ছনীয় নয়।

সুতরাং আশ্চর্যের নয় যে এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষকদের মধ্যে বহুদিন ধরে অসন্তোষ বিরাজ করছে। তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে বাঞ্ছনীয় সমাধান হলো মাধ্যমিক শিক্ষার জাতীয়করণ। অর্থাৎ সব মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা। এটা করা হলে বর্তমানের দ্বৈততার অবসান ঘটবে এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ শিক্ষক বলে পরিগণিত হতে হবে না। তাঁদের বেতন-ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হবে। তাঁরা মর্যাদাবান বোধ করবেন এবং শিক্ষাদানের প্রতি পরিপূর্ণভাবে মনোযোগী এবং নিবেদিত হতে পারবেন।

আরও পড়ুনশিক্ষা আন্দোলনের চেতনা বনাম রাষ্ট্রের নীরবতা১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

(মাধ্যমিক) শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের এ দাবি সরকার এ পর্যন্ত অগ্রাহ্য করেছে। বিদেশি ‘দাতা’ সংস্থাসমূহের ব্যক্তিকরণের সার্বিক চাপ এ ক্ষেত্রে একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। ফলে সরকারের পক্ষে জাতীয়করণের দাবিটি প্রত্যাশিত মনোযোগ পায়নি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি সুযোগের সৃষ্টি হয়েছিল দেশের শিক্ষা খাতের পুঞ্জীভূত সমস্যাবলি নিরীক্ষণ করে একটি মোড় পরিবর্তনমূলক কর্মপরিকল্পনা অথবা সুপারিশমালা প্রণয়ন করার। কিন্তু সরকার প্রায় এক ডজন সংস্কার কমিশন গঠন করলেও শিক্ষাবিষয়ক কোনো কমিশন গঠন করেনি। ফলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সমস্যার সার্বিক সমাধানের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়। এমতাবস্থায় তাঁরা কতগুলো সুনির্দিষ্ট দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন। এর মধ্যে রয়েছে মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া, ১ হাজার ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা ও কিছু উৎসব ভাতা। অনেক দিন ধরে এসব দাবি নিয়ে খণ্ডকালীন আন্দোলন করার পর এবার তাঁরা ঢাকায় এসে হাজির হন এবং লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন।

শিক্ষকদের লাঠিপেটাসহ বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হয়। তা সত্ত্বেও শিক্ষকেরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার মাত্র ৫ শতাংশ বাড়িভাড়া ভাতা দিতে সম্মত হয়। সেটি মেনে না নিয়ে শিক্ষকেরা আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ছিন্নমূলের মতো ঢাকায় এসে অবস্থান করা, শহীদ মিনার থেকে শাহবাগ, শাহবাগ থেকে যমুনা, যমুনা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে শহীদ মিনার—শিক্ষকদের এই সাফা-মারওয়া দৌড়াদৌড়ি নিশ্চয়ই প্রীতিকর কিছু নয়। কিন্তু তাঁরা যে এটা করতে বাধ্য হয়েছেন, তা থেকে তাঁদের বেপরোয়া পরিস্থিতি পরিষ্কার বোঝা যায়। অবশেষে তাদের বাড়িভাড়া মূল বেতনের ১৫ শতাংশ (ন্যূনতম দুই হাজার টাকা) করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। শিক্ষকেরাও এ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে আন্দোলনের ইতি টেনে ক্লাসরুমে ফিরে গেছেন।

নিশ্চয়ই জাতীয়করণকৃত শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করা একটি চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে দুর্নীতি যেভাবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে এবং একটি গভীর প্রোথিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাতে সরকারি স্কুলে অপচয় ও দুর্নীতির আশঙ্কা থেকেই যায়। কিন্তু দুর্নীতি ও অদক্ষতার কাছে আত্মসমর্পণ এ সমস্যার সমাধান হতে পারে না।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান দুর্দশাকর ত্রিখণ্ডিত অবস্থা। এর প্রতিফল ও তা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় সম্পর্কে আমার সম্প্রতি প্রকাশিত আগামী বাংলাদেশের দশ করণীয় গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ নিবন্ধের স্বল্প পরিসরে তার পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। সংক্ষেপে বলা দরকার যে পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রায় সম্পূর্ণরূপে সরকারি খাতে পরিচালিত হয়। ইউরোপের উন্নত দেশসমূহে, এমনকি উচ্চশিক্ষাও প্রায় সম্পূর্ণরূপে সরকারি খাতে ন্যস্ত। প্রতিবেশী ভারতেও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি খাতে।

বাংলাদেশের মতো দেশে জনগণকে শিক্ষিত এবং দক্ষ শক্তিতে পরিণত করাই সরকারের মূল দায়িত্ব। মাধ্যমিক (এইচএসসিসহ) পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা পুরোপুরি সরকারি খাতে পরিচালনা করাই এ করণীয় সম্পাদনের প্রকৃষ্ট পন্থা। সুতরাং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ একটি সংগত দাবি।

দেশের সব শিশু ও তরুণের মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বাধ্যতামূলক এবং বিনা বেতনে সুশিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য অর্জনের জন্য এটাই উপযোগী পন্থা। এরূপ একটি একীভূত শিক্ষাব্যবস্থা নতুন প্রজন্মের মধ্যে একটি অভিন্ন জাতিসত্তা সৃষ্টি করে। এ বয়স হলো মনোগঠনের বয়স। এ বয়সেই যদি তারা পারিবারিক আয়, ধর্ম, ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে পড়ে, তবে তাদের মধ্যে অভিন্ন জাতিসত্তার উপলব্ধি এবং জাতীয় সহমর্মিতা সবল হতে পারে না। জাতি গঠনে একীভূত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকার প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোকজন এসে যুক্তরাষ্ট্রে বসতি গড়েন। কিন্তু অভিন্ন, সরকারি প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুলগুলোর মাধ্যমে তাঁদের সন্তানেরা সবাই ‘মার্কিন’ হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুনবাংলাদেশে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষক ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ০৪ অক্টোবর ২০২৫

নিশ্চয়ই জাতীয়করণকৃত শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করা একটি চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে দুর্নীতি যেভাবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে এবং একটি গভীর প্রোথিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাতে সরকারি স্কুলে অপচয় ও দুর্নীতির আশঙ্কা থেকেই যায়। কিন্তু দুর্নীতি ও অদক্ষতার কাছে আত্মসমর্পণ এ সমস্যার সমাধান হতে পারে না।

শিক্ষাব্যবস্থার খণ্ডিকরণের বর্তমান প্রক্রিয়া সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সমস্যা আরও তীব্র করবে। কারণ, সমাজের এলিট শ্রেণির সদস্যরা তাঁদের সন্তানদের ব্যয়বহুল ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠাবেন এবং সরকারি স্কুলসমূহের পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও উদাসীন হবেন। পক্ষান্তরে যদি এলিট শ্রেণির সন্তানদেরও সরকারি স্কুলে যেতে হয়, তাহলে এই শ্রেণি সরকারি স্কুল ব্যবস্থার মানোন্নয়নে সচেষ্ট হবে এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, তদারকি নিশ্চিত করা, ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণে প্রয়াসী হবে। ফলে গোটা জাতি উপকৃত হবে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ কি দুঃসাধ্য কোনো লক্ষ্য? ২০২৩ সালে প্রতিবেশী ভারত ও ভুটান শিক্ষার জন্য ব্যয় করেছে জিডিপির যথাক্রমে ৪ দশমিক ১২ ও ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সে তুলনায় বাংলাদেশের ব্যয় ছিল মাত্র ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ভারত ও ভুটানের তুলনায় (যথাক্রমে ২০ দশমিক ৮ ও ২৪ দশমিক ২৫ শতাংশ) বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনেক কম (মাত্র ৮ দশমিক ২১ শতাংশ) হওয়ার কারণে সরকারের বাজেটের অনুপাত হিসেবে শিক্ষার জন্য বাংলাদেশের ব্যয় বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখি, এ ক্ষেত্রেও ভারতের ১৪ দশমিক ২ ও ভুটানের ১৭ দশমিক ২ শতাংশের তুলনায় চেয়ে বাংলাদেশের জন্য এই অনুপাত কম, ১০ দশমিক ৭ শতাংশ।

আরও পড়ুনমাধ্যমিক শিক্ষা কেন জাতীয়করণ করা হয় না?২১ জুলাই ২০২৩

বাংলাদেশের ২০২৪-২৫ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার জন্য মোট বরাদ্দ হয়েছে ৪৪ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাধ্যমিকের জন্য কত বরাদ্দ, তা আলাদা করে উল্লিখিত নয়। যাহোক মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা একত্র করেও বরাদ্দ মোট বাজেটের মাত্র ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ধরা যাক, এর অর্ধেক মাধ্যমিকের জন্য। সে ক্ষেত্রে মাধ্যমিকের জন্য মোট বরাদ্দ দাঁড়াবে ২২ হাজার ৫৫ কোটি টাকা, তথা বাজেটের ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এটা ভাবা কঠিন যে এ স্বল্প শতাংশের বাজেটের এমন কিছু বৃদ্ধি সম্ভব নয়, যার মাধ্যমে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সব দাবি পূরণ করা সম্ভব। লক্ষণীয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষার জন্য বরাদ্দ হলো ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। বাধ্যতামূলক মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষানীতির অনুসারে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রাথমিকের চেয়ে খুব পৃথক হওয়ার কথা নয়। সে দৃষ্টিকোণ থেকেও মাধ্যমিকের জন্য বরাদ্দের স্বল্পতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

দেশে এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা আনুমানিক ১৫০। মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দুই শতাধিক। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যে অভিযোগের কথা শোনা যায় তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের নিম্নমান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতির অভাব। সুতরাং উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই বিপুল বৃদ্ধি অনেকটা ‘গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালা’র মতো। লক্ষণীয় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার গুরুত্ব এক অর্থে প্রাথমিক পর্যায়ের চেয়েও বেশি। কারণ, প্রাথমিক পর্যায়ে ঘাটতি থাকলে তা মাধ্যমিক পর্যায়ে পূরণের সুযোগ থাকে। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে যদি গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতি থেকে যায়, তাহলে তা বহুলাংশে স্থায়ী চরিত্র গ্রহণ করে। সে কারণে বাংলাদেশের মানবসম্পদ বিকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার প্রতি অবহেলা বহুলাংশে আত্মহত্যার শামিল।

এমপিও শিক্ষকদের দাবি খুব বেশি কিছু ছিল না। তাঁদের অনেকের মোট মাসিক বেতন আনুমানিক ১০ হাজার টাকা। ঢাকা শহরের অনেক গৃহকর্মীই এখন এই পরিমাণ পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। তাদের অন্যান্য দাবিগুলো নিয়েও ভাবা উচিত এবং দীর্ঘ মেয়াদে গোটা মাধ্যমিক শিক্ষার জাতীয়করণের লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। একটি কমিশনের মাধ্যমে এ আলোচনার সূত্রপাত করা গেলে ভালো হতো। তবে অন্যভাবেও সেটা শুরু করা যেতে পারে।

নজরুল ইসলাম অধ্যাপক, এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন গবেষণার সাবেক প্রধান

*মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর য য় র শ ক ষ র শ ক ষ ব যবস থ র ন র শ ক ষকদ র শ ক ষ র জন য শ ক ষকদ র ম র জ ত য়করণ র জন য ব সরক র র ব সরক র ন শ চয়ই ন বন ধ বর দ দ পর চ ল রন ধ র র একট সমস য অবহ ল এমপ ও হওয় র দশম ক করণ র

এছাড়াও পড়ুন:

মুক্তিযুদ্ধে লোকশিল্পী ও চারণকবিদের সাংস্কৃতিক ভূমিকা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনায় যে বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি আলোকপাত হয়, তা হলো একদিকে সশস্ত্র যুদ্ধ, অন্যদিকে এক ব্যাপক সামাজিক জাগরণ। শহর, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজনৈতিক দল, আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং যুদ্ধকৌশল নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও, সেভাবে আলোচিত হয়নি গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ ও চারণকবিদের সাংস্কৃতিক ভূমিকা, যা মুক্তিযুদ্ধের অনানুষ্ঠানিক তথ্যপ্রবাহ, আবেগ-উদ্দীপনা, জনমত, প্রতিরোধচেতনা গঠনে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল।

মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করতেন। তাঁদের কাছে রেডিও, সংবাদপত্র বা রাজনৈতিক বক্তব্য তত সহজলভ্য ছিল না। যে মাত্রার ভয়াবহতা পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রামাঞ্চলে চালিয়েছিল—লুটতরাজ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা—সেগুলো প্রত্যক্ষভাবে প্রথম নথিভুক্ত করেছেন লোকগানের স্রষ্টা ও চারণকবিরা। চারণকবিদের গান ও কবিতা কেবল আবেগের প্রকাশ নয়, এগুলো হলো মৌখিক ইতিহাসের দলিল, গ্রামীণ সংস্কৃতির অভ্যন্তরভূমি থেকে লিখিত বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের অনুষঙ্গ, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

চারণকবিদের শ্রেণিগত পরিচয় ছিল সাধারণত কৃষক, জেলে, মাঝি, খেতমজুর, কামার, কুমার ও নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ। তাঁরা একদিকে লোকশিল্পী, অন্যদিকে ছিলেন গ্রামের স্মৃতিরক্ষক, অর্থাৎ কমিউনিটির ‘সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার’। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁদের রচনাগুলো রাষ্ট্রীয় ইতিহাস, বুদ্ধিজীবী রচনা, গবেষকনির্ভর বিশ্লেষণের বাইরে গিয়ে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে।

চারণকবিদের গান ও কবিতা কেবল আবেগের প্রকাশ নয়, এগুলো হলো মৌখিক ইতিহাসের দলিল, গ্রামীণ সংস্কৃতির অভ্যন্তরভূমি থেকে লিখিত বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের অনুষঙ্গ, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার গ্রামাঞ্চল কেবল যুদ্ধক্ষেত্র ছিল না, তা ছিল প্রতিরোধ, প্রেরণা ও সৃজনশীলতারও উর্বর ভূমি। সেই গ্রামবাংলায়, যেখানে মাঠের ধান পুড়ে ছাই, নদীর জল লাল হয়ে উঠেছে রক্তে আর ঘরহারা মানুষ অন্ধকারের ভেতর খুঁজে ফিরছে আলোর দিশা—সেখানেই একদল অকৃত্রিম চারণকবি, জারি-সারি ও পল্লিগানের গায়ক তাঁদের নিজস্ব ভাষায় সৃষ্টি করেছিলেন স্বাধীনতার মহাকাব্য। এই কবিরা শহরের নামকরা সাহিত্যিক ছিলেন না, তাঁদের ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, প্রকাশক বা মঞ্চ—তবু তাঁদের কণ্ঠ ছিল মানুষের কণ্ঠ, তাঁদের ছন্দে ছিল গ্রামের মাটির স্পন্দন।

চারণকবিরা মুক্তিযুদ্ধের সময় রচনা করেছেন অসংখ্য গান ও কবিতা। গ্রামের প্রকৃতি যেমন সজীব ও বৈচিত্র্যময়, তেমনি এখানকার মানুষও আবেগপ্রবণ ও শিল্পমনস্ক। তাই কৃষক, জেলে, কামার, কুমার, বয়নশিল্পী কিংবা নৌকার মাঝি—সবার ভেতরেই যেন লুকিয়ে ছিল একেক জন কবি। তাঁরা তাঁদের জীবনের গল্প, দুঃখ, লড়াই, হারানো স্বপ্ন আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে সুরে-ছন্দে বেঁধে তুলেছেন লোকগানের আকারে। এই গানগুলো ছিল কখনো শোকের, কখনো প্রতিবাদের আবার কখনো মুক্তির আহ্বানে দীপ্ত।

পাকিস্তানি সেনারা যখন গ্রাম দখল করে গণহত্যা চালাচ্ছিল, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই যখন আগুন ও রক্তের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছিলেন, তখনই চারণকবিরা তাঁদের সৃষ্টিতে মানুষের মনে সাহস জাগিয়েছেন। তাঁদের গান অস্ত্রের চেয়ে কম শক্তিশালী ছিল না। মুক্তিকামী মানুষ যখন ভয় আর হতাশায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল, তখন গ্রামের কবিরা তাঁদের কণ্ঠে তুলেছিলেন যুদ্ধের ডাক—‘জয় বাংলা’, ‘মুক্তির গান’, ‘দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ দে রে ভাই’—এসব আহ্বান প্রতিধ্বনিত হয়েছিল মাঠে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ও শরণার্থীশিবিরে। সুতরাং যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে লোকগান হয়ে ওঠে আবেগের ভাষা, সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক চেতনা, মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক জ্বালানি এবং মৌখিক ‘সংস্কৃতি–ডকুমেন্টেশন’।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, সাধারণ মানুষের যুদ্ধ। গ্রামের অনেক মানুষ সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, আবার অনেকে যুদ্ধ না করলেও খাবার, আশ্রয়, তথ্য, গোপন পথ দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দমননীতি গ্রামের মানুষের ওপর ছিল চরম। তবু তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গোপনে যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন—এই অবস্থান তৈরি করতে চারণকবিদের গানের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।

চারণকবি লাল মামুদের ‘বড়ইতলা গণহত্যা’ কবিতায় রয়েছে নির্দিষ্ট একটি গ্রামের নাম, হত্যার দিন, সময়, নিহতদের সংখ্যা, অসহায় নারীদের আর্তনাদ, ঘর পোড়ানো, কাটা ধানের আঙিনায় রক্তের দাগ—সব মিলিয়ে মৃত্যুর বাস্তব রেকর্ড।

পল্লিকবি শাহাব উদ্দিনের দীর্ঘ কবিতা ‘এহিয়ার হত্যাকাণ্ড’ একটি অসাধারণ দলিল। এ গীতিকবিতায় পাকিস্তানের ২৩ বছরের বৈষম্য, পূর্ব বাংলার মানুষের ভাষা, অধিকার, শোষণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, পশ্চিম পাকিস্তানের দমননীতি সবই উঠে এসেছে। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা এই লোকগানে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। শ্রোতারা বুঝতে পারে রাষ্ট্রকাঠামো কীভাবে আমাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করেছিল। আগরতলা মামলা ও ’৬৯-এর গণ–অভ্যুত্থান লোকগানের ভাষায় অত্যন্ত তীব্রভাবে উপস্থাপিত হয়েছে—

‘... হায়রে দুঃখের কথা (২) মনে ব্যথা
          ঝরে দুই নয়ন,
      বাঙালির উপর রাখল
          সামরিক শাসন।

দেখেন কেমন করে (২) শেখ সাবেরে
            নিল কারাগারে,
          আগরতলা ষড়যন্ত্রে
            ফেলিয়া তাহারে।

কত বেত মারে (২) যুক্তি করে
         ফাঁসি কাষ্ঠে দিতে,
     সংগ্রামী নেতারা তখন
          নামে সংগ্রামেতে।

জাগে ছাত্র শ্রমিক (২) কৃষক যুবক
          নেতাগণ মিলিয়া,
    শেখ সাবেরে বাহির করলো
         জেলখানা ভাঙ্গিয়া।…”
(এহিয়ার হত্যাকাণ্ড/ শাহাব উদ্দিন) 

এরপর তিনি ২৫ মার্চের ভয়াবহ রাত ও গণহত্যার কথা বর্ণনা করেন, এই অংশে শিল্পের চেয়ে ইতিহাসের তীব্রতা বেশি—আগুন, ট্যাংকের গর্জন, বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ড, নদীতে লাশ ভাসা এসব বিষয় লোকগানে এমনভাবে বলা হয়েছে, যা মানুষের স্মৃতি চিরদিন বহন করে। শাহাব উদ্দিনের কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে দেবচরিত্র নয়—একজন সংগ্রামী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানুষের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।

তাঁদের অনেকেই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী—নিজ চোখে দেখেছেন গণহত্যা, গ্রাম পোড়ানো, ধর্ষণ, শরণার্থীর মিছিল। এসব দেখেই তাঁরা লিখেছেন হৃদয়ের রক্তে ভেজা গান, যেখানে বেদনা ও প্রতিবাদ মিলেমিশে গেছে।

চারণকবি লাল মামুদের ‘বড়ইতলা গণহত্যা’ কবিতায় রয়েছে নির্দিষ্ট একটি গ্রামের নাম, হত্যার দিন, সময়, নিহতদের সংখ্যা, অসহায় নারীদের আর্তনাদ, ঘর পোড়ানো, কাটা ধানের আঙিনায় রক্তের দাগ—সব মিলিয়ে মৃত্যুর বাস্তব রেকর্ড। তাঁর ভাষা এমন যেন ঘটনাটি ঘটছে চোখের সামনে, যেন শ্রোতারা নিজেরাই আগুনের গন্ধ পাচ্ছেন। লাল মামুদের এই কবিতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরগঞ্জ জেলার সদর থানার বড়ইতলা গ্রামে সংঘটিত এক ভয়াবহ গণহত্যার প্রত্যক্ষ ও আবেগময় লোকবয়ান। এটি একটি লোকগাথা, যেখানে যুদ্ধের নৃশংসতা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা, রাজাকার-আলবদরদের নিষ্ঠুরতা এবং সাধারণ মানুষের অসহায়তা একসঙ্গে ধরা পড়েছে। প্রতিটি চরণই যেন বেদনামাখা জনপদের ইতিহাস:

‘… ডাকে লাল মামুদে (২) এই সভাতে
           করুণ কাহিনী
     এইসব কথা মনে হলে
        চোখে আসে পানি।

হায়রে কিশোরগঞ্জে (২) সদর থানা
        বড়ইতলা গ্রাম।
সাড়ে তিন শ মানুষ মারছিন
      এহিয়া বেইমান।

দারুণ অক্টোবরে (২) তের তারিখ
       বুধবাইরা দিন
বড়ইতলায় হইয়া গেল
    কারবালারও চিন।

… সাথে আল বদরে (২) অস্ত্র ধরে
              ভয় দেখাইয়া
       সাড়ে তিনশ মানুষ নিল
       বন্দুক দেয়া গুতাইয়া।

নিয়া বড়ই তলা (২) কইরা দলা
           কাতারে বসাইয়া
     মিশিনগানের গুলি ছাড়ে
           পশুর মত বইয়া।…’
(বড়ইতলা গণহত্যা/ লাল মামুদ) 

লোকগানে মুক্তিযুদ্ধের সহিংসতা উঠে আসে এভাবে—আগুন ও ধ্বংসের চিত্র, গ্রামের পর গ্রাম, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, গরু–ছাগল লুট, নারীদের ওপরে বর্বরতা। এসব গান, কবিতা নারী নির্যাতনের দলিল, এখানে নারীর আর্তি সরাসরি উচ্চারিত হয়েছে—এগুলো ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নথি। এ ছাড়া আছে শরণার্থীসংকট—মাইলের পর মাইল হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া, ক্ষুধার্ত শিশু, অনিশ্চয়তা, চারণকবিরা এগুলোকে স্রেফ তথ্য নয়—অভিজ্ঞতা হিসেবে রূপান্তর করেছেন। যুদ্ধকালীন সময়ে এইসব ভয়াবহ অমানবিক কর্মকাণ্ড লোকগানের মর্মস্পর্শী ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে—

‘… এইরূপ উনিশ জিলা (২) হত্যালীলা
       কত বলব ভাই,
সারা বাংলা আগুন দিয়া পুইড়া
        করলো ছাই।

আগুন নারায়ণগঞ্জে (২) মুন্সিগঞ্জে
       পুড়িল জিনজিরা,
        চট্টগ্রাম বরিশাল
       পুড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

পুড়ে কিশোরগঞ্জ (২) করিমগঞ্জ
         পুড়ে বাজিতপুর,
ময়মনসিংহ দিনাজপুর পুড়ে
          মধুপুরের গড়।

ছাতক সুনামগঞ্জ (২) কটিয়াদি
    পুড়িল মঠখোলা,
হারি মাষ্টারের বাড়ি পুড়ে
      চর মান্দালিয়া

এইরূপ গ্রামে গ্রামে (২) আগুন দিয়া
     হানাদারের জাতে,
জ্যাতা মানুষ ধইরা নিয়া
     ফেলে আগুনেতে।…’
(এহিয়ার হত্যাকাণ্ড/ শাহাব উদ্দিন)

চারণকবিরা কেবল গান রচনা করেননি, তাঁরা ছিলেন সেই সময়ের সংবাদদাতা, ইতিহাসলিপিকার এবং জনগণের প্রেরণাদাতা। তাঁদের অনেকেই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী—নিজ চোখে দেখেছেন গণহত্যা, গ্রাম পোড়ানো, ধর্ষণ, শরণার্থীর মিছিল। এসব দেখেই তাঁরা লিখেছেন হৃদয়ের রক্তে ভেজা গান, যেখানে বেদনা ও প্রতিবাদ মিলেমিশে গেছে। তাঁরা শাসকগোষ্ঠীর অবিচার ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছেন, সাধারণ মানুষকে সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের গান শোনা মানে ছিল সংগ্রামের আহ্বান শোনা, তাঁদের শব্দ-ছন্দে ছিল আগুন, কণ্ঠে ছিল স্বাধীনতার বিশ্বাস।

তাঁরা প্রমাণ করেছেন—সত্যিকার ইতিহাস শুধু বইয়ে লেখা হয় না, তা লেখা হয় মানুষের মুখে, গানে, অশ্রুতে, আর মাটির গন্ধে। তাঁরা আমাদের সাধারণ মানুষের কবি, অজ্ঞাত অথচ অমর।

লোককবিদের বিশেষত্ব ছিল তাঁদের সহজ ভাষা ও অন্তরঙ্গ বর্ণনা। তাঁরা বক্তৃতার ভঙ্গিতে ইতিহাস বলেন না, বলেন হৃদয়ের স্বরে। যেমন কোনো মা তার সন্তানকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর আগে কাঁদতে কাঁদতে আশীর্বাদ করেন, তেমনি এই কবিতাগুলিতেও মিশে আছে মায়ের অশ্রু, প্রেমিকার প্রতীক্ষা, বন্ধুর বিদায় ও যোদ্ধার মৃত্যুবেদনা। একেকটি গান যেন একেকটি জীবন্ত দলিল—যেখানে দেখা যায় গ্রামের অগ্নিদগ্ধ ঘর, নদীতে ভেসে থাকা লাশ কিংবা শহীদের রক্তে ভেজা মাটি।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে যখন দেশ স্বাধীন হলো, তখনো এই চারণকবিরা থেমে থাকেননি। তাঁরা তাঁদের প্রত্যক্ষ করা ঘটনার স্মৃতি ধরে রাখতে, সেই দিনগুলোর ভয়াবহতা ও গৌরব নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে গেয়ে চলেছেন নতুন গান। তাঁদের কণ্ঠে ইতিহাস বেঁচে আছে, তাঁদের ছন্দে এখনো বাজে মুক্তির মন্ত্র। গ্রামের হাটবাজারে, যাত্রাপালায়, মেলায় আজও সেই গান শোনা যায়—যে গান একসময় ছিল যুদ্ধের প্রেরণা, এখন তা স্মৃতির রক্ষক, চেতনার ধারক।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় এই চারণকবিরা এক অমূল্য সম্পদ। তাঁদের গান ও কবিতা থেকে আমরা পাই মানুষের ইতিহাস, প্রান্তিক জীবনের কণ্ঠস্বর আর স্বাধীনতার সেই অপরিশ্রান্ত আকাঙ্ক্ষা, যা বইছে আমাদের লোকসংস্কৃতির ধমনিতে। তাঁরা প্রমাণ করেছেন—সত্যিকার ইতিহাস শুধু বইয়ে লেখা হয় না, তা লেখা হয় মানুষের মুখে, গানে, অশ্রুতে, আর মাটির গন্ধে। তাঁরা আমাদের সাধারণ মানুষের কবি, অজ্ঞাত অথচ অমর। তাঁদের সৃষ্টিই দেখিয়ে দেয়, মুক্তিযুদ্ধ শুধু বন্দুকের লড়াই নয়—এটি ছিল গান ও কবিতারও এক বিপুল সংগীতযুদ্ধ, যেখানে প্রতিটি চারণকবি ছিলেন একেকজন অজানা সৈনিক, স্বাধীনতার চেতনার মশালবাহক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ