আমার জীবনে সক্কলের চেয়ে বড় পাওয়া আমার স্ত্রী, বলেছিলেন মান্না দে
Published: 23rd, October 2025 GMT
প্রথম আলো :
জীবনে কিছু যা পাওয়া সম্ভব, নাম-খ্যাতি, মানুষের ভালোবাসা... সবই তো আপনি পেয়েছেন। এর মধ্যে নিজে সবচেয়ে বড় পাওয়া মনে করেন কোনটিকে?
মান্না দে: আমার জীবনে সক্কলের চেয়ে বড় পাওয়া আমার স্ত্রী। ও কেরালার মালাবারের মেয়ে। উচ্চশিক্ষিত, বোম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি ভাষায় এমএতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। ওকে দেখে প্রথম দর্শনেই প্রেম বলতে যা বোঝায়, তা-ই হয়েছিল আমার। এরপর আমরা একে অন্যকে জানলাম, বিয়ে করলাম। এই ৫৫ বছরের বিবাহিত জীবনে সব সময়ই ওকে আমার সঙ্গী হিসেবে যেমন সেরা মনে হয়েছে, তেমনি বন্ধু হিসেবেও সেরা, যেকোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করার জন্য সেরা। ও শুধু আমার স্ত্রী-ই নয়; আমার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। আমার সবচেয়ে বড় সমালোচকও।
প্রথম আলো:এটা তো পুরো জীবনের পাওয়া। শুধু সংগীতজীবনটা যদি আলাদা করে নিই, তাহলে সবচেয়ে বড় পাওয়া মানেন কোনটিকে?
মান্না দে: সেই চাওয়া-পাওয়ার তো আর শেষ নেই। আমি যা হতে চেয়েছিলাম, সেই সর্বভারতীয় টপ সিঙ্গার হতে গেলে গোটাকতক জিনিস দরকার। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমি কোন অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করছি। আমি প্রতিনিধিত্ব করছি বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের যে গানবাজনা—রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদের গান, বাউল, ভাটিয়ালি—এগুলো তো সর্বভারতীয় হয় না। আমার সমসাময়িক যাঁরা ছিলেন, মোহাম্মদ রফি, মুকেশ, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোসলে—সবারই এমন একটা পরিমণ্ডলে জন্ম হয়েছিল, যেখানে সর্বভারতীয় গানবাজনা হতো। ওঁরা সেখানেই জন্মেছিলেন বলে ওঁদের একটা অ্যাডভান্টেজ ছিল। একটা বাঙালির ওঁদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাটা খুব মুশকিল ছিল। তা সত্ত্বেও আমি সহজে হার মেনে নিইনি, ভালো ভালো ওস্তাদের কাছে শিখেছি। এ কারণেই আমি একটু অন্যভাবেও গাইতে চেয়েছি। আমার যে গায়কি, তাতে সব সময়ই একটা ক্ল্যাসিক্যাল বেজ থাকত। বাংলা গানেও আমি এসব ইন্ট্রোডিউস করেছি। সুখের কথা, আমার বাঙালি শ্রোতারা সেটি দুহাত ভরে গ্রহণ করেছে। বাংলা ভাষায় আমি যত শক্তই গান করি, সে গানগুলো পপুলার হতো ও লোকে গ্রহণ করত। তবে এটা হিন্দি ফিল্ডে হয়নি। কারণ, হিন্দি ফিল্ডে আই ওয়াজ অ্যান আউটসাইডার। একজন বাঙালি, যে হিন্দি বা উর্দু গান গাইছে। সেখানে যাদের এটি নিজেদের ভাষা, তারা অনেকটাই এগিয়ে ছিল। যেমন রফি ছিলেন পাঞ্জাবি, হিন্দি-উর্দু ওঁর স্বাভাবিকভাবেই আসত। আমি সেটা মেনে নিয়েছিলাম। কারণ, রফির মতো গাইয়ে ভারতবর্ষে হয়নি। আমি বলছি লাইট মিউজিকের কথা.
এ কারণেই বললাম, আমি মেনে নিই। যেমন কিশোর কুমার, ও যদিও বাঙালি, গাঙ্গুলি পদবি, তবে ওর জন্ম মধ্যপ্রদেশে। সেখানে ওদের কথাবার্তা চলত হিন্দিতে। ওই একটা অ্যাডভান্টেজ পেয়ে গেল সে। তার পর ছিল কিশোরের ওই গলা। অদ্ভুত রকমের একটা গলা ভগবান তাকে দিয়েছিলেন। অত বিউটিফুল ভয়েস খুব কম এসেছে।
কিশোর, রফি, বাংলা গানে হেমন্ত—ওঁদের যে ঈশ্বরদত্ত অপূর্ব গলা ছিল, আমি তা পাইনি। আমার গলার মধ্যে অত আকর্ষণীয় কিছু ছিল না। কিশোরের গলা শুনলেই যেমন মনে হতো, ‘হোয়াট আ ভয়েস!’ হেমন্তবাবুর অত মিষ্টি ভয়েস; আর রফি—ওর গায়কি, গান করার ঢং, ওটা ছিল দারুণ। এ কারণেই নিজের জায়গা করে নেওয়ার জন্য আমাকে ক্ল্যাসিকের দিকে ঝুঁকতে হয়েছিল। ভারতবর্ষে যে ক্ল্যাসিক্যাল গানবাজনা, সেটি ভালোভাবে রপ্ত করে আমি ওদের সঙ্গে কমপিট করতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পর যা দেখলাম, আমার জন্য মিউজিক ডিরেক্টররা যে গান তৈরি করতেন, সে গান আমিই গাইতাম, অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়ানো যেত না।প্রথম আলো:
যেকোনো শিল্পীর জন্য নিজের ভাষার গান দিয়ে শুরু করাটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি বাংলা গান করলেন অনেক পরে, বোম্বেতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর। এটা কেন?
মান্না দে: আমার প্রথম বাংলা গান রেকর্ড করার ঘটনাটা খুব মজার। আমি আর লতা ‘অমর ভূপালী’ বলে একটা ছবির গান করছিলাম। ওই ছবিতে আমি আর লতা যখন গান রেকর্ড করছি, লতা আমাকে বলল, ‘মান্নাদা, আমি বাংলা গানের রেকর্ড বের করতে চাই।’ লতার জন্য গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা দুটি গান আমি সুর করে লতাকে শেখালাম। এরপর রেকর্ডিংয়ের জন্য তৈরি হলাম। কিন্তু জানি না কেন, লতা গাইতে পারল না অথবা গাইল না। তো আমি গেয়ে দিলাম ওই দুটি গান—‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল’ এবং ‘হায় হায় গো রাত যায় গো’। ওই দুটি গান শুরুতে তেমন সাড়া না ফেললেও পরে দারুণ হিট হলো। এটাই বাংলা গানে আমার প্রথম পদার্পণ। ওই দুটি গান ভালো চলার পর এইচএমভি আমাকে বলল, প্রতিবছর পুজোয় রেকর্ডিং করতে হবে। আর তখন আমি যে গানেরই সুর করি, দেখি তা হিট হয়ে যায়। আমি ভেবে দেখলাম, আমার সুর করার ধারাটা গতানুগতিক যেটা চলছিল, তার চেয়ে আলাদা এবং সেটিই পাবলিক খুব পছন্দ করছে। আমি সর্বভারতীয় একটা টাচ দিয়ে সুর করতাম। লোকেও দেখল, আরে, এর সুরটা বা গায়কিটা তো আলাদা।
এই যে অন্য রকম একটা দিক যোগ করা, এটা আমি জেনে-বুঝেই করেছিলাম। কারণ, হেমন্তবাবুর অমন সুন্দর গলা, ভাষাটা এমন সুন্দর বলেন তিনি এবং মিষ্টি মিষ্টি গান করেন, আমি দেখলাম, এই ধারায় আমি তাঁর সঙ্গে কমপিট করতে পারব না। আমাকে যেটা করতে হবে, সর্বভারতীয় সাংগীতিক রূপটাকে এনে গানটাকে পরের ধাপে নিয়ে নিতে হবে। সেটি করেই আমি সফল হলাম।
আমার প্রশ্ন ছিল, শুরুটা কি নিজের ভাষার গান দিয়ে হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল না?
মান্না দে: না, আমি কখনোই বাংলা গানের শিল্পী হতে চাইনি। আমার মনে আছে, শচীন কর্তা (শচীন দেববর্মন) আসতেন কাকার কাছে গান শিখতে। উনি বহুদিন কাকার কাছে গান শিখেছেন। শচীন কর্তার গান শুনে ভালো লাগত, কেমন অন্য রকম গান করেন। কথার উচ্চারণগুলো নাকে নাকে। আমার খুব পছন্দ হতো। ওগুলো নকল করে করে আমি কলেজে গাইতাম, ‘তুঁমি যে গিঁয়াছ বঁকুল বিঁছানো পঁথে, নিঁশীথে যাঁইও ফুঁলবনে’। তবে তখন আমার সর্বভারতীয় শিল্পী হওয়ার লক্ষ্য। কাকা সবকিছু গাইতেন—ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরি, গজল, নাত, কীর্তন। আমাদেরও কাকা সেভাবেই তৈরি করেছিলেন যে একটা ধ্রুপদ গাইতে হলে ধ্রুপদ গাইতে হবে তোমাকে। খেয়াল গাইতে হলে খেয়াল গাইতে হবে। বাংলা মডার্ন গাইতে হলে গাইতে হবে।
স্ত্রীর সঙ্গে মান্না দে। ছবি: ফেসবুকউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল র কর ড র জন য আম র স গ ন কর স র কর সবচ য
এছাড়াও পড়ুন:
আসিফের জন্য গণঅধিকার পরিষদের দরজা সবসময় খোলা: রাশেদ খান
উপদেষ্টা পরিষদ থেকে সদ্য পদত্যাগী স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেছেন, তার জন্য আমাদের দরজা সবসময় খোলা রয়েছে। তিনি আসলে যোগ্যতা ও মর্যাদা অনুযায়ী তাকে সম্মানিত করা হবে।
উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগের পর আসিফ গণঅধিকার পরিষদে যোগ দিতে পারেন এমন গুঞ্জনের মধ্যে বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘‘সাবেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এক সময় আমাদের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন এবং তার সঙ্গে আমাদের সখ্য রয়েছে। তিনি পদত্যাগ করার আগের দিনও তার সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। গণঅধিকার পরিষদে আসার ব্যাপারে তিনি ইতিবাচক। কিন্তু এখনো পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি যদি আমাদের সঙ্গে আসতে চান সেক্ষেত্রে তার যোগ্যতা ও মর্যাদা অনুযায়ী তাকে সম্মানিত করা হবে।’’
রাশেদ খান বলেন, ‘‘আন্দোলন সংগ্রমে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের তিনি নায়ক। তিনি চাইলে যে কোনো দলে যোগদান করতে পারেন। অথবা নতুন দলও গঠন করতে পারেন। সেই স্বাধীনতা তার রয়েছে। যেহেতু আমরা একসঙ্গে রাজনীতি করেছি, আমাদের সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে, সেক্ষেত্রে গণঅধিকার পরিষদে আসলে তার জন্য ভালো হবে। তিনি সহজে আমাদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন। যেটি অন্য দলের ক্ষেত্রে তার জন্য কঠিন হবে। তিনি যদি চান গণঅধিকার পরিষদে আসতে পারেন। তার জন্য গণঅধিকার পরিষদের দরজা সবসময় খোলা রয়েছে।’’
‘‘তিনি (আসিফ) উপদেষ্টা ছিলেন, সরকারে থাকলে সমালোচনা হয়। বয়স তো খুব বেশি না, এই বয়সে বেশ কিছু ভুলভ্রান্তি করেছেন। আমরা মনে করি বয়স বাড়ার সঙ্গে তার ভেতরে পরিপক্বতা বাড়বে। বুঝবেন, দেখবেন, শিখবেন। তার ভুলভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা করা এই মুহূর্তে সমীচীন নয়,’’ বলেন তিনি।
জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে রাশেদ বলেন, আসিফ মাহমুদের জন্যই ৬ আগস্টের কর্মসূচি একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট করা হয়। এই সাহসী ভূমিকা ছিল তার। যে সিদ্ধান্তের কারণে স্বৈরাচারী হাসিনার পতন হয়। তার প্রতি আমাদের ভালোবাসা দেখানো উচিত বলেও মন্তব্য করেন রাশেদ খান।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলম বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে সরকার থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এরপর থেকেই গণঅধিকার পরিষদে আসিফের যোগদান নিয়ে গুঞ্জন ছড়িযে পড়ে। যদিও এ বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেননি আসিফ।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন//