বিল গেটস—নামটি শুধু প্রযুক্তিজগতের জন্য নয়, মানবিক উদারতার প্রতীক হিসেবেও সমানভাবে পরিচিত। ১৯৫৫ সালের ২৮ অক্টোবর জন্ম নেওয়া প্রযুক্তি খাতের এই মহানায়ক ছোটবেলা থেকেই ছিলেন কম্পিউটারপ্রেমী। প্রোগ্রামিং ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। মা–বাবা চাইতেন বড় হয়ে আইনজীবী হবেন। কিন্তু বিল গেটসের জন্মই যেন হয়েছিল অন্য কিছুর জন্য। তাই তো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে বন্ধুর সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ছোট্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। গড়ে তোলেন মাইক্রোসফট। এর মধ্য দিয়ে বদলে দেন পুরো বিশ্বকে।

বিল গেটস বেড়ে ওঠেন উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে। মায়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মা মেরি গেটস শহরের সামাজিক, দাতব্য ও ব্যবসায়িক কাজে সক্রিয় ছিলেন। ছোটবেলায় মেরি প্রায়ই বিলকে তাঁর সঙ্গে স্কুল ও কমিউনিটি সংগঠনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়ে যেতেন। সেই অভিজ্ঞতা পরে বিলের নিজের সামাজিক উদ্যোগে প্রভাব ফেলে।

বিল ছিলেন ‘বইপোকা’। ছোটবেলা থেকেই সময় কাটত ঘণ্টার পর ঘণ্টা বই পড়ে। প্রায় ১১-১২ বছর বয়সে তাঁর মা–বাবা তাঁকে নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন হতে শুরু করেন। বিদ্যালয়ে তিনি ভালো করলেও মাঝেমধ্যে উদাসীন ও অন্তর্মুখী হয়ে পড়তেন। হয়তো তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে যাবেন—এ দুশ্চিন্তায় সেভেন্থ গ্রেডে থাকতেই তাঁকে পাবলিক স্কুল থেকে সরিয়ে সিয়াটলের বেসরকারি ‘লেকসাইড স্কুলে’ ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়।

স্কুলে সব বিষয়েই পারদর্শী ছিলেন বিল। গণিত ও বিজ্ঞানে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখান। পাশাপাশি নাটক ও ইংরেজিতেও ভালো ছিলেন।

মাত্র ১৩ বছর বয়সে লিখেছেন সফটওয়্যার প্রোগ্রাম

লেকসাইড স্কুলেই বিল গেটসের জীবনের সবচেয়ে বড় মোড় আসে। কম্পিউটার ছিল খুবই ব্যয়বহুল। এটি সবার কাছে সহজলভ্য ছিল না। সিয়াটলের এক কম্পিউটার কোম্পানি স্কুলছাত্রদের জন্য কম্পিউটার ব্যবহারের বিশেষ সুযোগ করে দেয়। ছাত্রদের মায়েদের ক্লাবের অর্থে কেনা হয় টেলিটাইপ টার্মিনাল। এটি একধরনের কম্পিউটার ইনপুট-আউটপুট ডিভাইস, যা টাইপরাইটারের মতো দেখতে। এতে স্ক্রিনের পরিবর্তে কাগজে কম্পিউটারের আউটপুট ছাপা হতো, আর কি–বোর্ডের মাধ্যমে কমান্ড পাঠানো যেত।

টেলিটাইপ টার্মিনালে কাজ করতে গিয়ে বিল গেটসের পরিচয় হয় লেকসাইড স্কুলের আরেক ছাত্র পল অ্যালেনের সঙ্গে। তিনি ছিলেন বিল গেটসের দুই বছরের বড়। দুজনেরই কম্পিউটারের প্রতি ছিল তীব্র আগ্রহ। এ আগ্রহই তাঁদের বন্ধুত্বের ভীত গড়ে দেয়।

এ টার্মিনাল বিলের কাছে ছিল যেন এক দিগন্ত উন্মোচনকারী যন্ত্র। যখন অন্যরা খেলাধুলা বা আড্ডায় সময় কাটাত, বিল তখন সেই কম্পিউটারেই ডুবে থাকতেন। বিল গেটস সেই টেলিটাইপ টার্মিনালেই প্রথম কম্পিউটার চালানো শেখেন। প্রোগ্রামিং শেখেন এবং মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম সফটওয়্যার প্রোগ্রাম লেখেন। এটি ছিল একটি গেম, যার নাম টিক-ট্যাক টো।

টেলিটাইপ টার্মিনালে কাজ করতে গিয়ে গেটসের পরিচয় হয় ওই স্কুলের আরেক ছাত্র পল অ্যালেনের সঙ্গে। তিনি ছিলেন গেটসের দুই বছরের বড়। দুজনেরই কম্পিউটারের প্রতি ছিল তীব্র আগ্রহ। এ আগ্রহই তাঁদের বন্ধুত্বের ভীত গড়ে দেয়। তাঁরা কাজের অবসরে বেশির ভাগই সময়ই প্রোগ্রামিং করে কাটাতেন।

১৯৭০ সালে হাইস্কুলে থাকতে মাত্র ১৫ বছর বয়সে গেটস পল অ্যালেনের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। তৈরি করেন ‘ট্রাফ-ও-ডেটা’ নামের একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এটি রাস্তায় চলাচল করা যানবাহন সম্পর্কে স্থানীয় সরকারকে তথ্য দিত। এ প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁরা প্রায় ২০ হাজার ডলার আয় করেন। ওই সময় তাঁরা সিয়াটলের একটি কম্পিউটার কোম্পানির জন্য পে‌রোল প্রোগ্রামও তৈরি করে দেন। এমন সাফল্যের ফলে দুই কিশোর নিজেদের একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কিন্তু বিলের বাবা-মায়ের চাওয়া ছিল ভিন্ন—ছেলে পড়াশোনা শেষে বাবার মতো আইনজীবী হবেন।

প্রোগ্রামিংয়ের নেশায় হার্ভার্ড ছাড়লেন

১৯৭৩ সালে বিল গেটস লেকসাইড স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বাবা-মায়ের প্রত্যাশার চাপে শুরুতে আইন পেশায় ক্যারিয়ার গড়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু হার্ভার্ডে পড়াকালীন কম্পিউটারের প্রতি তাঁর আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ক্লাসের তুলনায় হার্ভাডের কম্পিউটার ল্যাবেই বেশি সময় কাটাতেন তিনি। ফলে পরীক্ষার সময় অল্প ঘুমিয়ে রাত জেগে পড়তে হতো তাঁকে। তবে অসাধারণ মেধা ও মনোযোগের কারণে মোটামুটি ভালো ফল নিয়েই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেন।

১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে বিল গেটস ও পল অ্যালেন আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের সফটওয়্যার ব্যবসা শুরু করেন। প্রতিষ্ঠানের নাম রাখেন মাইক্রো–সফট। মাইক্রোকম্পিউটার ও সফটওয়্যার—শব্দ দুটি মিলিয়ে নামটি রাখা হয়। প্রথমে নামের মাঝখানে একটি হাইফেন ছিল। কিন্তু এক বছরের মধ্যে সেটি বাদ দিয়ে নামকরণ হয় মাইক্রোসফট।

গেটস যখন হার্ভার্ডে, অ্যালেন তখন ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে দুই বছর পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন ও বোস্টনে চলে যান। সেখানে একটি কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে গেটসের বন্ধুত্ব ও যোগাযোগ অটুট ছিল।

১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে অ্যালেন গেটসকে পপুলার ইলেকট্রনিকস সাময়িকীর একটি প্রতিবেদন দেখান। প্রতিবেদনটি ছিল আলটেয়ার ৮৮০০ নামের একটি মাইক্রোকম্পিউটার নিয়ে। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম ব্যক্তিগত কম্পিউটার বা পিসি। মাইক্রো ইন্সট্রুমেন্টেশন অ্যান্ড টেলিমেট্রি সিস্টেমস (এমআইটিএস) নামের একটি প্রতিষ্ঠান এটি তৈরি করে।

বিল ও পল দুজনই এ নতুন কম্পিউটারের সম্ভাবনা দেখে মুগ্ধ হন। তাঁরা বুঝতে পারলেন, এটি ব্যক্তিগত কম্পিউটিংয়ের জগতে বিপ্লব ঘটাতে পারে। তাঁদের আগ্রহ এতটাই বেড়ে যায় যে তাঁরা সরাসরি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দাবি করেন, তাঁরা আলটেয়ার ৮৮০০ কম্পিউটারের জন্য একটি ‘বেসিক’ সফটওয়্যার প্রোগ্রাম তৈরি করছেন।

বাস্তবে বিল ও পলের কাছে কোনো আলটেয়ার ৮৮০০ কম্পিউটার ছিল না। এমনকি কম্পিউটার চালানোর মতো প্রস্তুত কোনো কোডও হাতে ছিল না। আসলে তাঁরা জানতে চাইছিলেন, এ কথায় প্রতিষ্ঠানটি আগ্রহী হয় কি না। হলোও তা–ই। এমআইটিএসের প্রেসিডেন্ট এড রবার্টস এই দুই তরুণকে সফটওয়্যারটির একটি ডেমো দেখাতে বললেন।

এ কথা শোনার পর গেটস ও অ্যালেন আদাজল খেয়ে নামেন। দেরি হলেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই দুই মাস প্রায় দিনরাত এক করে হার্ভার্ডের কম্পিউটার ল্যাবে বেসিক সফটওয়্যার প্রোগ্রামটি তৈরি করলেন।

ফোর্বস সাময়িকী অনুযায়ী তিনি টানা ১৯৯৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ৪০০ ধনীর তালিকার শীর্ষে ছিলেন। পরে ২০০৯ সাল ও ২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্তও ছিলেন শীর্ষস্থানে। ফোর্বসের ২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, তাঁর মোট সম্পদ প্রায় ১০ হাজার ৭৩০ কোটি ডলার।

অ্যালেন সফটওয়্যারটি নিয়ে নিউ মেক্সিকোর আলবুকারকে এমআইটিএসের অফিসে নিয়ে গেলেন। মজার ব্যাপার হলো, তাঁরা সফটওয়্যারটি বাস্তবে কখনোই আলটেয়ার ৮৮০০ কম্পিউটারে চালিয়ে দেখেননি। তবু ঝুঁকি নিয়ে সেটি টেস্ট রান করালেন। আশ্চর্যজনকভাবে সফটওয়্যারটিও নিখুঁতভাবে কাজ করল।

এড রবার্টস খুব খুশি হলেন। সঙ্গে সঙ্গে অ্যালেনকে চাকরি দিলেন এমআইটিএসে। অল্প কিছুদিন পর গেটসও অ্যালেনের সঙ্গে কাজ করার জন্য পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে হার্ভার্ড ছেড়ে দিলেন।

মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠা

১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে বিল গেটস ও পল অ্যালেন আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের সফটওয়্যার ব্যবসা শুরু করেন। প্রতিষ্ঠানের নাম রাখেন মাইক্রো-সফট। মাইক্রোকম্পিউটার ও সফটওয়্যার—দুটি শব্দ মিলিয়ে নামটি রাখা হয়। প্রথমে নামের মাঝখানে একটি হাইফেন ছিল। এক বছরের মধ্যেই সেটি বাদ দিয়ে নামকরণ করা হয় মাইক্রোসফট।

আলটেয়ার কম্পিউটারে মাইক্রোসফটের সফটওয়্যারটি দারুণভাবে কাজ করেছিল। এ জন্য এমআইটিএস গেটস ও অ্যালেনকে মূল্য পরিশোধ করে এবং মালিকানা স্বত্ব দেয়।

গেটস তাঁর বিপুল পরিমাণ অর্থের বড় একটি অংশ জনমানুষের সেবায় ব্যয় করছেন। ২০০০ সালে তিনি ও তাঁর সাবেক স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের তহবিল নিয়ে ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’ গঠন করেন।

১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে ব্যক্তিগত কম্পিউটারের বাজার দ্রুত প্রসারিত হতে শুরু করে। সে সময় মাইক্রোসফট বুঝে গেল, আগামীর বিশ্বের চাবিকাঠি সফটওয়্যারের হাতেই। গেটস ও অ্যালেন সিদ্ধান্ত নিলেন, শুধু একটি কম্পিউটারের জন্য নয়; বরং বাজারে যত ব্যক্তিগত কম্পিউটার আসবে, সব কটির জন্য সফটওয়্যার তৈরি করবে মাইক্রোসফট।

১৯৮০ সালে বিশ্ববিখ্যাত কম্পিউটার কোম্পানি আইবিএম তাদের নতুন পিসি তৈরি করছিল। কম্পিউটার চালানোর জন্য দরকার ছিল একটি অপারেটিং সিস্টেম বা ওএস। আইবিএম মাইক্রোসফটের কাছে সাহায্য চাইল। মাইক্রোসফট তখনো নিজস্ব ওএস তৈরি করেনি, কিন্তু সুযোগ বুঝে গেটস চমৎকার এক সিদ্ধান্ত নিলেন। শহরের এক ছোট কোম্পানি থেকে কিউডিওস নামের একটি অপারেটিং সিস্টেম কিনলেন। পরে সেটিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নতুন নামে বাজারে আনলেন। নাম দেওয়া হলো মাইক্রোসফট অপারেটিং সিস্টেম বা এমএস-ডিওএস। এটিই হয়ে গেল আইবিএম পিসির প্রাণ।

১৯৭০ সালে সিয়াটলের লেকসাইড স্কুলে বিল গেটস ও তাঁর বন্ধু পল অ্যালেন.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সফটওয় য র ব ল গ টস র পল অ য ল ন ন ম র একট র বন ধ গ টস ও র জন য ব শ বব ক জ কর বছর র ব যবস প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

ওটিপি–নির্ভর প্রতারণা বাড়ছে

দেশে ও বিদেশে দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতারণা ও সাইবার হামলার ঝুঁকি। বিশেষ করে ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড চুরি, ফিশিং ও অত্যাধুনিক এআই-নির্ভর কৌশল এখন সাইবার অপরাধের নতুন হাতিয়ার। সাধারণত প্রতারকেরা ব্যাংক কর্মকর্তা, কাস্টমার সার্ভিস এজেন্ট বা কোনো অনলাইন বিক্রেতা সেজে ফোন করে। তারা বিভিন্ন অজুহাতে যেমন অ্যাকাউন্ট ব্লক হওয়া, পুরস্কার জেতা বা সার্ভিস আপডেটের মতো বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে আপনার ওটিপি জানতে চায়। এ ছাড়া গ্রাহককে একটি ক্ষতিকারক লিংকে ক্লিক করতে প্রলুব্ধ করে প্রতারণা করা হচ্ছে। ব্যবহারকারীর অজান্তে ডিভাইস থেকে ওটিপি বা ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হচ্ছে। এতে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ই-ওয়ালেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি করে বা ডেটা চুরি হচ্ছে।

আজ শনিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাইবার নিরাপত্তা সিম্পোজিয়ামে দেশের শীর্ষ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা এই ক্রমবর্ধমান হুমকি ও এর মোকাবিলা নিয়ে গভীর উদ্বেগ এবং সমাধানের পথ নিয়ে আলাপ করেছেন। বাংলাদেশ সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস ফোরাম (বিডিসাফ) আয়োজন করে এই সিম্পোজিয়ামের। দিনব্যাপী সিম্পোজিয়ামে বিভিন্ন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের ১২০ জন কর্মকর্তা ও পেশাজীবী অংশ নেন। রাজধানীর মহাখালীর সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ব্রেন স্টেশন-২৩ মিলনায়তনে সিম্পোজিয়াম আয়োজন করা হয়।

সিম্পোজিয়ামে বিশেষজ্ঞরা জানান, সহজলভ্য ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহারের কারণে সাধারণ মানুষ এখন অনলাইন প্রতারকদের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছে। বিশেষত আর্থিক লেনদেন ও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টগুলোতে প্রবেশের জন্য অপরিহার্য ওটিপি চুরি একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতারকেরা বিভিন্ন ফিশিং লিংক, ভুয়া কল বা টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য ও ওটিপি হাতিয়ে নিচ্ছে। ফলে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। সিম্পোজিয়ামের একাধিক কারিগরি অধিবেশনে ব্যাংকিং ও টেলিযোগাযোগ খাতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা জানান, নেটওয়ার্ক, অ্যাপ্লিকেশন ও সিস্টেমে শক্তিশালী টুলস ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরাপদ করা যেতে পারে। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া এই ধরনের প্রতারণা সম্পূর্ণভাবে ঠেকানো সম্ভব নয়।

বিডিসাফ সিম্পোজিয়ামের মূল আকর্ষণ ছিল ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রতারণার দ্বন্দ্ব: তথ্য সুরক্ষার যুগে বাংলাদেশের সাইবার প্রতিরক্ষা পুনর্নির্মাণ’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনা। আলোচকেরা জানান, এআই যেমন মানবজীবন ও কাজের ধারাকে উন্নত করছে, তেমনি এটি ডিপফেক, ভুয়া পরিচয় তৈরি এবং তথ্য ফাঁসের (ডেটা লিক) মতো নতুন ধরনের সাইবার অপরাধের আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। প্রযুক্তিবিদ শায়েরুল হক জোয়ার্দার এবং এপনিকের নির্বাহী কাউন্সিলের সদস্য সুমন আহমেদ সাবিরের মতো বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী এআইয়ের ব্যবহার বাড়ায় ডিপফেক ভিডিও ও ভুয়া পরিচয় দিয়ে প্রতারণা এখন একটি আধুনিক সাইবার হুমকির রূপ নিয়েছে। এই এআই-নির্ভর প্রতারণা মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাইবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন এবং তথ্য সুরক্ষা নীতিমালা আরও শক্তিশালী করার সময় এসেছে। প্যানেল আলোচনা পরিচালনা করেন বিডিসাফের সাধারণ সম্পাদক মোহিব্বুল মোক্তাদীর।

বাংলাদেশ এরই মধ্যে আর্থিক খাত এবং সরকারি সেবায় এআইয়ের ব্যবহার শুরু করেছে। কিন্তু এই প্রযুক্তির মাধ্যমে একটি সাইবার সহনশীল প্রযুক্তিকাঠামো গড়ে তোলা এবং এর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। টেলিযোগাযোগ পেশাজীবীরা ক্লাউড অবকাঠামো এবং জিরো ট্রাস্ট নেটওয়ার্ক ব্যবহারের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে আলাপ করেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, সরকার তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্তরে ডিজিটাল রূপান্তর চালাচ্ছে। প্রাথমিক স্তরে ডেটা নিরাপত্তা ও সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়নসহ ন্যাশনাল ডেটা গভর্ন্যান্স অথরিটি গঠন করা হচ্ছে। তিনি আরও আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে ফ্রিল্যান্সারদের জন্য শিগগরই সময়োপযোগী নীতিমালা আসছে।

প্রযুক্তিবিদ আবুল কালাম আজাদ তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন টুলস ব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক, অ্যাপ্লিকেশন ও সিস্টেম নিরাপদ করা যেতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা করেন। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করছেন বিডিসাফের সভাপতি প্রেসিডেন্ট মো. জোবায়ের আল মাহমুদ।

দিনব্যাপী কারিগরি অধিবেশন পরিচালনা করেন টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, সফটওয়্যার নির্মাতাসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তি–বিশেষজ্ঞরা। কারিগরি অধিবেশনে অংশ নেন ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির তথ্য নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, ইন্টারনেট সেবা প্রতিস্থান লিংক-থ্রির প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা রকিবুল হাসান, গ্রামীণফোনের হেড অব সিকিউরিটি অপারেশন সেন্টার রাসকিন পাল, সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিস্থান ব্রেন স্টেশন ২৩-এর প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান, বাংলাদেশ পুলিশের এসপি খালেদা বেগম, বাংলা লিংকের আইটি নেটওয়ার্ক ও সিকিউরিটি অপারেশন প্রধান এস এম আল মায়মুন, তথ্যপ্রযুক্তি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এস এম রুবায়েত ইসলাম, রবির জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক সামিনুল ইসলাম তরফদার, প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান টেক নোভেল্টি লিমিটেডের এ কে এম নুরুল আলাম ও ব্রেন স্টেশন ২৩-এর সলিউশন আর্কিটেক্ট আনোয়ার হোসাইন।

আয়োজনে সহযোগী ছিল ব্রেন স্টেশন ২৩ ও লিডিং এজ টেকনোলজি। প্রসঙ্গত, বিডিসাফ একটি তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবীদের ফোরাম। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পেশাজীবী সংগঠনটি প্রতি বছর একাধিক আয়োজনে প্রযুক্তি অবকাঠামো, সাইবার নিরাপত্তা ও তথ্যপ্রযুক্তির সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সিম্পোজিয়াম আয়োজন করছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ওটিপি–নির্ভর প্রতারণা বাড়ছে