পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে দেশের ব্যাংক খাত ব্যাপক লুটপাটের মধ্যে পড়েছিল। এর ফলে ব্যাংকগুলোর প্রায় ৩৫ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। পাঁচটি ব্যাংকে এই হার ৯০ শতাংশে পৌঁছেছে।

বক্তারা মনে করেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে এসব ব্যাংক একীভূত করে নতুন ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাতে পুনর্গঠনের কাজ সম্পন্ন হবে না। ব্যাংক খাতে আরও বহু সংস্কার প্রয়োজন, যা আগামী সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য একটি ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠনেরও সুপারিশ উঠে আসে গোলটেবিল আলোচনা থেকে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতা ও রেজল্যুশন প্রয়াস: উদ্যোগ ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। সভায় সভাপতিত্ব করেন পিআরআই চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার।

জায়েদি সাত্তার বলেন, ব্যাংকিং খাতের ‘রক্তক্ষরণ’ কিছুটা থেমে এসেছে এবং স্থিতিশীলতা ফিরছে। আগামী বছর দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁর আশা, ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন জাতির জন্য বড় উপহার হবে এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকার প্রত্যাশানুযায়ী অর্থনৈতিক নীতি পরিচালনা করবে।

ট্রুথ কমিশন গঠনের প্রস্তাব

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সময়কার অনিয়মের শিকড়ে পৌঁছানো জরুরি। প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে পরিস্থিতি আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে। এ জন্য তিনি অর্থনৈতিক অপরাধ, খেলাপি ঋণ ও ঋণ সৃষ্টির প্রক্রিয়া তদন্তে ‘একটি ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠনের’ প্রস্তাব দেন।

লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ‘সরকার বদলের পর কাজ শুরু করার সময় দেখি যে বহু তৈরি পোশাক কারখানার মালিক আগের সরকারের ঘনিষ্ঠতার কারণে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন; বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকেরা রাস্তায় অবস্থান করছিলেন। সরকারকে তহবিল জোগাড় করতে হয়েছিল; আবার কোথাও কোম্পানির নিজস্ব অর্থ আছে কি না, তা খুঁজে দেখতে হয়েছে।’

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দেখা যায়, বহু প্রতিষ্ঠানকে যে ঋণ দেওয়া হয়েছিল, তার হিসাবই স্পষ্ট নয়। ২২ হাজার থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেখানো হয়। অর্থাৎ ৪ হাজার কোটি টাকার হিসাবই নেই। কাকে ঋণ দেওয়া হয়েছে, অনেক প্রতিষ্ঠান তো কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিতই নয়। অর্থাৎ আমরা জানিই না কোন সত্তাকে অর্থ দেওয়া হয়েছে।’

লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ‘একই ভুল ভবিষ্যতে এড়াতে হলে আচরণের পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমালোচনা করলে “আদালত অবমাননা” হওয়ার মতো পরিবেশ থাকা উচিত নয়। তদারকির গাফিলতির দায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভেতরের কর্মকর্তাদেরও নিতে হবে।’

বাংলাদেশে যেভাবে পাঁচ ব্যাংক একীভূত হচ্ছে, বিশ্বের কোথাও এভাবে ব্যাংক উদ্ধার করা হয়নি। এসব ব্যাংকের ৯০ শতাংশ অর্থ পাচার হয়ে গেছে, এটাও বিশ্বে বিরল।মোহাম্মদ জহির হোসেন, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

আরও সংস্কারের দাবি

মূল প্রবন্ধে পিআরআইয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কার্যকর প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, তদারকি সক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ কাঠামো গড়ে তুলতে না পারলে এটি কাগুজে প্রতিশ্রুতিতেই সীমিত থাকবে। সংকটাপন্ন ব্যাংক পরিচালনা, আমানতকারীর সুরক্ষা ও পদ্ধতিগত ঝুঁকি কমানোর দক্ষতা তৈরি করাই সবচেয়ে বড় কাজ।

আশিকুর রহমান আর্থিক অপরাধ তদারকিতে পৃথক ইউনিট গঠন, পেশাদার সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন ও আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করায় জোর দেন।

প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান তানজিল চৌধুরী বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের অর্থনীতিতে ফেরার কোনো সুযোগ থাকা উচিত নয় এবং তাঁদের নতুন ঋণ দেওয়া যাবে না। পরিচালক হওয়ার ক্ষেত্রে ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের শর্ত বাদ দিয়ে পরিবারভিত্তিক শেয়ারসীমা নির্ধারণের আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ আখতার হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণের উচ্চহার মুদ্রাস্ফীতিকে প্রভাবিত করছে এবং মুদ্রানীতি প্রণয়নে সমস্যা তৈরি করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ জহির হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে যেভাবে পাঁচ ব্যাংক একীভূত হচ্ছে, বিশ্বের কোথাও এভাবে ব্যাংক উদ্ধার করা হয়নি। এসব ব্যাংকের ৯০ শতাংশ অর্থ পাচার হয়ে গেছে, এটাও বিশ্বে বিরল।’ তিনি জানান, পরবর্তী ধাপে আরও কিছু ব্যাংক ও ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রেজল্যুশনের আওতায় আসবে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসরুর আরেফিন বলেন, দেশে কোনো ব্যাংককে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। পাঁচ ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ যৌক্তিক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ব্র্যাক ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আহমেদ রশিদ বলেন, একীভূত ব্যাংকের গ্রাহকেরা কত শতাংশ আমানত ফেরত পাবেন এবং কত শতাংশ শেয়ার পাবেন, এটাই সাফল্য নির্ধারণ করবে। পুরো খাতের প্রকৃত খেলাপি ঋণ হিসাবে আনতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক এক ভ ত ন বল ন সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশ ও মঙ্গোলিয়ার মধ্যে ভিসা অব্যাহতি চুক্তি স্বাক্ষরিত

বাংলাদেশ এবং মঙ্গোলিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য পারস্পরিক ভিসা অব্যাহতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। 

বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

বাংলাদেশের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি। মঙ্গোলিয়ার পক্ষে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মঙ্গোলিয়ার অনাবাসিক রাষ্ট্রদূত গ্যানবোল্ট তামবাযাও। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি।

অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলেন, ‘‘আমাদের উচিত এই কূটনৈতিক সদিচ্ছাকে ব্যবসা-বাণিজ্যিক যোগাযোগে রূপান্তর করা যেন আমাদের অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের পূর্ণ সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয়।”

মঙ্গোলিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, “কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের অনুকূলে ভিসা অব্যাহতি চুক্তির পাশাপাশি সর্বসাধারণের জন্যও ভিসা অব্যাহতি চুক্তি করা যেতে পারে।”

মঙ্গোলিয়ার প্রতিনিধিদলে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মঙ্গোলিয়ার অনাবাসিক রাষ্ট্রদূত গ্যানবোল্ট তামবাযাও ও মঙ্গোলিয়ায় বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুল জেনারেল, নাসরিন ফাতেমা আউয়াল। 

বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিরাগমন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ফয়সল আহমেদ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত উইং) মোহাম্মদ নুরে আলম প্রমুখ।

বাংলাদেশ এবং মঙ্গোলিয়ার মধ্যে পারস্পরিক ভিসা অব্যাহতি চুক্তিতে মোট ১১টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এটি স্বাক্ষর হওয়ার ফলে উভয় দেশের কূটনৈতিক এবং অফিসিয়াল পাসপোর্টধারী নাগরিক অপর পক্ষের ভূখণ্ডে প্রবেশ, বহির্গমন ও ট্রানজিটের ক্ষেত্রে অনধিক ৩০ দিনের জন্য ভিসা ছাড়াই অবস্থান করতে পারবেন। এ চুক্তি অনির্দিষ্টকালের জন্য বলবৎ থাকবে। চুক্তিবদ্ধ যে কোনো পক্ষ ৯০ দিনের লিখিত নোটিশ প্রদানের মাধ্যমে এ চুক্তির অবসান ঘটাতে পারবে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বি-পাক্ষিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক অধিকতর ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভিসা অব্যাহতি চুক্তি সম্পাদন করা হয়। এ পর্যন্ত ৩৪ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ভিসা অব্যাহতি চুক্তি সই হয়েছে।

ঢাকা/এএএম/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ