পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গত ২৭ এপ্রিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের জন্য শর্ত সাপেক্ষে মানবিক করিডর দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে রাজি হয়েছে।

সেই থেকে দেশে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে মানবিক করিডর। রাজনৈতিক দলগুলো এর বিরোধিতা করছে। বিশ্লেষকেরা নানা বিষয় সামনে আনছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে, মানবিক করিডর কী? মানবিক করিডর নিয়ে এত বিতর্ক কেন? মানবিক করিডর দেওয়া হলে বাংলাদেশের জন্য কী কী ঝুঁকি তৈরি হবে?

বিশ্বব্যাপী শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল বলছে, মানবিক করিডর মূলত একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিরাপদ প্যাসেজ (চলাচলের পথ), যা নিয়ে সংঘর্ষরত পক্ষগুলোর মধ্যে চুক্তি হয়। এই করিডর নাগরিকদের যাতায়াতসহ মানবিক সহায়তা দিতে বা আহত, অসুস্থ বা মৃত মানুষদের সরিয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সান ডিয়েগোর একাডেমিক ডিরেক্টর ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অধ্যাপক টোফার ম্যাকডুগাল বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেছেন, মানবিক করিডর হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিরস্ত্রীকৃত এলাকা বা পথ, যার মাধ্যমে ত্রাণসামগ্রী ও সহায়তা পাঠানো যায় এবং বেসামরিক মানুষ ও স্বেচ্ছাসেবীরা নিরাপদে চলাচল করতে পারেন।

অধ্যাপক ম্যাকডুগাল আরও বলেন, যদিও মানবিক করিডর নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত, তারপরও অনেক সময় এগুলো অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। অনেক সময় বিবদমান পক্ষগুলো তাত্ত্বিকভাবে শর্তে রাজি হলেও বাস্তবে তা মানে না।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাখাইনে খাদ্য নিয়ে কোনো ট্রাক বা গাড়ি ঢুকতে বাধা দিচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। রাখাইন রাজ্যে সংঘাত, সহিংসতা ও খাদ্যসংকটের কারণে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত আছে।শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের হিসাবে, গত ১ বছরে ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে।

এর দুঃখজনক উদাহরণ দেখা গেছে ২০২২ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধে। যুদ্ধবিরতির শর্তে রাজি হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেন অভিযোগ করে যে রাশিয়া হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিক্রিয়ায় রুশ কর্মকর্তারা বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধবিরতির সময় প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান জোরদার করায় রাশিয়া আবার আক্রমণ করেছে।

আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে ফিলিস্তিনে। ২০২৩ সালের শেষ দিকে গাজা উপত্যকায় ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চলে ইসরায়েলি সেনারা স্কুল, আবাসিক ভবন ও শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্র লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করেছিল।

মানবিক করিডরের উদ্দেশ্য

মানবিক করিডর একটি নির্দিষ্ট এলাকায় খাবার, চিকিৎসাসহায়তা এবং অন্যান্য জরুরি সামগ্রী পরিবহনের সুযোগ তৈরি করে।

জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, মানবিক করিডর হলো আন্তর্জাতিক আইনের অধীন এমন এক চুক্তি, যার উদ্দেশ্য হলো বিপদে থাকা মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী, খাবার ও পোশাক দ্রুত ও নির্বিঘ্নে পৌঁছানো। এ ছাড়া যুদ্ধে আটকে পড়া নাগরিকদের জন্য মানবিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা।

১৯৯০ সালে জাতিসংঘে মানবিক করিডরের প্রস্তাব পাস হয়। রাজনৈতিক বা সামরিক উদ্দেশ্যে নয়, মানবিক দিক বিবেচনা করে বিষয়টির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

যুদ্ধের ইতিহাসে মানবিক করিডর

পৃথিবীর বিভিন্ন যুদ্ধ-সংঘাতে সাধারণ মানুষকে খাদ্য, ওষুধসহ দরকারি জিনিসপত্রের জোগান দিতে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক উদ্যোগে বিভিন্ন সময় মানবিক করিডর স্থাপন করা হয়েছে।

ককেশাসীয় অঞ্চলের তেলসমৃদ্ধ দেশ আজারবাইজান। কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মাঝখানে অবস্থিত দেশটির সঙ্গে জাতিগত দ্বন্দ্বে জড়ায় আর্মেনিয়া। দেশ দুটির মধ্যে প্রথম যুদ্ধ বাধে ১৯৮৯ সালে। ইতিহাসে সেটি নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধ নামে পরিচিত।

নাগোরনো-কারাবাখের সঙ্গে আর্মেনীয়দের যোগাযোগের জন্য আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় যে করিডর চালু করা হয়েছিল, সেটির নাম ছিল লাচিন। এই লাচিন করিডরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল রুশ সেনাবাহিনী। তবে সেটি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। দুই বছরের মধ্যেই আজারবাইজান সরকার সেটি বন্ধ করে দেয়।

২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রের উদ্যোগে নিরাপদ অঞ্চল বা ‘নো-ফ্লাই জোন’ স্থাপন করা হয়েছিল। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের একপর্যায়ে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে আলেপ্পো শহরে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে বেশ কিছু পরিবারের সদস্যসহ অন্যদের বের করে আনতে মানবিক করিডর স্থাপন করা হয়েছিল। এর উদ্যোগ নিয়েছিল রাশিয়া।

আফ্রিকার দেশ কঙ্গোয় ২০০৮ সালে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও জেনারেল লরেন্ট নকুন্ডার নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে গোমা অঞ্চলে একটি মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

‘মানবিক করিডর একটি “বিতর্কিত” পদক্ষেপ। আমাদের এ মুহূর্তে মানবিক হওয়ার সুযোগ নেই। এটা জাতীয় স্বার্থের বিষয়। আরাকানকে মানবিক করিডর দেওয়া হলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়া প্রলম্বিত হতে পারে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ সিদ্দিকী

বসনিয়া যুদ্ধের সময় ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার মাধ্যমে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল সেব্রেনিৎসা ছিটমহলকে নিরাপদ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। যদিও সে বছরই আরেক প্রস্তাবের মাধ্যমে সারায়েভো, জেপা, গোরাজদে, তুজলা ও বিহাচ অঞ্চলকেও যুক্ত করে ছয়টি মানবিক করিডর করা হয়েছিল।

যদিও ১৯৯৫ সালে সেব্রেনিৎসা মানবিক করিডর এলাকায় গণহত্যা সংঘটিত হয়। এটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের ‘নৃশংসতম গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

বাংলাদেশে আলোচনা

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গত ২৭ এপ্রিল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের জন্য শর্তসাপেক্ষে মানবিক করিডরের বিষয়টি সামনে আনার পর ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ২৯ এপ্রিল নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লেখেন, রাখাইন রাজ্যে যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে মানবিক সাহায্য দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সাপোর্ট (কারিগরি সহায়তা) দিতে রাজি হবে। এটাই বাংলাদেশের অবস্থান।

অন্যদিকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা-সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান ৪ মে বাংলাদেশ ইউনির্ভাসিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) মিলনায়তনে এক সেমিনারে বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মানুষের জন্য মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি।

সরকার মানবিক করিডর নিয়ে কোনো আলোচনা না করায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৮ এপ্রিল ঠাকুরগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘সরকারের উচিত ছিল, দায়িত্ব ছিল বিষয়টা নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলা। এটা কথা না বলে তারা (সরকার) এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ দেওয়ার জায়গা দিচ্ছে।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। জাতিসংঘ যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে এটা হতে হবে সব মানুষের সমর্থনে।’

এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা জড়িত আছে বলে উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল।

অন্যান্য রাজনৈতিক দলও মানবিক করিডর নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

মানবিক করিডরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও। ৩০ এপ্রিল রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।

রাখাইনের অবস্থা

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রাখাইন আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলছে। সেখানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছে বিভিন্ন সংস্থা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাখাইনে খাদ্য নিয়ে কোনো ট্রাক বা গাড়ি ঢুকতে বাধা দিচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। রাখাইন রাজ্যে সংঘাত, সহিংসতা ও খাদ্যসংকটের কারণে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত আছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের হিসাবে, গত ১ বছরে ১ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, মানবিক করিডরের উদ্দেশ্য হিসেবে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যসহায়তা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এটি দেওয়া সম্ভব হলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাবে। সে ভাবনা থেকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার মানবিক করিডর দেওয়ার বিষয়টি চিন্তা করে থাকতে পারে।

ঝুঁকি কোথায়

মানবিক করিডর দিলে বাংলাদেশের ঝুঁকি কোথায়, তা জানতে দুজন বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক ও একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক।

তাঁরা হলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.

) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ সিদ্দিকী এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ এস এম আলী আশরাফ।

আ ন ম মুনীরুজ্জামান কয়েকটি বিষয় সামনে এনেছেন। প্রথমত, রাখাইনে মানবিক করিডর স্থাপনের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে স্বচ্ছতা নেই। মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জটিল সংঘাতে বাংলাদেশের জড়িয়ে পড়া উচিত হবে না।

দ্বিতীয়ত, মানবিক করিডর দেওয়ার সিদ্ধান্তটি কঠিন, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। এটি পরিচালনার পাশাপাশি নিরাপত্তা দিতে হয়। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে বাংলাদেশের স্থল ও আকাশপথে ঝুঁকি আসবে।

তৃতীয়ত, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। তাদের সীমান্ত অনুমতি ছাড়া অতিক্রম করলে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হবে। দেশটির সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হবে। মিয়ানমার এটি প্রতিহত করতে সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারে।

মানবিক করিডরের নামে খাদ্য ও ত্রাণ ছাড়া অন্য কিছু যেন না যায়, তা নিশ্চিত করার বিষয় রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ এস এম আলী আশরাফ। তিনি বলেন, করিডরের নামে খাদ্যসহায়তার পাশাপাশি যদি আরাকানে অস্ত্র বা গোলাবারুদ ঢোকে, যদি ‘মিলিটারাইজেশন’ হয়, তাহলে পরিস্থিতি জটিল হবে। জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়, এমন কাজ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরত থাকা উচিত।

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, ‘মানবিক করিডর একটি “বিতর্কিত” পদক্ষেপ। আমাদের এ মুহূর্তে মানবিক হওয়ার সুযোগ নেই। এটা জাতীয় স্বার্থের বিষয়। আরাকানকে মানবিক করিডর দেওয়া হলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়া প্রলম্বিত হতে পারে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ সিদ্দিকী আরও বলেন, যাদের জন্য মানবিক করিডর দেওয়ার কথা চিন্তা করা হচ্ছে, সেই রাখাইন আর্মির তো কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। রাখাইন আর্মিকে মানবিক করিডরের নামে খাদ্যপণ্যের আড়ালে অস্ত্র দেওয়া হলে বা অস্ত্র ঢুকলে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এই অধ্যাপক আরও বলেন, মনে রাখতে হবে, জান্তা সরকারকে চীন সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে। সুতরাং এই ইস্যুতে ভবিষ্যতে চীনের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে।

আরও পড়ুনরাখাইনে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের২৭ এপ্রিল ২০২৫আরও পড়ুন‘মানবিক করিডর’ নিয়ে চুক্তি হয়নি০৫ মে ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র খ ইন র জ য র জন ত ক দ র জন য শরণ র থ সরক র র উপদ ষ ট ন র পদ হয় ছ ল আম দ র ব ষয়ট অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

তাহলে কি অ্যাপলের কারখানা আর চীন থেকে ভারতে যাচ্ছে না

ভারতের ‘বিশ্ব কারখানা’ হয়ে ওঠার স্বপ্ন বহুদিনের। এই স্বপ্ন পূরণের পথে যখন অগ্রগতির অল্পস্বল্প ইঙ্গিত মিলছিল, ঠিক তখনই ওয়াশিংটন ও বেইজিং নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের ঘোষণা দিল। তাদের এই ঘোষণা চীনকে সরিয়ে ভারতের বৈশ্বিক উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন পূরণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

চীনের ওপর বিশাল আকারের শুল্কারোপ থেকে সরে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত সপ্তাহে দুই দেশের প্রতিনিধিরা সুইজারল্যান্ডে একটি চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করার পর রাতারাতি চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক ১৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। ভারতের ওপর ২৭ শতাংশ শুল্কারোপ করেছেন ট্রাম্প।

দিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অজয় শ্রীবাস্তব মনে করেন, ওয়াশিংটন-বেইজিং বাণিজ্যিক সমঝোতার ফলে যেসব উৎপাদনবিষয়ক বিনিয়োগ উদ্যোগ চীন থেকে ভারতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, এখন সেগুলো হয় থেমে যাবে অথবা আবার চীনে চলে যাবে।

অজয় আরও বলেন, ভারতের কম খরচে পণ্য উৎপাদনব্যবস্থা হয়তো টিকে যাবে, কিন্তু মানগত বৃদ্ধি ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে।

গত মাসে মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান অ্যাপল তাদের আইফোন তৈরির বেশির ভাগ কারখানা চীন থেকে সরিয়ে ভারতে নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিল। দিল্লিতে তখন যে উৎসাহ ও আশাবাদ দেখা গিয়েছিল, সাম্প্রতিক মনোভাব তার পুরো বিপরীত চিত্র তুলে ধরছে।

যদিও অ্যাপলের আইফোন তৈরির কারখানা চীন থেকে ভারতে স্থানান্তরের সম্ভাবনা এখনো পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। অ্যাপল এ বিষয়ে এখনো মুখ খোলেনি।

যদিও অ্যাপলের আইফোন তৈরির কারখানা চীন থেকে ভারতে স্থানান্তরের সম্ভাবনা এখনো পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। অ্যাপল এ বিষয়ে এখনো মুখ খোলেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য নিজেই চান না, অ্যাপল ভারতে তাদের কারখানা নির্মাণ করুক। এ বিষয়ে ট্রাম্প একবার বলেছিলেন, তিনি অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিম কুককে ভারতে কারখানা নির্মাণ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি, উচ্চ শুল্ক আরোপ করা দেশগুলোর একটি ভারত।

এ বিষয়ে ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ শিলান শাহ বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পণ্য সরবরাহে ভারত খুব ভালোভাবে চীনের বিকল্প দেশ হয়ে উঠতে পারে। যদিও এ কথা তিনি সুইজারল্যান্ডে ওয়াশিংটন-বেইজিং বৈঠকের আগে বলেছিলেন।

সে সময় শিলান শাহ আরও বলেছিলেন, ভারত যুক্তরাষ্ট্রে সেসব পণ্য রপ্তানি করে, তার ৪০ শতাংশ পণ্য চীন যেসব পণ্য রপ্তানি করে, তার সঙ্গে মেলে।

শুল্কারোপের কারণে চীনের পণ্য সরবরাহে যে শূন্যতা তৈরি হচ্ছিল, তা পূরণে ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা আগেভাগেই প্রস্তুত হয়ে আছেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, ভারতে নতুন রপ্তানি আদেশ ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

এখন ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের যে ঘোষণ আসতে চলেছে, তাতে নয়াদিল্লির স্বপ্ন ভাঙতে যাচ্ছে।

কয়েকজন বিশ্লেষক অবশ্য এখনো তেমনটা মনে করছেন না। বরং তাঁরা বিশ্বাস করেন, কৌশলগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে বিশাল দূরত্ব এখনো রয়ে গেছে, তাতে ভারত দীর্ঘ মেয়াদে লাভবান হবে।

শুল্কারোপের কারণে চীনের পণ্যসরবরাহে যে শূন্যতা তৈরি হচ্ছিল, তা পূরণে ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা আগেভাগেই প্রস্তুত হয়ে আছেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে যে ভারতে নতুন রপ্তানি আদেশ ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

একটি সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করছে। এর মধ্যে চীন ত্যাগের যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তা এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতকে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। বৈশ্বিক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য সরবরাহব্যবস্থা বৈচিত্র্যময় করতে তাদের কার্যক্রম অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে।

আরও পড়ুনআইফোনের কারখানা সরালে কার বেশি ক্ষতি হবে ভারত নাকি যুক্তরাষ্ট্রের১৬ মে ২০২৫

ভারতের বৈশ্বিক কারখানা হয়ে ওঠার আশা ভেস্তে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হওয়ার কারণ শুধু চীন একা নয়, বরং এশিয়ার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেশও এই প্রতিযোগিতায় রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ সোনাল ভার্মা ও অরুদিপ নন্দী।

জাপানের বৃহৎ আর্থিক সেবা ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান নমুরার এই দুই অর্থনীতিবিদ বলেন, বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো ভিয়েতনামের মতো দেশের ওপর থেকে তাদের নজর পুরোপুরি সরিয়ে নেয়নি।

এ মাসের শুরুতে এই দুই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, সুতরাং, ভারতের জন্য এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে শুধু শুল্কভিত্তিক সুবিধা নিলেই হবে না, বরং ব্যবসা সহজীকরণে বাস্তব ও কার্যকর সংস্কার নিশ্চিত করাও জরুরি।

আরও পড়ুনঅ্যাপল ভারতে নয়, যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য উৎপাদন করুক: চান ট্রাম্প১৫ মে ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ