আজকের দুনিয়ায় প্রতিমুহূর্তে আমরা নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই। মানসিক চাপ, অর্থনৈতিক অস্থিরতা, সমাজের বিভেদ—এসবের মধ্যে মানুষ একটা অভ্যন্তরীণ ভরসা খোঁজে, যা তাকে স্থিতিশীল রাখবে এবং হৃদয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনবে। মানুষের জন্য ইমান ছাড়া কোনো ভরসা নেই।
ইমান কেবল বিশ্বাস নয়, এটি জীবনের শক্তির উৎস ও হৃদয়ের শান্তির চাবিকাঠি। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা ইমান এনেছে এবং তাদের হৃদয়গুলো আল্লাহর জিকিরে শান্তি লাভ করে। জানো, আল্লাহর জিকিরেই হৃদয়গুলো শান্তি লাভ করে।’ (সুরা রাদ, আয়াত: ২৮)
এ আয়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, টাকাপয়সা বা পদমর্যাদা দিয়ে কেনা যায় না এমন শান্তি, তা ইমানের মাধ্যমেই আসে। এটি একটি অলৌকিক শক্তি, যা মানুষকে দুর্যোগের মধ্যেও দাঁড়িয়ে থাকতে শেখায় এবং জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে।
ইমানের এ রহস্য কোনো নতুন কথা নয়। মহানবী মুহাম্মদ (সা.
এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, ইমান মানুষকে সুখ-দুঃখের দোলাচলে ভাসিয়ে নিয়ে যায় না, বরং প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে শিক্ষা ও উন্নতির সুযোগে পরিণত করে। সুখে কৃতজ্ঞতা বাড়ায়, দুঃখে ধৈর্য শেখায়—এভাবে ইমান মানুষকে অপরাজেয় করে তোলে। আজকের দ্রুতগতির জীবনে যেখানে একটা খারাপ খবরেই মানুষ ভেঙে পড়ে, সেখানে ইমানের এ শক্তি আমাদের অবিচল রাখতে পারে।
ইমানের শক্তি: ঐতিহাসিক সাক্ষ্যইসলামের ইতিহাসে ইমানের শক্তির অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আহজাব যুদ্ধের ঘটনা তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।
মক্কার কাফিররা ও ইহুদি গোত্রগুলো মিলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে এক বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিল। মদিনার চারপাশ ঘিরে ফেলা হয়েছে। খাদ্য-পানির অভাব, ঠান্ডা, ক্ষুধা—সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ। কিন্তু মুসলিমরা ভেঙে পড়েননি।
কেন? কারণ, তাঁদের ইমান তাঁদের শক্তি দিয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এবং এতে তাদের বাড়িয়েছে কেবল ইমান ও আত্মসমর্পণ।’ (সুরা আহজাব, আয়াত: ২২)
ওই সময় মহানবী (সা.)-এর দোয়া ও সাহাবিদের ইমানের জোরে আল্লাহর সাহায্য এসেছে—ঝড় উঠেছে, যা শত্রুদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছে। এ ঘটনা দেখায়, ইমান কেবল মনের শক্তি নয়, এটি বাস্তব ঘটনাকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা।
আরেকটি উদাহরণ হলো হজরত আয়েশা (রা.)-এর জীবন। তরুণী বয়সে ফিতনার অভিযোগে তিনি যে কষ্ট সহ্য করেছেন, তা কল্পনার অতীত। কিন্তু তাঁর ইমান তাঁকে ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছে। কোরআনে আল্লাহ তাঁর নির্দোষ ঘোষণা করেছেন এবং বলেছেন, ‘আর ধৈর্য ধরো, তোমার ধৈর্য তো আল্লাহ ছাড়া সম্ভব নয়।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ১২৭)
এ ধৈর্য ইমান থেকে উদ্ভূত, যা তাঁকে কেবল বাঁচিয়ে রাখেনি; বরং ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দিয়েছে। এসব ঘটনা আমাদের বলে যে ইমান কোনো অদৃশ্য জিনিস নয়। এটি যুদ্ধক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত সংকটে বা সমাজের ঝড়ে আমাদের অটল করে রাখে।
আধুনিক যুগেও এ শক্তির প্রমাণ দেখা যায়। কল্পনা করুন, একজন তরুণ উদ্যোক্তা, যার ব্যবসা ব্যর্থ হয়ে যায়, ঋণের চাপে ভুগছে। সাধারণ মানুষ হলে হতাশায় ভেঙে পড়ত। কিন্তু ইমানি দৃষ্টিতে যখন সে এটাকে পরীক্ষা মনে করে, তখন ধৈর্য ধরে নতুন পথ খোঁজে।
ফলে সে শুধু উঠে দাঁড়ায় তা নয়; বরং আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ শক্তি আসে কোথা থেকে? ইমান থেকে, যা মানুষকে বলে যে সবকিছু আল্লাহর হাতে এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাবে।
আরও পড়ুনইমান শক্তিশালী করার ১০ উপায়১০ জুন ২০২৫ইমানের শান্তি: হৃদয়ের স্থিরতাইমানের শক্তি যেমন বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে, তেমনি এটি অভ্যন্তরীণ শান্তির উৎস। আজকের দুনিয়ায় মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা বেড়েছে—উদ্বেগ, বিষণ্নতা, একাকিত্ব। ওষুধ বা থেরাপি সাময়িক সাহায্য দিতে পারে, কিন্তু স্থায়ী শান্তি আসে ইমানের মাধ্যমে।
কোরআনের সেই আয়াত (সুরা রাদ, আয়াত: ২৮) আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আল্লাহর স্মরণই হৃদয়কে শান্ত করে। জিকির, নামাজ, দোয়া—এগুলো কেবল আচার নয়; বরং মনের শুশ্রূষা।
ইমান মানুষকে রাগ, ঈর্ষা বা প্রতিহিংসার শিকল থেকে মুক্ত করে। এটি আমাদের শেখায় যে সবকিছুর পেছনে আল্লাহর হিকমত আছে। একজন মুমিন যখন কষ্ট পান, তা কেন, কী শিক্ষা? এ চিন্তা তাঁকে শান্ত রাখে।
মহানবী (সা.)-এর জীবন এর উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁর ওপর যে কত বিপদ এসেছে—তাইফের যন্ত্রণা, শিয়াবে আবি তালিবে বর্জন, হিজরতের কষ্ট, যুদ্ধের আঘাত। কিন্তু তাঁর হৃদয় সর্বদা শান্ত ছিল। কারণ, তাঁর ইমান অটল ছিল। এ শান্তি কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটি সমাজকেও প্রভাবিত করে। একজন মুমিনের ধৈর্য ও ক্ষমা অন্যদের অনুপ্রাণিত করে, সমাজে শান্তি ছড়ায়।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানও এখন ইমানের এ শক্তি স্বীকার করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষের চাপ কমায় ও মানসিক স্থিতিশীলতা বাড়ায়। কিন্তু ইসলামের ইমান এর থেকে অনেক গভীর—এটি কেবল মনের শান্তি নয়, জীবনের উদ্দেশ্য দেয়। যখন আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করি, তখন জীবনের অনিশ্চয়তা আর ভয় লাগে না। এটি আমাদের বলে, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কারণ, আল্লাহ আছেন।
আধুনিক যুগে ইমানের প্রভাবআজকের বিশ্বে প্রযুক্তির দৌড়, সোশ্যাল মিডিয়ার চাপ, অর্থনৈতিক অস্থিরতা—এসব মানুষকে ক্লান্ত করে দিচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা বিশ্বব্যাপী বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইমানের প্রতি ফিরে আসা কোনো বিকল্প নয়; বরং অপরিহার্য। ইমান আমাদের শক্তি দেয় বাস্তবের মুখোমুখি হতে এবং শান্তি দেয় হৃদয়ে। এটি আমাদের শেখায়, কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার ঈর্ষা থেকে মুক্ত হয়ে কৃতজ্ঞতায় জীবন যাপন করতে হয়।
আজকের তরুণ সোশ্যাল মিডিয়ার চাপে বিষণ্ন হন, কিন্তু ইমান তাঁদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যিকারের সৌন্দর্য হৃদয়ে। এটি তাঁদের উদ্যোগী করে তোলে, সমাজের জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করে।
ইমান হলো জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, যা শক্তি দেয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং শান্তি দেয় হৃদয়ে। এটি আমাদের শেখায় সুখ-দুঃখের মধ্যে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখলে জীবন সুন্দর হয়।
আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি হে আল্লাহ, আমাদের সত্য ইমান দান করুন এবং আপনার জিকিরে শান্ত হৃদয় দান করুন। যখন আমরা পাই, কৃতজ্ঞ হতে সাহায্য করুন; যখন পরীক্ষায় পড়ি, ধৈর্য দান করুন; যখন ভুল করি, তওবার সুযোগ দান করুন। আমিন।
আরও পড়ুনইমান কাকে বলে১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র শ দ ন কর ন আল ল হ জ বন র আজক র সবক ছ ক রআন
এছাড়াও পড়ুন:
শিশু হাফসা হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ, আরেক আসামি গ্রেপ্তার
পাবনা পৌর সদরের উত্তর শালগাড়িয়া সরদারপাড়া এলাকায় ৯ বছরের শিশু শিক্ষার্থী হাফসা হত্যার ঘটনায় সোমবার (১৭ নভেম্বর) দায়ের করা মামলায় আরো এক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে মামলার নামীয় তিন আসামিকেই গ্রেপ্তার হলো।
গ্রেপ্তাররা হলেন, পাবনা পৌর সদরের উত্তর শালগাড়িয়া সরদারপাড়া মহল্লার টিপু সরদারের ছেলে সাব্বির সরদার (২৬), ছবেদ আলীর ছেলে রমজান আলী (৩০) ও খালেক সরদারের ছেলে পান্না সরদার (২৮)। এদের মধ্যে সাব্বির ও রমজানকে রবিবার এবং পান্নাকে সোমবার বিকেলে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
আরো পড়ুন:
‘আবর্জনার মতো লাগে’ বলে অর্ধশত বকুলগাছ কাটা সেই ব্যক্তি গ্রেপ্তার
বরগুনায় নাশকতার অভিযোগে ৩ আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার
এদিকে, শিশু হাফসাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্য করা হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছে পুলিশ।
পাবনা সদর থানার ওসি (অপারেশন) সঞ্জয় কুমার সাহা এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, নিহত হাফসার মা রিতু খাতুন বাদী হয়ে সোমবার (১৬ নভেম্বর) দুপুরে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনজন নামীয়সহ অজ্ঞাতনামা আরো অনেককে আসামি করা হয়েছে।
তিনি জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সোমবার দুপুরে পাবনা টেক্সটাইল কলেজ এলাকা থেকে অভিযুক্ত পান্না সরদারকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে মামলার প্রধান অভিযুক্ত নামীয় তিন আসামিকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে, শিশু হাফসা হত্যার প্রতিবাদে ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন স্বজন ও এলাকাবাসী।
সোমবার (১৬ নভেম্বর) সকালে উত্তর শালগাড়িয়া সরদারপাড়া থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি বের হয়ে জেলা প্রশাসক কর্যালয়ের সামনে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে তারা। সেখানে নিহত শিশু শিক্ষার্থী হাফসার স্বজন ও এলাকাবাসী বক্তব্য দেন।
সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে তারা মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভ শেষে তারা আসামিদের গ্রেপ্তার করতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। অন্যত্থায় আরো কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ারি দেন।
এ সময় প্রায় ১ ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে সদর থানার ওসি আব্দুস সালাম ঘটনাস্থলে গিয়ে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিলে অবরোধ তুলে নেন বিক্ষোভকারীরা।
এর আগে, শনিবার (১৫ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে শিশু হাফসাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তার সন্ধান চেয়ে এলাকায় মাইকিং করা হয়। খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে প্রায় ২ ঘণ্টা পর রাত ৮টার দিকে বাড়ির পেছনের জঙ্গলের ভেতর পাটিতে মোড়ানো কাদা মাখা অবস্থায় হাফসার মরদেহ পাওয়া যায়।
খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় রাতেই সন্দেহভাজন হিসেবে রমজান ও সাব্বির নামের দুইজনকে আটক করা হয়।
নিহত হাফসা সদর উপজেলার মালঞ্চি ইউনিয়নের কামারগাঁও গ্রামের প্রবাসী হাফিজুর রহমানের মেয়ে এবং স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ছিল।
হাফসার নানার বাড়ির পাশের বাগানটি দীর্ঘদিন ধরে বখাটে, মাদকসেবী ও জুয়ারুদের আড্ডাস্থল ছিল বলে জানায় স্থানীয়রা। তারা এ হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পাবনা সদর থানার ওসি (অপারেশন) সঞ্জয় কুমার সাহা বলেন, “মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদনে শিশু হাফসাকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। ধর্ষণের পর তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। এছাড়া পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, শিশুটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতিয়মান হয়েছে।”
ঢাকা/শাহীন/মেহেদী