দলগুলোর মূল লক্ষ্য হোক নির্বাচন
Published: 17th, November 2025 GMT
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় ও গণভোটের তারিখ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি যা-ই থাকুক না কেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশ কার্যত নির্বাচনমুখী হয়েছে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে। গত কয়েক সপ্তাহে রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, সে প্রেক্ষাপটে এটি নিঃসন্দেহে বিরাট স্বস্তির বার্তা। পরপর তিনটি নির্বাচনে স্বাধীনভাবে নিজেদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত নাগরিকেরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের জাতীয় নির্বাচনের জন্য।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সংবিধান সংস্কারে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ৯ মাসের যে সংস্কারপ্রক্রিয়া, সেটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য এক ঘটনা। রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা, তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করে। কিন্তু সনদ বাস্তবায়নের উপায় ও গণভোটের তারিখ কবে হবে, তা নিয়ে শেষ মুহূর্তে দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা তৈরি হয়। পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ঐকমত্য কমিশন দলগুলোকে সমঝোতায় নিয়ে আসতে না পারায় সনদ বাস্তবায়নের উপায় কী হতে পারে, সেই সুপারিশ সরকারকে দেয়। অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে মতৈক্যে পৌঁছাতে সাত দিনের সময় বেঁধে দেয়। তাতে ব্যর্থ হওয়ায় উপদেষ্টা পরিষদ জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ অনুমোদন করে।
প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানান। উচ্চকক্ষে পিআর ও সংবিধান সংস্কার পরিষদের ব্যাপারে আপত্তি জানায় বিএনপি। আর নির্বাচনের দিন গণভোটের ব্যাপারে আপত্তি জানায় জামায়াত।
এই আপত্তি সত্ত্বেও বিএনপি, জামায়াতসহ অন্য দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে তাদের সিদ্ধান্তের জন্য ধন্যবাদ জানায়। জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট হওয়ায় বিএনপির মূল চাওয়াটি পূরণ হয়েছে, অন্যান্য ক্ষেত্রে মতপার্থক্য থাকলেও দলটির নেতৃত্ব জাতীয় নির্বাচনেই এখন মূল মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে। জুলাই জাতীয় সনদের সাংবিধানিক গুরুত্ব দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত আগামী নির্বাচন।
কোন আসনে কোন প্রার্থীকে কোন দল মনোনয়ন দিচ্ছে, এটাই বর্তমানে নাগরিকদের প্রধান একটা আলোচনার বিষয়। বড় দলগুলো এবার বেশির ভাগ আসনেই তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে। অনেক আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীরা জনসংযোগও শুরু করেছেন। তবে অনেক প্রার্থী মিছিল, শোডাউন করছেন, কোথাও কোথাও মনোনয়নবঞ্চিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকেরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। এ ধরনের জনদুর্ভোগও কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন ধরে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করেছে। ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা হলে দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনমুখী হবে। এর আগে প্রশাসনে রদবদল ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করাটা জরুরি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আগে থেকেই উদ্বেগ রয়েছে। তফসিলের আগে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হতে হবে। এখানে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল ভিত্তিই নির্বাচন। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণযাত্রা, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলোর সেটা সবচেয়ে ভালোভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের মাঠে মূল প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হোক, সেটাই সবার প্রত্যাশা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ল ই জ ত য় সনদ দলগ ল র ম উপদ ষ ট ব এনপ গণভ ট সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
মারিয়া মান্দার লেখা: লড়ি মাঝমাঠে, লড়ি জীবনের মাঠেও
ধোবাউড়ার মন্দিরগোনা গ্রামে জন্ম আমার। আমি গারো সম্প্রদায়ের মেয়ে। গারোরা এমনিতেই অনগ্রসর। তবে গারো হিসেবে আমার ফুটবল ক্যারিয়ারে বাধা আসেনি। কেউ বলেনি যে ফুটবল খেলো না। আমার সম্প্রদায় নিরুৎসাহিত করেনি কখনো। তবে মেয়ে হিসেবে আমরা যে গ্রামাঞ্চলে খেলাধুলা করেছি, তাতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে।
বলা হতো, গ্রামের মেয়েরা কেন ফুটবল খেলবে! তা-ও আবার হাফপ্যান্ট পরে! এটাই ছিল সবচেয়ে বড় বাধা। রক্ষণশীল সমাজ থেকে নিষেধ করা হতো ফুটবল খেলতে। বাধাটা পেয়েছি আদতে এলাকার কিছু মানুষের কাছ থেকে।
অনেকে আমার মাকে বলতেন, ‘মেয়েকে খেলতে দিয়েছেন, এটা ভালো না।’ অভিভাবকেরা মেয়েদের নিষেধ করতেন ফুটবল খেলতে। বলা হতো, মেয়েরা ফুটবল খেলতে পারবে না।
বাধা পেরিয়েতারপরও কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কোচ মফিজ উদ্দিন স্যার থেমে থাকেননি। সঙ্গে ছিলেন মিনতি রানী শীল ম্যাডাম। সপ্তাহে এক দিন-দুই দিন অভিভাবকদের সভা ডাকতেন; বোঝাতেন, কেন মেয়েদের খেলার সুযোগ দেওয়া উচিত। তাঁদের নেতৃত্বে আমরা ছোটবেলা থেকেই ফুটবল-পাগল হয়ে উঠেছিলাম, বাধা দিলেও অনেকে লুকিয়ে খেলত। তবে খেলার জগতে আসতে পরিবার থেকে বাধার মুখে পড়তে হয়নি বলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়ই বাবা বীরেন্দ্র মারাক মারা যান। তাঁর কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই। ঘরে তাঁর কোনো ছবি নেই, চেহারাটাও মনে করতে পারি না। তাই বাবার স্নেহ কাকে বলে, তা ঠিক জানি না। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের চার ভাইবোনকে একাই বড় করেছেন মা—এনতা মান্দা।
গারোরা ধান কাটা, ধন বোনার কাজই বেশি করেন। আমার মা-ও সেটাই করতেন। আমাদের লালন–পালনের জন্য প্রতিদিন যে পরিশ্রম তিনি করেছেন, সেটা সত্যিই অসাধারণ। ধান কাটার কাজ মানে দৈনিক মজুরি, আমাদের নিজের জমি ছিল না, অন্যের জমিতে কাজ করতেন মা। দিনে পেতেন মাত্র ২০০ টাকা। এই টাকায় সংসার চলত না। ঋণ করতে হতো। ছোটবেলা থেকে মা ঘামে, চোখের জলে এগিয়ে নিয়েছেন আমাদের। তাঁর সেই পরিশ্রম আর ত্যাগের মধ্যেই আমার শৈশব কেটেছে।
ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামে নিজ বাড়ির উঠানে কিশোরী মারিয়া মান্দার অনুশীলন