দুধ-ডিম ও সবজি গ্রহণে বেশি পিছিয়ে দেশ
Published: 16th, October 2025 GMT
বাংলাদেশের ভোক্তারা দুধ-ডিম ও সবজি খাওয়ায় এখনো আদর্শ মানের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছেন। যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ গ্রাম সবজি খাওয়া হচ্ছে আদর্শ পরিমাণ, সেখানে এ দেশের একজন মানুষ খাচ্ছেন ২০২ গ্রাম। একইভাবে ৩০ গ্রাম ডিমের বিপরীতে তাঁরা গ্রহণ করছেন ১৩ গ্রাম। দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যে আরও পিছিয়ে। দৈনিক দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য প্রয়োজন ১৩০ গ্রাম, এর বিপরীতে এখানকার ভোক্তারা খাচ্ছেন মাত্র ৩৪ গ্রাম।
বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকার বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন খাদ্যসচিব মো.
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এইচ এম সাইফুল ইসলাম। এতে তিনি বিভিন্ন খাদ্যে আদর্শ মানের বিপরীতে বাংলাদেশের ভোক্তারা ২০১৬ ও ২০২২ সালে যে পরিমাণ ভোগ করেছেন, সে হিসাব তুলে ধরেন। এতে দেখা যায়, ফল ভোগে দেশের বেশ উন্নতি হয়েছে। ২০১৬ সালে দেশে মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৬ গ্রাম। ২০২২ সাল তা বেড়ে ৯৫ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। যদিও আদর্শ মান ১০০ গ্রাম।
চাল গ্রহণ আগে আদর্শ মানের চেয়ে বেশি থাকলেও এখন তা কিছুটা কমেছে। ২০১৬ সালে দৈনিক চাল গ্রহণের হার ছিল ৩৬৭ গ্রাম, আর আদর্শ মান হলো ৩৫০ গ্রাম। তবে ২০২২ সালে চাল গ্রহণ কিছুটা কমে ৩২৯ গ্রাম হয়েছে। মাছ খাওয়াটাও আদর্শ মানের চেয়ে বেশি। দৈনিক ৬০ গ্রাম মাছ গ্রহণের কথা থাকলেও বাংলাদেশের ভোক্তারা গড়ে খাচ্ছেন ৬৮ গ্রাম। ২০১৬ সালে এই হার ৬৩ গ্রাম ছিল। একইভাবে তেল খাওয়ার পরিমাণও আদর্শ মানের চেয়ে বেশি আছে। দৈনিক ৩০ গ্রাম তেল খাওয়াটা আদর্শ মান হলেও এখানকার ভোক্তারা খাচ্ছেন ৩১ গ্রাম। ২০১৬ সালে যা ছিল ২৭ গ্রাম।
ইলিশ মাছ উৎপাদনে পোনা ছাড়তে হয় না, খাবার দিতে হয় না; তাতেও দাম এত বেশি কেন—সেটি জানতে চেয়ে কোনো ‘ভালো উত্তর’ এখনো পাইনি। দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই আমার মনে প্রশ্ন ছিল, ইলিশের এত দাম কেন? ইলিশের দাম বাড়ার বিষয়ে বলা হয়, মাছ ধরতে খরচ বেশি। আবার মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে দাম বেড়ে যায়। ঢাকা এলে দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের, সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে খাদ্যসচিব মো. মাসুদুল হাসান বলেন, দেশে কৃষি উৎপাদনে সাফল্যের পেছনে প্রধান ভূমিকা কৃষক ও কৃষিবিদদের। যদিও উৎপাদনকারীদের সঙ্গে বাজারের সংযোগ খুবই সামান্য। তাই কৃষকদের অবস্থা এখন হাসন রাজার ‘পরের জায়গা পরের জমি’ গানের মতো।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, ‘ইলিশ মাছ উৎপাদনে পোনা ছাড়তে হয় না, খাবার দিতে হয় না; তাতেও দাম এত বেশি কেন—সেটি জানতে চেয়ে কোনো ‘‘ভালো উত্তর’’ এখনো পাইনি। দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই আমার মনে প্রশ্ন ছিল, ইলিশের এত দাম কেন? ইলিশের দাম বাড়ার বিষয়ে বলা হয়, মাছ ধরতে খরচ বেশি। আবার মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে দাম বেড়ে যায়। ঢাকা এলে দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। এসব নিয়ে আরও কাজ করার আছে।’
মাছ উৎপাদন নিয়ে আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, এখন ধানের জমিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে কোনো মাছ হয় না। এগুলোর ব্যবহার কমানো নিয়ে গবেষণা করা দরকার। প্রাণিখাদ্যের দাম বাড়ার কারণে মাছ, দুধ ও ডিমের দাম বেড়ে যায় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রথম আলোর সংবাদ উদ্ধৃত করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব বলেন, ‘পত্রিকায় দেখলাম, এখন বিড়ালের জন্যও বছরে ৪০০ কোটি টাকার বিদেশি খাদ্য আমদানি করতে হয়। কিন্তু আমাদের সময়ে বিড়ালের জন্য বাজার থেকে খাবার আনতে হতো না। এসব খাবার দেশেই তৈরি করতে হবে।’
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী খন্দকার মো. ইফতেখারুদ্দৌলা বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রায় ৭৬ শতাংশ জমি মোটামুটি অনুর্বর ধরনের, যার পরিমাণ বাড়ছে। বছরে মাথাপিছু খাদ্য অপচয় আবার গড়ে ৮২ কেজি। তাই দুর্যোগপ্রবণ এই দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সব সময় প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কোনো একক প্রতিষ্ঠান বা কারও একার পক্ষে এটা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ জন্য শিক্ষক, গবেষক, সরকার, কৃষক সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে।’
সেমিনারে বক্তব্য দেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বাংলাদেশ প্রতিনিধি দিয়া সানো। তিনি বলেন, বিশ্বে মোট চাহিদার চেয়ে দেড় গুণ বেশি খাদ্য উৎপাদিত হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার কারণে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়। এর আগে সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান নাজমুন নাহার করিম। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইফাদের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ভ্যালানটাইন আচাঞ্চো। অনুষ্ঠান শেষে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। সভায় বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, গবেষক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত হ র ম হ ম মদ জ ব র আদর শ ম ন র চ য় ২০১৬ স ল পর ম ণ উৎপ দ গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
‘হেনী কলেজের টেঁয়া লই চুদুরবুদুর চইলত নঅ’ স্লোগানটি কেন আবার প্রাসঙ্গিক
ফেনী কলেজের ফটক দিয়ে ঢুকতেই লম্বা মাঠ। মাঠের একদিকে অনার্স ভবনের পাশে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। সম্প্রতি কলেজটির শিক্ষার্থীদের ফি বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ-অসন্তোষের বিষয়টি জানতেই কলেজে আসা। আড্ডারত শিক্ষার্থীদের কাছে ফি বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করলে একজন বললেন, ‘আমাদের কলেজের একটি স্লোগান নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে। কিন্তু এখন এটাই আমাদের বাস্তবতা। দীর্ঘ দিনের লুটপাটের কারণে কলেজের ফান্ডের(তহবিল) অবস্থা খারাপ। তাই বাড়তি ফি চাপানো হয়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর।’
‘হেনী কলেজের টেঁয়া লই চুদুরবুদুর চইলতো নঅ’— জনপ্রিয় এই স্লোগানটি কথা শেষে যোগ করে কিছুক্ষণ হাসলেন মুহাইমিন তাজিম নামের ওই তরুণ। কলেজের গণিত বিভাগের এই শিক্ষার্থী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কও। তাঁর কথার সঙ্গে একমত হলেন সেখানে বসে থাকা কলেজের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তাঁদের কথা, ফেনী কলেজের নানা অনিয়ম দুর্নীতি সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় স্লোগানটি আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর ফেনী কলেজে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁরা জানালেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নানা খাতে দুর্নীতির কারণে বর্তমান শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি ফি এর বোঝা চেপেছে। লুটপাটের কারণে কলেজের তহবিল সংকট পূরণ করতে বর্তমান অধ্যক্ষ শিক্ষার্থী প্রতি নতুন করে ১০০ টাকা ফি বাড়িয়েছেন।
কলেজটিতে চলতি বছর ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার্থীর শাখায় ছাত্রদের ২ হাজার ৬৮০ টাকা, ছাত্রীদের ২ হাজার ৫৬০ টাকা এবং বিজ্ঞান শাখার ছাত্রদের ২ হাজার ৭৮০ ও ছাত্রীদের ২ হাজার ৬৬০ টাকা হারে ফি দিয়ে ভর্তি হতে হয়েছে। বিগত বছরের এই ফি ১০০ টাকা বেশি।
ফি বৃদ্ধির যে কারণ দেখাল কর্তৃপক্ষ
চলতি বছরের ১০ এপ্রিল কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ফি বৃদ্ধি করা হয়। সভায় ‘অত্যাবশ্যকীয় নিরাপত্তা ফান্ড’ ৬৫০ টাকা স্থলে ৭৫০ টাকা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, কলেজের কর্মচারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেতন ও বোনাস মিলিয়ে কর্মচারীদের পেছনে বছরে ব্যয় হয় ৭১ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এই খাতে নতুন আরও আটজন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ায় বছর শেষে খরচ দাঁড়াচ্ছে ৭৩ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন-বোনাস ছাড়াও এই খাত থেকে টাকা ব্যয় করা হয় ভূমিসংক্রান্ত মামলার উকিলের ফি, কলেজ আঙিনার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়। গড়ে বছরে ব্যয় দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৮০ লাখ টাকা। কিন্তু এই খাতে শিক্ষার্থীদের থেকে বছরে আদায় হচ্ছে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
ফেনী কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আবু হেনা আবদুল আউয়ালের সঙ্গে কলেজের নানা অনিয়ম নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি বলেন, ফেনী কলেজ নিয়ে জনপ্রিয় হওয়া স্লোগানের একটা ইতিহাস আছে। ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় স্থানান্তরিত হয়। সেখানকার স্থানীয় কিছু ব্যক্তির সঙ্গে কলেজের অর্থ নিয়ে বিবাদ তৈরি হলে ছাত্ররা এমন স্লোগান দেয়। আর্থিক অনিয়মের প্রতিবাদ থেকেই এই স্লোগানের জন্ম। এই পরিস্থিতিতে স্লোগানটি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।উৎসব-অনুষ্ঠানের অতিরিক্ত ব্যয়
কলেজের বিবিধ খাতের টাকা থেকে উৎসব ও অনুষ্ঠানের আয়োজনের বিধান থাকলেও নিরাপত্তা খাত থেকে টাকা নিয়ে উৎসবে খরচ করা হয়েছে। কলেজের নথিপত্র বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ব্যয় করা হয় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৪২৮ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ লাখ ২০ হাজার ৩০৪ টাকা। তবে বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ব্যয় কমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই খাতে ব্যয় হয় ৪৮ হাজার ১৫৪ টাকা।
২০২৪ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ব্যয় হয় ৪৮ হাজার ১৫৪ টাকা। তার আগের দুই বছর ২০২৩ সালে হয় ১ লাখ ২৯ হাজার ৯০৬ টাকা। ২০২২ সালে হয় ১ লাখ ১৪ হাজার ৮১১ টাকা।
বিগত কয়েক বছরে সরকারি দিবস কিংবা উৎসবে অস্বাভাবিক এমন খরচের পেছনে দুর্নীতিই মূল কারণ বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক জানিয়েছেন। কলেজের একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জানান, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস কিংবা শহীদ দিবস দিবসগুলো সরকারি ছুটি হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তেমন থাকত না। রোভার স্কাউট, বিএনসিসি, অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী, শিক্ষক-কর্মচারীসহ সব মিলিয়ে গড়ে উপস্থিতি থাকত দুই শতাধিক। এত অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য খরচ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক বলে মনে করেন তাঁরা।
শতবর্ষ পুরোনো এই কলেজে বিভিন্ন বিভাগে ১৮ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। ফি বৃদ্ধি নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ রয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে