‘আগামীকালের পরীক্ষা হবে কি না, সেটাও জানতে পারছি না’
Published: 1st, December 2025 GMT
সোমবার বেলা সাড়ে ১১টা। যশোর জিলা স্কুলের মূল ফটকে দাঁড়িয়ে আছে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. মুবিন হোসেন। তার হাতে একটি সাদা ফাইল। ফাইলের ভেতরে কলম ও প্রবেশপত্র। ফটকের পাশে ছোট একটি ঘর। সেখানে বসে আছেন নিরাপত্তা প্রহরী। তিনি মুবিনকে বললেন, ‘স্যাররা বলেছেন, আজ পরীক্ষা হবে না।’
এরপর কথা হয় মো. মুবিন হোসেনের সঙ্গে। সে জানায়, ‘আজ আইসিটি (তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি) পরীক্ষা ছিল। দুপুর একটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। পরীক্ষা দিতে এসেছি। এখন শুনছি আজ পরীক্ষা হবে না। আগামীকালের পরীক্ষা হবে কি না, সেটাও জানতে পারছি না।’
দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা চার দফা দাবিতে কর্মবিরতি ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির ডাকে যশোর জিলা স্কুল, যশোর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, মনিরামপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় এবং মনিরামপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কর্মবিরতি পালন করছেন। বিদ্যালয়গুলোতে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা এবং দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা চলছে। শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে এই চারটি বিদ্যালয়ের আজকের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু যশোর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় গতকাল রোববার একটি নোটিশ দিয়ে ‘অনিবার্য কারণবশত’ আজকের পরীক্ষা বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দেয়। অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকালে ও বিকেলের পালায় পরীক্ষা দিতে এসে এভাবেই ফিরে যায়।
বেলা ১১টা ৫৩ মিনিটে আইসিটি পরীক্ষা হবে না জেনে ফিরে যাচ্ছিল যশোর জিলা স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির দুই ছাত্র মুনকার নাঈম রুশদী ও ইয়াসির আরাফাত মাহিন। বিদ্যালয়ের মূল ফটক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তারা জানায়, আগে থেকে জানতে পারেনি আজ পরীক্ষা হবে না। কেউ বলেননি। এখন শুনছে পরীক্ষা হবে না। এ জন্য বাসায় ফিরে যাচ্ছে।
যশোর জিলা স্কুল সূত্র জানায়, গত ২০ নভেম্বর থেকে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা এবং ২৬ নভেম্বর থেকে দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আগামী ৭ ডিসেম্বর বার্ষিক এবং ১১ ডিসেম্বর নির্বাচনী পরীক্ষা শেষ হবে।
সূত্র জানায়, বিদ্যালয়ে দুই পালায় (শিফট) পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। সকালের পালায় ৯টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকেলের পালায় বেলা ১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত পরীক্ষা হয়। আজ সোমবার সকালে সপ্তম ও নবম শ্রেণির তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি পরীক্ষা ছিল। বিকেলে ষষ্ঠ শ্রেণির তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, অষ্টম শ্রেণির ধর্ম এবং দশম শ্রেণির ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষা ছিল।
স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘কর্মবিরতির কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা সাময়িক অসুবিধায় পড়েছে। আমরা তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়টি জানাইনি। তারা বিভিন্নভাবে জেনেছে। অনেক শিক্ষার্থী আজ বিদ্যালয়ে এসে জেনেছে। এ জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। সরকারকে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।’
যশোর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো.
সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষদের চার দফা দাবির মধ্যে রয়েছে—‘সহকারী শিক্ষক’ পদটিকে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত করে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গেজেট দ্রুত সময়ে প্রকাশ করা; বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখায় কর্মরত শিক্ষকদের বিভিন্ন শূন্য পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন দ্রুত কার্যকর করা; সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে বকেয়া টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মঞ্জুরি আদেশ তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রদান এবং ২০১৫ সালের আগের মতো সহকারী শিক্ষকদের ২ থেকে ৩টি ইনক্রিমেন্টসহ অগ্রিম বর্ধিত বেতনসুবিধা বহাল করে গেজেট প্রকাশ করা।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
টাঙ্গাইলে সহকারী শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে প্রাথমিকের পরীক্ষার হলে দায়িত্বে অভিভাবকেরা
পরীক্ষার হলে নেই চেনা শিক্ষকেরা, প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে কক্ষ পরিদর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়েছেন অভিভাবকেরা। কোথাও বাবা দায়িত্বে, কোথাও মা হাঁটাহাঁটি করছেন বেঞ্চের ফাঁকে। তিন দফা দাবিতে সহকারী শিক্ষকদের অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির মধ্যে টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আজ সোমবার এই দৃশ্য দেখা গেছে।
অভিভাবকেরা জানান, প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের কর্মবিরতি শুরু হলে উপজেলাজুড়ে বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এমন অবস্থায় বাধ্য হয়ে প্রধান শিক্ষকেরা অভিভাবকদের ডাকছেন। আর সেই ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে তাঁরা এই দায়িত্ব পালন করছেন।
আরও পড়ুন‘স্কুলে আসার পর স্যাররা বলল আজ পরীক্ষা হবে না’৪৮ মিনিট আগেশিক্ষকদের সূত্রে জানা যায়, বেতন গ্রেড উন্নীতকরণসহ তিন দফা বাস্তবায়নের দাবিতে সারা দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরা গত বৃহস্পতিবার থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন। কর্মসূচিতে বার্ষিক পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন তাঁরা। আজ সখীপুর উপজেলার ১৪৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের নতুন সিদ্ধান্ত না আসায় আন্দোলনকারী সহকারী শিক্ষকেরা বার্ষিক পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করছেন না। তাই বাধ্য হয়ে প্রধান শিক্ষকেরা অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সখীপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সহকারী শিক্ষকেরা অফিস কক্ষে বসে আছেন। পরীক্ষার হলগুলোতে দায়িত্ব পালন করছেন অভিভাবকেরা। তবে দু-একটি কক্ষে অভিভাবক বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ ছিলেন না। পরে প্রধান শিক্ষক আগ্রহী অভিভাবকদের খুঁজে এনে কক্ষের দায়িত্ব দিচ্ছিলেন।
শিক্ষকদের পরিবর্তে অভিভাবক দিয়ে পরীক্ষা চালানো মোটেই ঠিক হচ্ছে না। কারণ, তাঁরা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ নন।ফারজানা আক্তার, অভিভাবকউপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দেশে পরীক্ষা চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে জানান বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক শাহীনা আখতার। তিনি বলেন, ‘সহকারী শিক্ষকেরা আমাকে কোনো সহযোগিতা করছেন না। এমনকি অভিভাবকদেরও পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালনে বাধা দিচ্ছেন।’ তবে অভিযোগটি অস্বীকার করে ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আফরোজা আক্তার বলেন, ‘আমরা পরীক্ষার চালাতে কোনো বাধা দিচ্ছি না, তবে সহযোগিতাও করছি না। প্রধান শিক্ষকই আমাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করছেন না।’
এদিকে পরীক্ষা গ্রহণে এমন বিশৃঙ্খল পরিবেশ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন অভিভাবক। তাঁরা বিদ্যালয়টির মূল ফটকের সামনে হইচই করে প্রতিবাদও জানিয়েছেন। ফারজানা আক্তার নামের এক অভিভাবক বলেন, শিক্ষকদের পরিবর্তে অভিভাবক দিয়ে পরীক্ষা চালানো মোটেই ঠিক হচ্ছে না। কারণ, তাঁরা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ নন।
আরও পড়ুন‘শিক্ষার্থীদের জিম্মি করা, বাজে নজির হয়ে থাকবে’৩ ঘণ্টা আগেআরেকজন অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সহকারী শিক্ষকেরা কর্মবিরতি পালন করছেন, এটা ভালো কথা। কিন্তু খুদে শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করা উচিত ছিল।
এ ছাড়া পরীক্ষার হলে অভিভাবকদের দায়িত্ব পালনের সময় নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অভিভাবকদের কেউ কেউ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অভিভাবক বলেন, ‘যেসব অভিভাবক পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা নিজেদের ও পরিচিত শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়েছেন।
পরীক্ষা গ্রহণে কোনো ধরনের স্বজনপ্রীতি হচ্ছে বলে দাবি করেছেন সখীপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দায়িত্বরত এক অভিভাবক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই ব্যক্তি বলেন, ‘আমার বাচ্চা যে কক্ষে বসে পরীক্ষা দিচ্ছিল, সে কক্ষে দায়িত্ব পালন করিনি। আমি চেষ্টা করেছি, সহকারী শিক্ষকদের মতোই দায়িত্ব পালন করতে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অনুরোধেই মূলত এটি করেছি।’
আমার বাচ্চা যে কক্ষে বসে পরীক্ষা দিচ্ছিল, সে কক্ষে দায়িত্ব পালন করিনি। আমি চেষ্টা করেছি, সহকারী শিক্ষকদের মতোই দায়িত্ব পালন করতে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অনুরোধেই মূলত এটি করেছি।পরীক্ষার হলে দায়িত্বরত এক অভিভাবকআরও পড়ুন‘স্কুলে এসে দেখছি পরীক্ষা স্থগিত’৫ ঘণ্টা আগেউপজেলার দু–একটি বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকদের চাপ প্রয়োগ করে পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কালিদাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও কেন্দ্রীয় দাবি বাস্তবায়ন কমিটির সক্রিয় কর্মী মুক্তি মালেক। তিনি বলেন, তবে অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরা বার্ষিক পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে বিরত ছিলেন।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান বলেন, ‘প্রাথমিক অধিদপ্তর থেকে বার্ষিক পরীক্ষা চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী উপজেলার প্রতিটি বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। তবে কিছু বিদ্যালয়ে অভিভাবকেরা পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন বলে শুনেছি ও দেখেছি। তবে আমি মনে করি, সহকারী শিক্ষকদের অন্তত পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করা উচিত।’