ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থার বলি শিক্ষার্থীরা কেন হবেন
Published: 19th, October 2025 GMT
এ বছর উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষার ফল বিপর্যয় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বহুমুখী সংকট ও গলদকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অথচ সেটাকে আমরা দশকের পর দশক ধরে কার্পেটের তলায় চাপা দিয়ে এসেছি। এতে ফলাফলের অঙ্কটাকে সাফল্য হিসেবে দেখানো গেছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও সমাজকে ঠিক পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দক্ষ ও মেধাসম্পন্ন নাগরিক তৈরি হচ্ছে না। সবখানেই বুদ্ধিবৃত্তিক মেধাশূন্যতার জয়জয়কার। এই বিবেচনায় এবারের এইচএসসির ফলাফল প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার পুরোনো ব্যবস্থার সঙ্গে ছেদ ঘটিয়ে নতুন শুরুর সতর্কঘণ্টা শুনিয়েছে।
বৃহস্পতিবার ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন প্রকাশিত এইচএসসির ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, এবারের পরীক্ষায় পাসের হার দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। ১০ লাখ ৪৭ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছেন ৫ লাখ ৯৮ হাজার, শতকরা হিসাবে যা ৫৭ দশমিক ১২। গত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে প্রায় ১৯ শতাংশ। এর অর্থ প্রায় ৪ লাখ ৪৭ হাজার শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন। ফলাফলের বিচারে এ অঙ্কটা নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। এর বড় একটা অংশ ঝরে পড়ার আশঙ্কা আছে। এ বছরের এসএসসি পরীক্ষাতেও পাসের হার ১৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল। এবারের এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৬৩ হাজার ২১৯, গতবার এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার।
পাস ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর বিচারে এই ফলাফল নিঃসন্দেহে বড় একটা বিপর্যয়। ফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, শহর অঞ্চলের কলেজগুলোর ফলাফল গ্রাম ও মফস্সল এলাকার কলেজগুলোর তুলনায় বেশ ভালো। দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা শ্রেণিকক্ষের বাইরে কোচিং, গাইড ও প্রাইভেট শিক্ষকনির্ভর হয়ে উঠেছে। এর ফলে শিক্ষায় যে বিপুল ব্যয় বেড়েছে, তা নির্বাহের সক্ষমতা বিপুলসংখ্যক অভিভাবকেরই নেই। এইচএসসির ফলের এই বিপর্যয়কে আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বাইরে গিয়ে দেখার সুযোগ খুবই সীমিত।
আন্দোলনসহ নানা কারণে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাস হয়নি। এরও একটি প্রভাব পড়েছে ফলাফলে। উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন ইংরেজিতে। পাসের হার ও জিপিএ-৫ আগের বছরগুলোর তুলনায় কম কেন, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার শিক্ষাব্যবস্থায় অস্বস্তিকর সত্যকে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতি তৈরি হয় এবং সেই ঘাটতি বছরের পর বছর ধরে বাড়তে থাকে। আমরা মনে করি, উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন, আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি, যেখানে সংখ্যাই সত্য হয়ে উঠেছে। এখানে পাসের হারই সাফল্যের প্রতীক, জিপিএ-৫-এর সংখ্যা তৃপ্তির মানদণ্ড!
কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করতে পারেননি, দায়টা কি তাঁদের, না শিক্ষা নিয়ে ভুল নীতির। শিক্ষার এই দৈন্য নিয়ে বহু বছর ধরেই শিক্ষাবিদেরা, অভিভাবকেরা অভিযোগ করে আসছেন। সবাই আশা করেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের আশু কর্তব্য হিসেবে শিক্ষা খাত সংস্কারের জন্য কমিশন করবে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের মতোই পাঠক্রম বদল ছাড়া শিক্ষা খাতে কোনো সংস্কার উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
এইচএসসির ফল বিপর্যয়, নিশ্চিত করেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে কতটা ভঙ্গুর অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে, তারই প্রতিফলন দেখা গেল। এখন সরকারের গুরুদায়িত্ব হলো গলদগুলো চিহ্নিত করে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে মনোযোগী হওয়া। এইচএসসিতে যাঁরা কৃতকার্য হয়েছেন, তাঁদের অভিনন্দন। যাঁরা কৃতকার্য হতে পারেননি, তাঁদের মনে রাখতে হবে, ব্যর্থতাই সাফল্যের চাবিকাঠি। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের প্রতি অভিভাবক, স্বজন, শিক্ষক সবাইকে সংবেদনশীল আচরণ করতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র শ ক ষ ব যবস থ এইচএসস র ফল ব যবস থ র আম দ র বছর র ফল ফল
এছাড়াও পড়ুন:
এইচএসসির ফলাফল: টাঙ্গাইলের ৭ কলেজে শতভাগ ফেল
টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় ১০৭টি কলেজ রয়েছে। এর মধ্যে সাতটি কলেজের শিক্ষার্থীদের কেউই এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) ফলাফল প্রকাশের পর জেলা শিক্ষা অফিস থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
আরো পড়ুন:
এইচএসসির ফলাফল: রংপুরের ৪ কলেজে পাস করেনি কেউ
এইচএসসির ফলাফল: নীলফামারীর ১০ কলেজে পাস করেনি কেউ
শিক্ষাবিদরা বলছেন, নিয়মিত ক্লাশ না হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা অকৃতকার্য হয়েছে।
শতভাগ অকৃতকার্য কলেজগুলো হচ্ছে- সদর উপজেলার আল্লামা ইয়াকুব আলী কলেজ, টাঙ্গাইল কলেজ, টাঙ্গাইল কমার্স কলেজ, শাহীন কলেজ, মির্জাপুরের ফতেপুর ময়নাল হক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মধুপুরের মধুপুর মহিলা কলেজ ও গোপালপুরের হাদিরা বাধুরিরচর কলেজ।
জেলার ১০৭ কলেজ থেকে ২৫ হাজার ১৩০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। এর মধ্যে ১১ হাজার ১১৯ জন শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়েছে। সে হিসাবে পাসের হার ৪৪.২৫ শতাংশ। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে ৫৭৩ জন।
আলীম পরীক্ষায় ১ হাজার ৪৯০ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে ৯৯৭ জন পাস করেছে। পাসের হার ৬৬.৯১ শতাংশ। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে ২৩ জন।
বিএম পরীক্ষায় দুই হাজার ২৬৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে ১ হাজার ৩৯৫ জন পাস হয়েছে। পাসের হার ৬১.৫৯ শতাংশ। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে পাঁচজন। ভোকেশনাল পরীক্ষায় ৫৩৮ জন অংশ নিয়ে ২৪০ জন পাস হয়েছে। পাসের হার ৪৪.৬১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে একজন।
শতভাগ ফেল করা কলেজগুলোর মধ্যে আল্লামা ইয়াকুব আলী কলেজ থেকে ১৬ জন, গোপালপুরের হাদিরা বাধুরিরচর কলেজ থেকে ১৬ জন, টাঙ্গাইল কলেজ থেকে ৯ জন, টাঙ্গাইল কমার্স কলেজ, শাহীন কলেজ ও মধুপুর মহিলা কলেজ থেকে ২ জন করে, মির্জাপুরের ফতেপুর ময়নাল হক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ১৮ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন।
শতভাগ অকৃতকার্য হওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি।
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এসএম সাইফুল্লাহ বলেন, “অভ্যুত্থানের পর শিক্ষাব্যবস্থাকে অনেক গুরত্ব দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আরো সচেতন হতে হবে।”
তিনি বলেন, “কলেজে না গিয়ে বাসায় নামমাত্র পড়াশোনা করলে পাস করা যায় না। নিয়মিত শ্রেণী কক্ষে গিয়ে ক্লাস করতে হবে। কলেজ বা শ্রেণী কক্ষে শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি শিক্ষাদানের আমুল পরিবর্তন আনতে হবে।”
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রেবেকা সুলতানা বলেন, “বিষয়টি জেলা প্রশাসনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
ঢাকা/কাওছার/মেহেদী