নারীবান্ধব নির্বাচনী ইশতেহার চাই
Published: 5th, December 2025 GMT
নারীবান্ধব নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। নারী প্রার্থীদের নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া, নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের অঙ্গীকারসহ নারীবান্ধব বিষয় থাকতে হবে ইশতেহারে। ইউএনডিপি বাংলাদেশের সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ আয়োজিত ‘নারী-ম্যানিফেস্টো (ইশতেহার) ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় নির্বাচন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন বক্তারা। এ আয়োজনে প্রচার সহযোগী হিসেবে ছিল প্রথম আলো। তাঁরা জেন্ডারবান্ধব নীতিগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক করা এবং নারী ও তরুণদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বাড়ানোর ওপর জোর দেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অংশ নেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হকের নেতৃত্বে পরিচালিত জরিপের তথ্য তুলে ধরেন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মো.
প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে ১২টি জরুরি বিষয়ে অঙ্গীকার থাকার ওপর জোর দেওয়া হয়। সেগুলো হচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ, নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও নেতৃত্ব, সাইবার নিরাপত্তা, চলাফেরার নিরাপত্তা, আইনে সমান অধিকার, জেন্ডার সংবেদনশীল পাঠ্যক্রম, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও বিনা মূল্যের গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি, প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও সাংস্কৃতিক বাধা দূর করা, প্রান্তিক নারীদের অন্তর্ভুক্তি, মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক কাঠামোয় সহায়তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির ক্ষেত্রে নারীর ন্যায্যতা নিশ্চিত করা।
নানা প্রতিশ্রুতিবৈঠকে স্বাগত বক্তব্যে ইউএনডিপি বাংলাদেশের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আনোয়ারুল হক বলেন, নারী, তরুণ এবং বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা, তথ্য ও পরামর্শের ভিত্তিতে নারী ইশতেহারটি তৈরি করা হয়েছে। জবাবদিহি তখনই শক্তিশালী হয়, যখন প্রতিশ্রুতিগুলো সুনির্দিষ্ট, বাস্তবায়নযোগ্য এবং নাগরিক, গণমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্যবেক্ষণে থাকে।
বৈঠকে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সাবেক প্রধান শিরীন পারভীন হক বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো এখন নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির পর্যায়ে রয়েছে। ফলে এখন দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসে শোনা যেতে পারে তারা নারীদের কোন দাবি নিতে পারবে, কোনটা পারবে না। প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠ তৃণমূল থেকে আইনসভায় (সংসদ) নিতে হলে কাজের বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। জনসংখ্যা বিবেচনায় সংসদের আসনসংখ্যা ৬০০ করা এখন যৌক্তিক। এর মধ্যে ৩০০ আসনে সবাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। বাকি ৩০০ আসনে শুধু নারীরা সরাসরি নির্বাচন করবেন। তিনি বলেন, কর্মঘণ্টা কমিয়ে পাঁচ ঘণ্টা করা নিয়ে বিতর্ক হলো। কর্মঘণ্টা যদি কমাতে হয়, তাহলে তা কর্মজীবী নারী ও পুরুষ—দুজনের জন্যই কমাতে হবে। যাতে দুজনই সন্তান পালন ও গৃহকর্মের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে সময় দিতে পারেন।
বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা হাবীবা বলেন, নারীদের মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপি সব সময় ইতিবাচক। বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে, এমন নারী প্রার্থীদের এবারে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচনে অন্তত ৩০ শতাংশ নারীকে যেন মনোনয়ন দেওয়া হয়, সে লক্ষ্যে কাজ করা হবে। এতসংখ্যক নারীকে মনোনয়ন দিতে হবে—রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এমন আইন থাকলে সব দল তখন বাধ্য হতো।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাইফুল আলম খান বলেন, ‘আমরা নারীর শিক্ষা, চাকরি ও ব্যবসায় কোনো সমস্যা দেখি না। ইসলামি চিন্তাবিদদের সঙ্গে নারী অধিকারকর্মীরা আলোচনা করলে এসব বিষয়ে দূরত্ব দূর হয়ে যাবে। নারীর চাকরিবান্ধব কর্মঘণ্টা তৈরি জরুরি। নারীর জন্য পাঁচ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা করার প্রস্তাব জামায়াতে আমির দিয়েছিলেন, তা নিয়ে অনেকে বিতর্ক তৈরি করেছেন। কিন্তু এটা বলা হয়েছিল মূলত যেসব কর্মজীবী নারীর ছোট সন্তান রয়েছে, তাঁদের কথা ভেবে। সমস্যাগুলো তুলে ধরে বিষয়টি নিয়ে আমরা আরও আলোচনা করতে তৈরি আছি।’
নির্বাচনে বেশিসংখ্যক নারীকে মনোনয়ন দেওয়া, ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি, দিবাযত্ন কেন্দ্র ও বিনা মূল্যে গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি ইত্যাদি বিষয়কে এনসিপি ইশতেহারে গুরুত্ব দেবে বলে জানান এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব ও মিডিয়া সেলের সম্পাদক মুশফিক উস সালেহীন। তিনি বলেন, শুধু নারীর জন্য কর্মঘণ্টা কমালে তা নারীর কাজের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করতে পারে। এনসিপি নারী–পুরুষের কর্মক্ষেত্র ও ব্যক্তিজীবনে ভারসাম্য আনার জন্য সবার জন্যই কর্মঘণ্টা নির্ধারণ নিয়ে চিন্তা করছে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, তাঁর দল যদি ক্ষমতা প্রভাবিত করার নিয়ামক হয়, তাহলে তাঁর দল নারীবান্ধব প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করবে। তিনি বলেন, রাজনীতিতে থাকা নারীরাও অনলাইন–অফলাইনে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তবে এক দলের নারীরা হয়রানির শিকার হলে অন্য দলকে তা নিয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না। এ ধরনের প্রবণতা থেকে বের হওয়া দরকার।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নারী সেলের সদস্য তাহমিনা ইয়াসমিন বলেন, দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতি পুরুষতান্ত্রিক। নারীদের মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি দীর্ঘ চর্চার মধ্য দিয়ে আসতে হবে। সিপিবি অন্তত ৩০ শতাংশ নারীকে মনোনয়ন দিতে চেষ্টা করবে।
গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পর্ষদের সদস্য তাসলিমা আখতার বলেন, শিশু লালন–পালন ও গার্হস্থ্যকাজ নারী ও পুরষ দুজনেরই কাজ এবং নারী–পুরুষের জন্য একটি জাতীয় মজুরি তৈরি করা—এ দুটি বিষয়কে ইশতেহারে গুরুত্বে দেবে তাঁর দল।
নাগরিক সমাজের পক্ষে একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বন্ধে ব্যবস্থা চাই। নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন চাই। রাজনৈতিক দল যখন ইশতেহার দেয় এবং যখন ইশতেহার বাস্তবায়ন করে না, তখন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার প্রক্রিয়া কী সেটা জানতে চাই।’
এ ছাড়া আরও বক্তব্য দেন ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ মাসাকি ওয়াতাবে, ইউএন উইমেন বাংলাদেশের তপতী সাহা, এনডিএমের মহাসচিব মমিনুল আমিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সদস্য হেমা চাকমা, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক নাজিফা জান্নাত প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ দেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের প্রধান কারিগরি উপদেষ্টা অ্যান্ড্রেস ক্যাসটিল্লো এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন সহযোগী অধ্যাপক সাবিহা ইয়াসমিন রোজী।
গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক দল র র জন ত দলগ ল র ইশত হ র র সদস য র জন য ন র জন উইম ন সহয গ ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি, আবার পুতিনকেও উষ্ণ অভ্যর্থনা: একসঙ্গে দুই কূল কি রাখতে পারবে ভারত
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দুই দিনের সফরে ভারতে পৌঁছেছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে পৌঁছানোর পর দেশটির বিমানবাহিনীর পালাম ঘাঁটিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাঁকজমকপূর্ণ ও আনুষ্ঠানিক আয়োজনের মাধ্যমে তাঁকে স্বাগত জানান। শুক্রবার দুজন শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হবেন।
তিন বছর আগে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু করার পর প্রেসিডেন্ট পুতিনের এটাই প্রথম ভারত সফর। সর্বশেষ ২০২১ সালের ডিসেম্বের নয়াদিল্লি সফর করেন তিনি।
এবারের সফরে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের পাশাপাশি ২৩তম রাশিয়া-ভারত বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেবেন পুতিন। শুক্রবার শীর্ষ বৈঠকের আগে পুতিনকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানানো হবে। পরে তিনি নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেবেন। এ হায়দরাবাদ হাউসেই পুতিন অবস্থান করবেন।
ভারতের মস্কোর দিকে ঝুঁকে পড়ার শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকে। তা হয় ভারতের প্রধান প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে ওয়াশিংটন সামরিক ও আর্থিক সহায়তা বাড়াতে থাকায়। তখন রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে এবং মস্কো ভারতের কাছে একটি নির্ভরযোগ্য বন্ধুরাষ্ট্র হয়ে ওঠে। রাশিয়ার এই ভূমিকাকে এখনো মূল্যায়ন করে ভারত।পুতিনকে যে ধরনের আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের সঙ্গে বরণ করে নেওয়া হলো, তেমন আনুষ্ঠানিকতা কেবল নয়াদিল্লি তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সৌজন্যেই দেখায়। এরপরও মোদি একইসঙ্গে পুতিনের রাশিয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি গভীর কৌশলগত অংশীদারত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এটাই ভারতের কূটনীতির বিশেষ দিক। একদিকে রাশিয়ার উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান ও সাশ্রয়ী দামে জ্বালানি তেল কেনা এবং স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে গড়ে ওঠা দৃঢ় বন্ধুত্ব ধরে রাখা। অন্যদিকে প্রযুক্তি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আরোপিত বর্ধিত শুল্ক প্রত্যাহার করবেন বলে আশা করা।
পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের পর ভারত তার কৌশলগত সম্পদ (বিশাল বাজার এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান) কাজে লাগিয়ে হোয়াইট হাউস ও ক্রেমলিন দুই পক্ষেরই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
তবে যুদ্ধ শুরুর পর পুতিন প্রথম ভারত সফরে এলেন এমন সময়ে, যখন মোদি একটি উদ্বেগজনক সময় পার করছেন।
নয়াদিল্লি এখন ওয়াশিংটনের সঙ্গে খুবই প্রয়োজনীয় বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এই শুল্কের অর্ধেকই আরোপিত হয়েছে ছাড় মূল্যে রাশিয়ার তেল কেনা অব্যাহত রাখায় নয়াদিল্লির জন্য ওয়াশিংটনের সরাসরি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে।
নয়াদিল্লি সম্প্রতি ওয়াশিংটনকে সন্তুষ্ট করতে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তারা রাশিয়ান তেল কেনা কমিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২ লাখ মেট্রিক টন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) কিনতে রাজি হয়েছে।
এরপরও পুতিনের এবারের সফরে যে বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে, তা হলো মস্কোর সঙ্গে আরও প্রতিরক্ষা চুক্তি—অস্ত্র কেনা, যেটাকে পাকিস্তান ও চীনের কাছ থেকে নিজের রক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করে ভারত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান ও চীন দুই দেশের সঙ্গেই ভারতের সীমান্ত উত্তেজনা বেড়েছে।
ভারতকে কত জটিল এক পরিবেশের মধ্যে পথ চলতে হয়, তা এ বিষয়ে বোঝা যায়: রাশিয়া চীনেরও ঘনিষ্ঠ অংশীদার, আবার পাকিস্তানের অস্ত্রশস্ত্রের প্রধান উৎসগুলোর একটি বেইজিং।
পুতিনের জন্য লালগালিচা বিছিয়ে নয়াদিল্লি পশ্চিমা বিশ্ব ও চীন দুই পক্ষকেই এই বার্তা দিচ্ছে যে ভারতের ‘বিকল্প আছে’, এমনটাই মনে করছেন অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর কান্তি বাজপেয়ী।
প্রফেসর কান্তি বাজপেয়ী বলেন, এটা একটা ইঙ্গিত যে ভারত রাশিয়ার সঙ্গেই থাকতে চাচ্ছে, যদিও মস্কো ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই অধ্যাপকের মতে, তেল আর অস্ত্রের বাইরে এটা একধরনের কূটনৈতিক কৌশল, বেইজিং ও ওয়াশিংটনকে দেখানো যে দিল্লির হাতে তৃতীয় বিকল্প আছে। আর এতে তার দর–কষাকষির সুযোগও আরেকটু বাড়ে।
পরীক্ষিত বন্ধুত্বরাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময়, যখন সদ্য স্বাধীন দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জোটনিরপক্ষ’ ছিল, কিন্তু নতুন রাষ্ট্র হিসেবে পথচলার শুরুতে শিল্প খাত ও অর্থনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক সহায়তা পেয়েছিল।
অবশ্য ভারতের মস্কোর দিকে ঝুঁকে পড়ার শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকে। তা হয় ভারতের প্রধান প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে ওয়াশিংটন সামরিক ও আর্থিক সহায়তা বাড়াতে থাকায়। তখন রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে এবং মস্কো ভারতের কাছে একটি নির্ভরযোগ্য বন্ধুরাষ্ট্র হয়ে ওঠে। রাশিয়ার এ ভূমিকাকে এখনো মূল্যায়ন করে ভারত।
বিশ্বে অস্ত্র বিক্রির ওপর নজর রাখা চিন্তনপ্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরই) তথ্যমতে, গত চার বছরে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের অস্ত্র কেনা কমলেও মস্কো এখনো দেশটির প্রধান সামরিক সরবরাহকারীর অবস্থানে রয়েছে।
এসব রুশ সামরিক সরঞ্জামের বড় অংশই কেনা হয়েছে ভারতের প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকা চীনের দিকে নজর রেখে। অবশ্য চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মস্কোর ঘনিষ্ঠ অংশীদারগুলোর একটি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই দেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের সীমান্ত উত্তেজনা রয়েছে।এসব রুশ সামরিক সরঞ্জামের বড় অংশই কেনা হয়েছে ভারতের প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকা চীনের দিকে নজর রেখে। অবশ্য চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মস্কোর ঘনিষ্ঠ অংশীদারগুলোর একটি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ দেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের সীমান্ত উত্তেজনা রয়েছে।
অন্যদিকে বেইজিং ভারতের বৈরী দেশ পাকিস্তানের বড় অস্ত্র সরবরাহকারী, যার মধ্যে জঙ্গিবিমানও রয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বলেছে, এ বছরের শুরুতে সীমান্তে সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষের সময় ভারতের যুদ্ধবিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করতে তারা এটা (চীনা জঙ্গিবিমান) ব্যবহার করেছিল। পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, ভারতের যেসব যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছিল, সেগুলোর একটি ছিল রাশিয়া নির্মিত সুখোই এসইউ-৩০।
রয়টার্সের তথ্যমতে, বর্তমানে ভারতের ২৯টি যুদ্ধবিমানের মধ্যে বেশির ভাগই রাশিয়ান সুখোই এসইউ-৩০ যুদ্ধবিমান।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, এই সপ্তাহে রাশিয়ার সঙ্গে (ভারতের) আলোচনা সম্ভবত তাদের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান এসইউ-৫৭–এর জন্য সম্ভাব্য অস্ত্র চুক্তি নিয়ে হবে।
কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মস্কোর সঙ্গে নয়াদিল্লির অর্থনৈতিক সম্পর্ক বারবার শিরোনামে এসেছে, যা সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দিলে রাশিয়ার তেলের দাম দ্রুত কমতে থাকে, ভারত সেই সুযোগ লুফে নেয়। বিকাশমান অর্থনীতিতে রসদ জোগানো এবং দেশের ১৪০ কোটি মানুষকে সহায়তার জন্য আগ্রহী ভারত রাশিয়ার অপরিশোধিত জ্বালানি তেল কেনা ব্যাপকভাবে বাড়ায়। দেশটি ক্রেমলিনের শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশের একটি হয়ে ওঠে।
পশ্চিমাদের সমালোচনার জবাবে ভারত বারবার বলেছে, দেশের জনগণ ও অর্থনীতির প্রতিই তাদের প্রথম দায়িত্ব।
নয়াদিল্লিভিত্তিক চিন্তনপ্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) ডিস্টিংগুইশড ফেলো নন্দন উন্নিকৃষ্ণনান বলেন, ‘আমাদের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ আছে। তাদের দারিদ্র্যসীমার বাইরে নিয়ে আসা দরকার…আর সেটা করতে গেলে ভারতের সব বড় শক্তির সঙ্গে একটি পরিশীলিত কর্মসম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন।’
কিন্তু গত আগস্টে ট্রাম্পের ধৈর্য কমে আসে এবং তিনি ভারতের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেন। এটা ছিল ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি, পাশাপাশি রাশিয়ার তেল কেনার শাস্তি।
এরপর অক্টোবরে ট্রাম্প রাশিয়ার দুটি বৃহত্তম তেল কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন, যা ভারতে বিভিন্ন দপ্তরে ধাক্কার মতো হয়ে আসে। ভারতের বাণিজ্য ও তেল পরিশোধন–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো রয়টার্সকে জানিয়েছে, ডিসেম্বর মাসে দেশটির তেল আমদানি কমে অন্তত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নামতে যাচ্ছে।
ওয়াশিংটনের আর্থিক চাপ শুধু সম্পর্কেই টান দিচ্ছে না, বরং বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির উত্তেজনা প্রশমনও যেন দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ভারতের ওপর ট্রাম্পের শুল্ক কার্যকর হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই একটি সম্মেলনে যোগ দিতে মোদি সাত বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো চীনে যান। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সেই সম্মেলন আয়োজনের লক্ষ্য ছিল, পশ্চিমাদের পাল্টায় বৈশ্বিক নেতৃত্ব দিতে বেইজিংয়ের সমক্ষতা তুলে ধরা।
সেই সম্মেলনেই মোদি ও পুতিনের সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয়। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে দুজন হাসি দিয়ে উষ্ণ ও দৃঢ় করমর্দন করেন, এরপর জনসমাগম থেকে সরে গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্টের লিমুজিনে বসে প্রায় এক ঘণ্টার একটি ব্যক্তিগত বৈঠক করেন।